স্মরণ


কিংবদন্তী এক শিক্ষকের জীবনাবসান


কানাই দাশ।। পুবাকাশ


আত্মপ্রচার বিমুখ, জ্ঞানের নিভৃত এই সাধক নিঃশব্দে নীরবে শেষ জীবন অতিবাহিত করেছেন।
দীর্ঘ দেহী, পোশাকে-চেহারায় অপূর্ব ব্যক্তিত্বের অধিকারী, সুদর্শন আলী স্যারের যাপিত জীবনের শেষ পর্যন্ত আধুনিক মনের প্রতিফলন ছিল। তিনি কোন অন্ধ লোকাচারে বিশ্বাসী ছিলেন না। মনে হয় ভিক্টোরিয়ান আধুনিকতার মূর্ত প্রতীক ছিলেন প্রফেসর মোহাম্মদ আলী। এজন্য তিনি একদিকে ছিলেন ডানপন্থী কনজারভেটিভ ডেমোক্র্যাট অন্যদিকে এরি অনুষঙ্গ হিসেবে ছিলেন সেকুলার ভাবনা চিন্তার লোক।

১৯৫০ এর দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের তুখোড় মেধাবী ছাত্র, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক ও প্রথম নির্বাচিত উপাচার্য, এক সময়ের বিশিষ্ট রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী ও রবীন্দ্র সাহিত্যানুরাগী, জ্ঞানতাপস, দেশখ্যাত অনেক শিক্ষকের শিক্ষক, আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রফেসর মোহাম্মদ আলী গত ২৪ জুন বৃহস্পতিবার ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চাশের দশকের সৃষ্টিশীল অসাধারণ একটি মেধাবী প্রজন্মের প্রায় অবসান হতে চলল। এদের মধ্যে আমার জানামতে এখনো সক্রিয় আছেন তাঁরই সহপাঠী প্রখ্যাত লেখক ও সাহিত্যিক প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ১৯৩৩ সনে ফটিকছড়ির বিদ্যোৎসাহী এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে ঢাকা বোর্ড থেকে ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন ও ১৯৫২ সালে আই এ পাস করেন। ১৯৫৫ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক ও ১৯৫৬ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে ইংরেজিতে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি এম.এ পরীক্ষায় রেকর্ড পরিমাণ নম্বর পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সর্বোচ্চ পুরস্কার পোপ গোল্ড মেডেলিস্টের সম্মান লাভ করেন। এরপর সম্ভবত ১৯৬০ সালের দিকে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ করেন। প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রয়াত প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও প্রফেসর মোহাম্মদ আলী এ দু’জন আমার জানামতে বাংলাদেশ থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অক্সফোর্ডের এম এ করার বা “অক্সন” খেতাবে ভূষিত হবার গৌরব অর্জন করেন। তিনি তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে অনেকের মত সে সময় সহজেই পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস বা সিএসপিতে যোগ দিয়ে একজন জাঁদরেল আমলা বনে যেতে পারতেন কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত শিক্ষকতাকেই জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নেন এবং আমৃত্যু একজন শিক্ষক হিসাবেই শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে জীবনযাপন করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর খালেদা হানুম এর সাথে তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। আত্মপ্রচার বিমুখ, জ্ঞানের নিভৃত এই সাধক নিঃশব্দে নীরবে শেষ জীবন অতিবাহিত করেছেন।
দীর্ঘ দেহী, পোশাকে-চেহারায় অপূর্ব ব্যক্তিত্বের অধিকারী, সুদর্শন আলী স্যারের যাপিত জীবনের শেষ পর্যন্ত আধুনিক মনের প্রতিফলন ছিল। তিনি কোন অন্ধ লোকাচারে বিশ্বাসী ছিলেন না। মনে হয় ভিক্টোরিয়ান আধুনিকতার মূর্ত প্রতীক ছিলেন প্রফেসর মোহাম্মদ আলী। এজন্য তিনি একদিকে ছিলেন ডানপন্থী কনজারভেটিভ ডেমোক্র্যাট অন্যদিকে এরি অনুষঙ্গ হিসেবে ছিলেন সেকুলার ভাবনা চিন্তার লোক।

এক্ষেত্রে মহান ভাষা আন্দোলনের প্রভাব তাঁর মধ্যে সতত সক্রিয় ছিল। বস্তুত ভাষা আন্দোলনের পূর্বাপর সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একঝাঁক মেধাবী ছাত্র জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, এ জেড এম ওয়াবদুল্লাহ খান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মোহাম্মদ আলী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিসুজ্জামান প্রমুখ কমবেশি এই আন্দোলনের অন্তর্নিহিত ও অনিবার্য সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গীতে প্রভাবিত ছিলেন ও পরবর্তীতে কেউ বামে গেছেন, কেউ গেছেন ডানে। প্রফেসর আলী চিন্তার দিক থেকে ডান দিকেই ছিলেন।

বন্ধু কবি হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেছেন প্রফেসর আলী। সেই অনুবাদ সংকলনে তাঁর লেখা ভূমিকায় পাকিস্তানিদের নিপীড়ন, ভাষা আন্দোলনে বামদের প্রভাব, সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী ফুটে উঠে। তিনি লিখছেনThe fiftiees and sixties not only witnessed onslaught on the Bengali Language these decades also saw aggression on our culture………. and for a time by an order of the government Radio stations stopped broadcasting Rabindra Sangeet. এর পরেই অভিযোগের সূরে লিখছেন The communist party was banned and all Marxist literature proscribed. তিনি ছিলেন ষাট ও সত্তরের দশকের প্রথমার্ধের বাংলাদেশ বেতারের নিবন্ধিত রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী। তাঁর বোধ ও ভাবনা বাণী প্রধান রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রভাবে নিশ্চয় উজ্জীবিত ছিল। সেই বাণীর নিহিতার্থ হল অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনা। রবীন্দ্র সাহিত্যের গভীর অনুরাগী পাঠক ছিলেন তিনি এবং সেই পাঠের পরিধি ছিল বিস্তৃত।

১৯৮৪ সালের জানুয়ারি-মার্চ এ প্রকাশিত বাংলা একাডেমির সাহিত্য পত্রিকা উত্তরাধিকার এ তিনি রবীন্দ্র সৃষ্টি সম্ভারের সবচেয়ে কম আলোচিত রবীন্দ্র চিত্রকলার উপর “রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম” নামে লিখিত একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে রবীন্দ্র চিত্র শিল্পের পটভূমি ও স্বরূপ তুলে ধরেছেন চমৎকার যুক্তিগ্রাহ্য নিপুণতায়। তিনি লিখেছেন “রবীন্দ্র চিত্রশিল্প রবীন্দ্রনাথের কবিকৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে তার সমগ্র সৃষ্টিকর্মকে ইউনিটি বা সংহতি দান করেছে। রবীন্দ্র জিজ্ঞাসায় এই সত্যের উপলব্ধি বিশেষ প্রয়োজন”। আমাদের দুর্ভাগ্য তাঁর অন্তর্গত এক নিস্পৃহ প্রকৃতির কারণে লেখালেখির জগতে তিনি অপরিচিত থেকে গেলেন আর আমরা বঞ্চিত হলাম তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বিশাল আধার থেকে। তাঁর অন্যতম কীর্তি হল বাংলা একাডেমি প্রকাশিত দেশে বিদেশে উচ্চ প্রশংসিত বাংলা-ইংরেজি অভিধানের অনুপম সম্পাদনা।
শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি ছিলেন একজন প্রিয় ও সফল শিক্ষক। ছাত্র হিসেবে অভিভূত হয়ে লক্ষ্য করেছি অত্যন্ত সহজ ও প্রাঞ্জল ইংরেজিতে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলদ গম্ভীর কণ্ঠে মধ্য যুগের দূর্বোধ্য ইংরেজি গীতি কবিতা ও চসার থেকে শুরু করে ইংরেজি সাহিত্যের যে কোন যুগের যে কোন কবি ও লেখক সম্পর্কে অনর্গল বলে যেতে পারতেন সাথে থাকত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কবি ও লেখকদের অনায়াস উদ্ধৃত রেফারেন্স।
তাঁর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তাঁর প্রিয় কবি শেলীর উদ্ধৃতি দিয়ে তাই বলতে ইচ্ছা হতো Teach সবhalf thy gladness/ That thy brain must know/ such harmonious madness/ from my lips would flow/ the world should listen then as I am listening now.
দেশের তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতি এই চারটি বিভাগ ও শতাধিক শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। তিনি ছিলেন ইংরেজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান। দীর্ঘ ৩০ বছরের নিরলস চেষ্টায় তিনি এই বিভাগকে একটি মান ও মর্যাদাসম্পন্ন বিভাগ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৮৫ সালের মার্চে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নির্বাচিত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে শিক্ষকদের একাংশের বিক্ষোভ, তাঁকে সামনে রেখে, তাঁর কৃতজ্ঞতাবোধের সুযোগ নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল একটি রাজনৈতিক চক্রের সুবিধা আদায়ের ঘৃণ্য প্রচেষ্টা সব মিলিয়ে তিনি নিজ সিদ্ধান্তে নীরবে উপাচার্যের পদ ত্যাগ করে পুনরায় নিজ বিভাগে শিক্ষকতার কাজে ফিরে যান। এতে তাঁর তথাকথিত শুভান্যুধ্যায়ীরা অখুশিই ছিল।

১৯৯৫ সনে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। এর পর তিনি তিনটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য হিসেবেও তিনি কাজ করেছেন। দুঃখজনক বিষয় হলো সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র জীবিত প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক ও সাবেক উপাচার্য হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে তাঁকে আমরা অনুপস্থিত থাকতে দেখলাম। এ দৃষ্টিকটু বিষয়টি সেদিন আমাদের অনেককে পীড়িত করেছে। শেষ জীবনে এসে তিনি মানসিকভাবে এতে ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন এবং তা তিনি প্রকাশও করেছেন। অবশ্য কর্তৃপক্ষ নিয়ম রক্ষার জন্য আমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়ে দায়িত্ব সেরেছেন। আমি মনে করি সব কিছুর উর্দ্ধে উঠে সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন কমিটির কর্তব্যের মধ্যে আলী স্যারের উপস্থিতি নিশ্চিত করার বিষয়টি বিবেচনায় থাকা উচিত ছিল। এ ছিল ইতিহাসের দায়।বিশ্ববিদ্যালয় হলো উদার, মুক্তবুদ্ধির চর্চার জায়গা, বিশ্ব বিদ্যার সংগ্রহশালা, জ্ঞান সৃষ্টির পাদপীঠ। এখানে কোন ধরনের মতান্ধতা ও সংকীর্ণতার স্থান হতে পারে না।
১৯৯৫ সনে তাঁর অবসর গ্রহণের দিন বিভাগে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তার অনুরোধে সেদিন অত্যন্ত সাদামাটাভাবে তাঁর বিদায় অনুষ্ঠান বিভাগের সেমিনার রুমে অনুষ্ঠিত হয়। আমরা কিছু শিক্ষক শিক্ষার্থী সমবেত হয়েছিলাম ত্বাকে বিদায় জানাতে। সেদিন তারাশঙ্করের “কবি” উপন্যাসের একটি লাইন উদ্ধৃত করে তিনি বলেছিলেন “জীবন এত ছোট ক্যান রে”, বলেছিলেন কোন ফাঁকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনের ৩০ টা বছর চলে গেল। তাঁর চিরবিদায়ে আমাদেরও বলতে ইচ্ছে করে আসলে “জীবন এত ছোট ক্যান রে”।


লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন