খোরশেদ মুকুল

“কোনো বিশ্ব ব্যক্তিত্বের পক্ষেই যে সাংবাদিককে “না” বলা সম্ভব নয়” তিনিই হলেন ওরিয়ানা ফাল্লাচি (১৯২৯-২০০৬)। উপন্যাস আর স্মৃতিকথা লিখলেও ইতালিয়ান এই আপোসহীন লেখিকা রাজনৈতিক সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী হিসেবেই অধিক পরিচিত। হেনরি কিসিঞ্জার, আয়াতুল্লাহ খোমেনি, উইলি ব্রান্ডিড, জুলফিকার আলী ভুট্টো, ওল্টার ক্রনকিট, ওমর খাদাফি, ফেডরিকো ফেলিনি, ইয়াসির আরাফাত, ইন্দিরা গান্ধী, শন কানারি প্রভৃতি প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার তিনি নিয়েছেন। মাত্র ৯ বছর বয়সেই প্রথম লেখালেখির হাতেখড়ি হলেও প্রকৃতপক্ষে লেখালেখির প্রতি মনোযোগ দেন ১৬ বছর বয়সে। ভিয়েতনামের উপর লেখা “নাথিং অ্যান্ড সো বি ইট”, অনাগত সন্তাানের সাথে কথোপকথন “লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন” এবং প্রেমিক অ্যালেক্সান্ডার প্যানাগোউলিসকে নিয়ে লেখা “এ ম্যান” তাঁর উল্লেখযোগ্য বই। আবেগকে আশ্রয় করে জীবনের কঠিনতম পাঠের শিক্ষা পাওয়া যায় তাঁর লেখায়। আবেগ আর বাস্তবতার অপূর্ব মেলবন্ধন বলা চলে।

“লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন” বিবাহ বহির্ভ‚ত উপায়ে গর্ভে ধারণ করা এক মা এবং অনাগত সন্তানের দীর্ঘ আলাপন। কঠিন ব্যস্ততার মাঝেও দৃঢ় আবেগ এবং প্রচলিত নিয়ম ভাঙার এক সাহসি উচ্চারণ গ্রন্থটি। এটি মূলত বর্ণনা প্রধান রচনা। বর্ণনার ঢঙে কথা বলার সময় সন্তানের হয়ে নিজে প্রশ্ন করে নিজে উত্তর দেয়ার একটি অভিনব বিষয় লক্ষ্য করা যায়। তবে মাঝেমাঝে পরিবেশ উদগত সংলাপগুলো উপন্যাসকে দিয়েছে সার্থকতা।
বিবাহ বহির্ভ‚ত সন্তান জন্ম দেয়া আমাদের মত রক্ষণশীল সমাজে যেমন চোখের বালি ঠিক তেমনি মুক্তমনাদের চারণভ‚মি খ্যাত ইউরোপেও। সেখানে এই ধরণের গর্ভধারণ প্রিয়াত্মা প্রেমিক যেমন স্বীকার করতে চায় না, সবচে’ কাছের বন্ধুটিও এটিকে এড়িয়ে যেতে বলে। শুধুমাত্র কাছে থেকে সাহস জোগায় গর্ভধারিণী মা-বাবা। এরকমই ঘটনা প্রবাহের মধ্যে এগিয়েয়েছে “লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন”।

স্রোতের প্রতিক‚লে, নানা বাধা বিপত্তি স্বত্বেও সন্তানকে পৃথিবীতে আনার এক দৃঢ় এবং স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে কর্মঠ মা। যদিও এতে তার কোনো আগ্রহ কিংবা প্রয়োজন নেই। আছে গর্ব। লেখকের ভাষায়-
“ নিজের শরীরের ভেতর আরেকটি জীবন লালন করার মধ্যে একধরণের গর্ব আছে, গর্ব আছে একজনের ভেতর দু’জনকে অনুভব করার মধ্যে।”

পৃথিবীতে নবাগত সন্তান মেয়ে হলে যেমন সময়ের ব্যবধানে কিছু সমস্যার সম্মুখিন হতে হয় ঠিক তেমনি ছেলে হলেও পোহাতে হয় নানা ঝামেলা। যদিও লেখক এতে মেয়ে সন্তানের সমস্যা বেশি-ই বলে উল্লেখ করেন। তবে এটা ঠিক “ হৃদয় ও মস্তিষ্কের কোনো নারীপুরুষ ভিন্নতা নেই”। সমস্যা আমাদের সমাজে, সমস্যা আমাদের প্রতিটি ক্ষেত্রে। সমস্যায় জর্জরিত আমাদের যাপিত জীবন। “ক্ষুধা, দারিদ্র, অপমান, বঞ্চনা, কপটতাপূর্ণ এ পৃথিবীতে একজন নতুন মানুষ নিয়ে আসা কী ঠিক?” তাই এতো সমস্যার মাঝে অনাগতের আগমনকে ভয়ের চোখেই দেখতে বাধ্য হচ্ছে মা।

সন্তানের বয়স বাড়তে থাকলে আকৃতিও পরিবর্তন হয়। এতে মায়ের পেটের আকারেও স্বাভাবিকের চেয়ে পরিবর্তন আসে। অবিবাহিত নারীর এমন পরিবর্তন সমাজ মানতে নারাজ। যার কারণে মা হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করা হয় সে পুরুষও পর হয়ে যায়। ডাক্তারও ভালো চোখে দেখে না এমন রোগীকে। এখানেই একাকার হয়ে যায় প্রাচ্য আর প্রাশ্চাত্যের সরলরেখা। এতে একটি বিষয়ই প্রতিয়মান তত্ত¡ আর তথ্য এক বিষয় নয়। সময় থেমে থাকে না। সময়ের সাথে কাজও তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই কাজের তাড়নায় ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় ময়দানে। কিন্তু নিজেকেও সামলাতে হবে। এমনই কঠিন পরিস্থিতি সামলানো চারটিখানি কথা নয়। এমন সময় শীতের আগমন কথকের মনে আশার সঞ্চার করে। কারণ-
“ শীত শুরু হলে ভালো হয়েছে। বড় ওভারকোটের নিচে উঁচু পেট আর চোখে পড়বে না। আমিও আর অস্বস্তিতে পড়ব না।”

ঘটনা এবং বর্ণনায় প্রসঙ্গক্রমে উঠে এসেছে নানা কুসংস্কার। যা আমাদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় চোখে পড়ে হরহামেশায়। “বিছানার উপর ফুল অশুভ চিহ্ন। শুধুমাত্র মৃতের বিছানাতেই ফুল রাখা যায়”। “অনেকে বলে বাচ্চা জন্মানোর আগে দোলনা কেনা নাকি অমঙ্গলের লক্ষণ”। এমনই নানা কুসংস্কার উঠে আসে ভিবিন্ন জায়গায়।

অসতর্কতার কারণে যে সন্তান মায়ের গর্বে চলে এসেছে। তা নীরবেই; অনেকটা অভিমানেই হারিয়ে গেছে জগত থেকে। রেখে গেছে স্মৃতির পদচিহ্ন। দিয়েছে প্রশ্ন ছুঁড়ে- “সুখ, স্বাধীনতা, ভালোবাসা- খুঁজে পেয়েছ তুমি?”

গ্রন্থটি মূল ইতালি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন জন শিপলি। আর ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের জন্য বইটি “হাত বাড়িয়ে দাও” নামে বাংলা ভাষায় অনুবাদ (কোথাও কোথাও কিছুটা) সম্পাদনা করেছেন আনু মুহাম্মদ।

খোরশেদ মুকুল : কবি ও প্রাবন্ধিক।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন