স্মৃতিকথা
নানির কথা – শেষ পর্ব
আবু জাফর সিকদার।। পুবাকাশ
নানিকে নিয়ে লিখতে গিয়ে একটা প্রশ্ন বারবার আমার মানসপটে ভেসে উঠছে, তা হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কি আমাদের প্রকৃত মানুষ করে গড়ে তুলতে পারছে?
আমার নানির তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলো না, মকতবে সিপারা, কোরআন ও কিছু ধর্মীয় দোয়া দরুদ শেখা ছাড়া তো পড়ালেখার কোন সুযোগই তাদের জন্য রাখা হয়নি। অনেকটা শিশুকালেই বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দেয়া হয়েছে কিন্তু তার চারিত্রিক সুষমা এতটা উজ্বল হলো কীভাবে আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহন করেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হয়েও মানুষের নৈতিক মান এতটা অধপতিত হয় কী করে তা হিসাব মিলাতে পারি না! নিশ্চয়ই অভিজ্ঞতালব্ধ ও পারিবারিক শিক্ষাই তার বিবেককে সদা জাগ্রহ রাখতে পেরেছেন।
নানির একটি টনটনে আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলো, তাকে মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে জোর করেও বেশিদিন রাখা যেতো না, খুব অস্বস্তিবোধ করতেন। আমার আম্মা তাঁর বড় মেয়ে হওয়া শর্তেও আমাদের বাড়িতেও এলে জোরজবরদস্তি করে এক দুদিন রাখা যেতো, তারপর নানা অজুহাত দেখিয়ে ঠিক চলে যেতেন। এমনকি শেষ বয়সেও আমার মা খালারা সেবাশুশ্রূষার জন্য নিয়ে গেলেও বেশিদিন থাকতে চাইতেন না। তবে শেষদিনগুলোতে তিনি নিজের বড় মেয়ের সাথে কাটিয়ে দিতে তেমন আপত্তি করেননি।
নিজের একটি মাত্র ছোট ভাই ছিলেন, নানা কারণে হয়তো তিনি বোনের তেমন খোঁজখবর করতেন না। নানির ভাই এর প্রতি একটি অদম্য টান ছিলো বোঝা যেত কিন্তু অভিমানও ছিলো। তাই বাপেরবাড়িতে খুব একটা যাওয়া হতোই না নানির।
নানির বাপেরবাড়ি ছিলো দোহাজারীর পশ্চিমে হাছনদণ্ডী গ্রামে। আমার শৈশবে
আমরা একবার , অনেকটা পিকনিকের আমেজে, নানির বাপেরবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মামা, খালা, মামাতো-খালাতো ভাইবোন মিলে ছোট বড় প্রায় দশবারজন গিয়েছিলাম। কী এক রোমাঞ্চকর ও লোমহর্ষক ভ্রমণ ছিলো সেটি আজও ভুলিনি!
আমরা দল বেঁধে ছৈ ও পাল তোলা নৌকায় চড়ে রওয়ানা দিয়েছিলাম, তখন পুরানগড় থেকে দোহাজারী যাওয়ার এটাই ছিলো সহজ বাহন।না হয় লালটিয়া পাহাড় পার হয়ে হেঁটেই যেতে হতো! পুরানগড় আমার নানার বাড়ির ঘাটা থেকে উঠে ভাটিগাঙে বয়ে চলা নদীর স্রোতে ভাসলো নাও! কী মজা, আর কী এক আনন্দ!
কিন্তু এই আনন্দ কিছুক্ষণ পর আতংকে রূপান্তর হয়ে গেল। হঠাৎ মেঘ করে ঝড় ও বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল! তখন আমাদের ডিঙি বেয়ানবাজার বিশ্বহাট পেরিয়ে লালটিয়ার মোড়ে পৌঁছে, এই স্থানটি ছিলো খুবই গভীর খাদযুক্ত একটি ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদ , এখানে পানির ঘূর্ণি এতটাই প্রবল যে যেকোন নৌকাকে মুহুর্তে তলদেশে ডুবিয়ে নিতে সময় নেয় না! এই ঘুর্ণির কবলে পড়েই নদীর অপর পাড়ের আলমগীর গ্রামটি প্রায় নিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। এরকম একটি ঝড়োহাওয়া ,বৃষ্টি, ঘূর্ণি আবর্তে পড়ে আমাদের বাঁচার আশা প্রায় নিঃশেষিত হতে চলছিল। আমরা ছোটরা কেবল নয় বড়দের মাঝেও কান্নার রোল শুরু হয়ে গেলো।
আল্লাহর অশেষ রহমতে, মাঝির দক্ষতায় নৌকা কোনোরকমে লালটিয়ার চড়ে ভিড়াতে সক্ষম হন। আমাদেরকে দোহাজারীর মূল স্টেশনে পৌঁছার আগেই বোধ হয় নামিয়ে দেয়া হয়েছিলো। বৃষ্টি তখন কিছুটা ধরে আসে। অনেক কষ্টে সবাই সেদিন নানিরবাপের বাড়ি পৌঁছাই বটে! তারপর শুরু হয়ে যায় আর এক লীলাখেলা। বিরামহীন বৃষ্টি শুরু হলো। সপ্তাহ পেরিয়ে গেলো। বৃষ্টি থামার নাম নেই। সাঙ্গু উত্তাল। হুহু করে ঘোলা পানি ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। চারদিকে পানি থৈ থৈ। যেন বর্ষাকালের আর এক টাঙ্গুয়ার হাওড়! হাওড় তো জলধি, ঠাণ্ডা শীতল, কিন্তু এটি তো রুদ্রমূর্তি,গাছপালা ঘরবাড়ি সবকিছু ভেঙ্গেচুরে নিয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যিস নানিদের বসতবাড়ি বেশ খানিকটা উঁচুতে ছিলো। সামনের পেছনের পুকুরগুলো ডুবে গেলো! ঘর আর উঠোনেই আমরা বন্দী হয়ে গেলাম। গ্রামের বাড়ির সাথে আমাদের যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। না কোন খবর দেয়া যাচ্ছে, না পাওয়া যাচ্ছে! আমরা এতগুলো মানুষ নৌকায় করে রওয়ানা দিলাম, ঠিকমতো না পৌঁছার সংশয়ে বাড়ির লোকজনও ভীষণ টেনশনে দিন পার করছিলেন। আমরা সাঙ্গু পাড়ের মানুষ হলেও আমাদের গ্রামটা এবং সাঙ্গুর পাড়টাও বেশ উঁচু বিধায় আমরা বর্ষায় সাঙ্গুর এই রূপ দেখতে অভ্যস্ত, কিন্তু এর ভুক্তভোগী নই! মাহালিয়া, আলমগীর, চাগাচর, চর খাগরিয়া,হাছনধণ্ডি ইত্যাদি ভাটি অঞ্চলে এর বন্যা পরিস্থিতি সত্যিই ভীতিপ্রদ।
যা হোক, পরিস্থিতি একটু উন্নত হলে বড়মামা অনেক কষ্টে আমাদের খবরাখবর নিতে ছুটে আসলেন। নানির সাথে নানির বাড়িতে সেই বেড়াতে যাওয়া আমার কাছে এখনও ভীষণ আনন্দদায়ক ও লোমহর্ষক এক স্মৃতি। এই ঘটনা উল্লেখ করার আরও একটি কারণ হলো,এর পর চল্লিশ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে কিন্তু নানি তিন চারবার বাপের ভিটায় গিয়েছেন কিনা সন্দেহ! এভাবেই নারীরা ধীরে ধীরে বাপের ভিটেমাটি থেকেও উদ্বাস্তু হয়ে যায়। এটাই বড় নির্মমতা! কবি ও নাট্যকার, অভিনয়শিল্পী রওশন জান্নাত রুশনি নিচের কবিতায় চমৎকার ও করুণভাবে বিষয়টি ফুটিয়ে তুলেছেন।
“বাপের ভিটা কতোই মিঠা
ভাইয়ের ভিটায় খরা
স্বামীর ভিটা নিমের তিতা
পুতের ভিটায় মরা
ভবের ভিটা কর্মের মিতা
গোরের ভিটায় ধরা।”
আতিথেয়তায় নানির জুড়ি মেলা ছিল ভার। বরাবরই তিনি অতিথি সমাদরে, আপ্যায়ণে কার্পণ্য করতেন না। কোনো মেহমান যেন কিছুতেই খালি মুখে যা যেতে পারেন, সেদিকে তার ছিলো সদা সজাগ দৃষ্টি। এমন কি তিনি যখন খুব অসুস্থ, ঠিক মতো উঠে বসতেও পারছিলেন না এসময় আমাদের বাড়িতে কেউ তাকে দেখতে এলে বারবার তাগাদা দিতেন যেন মেহমানদারি করা হয়। আজীবন তিনি, আমাদের, নাতি নাতনিদের আবদার মিটিয়ে গেছেন খুবই আন্তরিকতা ও মমতা দিয়ে। শেষ বয়সে এসে ছোট মামার ছেলে মেয়েরা পর্যন্ত, মামাতো ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট, তার অপত্য স্নেহ মমতায় বেড়ে উঠেছে!
মামারা যখন যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যার যার মতো আলাদা সংসারি হলেন, তখন থেকে নানির একটা ত্রিশঙ্কু অবস্থা শুরু হয়ে গেল। নাতি নাতনিরাও অনেকে নানির স্নেহের বন্ধন থেকে কিছুটা হলেও ছিটকে গেলো। তবে যখন কারো কাছে আসার সুযোগ হয়েছে, তাকেই তিনি উজাড় করে ভালোবাসা দিয়েছেন। তবে উনার প্রকাশ ভঙ্গিতে প্রগলভতা ছিলো না, উনি উচ্ছ্বসিত হতেন, তবে নিজের ব্যক্তিত্বকে ছাপিয়ে নয়।তাকে খুশিতে অট্টহাসি দিয়ে ফেটে পড়তে কখনও দেখা যেতো না। খুবই চাপা স্বভাবে সব কিছু প্রকাশ করতেন। মুক্তা, কাজল, হেলাল, খোকন থেকে শুরু করে সব শেষের আসাদু, ফরমান, তুষার এবং মাহির – আমার বিশ্বাস তাদের কারও কোন ন্যূনতম অভিযোগ জমা পড়বে না নানির বিপক্ষে! আমরা খালাতো ভাইবোনরা নানি, নানু বলে ডাকলেও আমার মামাতো ভাইবোনরা ‘দাদা’ বলেই ডাকে!তারা দাদির ভেতর, দাদা ও দাদির একটি অভিন্ন ছায়ায় বড় হয়ে উঠেছে। এককথায়, তাদেরকে দাদি, দাদার শূন্যতাটা অনুভব করতে দেয়নি।
আমার লেখায় মন্তব্য করতে গিয়ে অনেক প্রত্যক্ষদর্শী নানা মন্তব্যে বলেছেন নানির পরহেজগারি ও আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে। এটা প্রদর্শনী বা বলার বিষয় নয়,তাই আমি এ বিষয়ে বিশেষ কিছু বলতে চাই না।কেবল আমরা যাতে শিক্ষা নিতে পারি সেজন্যে শুধু দুটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমরা নানা অজুহাতে নামায কাযা কিংবা তরক করে ফেলি কিন্তু নানি শত ব্যস্ততার মাঝেও এ কাজটি কখনই করতেন না।তার যখন একেবারে শেষ সময় সমাগত, বাম পাশ মাথা থেকে পা পর্যন্ত অবশ। ডান পাশটা কিছুটা সচল। সবাই বলছিলেন, ‘সখরাত’ চলছে! অনেক ‘মোহরমাত’ চারপাশ ঘিরে বসে আছে। এক চোখ পুরো বন্ধ, অন্যটি একটু করে খোলা, চোখের কোণে সামান্য স্বচ্ছজল দানা বেঁধে আছে, গড়িয়ে পড়ছে না! প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। নাকে অক্সিজেনের নল, হাতের কব্জিতে স্যালাইনের সুঁই লাগানো। বারবার হাত উঠাতে গিয়ে ছুটছে ক্ষীণ রক্তধারা,কখনও ভিজে উঠছে, কখনও শুকিয়ে আসছে ! সেই সময়ও তিনি মাঝে মাঝে ডান হাতটা অনেক কষ্ট করে মাথার কাছে নিয়ে বারবার শাড়ির আঁচল টানার চেষ্টা করছিলেন! জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণেও তিনি আজীবনের লালিত চেতনা থেকে বিচ্যুত হননি। অনেক কাজের ছুটাছুটিতেও নানিকে কখনও দেখিনি যে তিনি মাথা বা গায়ের কাপড়চোপড় ফেলে দিয়ে ছুটছেন। নিঃসন্দেহে তার জীবনাচার, পরহেজগারি ও তাকওয়া ছিল অতি উচ্চতায়। স্রষ্টা ও বান্দার সম্পর্কের যে নানা স্তর রয়েছে তার সর্বোত্তম স্তরের মোখলেস ও মোহসীন বান্দা হিসাবে নানিকে কবুল করুন, মহান রবের দরবারে কায়মনোবাক্যে এই মিনতি জানাই।
অল্প কিছু অনুভূতি ও স্মৃতিকথা লিখবো ভেবেছিলাম, কিন্তু আমার অবচেতনে যে একটা দীঘল আলোকরশ্মি পড়ে আছে, ভাবিনি! লিখতে গেলে, আরও অনেক কিছুই লেখার বাকী রয়ে গেছে। কিন্তু আপাতত এই পর্বেই ইতি টেনে রাখলাম।তবে এখানে আর দু’একটা কথা না বলে শেষ করতে গেলে দায়টা হয়তো এড়াতে পারবো না! শেষবার যখন নানি আমাদের বাড়িতে আসলেন, মামা-খালারা বারবার নিজের কাছে নিয়ে যেতে আবদার করেছেন। নানি যেতে রাজি হলেন না। নানি তো বয়োবৃদ্ধ হিসাবে অসুস্থ, আমার আম্মা অনেকটা আমার নানির চেয়েও অসুস্থ থাকেন সবসময়। তবুও নানির জন্য আম্মা যথাসাধ্য করেছেন, বিশেষ করে আমার ছোট বোন, ঝুনু, নানিকে শেষ দিনগুলোতে প্রাণভরে সেবাশুশ্রূষা দিয়ে সার্বক্ষণিক পাশে থেকেছে। বড় মামা প্রায় প্রতিদিন ছোট বাচ্চার মতো এসে মায়ের পাশে বসে থাকতেন!হাতের আঙ্গুল টেনে দিতেন, পায়ে আঙ্গুল টেনে দিতেন। সেজ কাঞ্চন মামা আসতেন সব সময়, ছোটমামা শহর থেকে ছুটে যেতেন। খালারাও খবরাখবর নিতেন, ছুটে আসতেন মাঝেমাঝে।।মামিরা আসতেন, নাতি নাতনিরাও সময় সুযোগ মতো ছুটে আসতো। যেন এক একান্নবর্তী পরিবারের মতো সবাই এক মোহনায় এসে মিলিত হতো!
নানি, আলহামদুলিল্লাহ, চার প্রজন্মের দর্শন করে যেতে পেরেছেন, জানি না আল্লাহ আমাদের কারো কপালে সেই সৌভাগ্য লিখে রেখেছেন কিনা! তাই নানির এই জীবন আল্লাহর অসীম নেয়ামত! আমি তার দীর্ঘ জীবনের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসাব এখানে মিলাতে বসিনি। কী দিয়েছেন, কী পেয়েছেন সেই জাবেদাও এখানে মিলাবো না।
দুনিয়ার এই জীবনটাই তো এক গোলকধাঁধা! হাসি কান্না,আনন্দ বেদনা, সুখ দুঃখ,সাফল্য ব্যর্থতা, দারিদ্র্য ও প্রাচুর্য, তৃপ্তি ও অতৃপ্তি, প্রেম ঘৃণা, শত্রুতা মিত্রতা, আবেগ বিবেক এই সব কিছু মিলে একজন মানব, একজন মানবী।
ভালোবাসার অদম্য টানে কিংবা মায়া।মমতার বাহুডোরে বেঁধে পড়া এই একজীবনে মানুষের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা আকাশচুম্বী!
যাপনের পরিতৃপ্তি যতটুকুন থাকুক না কেন, যারা কেবল আত্মকেন্দ্রিক হয়ে বাঁচতে শিখেননি, তারা ফুলের মতো সৌরভ ছড়াতে ছড়াতে নিঃশেষ হতেই বেশি তৃপ্তিবোধ করেন, নানি তাদেরই সমগোত্রীয় একজন ছিলেন। আমরা তার উত্তরপ্রজন্ম হিসাবে তার থেকে এই শিক্ষাটুকু ধারণ করতে পারলেও নিজেদের সার্থক করে তুলতে পারবো।
আবু জাফর সিকদার: কবি ও কথাকার।