গুচ্ছ কবিতা

পাহাড়ী ভট্টাচার্য

চোখ

এই চোখ দেখেছে পৃথিবীর প্রেম-অপ্রেম
দ্রোহ ও দহন কত, ক্ষমাহীন অপারগতায়;
এই চোখ কালের স্বাক্ষি তাবৎ দৃশ্যান্তরের,
তবুও জন্মান্ধ যেন, তুমিহীন দুর্বোধ্যতায়!

তুমিহীন

তুমিহীন এক আগ্রাসী শুন্যতায় বিক্ষত হৃদয়
প্রাগৈতিহাসিক স্তব্ধতা ঘিরে থাকে পাথর সময়
তোমার প্রতীক্ষায় বাড়ে গোপন রক্তপাত কত,
নগ্ন ক্যানভাস জুড়ে সফেদ শুন্যতা অবিরত।
তুলিতে, ইজেলে মৌন অশ্রুপাত, রঙে ও রেখায়
প্রেমাংশুর অর্কেষ্ট্রা;তুমিহীন ম্লান যত বিপন্ন বিষ্ময়!

তুমি

তোমার জন্যে অপরিমেয় যুগ কেটে গেল
অপার্থিব অনুরণনে অতিক্রান্ত হল অষ্টপ্রহর
জ্বেলেছি মোমের প্রদীপ, পুড়িয়েছি খড় কত
অগন্য অভিমানে আমি প্রতীক্ষায় অবিরত;
তবু তুমি মনোনীতা হৃদয়ের ক্ষত
ঢাকোনি আহ্বানের প্রলেপে অপার!
যায় দিন বৃথা প্রেমহীন, তুমি নেপথ্যে নিশ্চুপ
অামিও জ্বেলেছি বুকে অনন্ত দহন
স্বপ্নে-জাগরণে-দৃশ্যান্তরে তোমার অবয়ব
পুড়ে যায়, পুড়ে যায় বুক!

ইদানিং

এখন আমার খুব একটা ব্যস্ততা নেই,
নেই তোড়জোড়, অযাচিত দায়, তাড়া
আমার প্রতীক্ষায় নেই কেউ অষ্টপ্রহর;
স্বেচ্ছাবন্দিত্বে অবিরত আত্ম-বোঝাপড়া!
ইদানিং আমার সবিশেষ অনুযোগও নেই,
নেই ঘৃনা, ক্ষোভ, অভিমান কিংবা পক্ষপাত
নিজের ছায়ার সাথেই যাবতীয় দ্বৈরথ,
কথোপকথন, প্রেম-দ্রোহ-বিরহ-সংঘাত!
ইদানিং আমার অতৃপ্তি নেই, নেই অনুতাপ;
না প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার দোলাচল, না দীর্ঘশ্বাস;
মহেশ্বরের মত মৌতাতে মগ্ন আমি সিসিফাস
নিসর্গে থমকে আছি, অভিশপ্ত, বিদ্ধ-মহাপাপ!

অচেনা নগর

অবিন্যস্ত কিছু এবরো-থেবরো গলি-ঘুপচিতে
পুরনো পলেস্তরা খসা দেয়ালে, চিলেকোঠায়
অসংলগ্ন সন্ধ্যেরা নামে, মৃত লাইট-পোষ্ট যত
ক্রমশ প্রগাঢ় অন্ধকারের অন্তর্জাল ছড়ায়!
সন্ক্রান্ত এই নগর বস্তুত আমার নয়, দৃশ্যত;
অনভ্যস্ত আমি এ পরিত্যক্ত শহরে, প্রাণহীন;
এখানে প্রহর কাটে অপরিমেয় অনিশ্চয়তায়
নিরাবেগ বোঝাপড়া বাড়ায় হৃদয়ের ক্ষত!
বিষাক্ত বাতাসে হাসপাতালের ঘ্রান, পতঙ্গের
কানাকানি, গাছেদের ফিসফাস শুনি কবরের
নিস্তব্ধতা নামে ক্রমাগত পথে ও প্রান্তরে, বিমর্ষ
দিন শেষে বাড়ে মারি ও মড়ক , অনুতাপহীন।

মহাকাল

ক্রমাগত অযুত শঙ্কা ব্যতয় ঘটায় মানুষী নির্লিপ্ততায়!
আশঙ্কা জন্ম দেয় অনুমান-লব্ধ যত ভয় ও দু:স্বপ্নের
ঘটনার নিত্য ঘনঘটায় স্তব্ধ-প্রায় পৃথিবী ও মহাকাল
আজ, এক অণুজীব মত্ত প্রবল প্রতিশোধ-স্পৃহায়।

বিপর্যয়হীন সংবেদী পৃথিবীর স্বপ্নদ্রষ্টাগণ আজ গত
লুঠেরা পুঁজির দেরাজে বন্দী বিবেক দিক-ভ্রান্ত, মৃত!

অনিবার্য আয়ুহীন স্তব্ধতা ও অপরিমেয় বিষ্ময়ের দিকে যেতে যেতে বিপন্ন থমকে দাড়াই, দেখি মহাপৃথিবীর কত প্রান্তরে আজো নামে চিরায়ত মায়াবী চাঁদ, সন্তস্ত্র কাল-
রাত্রি শেষে অমোঘ ভোর, নি:শঙ্ক সকাল। লুপ্তপ্রায় কি এ মহাকাল? আর মানুষী মোহ, পাপ, জিঘাংসা-র ঘের যত!

অসুখ

ভ্যাটিকানে পোপের কন্ঠে নিসঙ্গতার সারমন
হিথরো থেকে আজও ওড়েনি কোন বিমান
প্যারিস-মিলান-বার্লিন-এথেন্সে বিমর্ষ দিন
লন্ডনও বিষন্ন বড়, বার্সিলোনা, প্রাগ প্রাণহীন।

যারা বেঁচে ছিল, আর যারা আজ মৃতপ্রায়
তাদের নি:শ্বাসে পৃথিবীর বাতাস বুঝি লীন
কি হবে সাপ্লাই চেন, জিয়োপলিটিক্স, আগামীর দিন
ভাবনাক্লিষ্ট বিল গেটস, চমষ্কি, অরুন্ধতি রায়।

মন্দা-বেকারি-অনাহার-মৃত্যু ও মহামারি
ধেয়ে আসছে মানুষের দিকে, ত্রস্ত মহাকাল
চুরি যায় ত্রান, শ্রমিকের ব্যরিকেড রাস্তায়
দুরত্বে অনুভবেরা মৃত, তবু মানুষী আহাজারি!

আফ্রোদিতি আর প্রমিথিউসের প্রতীক্ষায়
মহাপৃথিবী জেগে আছে আসমূদ্র হিমাচল,
কে সারাবে আজ পৃথিবীর যত ক্ষত হায়
অমানুষী ভালবাসায়, পল-অনুপল!

একদিন

ভূলে যেতে চাই দ্রূত এইসব ক্ষতচিন্হ
মৃত্যু ও সংক্রমনের গদ্য, ডাটা, গ্রাফ
ভুল মানুষের পৃথিবী বদলাবে একদিন,
মহাকাল লিখবে মানুষের এপিটাফ।

গার্হস্থ্য-কাল

এই ঘর-গেরস্হালী, পাঁচিল, পুরনো খিড়কিদুয়ার,
অপরিসর উঠোনের মত অবিন্যস্ত জীবনকে ভুলে
এক রৌদ্রছায়াময়, অবারিত আলোর দিনে নিশঙ্ক;
অপরিমেয় অন্ধকার ডিঙিয়ে তোমার কাছে যাব।

এই গৃহবাস ক্রমাগত বিক্ষত, বিপন্ন করে আমায়
দেয়ালের পলেস্তরার মত বোধ, খসে পড়ে, হায়!
মরচে ধরা জানালায় বিমর্ষ দিন, গার্হস্হ্য আঁধার
ঘিরে থাকে মহাজাগতিক বিমূর্তকাল আমার!

এই গৃহকাল, ঠুনকো যাপনের দ্বন্ধ, তাবৎ দায়
দেরাজে-চৌকাঠে তুলে রেখে নির্দ্ধিধায় নির্ভার
হতে চাই; অসংকোচের আর্গল ভেঙ্গে মন্হন-মগ্ন
এক গৃহত্যাগী গৈরিক, অপার্থিব মুগ্ধতায় লীন!

সমাপ্তি

এর চেয়ে সমাপ্তি-ই শ্রেয়তর ছিল ঢের
জীবন-মৃত্যুর দ্বৈরথে, এ যুগলবন্দিত্বে
অমরত্ব চাইনি। দীর্ঘায়ু নয়, অপরিমেয়
কাল নয়, নিঃশঙ্ক পারাপার; শুধু এক
অমোঘ আশ্রয় আরাধ্য ছিল!
এর চেয়ে ঘুমহীন ঘুমের ঘোর প্রিয়তর
ছিল বুঝি; অমানুষী ভালবাসার নির্ঘুম-
রাত যত, মৌন হিরন্ময় ভোর, হন্তারক
তিমির শেষে সেই বাহুডোর! প্রেম কত
অনুযোগহীন আহা, নির্বোধ ছিল!

প্রকৃতি
(শিল্পী দুর্জয় প্রসাদ দাশ-এর একটি চিত্রকর্ম অবলম্বনে)

জ্যেষ্টের সুতীব্র দাবদাহ পেরিয়ে
শ্রাবনের ঝড়-মেঘ-বৃষ্টির শেষে
পৌষের হিম-রাত্রি নামে, অতপর
ফাগুনের আগুন-রাঙা দিনান্তে
চৈত্রের অমোঘ সন্ধ্যা আসে
আমি প্রতীক্ষায় থাকি…

কত আটপৌড়ে দুপুর কেটে যায়
অপেক্ষার নৈর্ব্যক্তিক বিকেল, কত
সন্ধ্যা গড়িয়ে নামে রাত, অনুযোগহীন
পঙ্চমীর চাঁদ; তবু প্রতীক্ষায় থাকি….

অধৈর্যে, সুনীল সমূদ্রে ফের ঘুর্ণী ওঠে
ফিরে আসে দু:সাহসী নাবিকের দল,
হিজল-তমাল-বট মহুয়ার ঘ্রানে মাতে
বনবিথীজুড়ে ঝিঁঝির কনসার্ট কেবল
আমি প্রতীক্ষায় থাকি…

আয়ুহীন স্তব্ধতা ও অপরিমেয় বিষ্ময়
ক্রমাগত গ্রাস করে আজ বিপন্ন অামায়,
সম্পর্কের স্বরলিপীতে-ই খুঁজি সুর:
আঁকি তোমায়, মুদ্রিত বিনম্র মূদ্রায়!

১২.০৩.২০২০; চট্টগ্রাম।

পাহাড়ী ভট্টাচার্য : কবি ও প্রাবন্ধিক।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন