জগলুল আসাদ
০১.
ছোটবেলায় খিচুরি খেতে খুব পছন্দ করতাম । এখনো করি। একটু ‘ন্যাসা ন্যাসা’ খিচুড়ি। বেশি করে ডাল দিয়ে,নানা ধরনের ডাল দিয়ে রান্না করা খিচুড়ি।খুব ছোটবেলায় একবার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচনের এক মিছিলে গিয়েছিলাম।খেতে দিয়েছিল সব্জি খিচুরি। কলাপাতায় । খোলা মাঠে। ‘সৈয়দ’ বাড়ির পোলা হওয়ায় ও ভালো ছাত্র হিশেবে পরিচিতি থাকায় বড়রা ভেতরে গিয়ে চেয়ার-টেবিলে বসে খেতে ডেকেছিল । কিন্তু মাঠ ছেড়ে উঠিনি । সেই থেকে খিচুরির প্রতি এক দুর্নিবার আকর্ষণ আমার। ছোটবেলায় যখন আমরা করটিয়া থাকতাম, কিংবা কলেজে পড়ার সময় যখন মির্জাপুরে আসা হতো, প্রতিবশীরা আমার জন্যে খিচুরি পাঠাতেন। যাদের মধ্যে কাউকে হয়তো ডাকতাম আপা,ভাবি,ফুপু বা খালাম্মা । গরম গরম খিচুরি এনে বলতো,ডলি (আমার আম্মার ডাক নাম) আপা এই খিচুরি জগলুকে দিয়েন । সেই খিচুরির স্বাদ এখনো লেগে আছে জিহবায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোটা সময় সকালের নাস্তা করেছি খিচুরি, ডিম,আর ভাজি দিয়ে। কামাল উদ্দীন হলের সামনে হারূন ভাইয়ের দোকানে। মাঝে মাঝে লালু ভাইয়ের দোকান থেকেও খাওয়া হতো। এখনো আমাদের ডিপার্টমেন্টের পিয়ন আলামিন প্রতিবছর একবালতি “ঢ্যালা খিচুরি” পাঠায় আমার জন্যে। ওর কোন এক পীর সাহেবের উরসের জন্যে রান্না করা সুস্বাদু-কুদরতি খিচুরি!
ছোট বেলায় কবুতরের মাংসও খুব পছন্দ করতাম।আম্মার সাথে মাঝে মাঝে টাঙ্গাইল শহরে তার অফিসে গেলে কবুতরের মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ার বায়না ধরতাম । শৈশবে স্বপ্ন দেখতাম, বড় হলে আমার যখন অনেক টাকা হবে,আমি তিনবেলা কালিজিরা চালের ভাতের সাথে কবুতরের মাংস খাবো।পরে কবুতর-মাংসের জায়গা নিলো খিচুরি।চাকুরি জীবনে শিখলাম শুটকি খাওয়া । আমার প্রথম পোস্টিং ছিলো সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে।সুনামগঞ্জ-সিলেট অঞ্চলের মানুষ শুটকি খেতে পছন্দ করে খুব । সেখানে মানুষজন ইফতারও করে খিচুরি দিয়ে। খিচুরি ছিল ইফতারের কমন আইটেম।যাহোক,শুটকি আমি এখনো পছন্দ করি । বেগুন ও আলু দিয়ে রান্না করা ভুনা শুটকি,বা ঝাল করে বানানো ভর্তা।
মুন্সিগঞ্জ আসার পর এক অনবদ্য খাবারের সাথে পরিচিত হলাম। নাম “বৌওয়া”। নানা ধরনের ভর্তা ও ডিম ভাজা সহযোগে খিচুরির মতো করে পাক করা সাদা ভাতকে বৌওয়া বলে। অপূর্ব রসনাতৃপ্তিকর খাবার এটি। সহৃদয় দু’একজন শিক্ষার্থী মেহেরবানি ক’রে এই অনবদ্য খাবার আমার জন্যে মাঝে মাঝে বরাদ্দ করে! আর আমি বিহ্বল হয়ে ভোজন সারি!
মিষ্টিও খুব পছন্দ আমার। ছোটবেলায় আমার নানা আমাকে প্রতিদিন মিষ্টি খাওয়াতেন। নানা করটিয়া সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের লাইব্রেরিয়ান ছিলেন। ভালো ইংরেজি জানতেন। কাঁপা কাঁপা গলায় সুরেলা কণ্ঠে গাইতেন উর্দু-হিন্দি গান । আব্বা নিষেধ করলেও নানা কখনো মিষ্টি আনা বন্ধ করেননি।শিক্ষার্থীরা ভালো রেজাল্ট করলে এখনো অনেকে মিষ্টি আনে,অন্তত যারা জানে আমি মিষ্টি পছন্দ করি।মিষ্টির দোকান দেবারও ইচ্ছে ছিল কৈশোরে । মনে পড়ে,খুব ছোটবেলায় এক বসায় ১৫/১৬ টা মিষ্টি খেয়েছিলাম। এখন অবশ্য ভাবি পরিচ্ছন্ন, টিপটপ ও শৈল্পিক একটা খাবার হোটেল দেয়ার কথা। আজকাল খেতে ভালো লাগে গরম সাদাভাত,বেগুন ভর্তা,ডিম ভাজি। চাইলে দিনের পর দিন এগুলো খেয়ে থাকতে পারি আমি। ইদানীং পোড়ামরিচ খাবার অভ্যাস হয়েছে, প্রায় প্রতিবেলাতেই খাই। একটা মচমচে টালা শুকনো মরিচ!
অবসর জীবনে দেশী খাবারের একটা হোটেল দেওয়ার কথা ভাবি মাঝে মাঝে। কোন এক বিশ্বস্ত কর্মচারী থাকবে পাশে,আর আমি বসে বসে পড়ব। আর অপেক্ষা করবো ওপারের। ওপারের অপেক্ষার আরেক নামই তো জীবন। যে পিয়াজ-শুকনো মরিচ আর ভর্তা দিয়েই খেতে পারে দু প্লেট,জাগতিক কোন প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তি তাকে স্পর্শ করেনা খুব । জাগতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা কোনদিন ছিলনা আমার,যদিও বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চাভিলাষ থেকে আমি মুক্ত ছিলাম না কখনোই।…সব সত্ত্বেও,বেঁচে আছি, এও কি কম পাওয়া!
২.
ভেতো বাঙ্গালি বলতে যা বোঝায়, আমি তাই । যা-ই খাই,ভাত ছাড়া আমার চলেনা । ভাতের সাথে প্রতিদিন ডাল হলেও তৃপ্তি ভ’রে খেতে পারি । আর ডিম ভাজা। হাত দিয়ে খেতেই ভালো বোধ করি । কাটা চামচে খাওয়ার সাহেবিয়ানায় স্বচ্ছন্দ হতে পারিনি।ফরাসি দেশের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের আমলে নাকি কাঁটা চামচের ব্যবহার খুব বাড়ে, আর পোর্সিলিন পাত্রশিল্পের বিকাশ হয়,যদিও পশ্চিমা মুলুকের রন্ধনশালার জননী হিশেবে ইতালি পরিচিত।তবে,পোড়া মাংস কাঠি দিয়ে খাওয়ায় গুহামানবের প্রত্নস্মৃতিও আছে । আমি হাত দিয়ে না খেলে খেয়েছি ব’লে মনেই হয়না । খাবারের সাথে খাবার শুধু নয়,মনের যোগও যে লাগে। কী খাই, কিভাবে খাই তাও সংস্কৃতিরই অংশ,যদিও এমন সংস্কৃতি অপরিবর্তনীয় ও অটল কিছু নয় । বাংলাদেশে চাইনিজ ও থাই ফুড,বোতলবদ্ধ পানি ও পানীয় এবং নানা মোড়কাবৃত শিশু ও বড়দের খাবার তো আমাদের খাদ্য সংস্কৃতির পরিবর্তনকেই নির্দেশ করে।বাংগালী খাদ্যের সুস্বাদ নিয়ে যতটা ভাবিত অতটা পুষ্টিমান নিয়ে নয় । কে যেনো পুষ্টির সাথে মহত প্রতিভার সম্পর্ক নিয়ে বলেছিলেন । কথা হয়তো মিথ্যা নয়।মানসিক শ্রমেও প্রচুর ক্যালরি লাগে।মস্তিস্কের সচলতায় খাদ্যের ভুমিকা তো বলাই বাহুল্য । ভারতীয় গবেষক সুধীর কাকার এশীয় শিশুদের নির্ভরশীল মানসিকতা গঠনে দীর্ঘকালব্যাপী মাতৃদুগদ্ধ পানের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন।বাঙ্গালীর নির্ভরশীল মানসিকতার জন্য নাকি সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাস দায়ী । এই গবেষণাকে প্রশ্ন করাই যায়। নির্ভরশীলতা ও মুখাপেক্ষীতা তো মানুষের সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্যই, যদিও এই নির্ভরশীলতার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে বিচিত্র । যাকগা ,রসনাতৃপ্তির সাথে কিছুটা পুষ্টিমান যোগ হলেই আমার চলে। ধরা যাক,একটা ডিম,আর মাঝে মাঝে এক গ্লাস দুধ।
সম্পাদক: চিন্তাযান