‘ইংরেজি শিক্ষা হারাম’ ফতওয়া: একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা ।। কাজী একরাম ।। পুবাকাশ
ইসলামের জন্মভূমি আরব। ইসলামের অনুসারী মুসলমানদের ধর্মীয় ভাষা আরবি। কিন্তু ইসলাম যখন আরবের বাইরে বহির্বিশ্বে তার বিস্তারযাত্রা আরম্ভ করে, সেখানকার স্থানীয় ভাষাসমূহের সাথে তার পরিচয় ঘটে। মুসলিমরা সে-সকল ভাষা আয়ত্ত ও আত্মস্থ করে নেয়। পারস্যদেশ বিজয়ের পর মুসলমানদের ভেতর ফার্সি ভাষা বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। এতটাই জনপ্রিয় যে, তা মুসলমানদের ঐতিহ্যের ভাষায় পরিণত হয়। ভারতবর্ষে আগমনের সময় মুসলিমরা একই সাথে নিয়ে আসে আরবি, ধর্মীয় ভাষারূপে এবং ফারসি ঐতিহ্যের ভাষারূপে। এ ভাষায় তারা রচনা করে একের পর এক মুল্যবান গ্রন্থ আর মহাকাব্য। এ ভাষার কবিসাহিত্যিকগণ হয়ে ওঠেন জ্ঞানানুরাগী মুসলমানদের নিত্যপাঠ্য। এমনকি তাদেরকে করা হয় সিলেবাসভুক্ত।
যদি খতিয়ে দেখা হয় ফারসি ভাষার প্রকৃতি কী ও কেমন ছিল, তবে জানা যাবে এরচেয়ে অইসলামী বিশ্বাস সংশ্লিষ্ট ভাষা আরেকটি হয় না; যে ভাষার ভাণ্ডারে মুশরিক ও অগ্নিপুজকদের শিরকি ও আল্লাহবিস্মৃতির অজস্র উপাদান মজুদ রয়েছে, রয়েছে ভোগবাদী জীবনচর্চা ও বিলাসিতার রমরমা উপকরণ। কিন্তু তবুও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মুসলমানগণ সেই ভাষাটিকে সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছেন। এর মাধ্যমে তারা ‘উলুম ও মাআরিফ, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য গড়ে তুলেছেন!
কোনো বিজাতীয় এবং ইসলামি চেতনাবিরুদ্ধ কোনো বিদেশি ভাষার ক্ষেত্রে মুসলমানদের আচরণের এ এক ঐতিহাসিক উদাহরণ। এমনতরো উদাহরণের আলোকে অতএব এ কথা বলাই যায় যে, কোনো ভাষাবিশেষের ব্যাপারে মুসলমানদের বৈরী মনোভাব আদতে নেই। ভাষা সম্পর্কে এহেন বৈরী মনোভাব পোষণ করার বা কোনো ভাষা শিক্ষা করার ব্যাপারে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার অভিযোগ নিতান্তই অমূলক এবং আরোপিত।
ইসলামের বিরুদ্ধে ইংরেজ তথা খ্রিস্টান পাশ্চাত্যের সংঘাতের রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। মুসলমানদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের ক্রুসেডীয় উগ্রতা ও উন্মাদনা কখনও থামেনি। ভারতবর্ষে আগমনের পরেও তারা তাদের সেই পুরনো খাসলত সমেত আত্মপ্রকাশ করে।
মিশনারি তৎপরতার মধ্য দিয়ে ইসলাম ও পয়গম্বরে ইসলাম সম্পর্কে বিষোদগার ও অপপ্রচার চালাতে শুরু করে। নানা ষড়যন্ত্র ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মুসলমানদের থেকে শাসনকর্তৃত্ব কেড়ে নিয়েই তারা ক্ষান্ত হয় নি বরং জাগতিকভাবে মুসলমানদের পুরোপুরি পঙ্গু করে দেওয়ার পায়তারা করে। শিক্ষা, চাকরি, বৈষয়িক সম্পত্তি সবকিছু থেকে করে বঞ্চিত ও বরখাস্ত। এহেন পরিস্থিতিতে মুসলমানদের ইংরেজ বিরোধিতা বা ইংরেজদের এড়িয়ে চলার প্রবণতা কত প্রকট হবে এবং হওয়াটা যে নিতান্তই স্বাভাবিক, তা বলাই বাহুল্য!
স্যার সৈয়দ আহমদ লিখেছেন, মুসলমানদের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাবের অন্যতম একটি কারণ হল তারা আমাদের ধর্মে হস্তক্ষেপ শুরু করেছিল এবং আমাদের তাহজিব-তমদ্দুন, সভ্যতা-সংস্কৃতি ধ্বংস করার পায়তারা করেছিল। ব্রিটিশ সরকার তার প্রচারকদের মাধ্যমে খুব ধীরে ধীরে, সন্তর্পণে এবং অত্যন্ত চতুরতার সাথে সবকিছু চালিয়ে নিচ্ছিল। কারও ধর্ম পরিবর্তন করার বিষয়ে সরকার জবরদস্তি না করার আহ্বান জানিয়েছিল, তবে গোপনে গোপনে আরবি ও সংস্কৃত ভাষাকে নির্মূল করার পরিকল্পনা জারি রেখেছিল, যাতে ভারতীয়রা তাদের ধর্মীয় ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞ হয়ে পড়ে। বহুরকম লোভ ও প্রলোভন দেখিয়ে ইংরেজ সরকার লোকদেরকে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে রাজি করাতো। [১]
মুসলিম শাসনের পতন পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতি মুসলমানদের পক্ষে সর্বনাশ হলেও হিন্দুদের জন্য ছিল অনেকটা অনুকূল। হিন্দুরা ইংরেজদের সাথে আঁতাত করে তাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, চাকরি-বাকরি সবকিছু লাভ করল।
নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থের হেফাজতে ইংরেজরা হিন্দুদের জন্য খুলে দিল যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার সকল দ্বার। পক্ষান্তরে মুসলমানদের জন্য রূদ্ধ হল সব। খ্রিস্টান মিশনারীকর্তৃক স্থাপিত স্কুল-কলেজে পরিকল্পিতভাবে এমন শিক্ষাপদ্ধতি ও সিলেবাস চালু করা হল, যেগুলি মুসলিমদের ধর্মীয় শিক্ষা ও চেতনার সরাসরি বিরোধী। ফলত মুসলিম শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পক্ষে তৈরি হয় একধরণের প্রতিবন্ধক।
মিশনারি স্কুলগুলি সম্পর্কে স্যার সৈয়দ আহমদ লিখেন: মুসলমানদের এসব কলেজে পড়াশোনা করে উন্নতি করা, জাতীয় পরিকল্পনা এগিয়ে নেয়া এমনকি অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকা আদৌ সম্ভব নয়। অতএব, এই সকল বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে কেউ আশা করতে পারে না যে, আমাদের জাতি এর মধ্য দিয়ে একটি সত্যিকার জাতি হয়ে উঠবে।[২]
বস্তুত, মুসলিম জাতিকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রাখতে খৃষ্টান মিশনারী, ইংরেজ শাসক এবং এদেশীয় দোসরদের যুথবদ্ধ পরিকল্পনা জারি ছিল৷
একদিকে অর্থনৈতিকভাবে মুসলমানদেরকে সংকটে ফেলে দেয়া হল, অপরদিকে তারা এমনসব শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করল, যার ব্যয়ভার বহন করা সাধারণ মুসলমানদের সাধ্যের ভেতর ছিল না আদৌ। তাছাড়া এমন স্কুল ও কলেজও ইংরেজ সরকার বা ইংরেজ অর্থায়নে হিন্দুরা প্রতিষ্ঠিত করে, যা কেবলই বরাদ্দ ছিল হিন্দুদের জন্য।
খৃস্টান মিশনারী সােসাইটির (C.M.S.) কোলকাতা শাখার উদ্যোগে বর্ধমানে ১৮১৯ সালে হিন্দুদের জন্যে একটি ইংরেজী স্কুল স্থাপিত হয়। কোলকাতা শাখার প্রতিনিধি Mr. Shrew এবং Mr. Thompson নিয়মিত স্কুলটি পরিদর্শন করতে থাকেন। অবশেষে যখন ১৮২২ সালে স্কুলটিকে একটি গীর্জা প্রাঙ্গণে স্থানান্তরিত করা হয়, তখন ছাত্রদেরকে খৃষ্টীয় ধর্মে দীক্ষিত করা হবে এ আশঙ্কায় স্কুলটি নষ্ট হয়ে যায়। অনুরূপভাবে ১৮৩২ সালে বিশপ কোরী (Corrie) কলকাতার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা কলংগিতে একটি ইংরেজি স্কুল স্থাপন করেন। কিন্তু যখন তার পাশে একটি গির্জা নির্মাণ করা হলো, তখন অধিক সংখ্যক মুসলিম ছাত্র স্কুল পরিত্যাগ করে। মিঃ টমসন তার রিপোর্টে মুসলিম ছাত্রসংখ্যা হ্রাসের কারণ বর্ণনা করে বলেন যে, “হিন্দুরা পাশ্চাত্য ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি যেমন অনুরাগী, মুসলমানরা তেমন নয়।[৩]
মিঃ টমসন প্রকৃত কারণটি গােপন রেখে কৌশলে মুসলমানদের উপরেই এখানে দোষ চাপিয়েছেন। প্রকৃত কারণ এই যে, পাশ্চাত্যের ভাষা ও সাহিত্যের সাথে খ্রিস্টান ধর্মের প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ ওতপ্রােতভাবে জড়িত। এসব মিশনারী স্কুলে যেতে নিজেকে মানসিক দিক দিয়ে প্রস্তুত করা মুসলমানদের জন্যে যতােটা কষ্টকর ছিল, হিন্দুদের ততােটা ছিল না। খৃষ্টধর্মের প্রতি মুসলমানদের ছিল বীতশ্রদ্ধা এমনকি ঘৃণাও বলা যেতে পারে। কারণ মুসলমানগণ খৃষ্টধর্মকে নাকচ করে তাদের ধর্মবিশ্বাস গড়ে তুলেছে। পক্ষান্তরে এ বাস্তবতা হিন্দুদের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। ধর্মের দায় থেকে তাদের এমন কোন সংকট ছিল না, সে জন্যে তারা সহজেই খৃষ্টধর্মে প্রভাবিত হতো।
ভারতে ইংরেজি শিক্ষার গোড়াপত্তন হয় মূলত মিশনারিদের মাধ্যমে, ইউরোপীয় বণিকদের আর্থিক সহযোগিতায়। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন মিস্টার ডেভিড হেয়ার এবং স্যার এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট। তাদের সহায়তায় হিন্দু যুবকদের শিক্ষার জন্য ১৮১৭ সালে কোলকাতায় হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয়। ১৮১৬ সালের ২৭ আগষ্ট স্যার এডওয়ার্ডের বাসভবনে হিন্দুদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এক সাধারণ সভায় এ প্রস্তাবিত কলেজের গঠনতন্ত্র ও নিয়মনীতি প্রণীত হয়। বলা হয় যে, ‘হিন্দু সন্তানদেরকে ইংরেজী ও ভারতীয় ভাষা এবং ইউরোপ-এশিয়ার সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়া প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য।’ [৪]
এ হিন্দু কলেজটি ১৮২৩ সালে একটি সরকারি কলেজে পরিণত হয়। এভাবে সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষকতা করে। হিন্দুদের উচ্চশিক্ষার জন্য হিন্দু কলেজ ছাড়াও বহু ইংরেজী স্কুল, হিন্দু, ইংরেজ, মিশনারী এবং কোলকাতা স্কুল সোসাইটির মাধ্যমে স্থাপিত হয় কিন্তু কোথাও মুসলমানদের প্রবেশ করার কোন উপায় ছিল না। অ্যাডাম সাহেবের বর্ণনামতে, কোলকাতা আপার সার্কুলার রোড এবং বড় বাজারে জনৈক খ্রিস্টান এবং জনৈক হিন্দু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দুটি স্কুল ছিল। তারা স্কুলে শিক্ষকতাও করতেন। আরেকটি শোভাবাজারে। এখানে তিনশত ছাত্র অধ্যায়নরত ছিল। এই স্কুলটিও একজন খ্রিস্টান ও একজন হিন্দু পরিচালনা করতেন। এসব স্কুল যেহেতু বেসরকারি ছিল, সেজন্য ছাত্রদের নিকট থেকে মোটা বেতন আদায় করা হতো। সেখানেও মুসলমানদের প্রবেশাধিকার ছিল কিনা জানা যায় না, তবে থাকলেও তারা অর্থাভাবে তাদের সন্তানকে সেখানে পাঠাতে পারত না, সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে।
মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৭৮০ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক কলকাতা মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। কিন্তু ১৭৮০ থেকে হাজার ১৮২৯ সাল পর্যন্ত চল্লিশ বছরের এই মাদ্রাসার ইতিহাস অত্যন্ত বেদনাদায়ক। মাদ্রাসা কমিটির জনৈক প্রভাবশালী সদস্য ডাক্তার এম ল্যামসডেন তার রিপোর্টে একজন ইউরোপিয়ান অধ্যক্ষ নিয়োগের সুপারিশ করেন। সরকার সে সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেন। ল্যামসডেন পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই-পুস্তক আরবি ও ফার্সিতে অনুবাদ, মাদ্রাসায় ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন ও মুসলমান ছাত্রদেরকে ইংরেজি শিক্ষাদানের জন্য প্রস্তাব দেন, কিন্তু সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং উপর্যুপরি দাবি সত্ত্বেও সরকার গড়িমসি আচরণ প্রদর্শন করেন।
এইসব তথ্য-উপাত্ত এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ বিবেচনায় নিলে, মুসলমানরা ইচ্ছাকৃতভাবে নিছক ধর্মীয় দোহাই দেখিয়ে ইংরেজি শিক্ষা ও পাশ্চাত্য জ্ঞান অর্জন করা থেকে দূরে ছিল মর্মে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচলিত যে অভিযোগ, তা খোদ নিজেই অভিযুক্ত হওয়ার অবকাশ তৈরি হয়। এর বিপরীতে বরং ইংরেজরা পরিকল্পিতভাবে মুসলমানদেরকে সর্বপ্রকার শিক্ষাগত সুবিধা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে–সেটাই হয়ে ওঠে প্রচলিত ইতিহাসের প্রতিবাস্তব!
এবার দেখা যাক, ভারতীয় উপমহাদেশের তৎকালীন শীর্ষ স্থানীয় আলিমদের ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ও আধুনিক জ্ঞানচর্চা সম্পর্কে কী ধরনের অবস্থান ছিল এবং তাঁরা কেমন দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতেন। তারা আসলেই কি ইংরেজি শিখার বিরুদ্ধে হারামের ফতওয়া দিয়েছিলেন? বলেছিলেন কি এটা কাফিরদের ভাষা, মুসলমানদের পক্ষে এটা শিখা, পড়া জায়েজ হবে না?
দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসিম নানুতবী রহ. (১২৯৭ হি. ১৮৭৯ ঈ.) শেষ জীবনে ইচ্ছা প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, আমি যদি ইংরেজি জানতাম, তাহলে ইউরােপের পাণ্ডিত্যের দাবিদারদের সামনে ঘােষণা দিতাম যে, তােমরা যাকে জ্ঞান মনে কর, তা আদৌ জ্ঞান নয়; বরং জ্ঞান হল যা নবীদের (আ.) বক্ষ থেকে বেরিয়ে আলােকিত অন্তরে এসে অবস্থান নিয়েছে। –আর-রশীদ, দারুল উলুম দেওবন্দ সংখ্যা, পৃ. ১৬৪। বলাবাহুল্য, বিরোধিতা নয় বরং নানূতুবির অন্তিম সময়ের এই অভিব্যক্তিতে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার গুরুত্বই উচ্চকিত হয়েছে।
রশীদ আহমদ গাঙ্গুহি রহ. তদীয় ফাতওয়াগ্রন্থে জনৈক ব্যক্তির প্রশ্নের জবাবে লিখেছেন, ইংরেজী ভাষা শেখা জায়েয। –ফাতাওয়া রশীদিয়াহ, পৃ.৫৭৪। একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন মাওলানা কাসিম নানুতবী রহ.-এর সমসাময়িক বিখ্যাত আলেম মাওলানা আব্দুল হাই লখনভী রহ.। তিনি তাঁর ফাতওয়ায় লিখেন, ‘ইংরেজি পড়া ও ইংরেজি শেখা জায়েয, যদি এতে দ্বীনদারির ক্ষতি না হয়।’ –ফতওয়ায়ে মাওলানা আল হাই লখনভী, ২/২৩৩।
১৯২০ সালে মাল্টার বন্দিশালা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি রহ. আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দাওয়াতে আলীগড় আমন্ত্রিত হন। সেখানে তিনি তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘উলামায়ে কেরাম কখনো ইংরেজী ভাষায় ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে নিষেধ করেননি।’ –আর রশীদ, দারুল উলুম দেওবন্দ সংখ্যা, পৃ. ৬৬০ ইমদাদুল ফাতাওয়া ৫/ ১৫৬-১৫৭।
আশরাফ আলি থানভি রহ. ইংরেজি পড়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, “তাহকীকে তা’লীমে আংরেজী পুস্তিকা”য় বিস্তারিতভাবে লিখেছি। সারকথা এই যে, অন্যান্য ভাষার মতাে ইংরেজিও একটি মােবাহ (বৈধ) ভাষা, কিন্তু আনুসঙ্গিক বিভিন্ন কারণে তা দোষযুক্ত হয়। যদি কেউ সেইসব অনুষঙ্গ থেকে মুক্ত থাকে অর্থাৎ তার আকীদা-বিশ্বাস বিনষ্ট হয়, যার সহজ বরং একমাত্র পথ হচ্ছে, ইলমে দ্বীন হাসিল করে চিন্তা- চেতনায় তা বদ্ধমূল রাখা এবং আমল-আখলাকও নষ্ট না হয় এবং সংকল্পও এই থাকে যে, এর মাধ্যমে জীবিকা উপার্জনের শুধু এমন পথ অবলম্বন করব, যা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয। অতঃপর কার্যক্ষেত্রেও এ নীতির উপর অটল থাকে, তাে এমন ব্যক্তির পক্ষে ইংরেজি শেখা জায়েয ও মােবাহ। আর যদি নিয়ত এই থাকে যে, একে দীনের খেদমতের জন্য ব্যবহার করবে, তবে তা ‘ইবাদত বলে গণ্য হবে।
ভারতের তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় আলেমদের এসমস্ত ফতওয়ার উদ্ধৃতি আমাদের সামনে যে সত্য হাজির করছে, বলাবাহুল্য, তা ইতিহাসের প্রচলিত প্রচারণার সম্পূর্ণ বিপরীতে। হ্যাঁ, প্রকৃত ইতিহাস এটাই। ইংরেজি শিক্ষা থেকে মুসলিম সন্তানদের দূরে রাখা বা বিরত থাকার মূল কারণ কোনভাবেই উলামায়ে কেরামের ফাতওয়া ছিল না। সমসাময়িক মান্যগণ্য আলেমদের কেউই ইংরেজি শিক্ষার সরাসরি বিরোধিতা বা হারাম হওয়ার পক্ষে ফতওয়া দেননি, বরং পরিকল্পিতভাবে চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষাব্যবস্থা আর উদ্ভূত সংকটময় পরিস্থিতিই মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে মূল বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছিল।
“ইংরেজি শিক্ষা বর্জনের জন্য ধর্মীয় গোঁড়ামির চেয়ে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা ছিল সবচেয়ে বেশি দায়ী। উনবিংশ শতকে শিক্ষা ছিল অত্যধিক ব্যয়বহুল। ফলে এটা সমাজের অধিকতর ধনী উচ্চশ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলাদেশের মুসলমান বেশিরভাগই ছিল কৃষক। তখন কৃষকদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। অতএব, দারিদ্র্যের দরুন মুসলমান পরিবারের পক্ষে ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণ ছিল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। মুসলমানদের মধ্যে যারা ছিলেন ধনী, তাদের সন্তানদের অনেকেই ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেছেন। ধর্মের নামে তারা ইংরেজি শিক্ষা অর্জন করেননি। প্রথম মহাযুদ্ধের মূল্য বৃদ্ধি পায়। বাঙালি মুসলমান কৃষকের অর্থনীতি সচল হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে তাদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষাও বিস্তার লাভ করে।” [৫]
আগেই বলেছি, মুসলমানদের সাথে ইংরেজদের ঐতিহাসিকভাবে একটা শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব সক্রিয় ছিল সবসময়৷ ১৮৫৭ এর সিপাহি বিপ্লবের ব্যর্থতা মুসলমানদেরকে ব্রিটিশ কোপানলে নিক্ষেপ করে পুরোপুরি। কারণ, এ বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের উলামাগণ, বিধায় মুসলমানদেরকে প্রতিপন্ন করা হয় ইংরেজশাসনের একক প্রতিপক্ষ শত্রুরূপে। এরই ফলশ্রুতিতে তাদেরকে শিক্ষাগতভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করে। যতদিন এই মুসলমানদেরকে অবদমিত করা যাবে না, ততদিন ইংরেজ শাসন নিরাপদ নয়–এ বিশ্বাস তাদের অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে বসে গেছে। কাজেই মুসলমানদেরকে নানারকম কায়দা কারসাজি করে যাবতীয় শিক্ষা-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে দেয়। তাদের উপর মূর্খতার অভিশাপকে চাপিয়ে দিয়ে তাদেরকে করে দেয় একেবারে বিকলাঙ্গ। কিন্তু, মুসলমানদেরকে এই যে পরিকল্পিতভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হল, ইংরেজদের স্বার্থ চরিতার্থ করার মতলবে তাদেরকে মূর্খ করে রাখা হল–এর দায়ভার যাতে ইংরেজদের উপর না আসে, এমন অভিযোগ যাতে তাদের বিরুদ্ধে কেউ উত্থাপন করতে না পারে, সেজন্য তারা নিজেদের রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের এই হাতিয়ার। প্রচার করতে থাকে, আমরা নই, মুসলমানরা খোদ নিজেরাই নিজেদের ধর্মীয় গোঁড়ামিবশত ইংরেজি শিক্ষা ও আধুনিক জ্ঞান থেকে দূরে ছিল। এভাবে নিজেদের কৃতকর্মের পুরো দায়ভার কৌশলে চাপিয়ে দেওয়া হল মুসলমানদের ঘাড়ে।
চতূর ইংরেজরা অপপ্রচারের অংশ হিসেবে বিশেষভাবে ‘ফতওয়া কথা’টাকে ব্যাবহার করল। বলল, মুসলিম উলামাদের ইংরেজি শিক্ষার বিরুদ্ধে হারামের ফতওয়ার কারণে সাধারণ মুসলমানরা শিক্ষা থেকে মাহরুম হলো! তারাই মুসলমানদেরকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে রাখলো! বলাবাহুল্য, এর মধ্য দিয়ে তারা যে ফায়দাটা লুটতে পেরেছে তা বড়োই করুণ। তারা এর মধ্য দিয়ে সাধারণ মুসলমান এবং ইসলামের ধারক-প্রচারক আলেমসমাজের মধ্যে একধরনের পারস্পরিক দ্বিধা-বিভক্তি তৈরি করে দেয়।
সাধারণ মানুষ ইংরেজ-প্রচারিত তথাকথিত ‘হারাম ফতওয়া’র প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে ভেবেছে যে, আলেমদের সাথে থাকলে, তাদের কথা মানলে জগতে মূর্খ হয়ে থাকতে হবে। তাদের দ্বারা আর যাই হোক দুনিয়াদারি চলবে না। বলাবাহুল্য এমন বিপজ্জনক মনোভাব আজও সক্রিয় রয়েছে সাধারণ মুসলমানদের মনে।
মুসলমানরা আলিমদেরকে শুধু ভুল বুঝল তাই নয়, সাম্রাজ্যবাদী ইসলামবিরোধী বৃটিশদেরকে ভাবতে শুরু করল নিজেদের পক্ষে আশীর্বাদ এবং উন্নতি-অগ্রগতির পক্ষে একমাত্র আদর্শ। যার পরিণতি হয়েছে আত্মঘাতী। কে না জানে, কোনো জাতি যখন তার প্রকৃত কল্যাণকামী এবং আদর্শবান শ্রেণীকে নিজেদের ‘পর’ জ্ঞান করে, প্রতিপক্ষ মনে করে আর স্বার্থবাদী আদর্শহীন বিজাতীয়দেরকে নিজেদের ‘আপন’ বলে ধরে নেয়, তার ধ্বংস তখন অনিবার্য হয়ে ওঠে।
উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজকর্তৃক পরিকল্পিতভাবে প্রচারিত প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়া সেই উলামাবিরোধী মনোভাবের বিষাক্ত প্রভাব আমাদের সমাজে এখনও নানাভাবে প্রকাশ পায়। মুসলিম জনসাধারণ থেকে এমন দূর্ব্যবহার আর অবজ্ঞার হকদার উলামায়ে কেরাম আদৌ ছিলেন না। যেখানে এই আলেমসমাজ সবসময় ইসলামের সুরক্ষা আর মুসলমানদের বৃহত্তর স্বার্থচিন্তায় জীবন ও জগতের যাবতীয় আয়েশ-খায়েশ বিসর্জন দিয়েছেন এবং দিয়ে চলছেন, সেখানে শত্রুদের মিথ্যা প্রচারণার জের ধরে উলামায়ে কেরামকে অবিশ্বাস করা, তাদেরকে এড়িয়ে চলা তাঁদের অবদানকে অস্বীকার করা মোটেই তাঁদের প্রতি সুবিচার নয়।
উলামায়ে কেরাম কখনও মুসলিম জনসাধারণের কল্যাণ বৈ কিছু করেন নি। তারা নবির ওয়ারিস হয়ে উম্মতের সাথে কোনপ্রকার খেয়ানত করবেন–এটা আদৌ হতে পারে না। তাঁরা ইংরেজবিরোধী ছিলেন তা ঠিক, কিন্তু তাই বলে কখনও ইংরেজি ভাষা ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা করা থেকে দূরে থাকার কথা বলেন নি। স্থান কাল পাত্র বিচারে বিভিন্ন মতামত প্রদান করেছেন হয়তো, কিন্তু নির্বিচারে এমন কোনো সিদ্ধান্ত তাঁরা চাপিয়ে দেন নি, যা সমাজ ও জাতির জন্য সামষ্টিকভাবে অকল্যাণ বয়ে আনতে পারে। এটাই স্বাভাবিক এবং ইতিহাসের প্রামাণিক সত্য, এ সত্যকে আমরা যত দ্রুত নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারবো, আমাদের জন্য ততই মঙ্গল!
——————————
তথ্যসূত্র :
১. স্যার সৈয়দ আহমদ, খুতবাতে স্যার সৈয়দ, প্রকাশকাল, ১৯৭৩ খৃষ্টাব্দ।
২. প্রাগুক্ত।
৩. আব্বাস আলী খান, বাংলাদেশের মুসলমানদের ইতিহাস, পৃষ্ঠা, ১৫৭, পঞ্চম প্রকাশ ২০০৬, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার ঢাকা।
৪. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা, ১৬০।
৫. বাংলাদেশের ইতিহাস, সংকলনগ্রন্থ, পৃষ্ঠা ৪৪৯, নওরোজ কিতাবিস্তান, প্রকাশ, ২০০৬ খৃ.।
———-
কাজী একরাম। ইসলামি গবেষণা বিভাগ। শিক্ষার্থী: মাহাদুল ফিকরি ওয়াদদিরাসাতিল ইসলামিয়্যা, ঢাকা৷