একগুচ্ছ কবিতা
সৈয়দ আহমদ শামীম
পুবাকাশ
রঙর বাজার, ভাঙ্গি যাইব একদিন চোখর নিমিষে
কর্ণফুলীর জল ভেঙে একদিন উনিশশো সাতাত্তরে এই নগর কেন্দ্রে এসে নেমেছিলাম
জলের স্মৃতি কোনওদিন মুছে যায়নি আমার
একটি সাদা কালো ধূসর মাছের দোলা আজও প্রাণ ধরফর করে জলপৃষ্ঠে ভেসে মাত্র ডুবে যায়
তার সঙ্গে অতলে নামার নিয়তি লয়ে নগর মাঝারে আমি ডুবতে শুরু করেছিলাম
কত রঙ কত সত্য শিল্প আনাচে-কানাচে
কত সূক্ষ্মতন্ত্রী ধর্ম ও বিধান অনুসার কত কত শ্রুতির প্রতিশ্রুতির সংগম পার হয়ে আজও জীবনের সারাৎসার খুঁজে ক্লান্ত হয়ে নদীর কিনারা ধরে বসি
এত শিল্প পণ্য জাহাজের পটভূমি পটে কোথায় সে ভেসে ওঠা অতল বিলাসী মাছ দেখা দেবে আর
এই দুধ আর বিষের প্রহসনের নদীতে কেবল গফুর হালী চলে গেছে সাম্যের নিটোল নৌকা বেয়ে
♣সেপ্টেম্বর ৯, ২০২১
হেগেল
আমি দেখলাম হের অধ্যাপনায় যুক্ত লোকেদের রচনায়, হেগেল ব্যক্তি ও সমগ্র মানুষের মনোকাঙ্ক্ষা যত দূরব্যাপ বিচিত্র সাধের আকাশে উড়ুক না কেন তার মর্মবিন্দু টেনে এনে মহামহিম রাষ্ট্রের দেয়ালে সজীব চৈতন্যকোষ রূপে রুয়ে দিয়েছেন
সোকির বিদ্রূপের সুর সে রাষ্ট্রের ঈষৎ বিভ্রম আনেনি
সুতরাং একটি অনুপম খৃষ্ট চিদাত্মা দক্ষিণ এশিয়ায় নিরুপম ভ্রমণ করিতেছে
♣সেপ্টেম্বর ১৩,২০২১
কিয়ের্কেগার্ড
হেগেল জাতি-রাষ্ট্রকে জান্নাতসম নির্মাণ করে
সোকি’র মতে, তিনি এর পাশের গুদামঘরে বাস করতেন
শৈশবে সোকি সে জান্নাতের অধিবাসে বিশ্বাস করতেন, পরে তার স্রষ্টাকে বিদ্রূপ করতে করতে পালাতে গিয়ে দেখেন, বেচারা হেগেলের “মন বাস করে মাথার খুলির মতো সাধারণ গৃহে”
♣সেপ্টেম্বর ১৩,২০২১
অন্ধ ডানার চোখ
কী চাহ চোখ স্মৃতিগুল্মের অন্তঃকলহ মধু!
বেলা হারাবার, অতলে, এসেছে কাল
প্রবাল মেলেছে সমুদ্র তলদৃশ্যের
বিস্ময় ঘেরে সংগমকংকাল!
লেলিহা মরে না অক্ষি অজর তৃষ
চরাচরব্যাপ কণ্ঠালগ্ন মায়া
মৃত্যু ছিটকে পড়েছে তুচ্ছ অলোকে
যেন বা জীবন অবিধি প্রাণোচ্ছল
দেখেছ নিগূঢ় জানালার বাহিরে
পলকশূন্য ছায়া পারাপার চোখ
অলোকের কোনো নিভাষ দৃশ্য পেয়েছে
কুলে টেনে তারে কেই বা কীরূপে আনে
আহ্! এই কুলের সংগ সংগম
মিছে নয় তবু মিছা ঘোরতর মনে হয়
দেহনিকুঞ্জে প্রলম্বতর রেখা
অচিন সায়রে প্রাণকে একলা ভাসায়
কী দিয়ে ধরিবে পরানে উড়ন্ত পাখি
মনের অন্ধ বিহ্বলতার সীমা
শৈশব কাল মহাকালে রুয়েছিল
একজোড়া চোখ, সেসব ফিরবে নাকি!
♣সেপ্টেম্বর ২, ২০২১
অশ্রুসিক্ত হবার জন্য বসো
দুনিয়ার সমস্ত সমাজ জুড়ে যারা থাকে
তারা জানে না যে ভাষা ভালোবাসে
যখন তার চারপাশের গাছের শেকড় পাতায় সুর ছড়িয়ে দেয় তারা ভাষার প্রেমে পড়ে যায়
বাতাস হতে পাওয়া সুরের শোণিতে যখন নদী সমুদ্র দিশাহারা হয় তারা সেখানে গিয়ে বসে
তাদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে
তারা ফলিয়ে তোলে মাছ স্নান করে
গোবাছুর আনাজের ক্ষেত সুরলগ্ন গৃহের মাটি
ঈষৎ বিভ্রমের রেখা ধরে বুকের অচেনা সুরের খুন করে হাওয়ায় মেলানো শরীর
অপার চক্রাবর্ত খুন হয়ে যাওয়ার সাধে অমরতার খোঁজে মধুরতা চক্রাবর্ত ঘুরে
অশ্রুসিক্ত হওয়ার জন্য বসো
প্রেম শব্দটিরে শত রুদ্ধ দুয়ার খুলে নিত্য দুয়ারে পেলে
চক্রাবর্তে থেকে মানবসমাজে যারা আছে
সবাদের প্রেম রয়েছে
যৌবনে তারা বিভ্রমের মধুরতার সাথে গিয়ে কারু অশুভ হয়েছে কারো ঘোর কিংবদন্তি অঙ্গঅঙ্গ জুড়েছে, সমাজের কারো ঘোর গ্রন্থিচ্যুতি ঘটেনি রসিক!
প্রকৃত অশ্রুসিক্ত হবার জন্য বসো
মানুষ অমরতার বাসনা পেয়েছে
অমরত্বের জন্য সে স্বয়ম্ভু সুরের সাথে প্রতিবার জন্মদাতার সাধ লভিয়াছে
শূন্য শব্দের সাথে সুরের লগ্নি ঘটিয়ে কবি অভিহিতি করেছে
শব্দ ও সুর গেথে দৃষ্টির মায়ার সাথে নারীর জন্য ফাঁদ পাতিয়াছে
শব্দ সুরের প্রকৃত আধিকারিকের সন্ধানবিনে নারী তার অপার মুক্ত করে নিঃশেষিত হয়ে অনন্ত তৃষ্ণার লোভের কাছে ফতুর হয়েও সংসারে সমাজ থেকেছে
সময় ফুরায় কাল মহাকাল পিপড়ের সারির মতো যায়
সভ্যতা বাড়িয়ে ক্লান্তি লাগে কারোর, সমাজ বিচ্যুত হয় না
কালো কুচ্চিত ধবধবে ফর্সা ফিরিঙ্গী তামিল এশীয় সুশ্রী অভিহিত উত্তর ভারতী ঋজু নাসাগ্ররমণী কাদামাখা তেলঝা আফ্রিকা বালিকা সবাই সবাই দেখেছ অবশেষে কিছুই ফুরায় না
লাইনচ্যুত একটা পিপড়ার মতো মৃত্যু ছিটকে একটা আশা বেরিয়ে ছিটকে পড়েছে অমরতার বাসনার দিকে
যত ভারতবর্ষীয় কৃষ্ণমূর্তি আর বুদ্ধের বিগ্রহ হোক প্রতীচ্য পুরোহিত লুকিয়ে রাখুক যীশুসংহিতা
অমর সত্তা জানে মানুষ ও সমাজ তার প্রকৃত সত্তার সন্ধানে উন্মুখ রয়েছে নদীপাহাড়ের নির্জনে পাতা পিপড়ের মতো ধ্যানে
সৈয়দ আহমদ শামীম : কবি। প্রকাশিত গ্রন্থ দু’টি। অবলীলাদের বাড়ি, অনতিহাসের কথকতা।