মুক্তগদ্য
ভোর যেন এক রূপকথার গল্প
সবুজ ভট্টাচার্য্য।। পুবাকাশ
এসময়ের শিশুরা জানেও না ঊষা দেখতে ঠিক কেমন হয় অথবা ভোরবেলাটা দেখতেইবা কেমন। তাদের কাছে ঊষা বা ভোরবেলা থেকেও মধ্যরাত অনেক বেশি চেনা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই মধ্যরাত তাদেরকে চেনালোইবা কে আর চিরায়ত সেই উষা ও ভোরবেলা কে তাদের ভুলে যাওয়ার পেছনে কারাইবা দায়ী।
কথায় আছে “সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।” তাই বর্তমান আধুনিক সমাজ সময়কে তোয়াক্কা না করেই স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে শুরু করেছে নির্দ্বিধায়। চিরায়ত জীবন্ত চরিত্রের পাশাপাশি কিছু কৃত্তিম চরিত্র গ্রাস করে নিয়েছে আমাদের সময়। ডিজিটাল পর্দার ফোরকে রেসোলিউশনে প্রকৃতিকে দেখতে দেখতে প্রকৃত প্রকৃতি আমাদের তেমন একটা চোখে লাগে না। তাই দিনের শুরুতে যে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা, পাখির যে গুঞ্জন, গ্রীস্মের দাবদাহের মাঝেও যে শীতলতার ছোঁয়া তার স্বাদ আহরণের সুযোগ অনেকেরই হয় না।
যদি বর্তমান সময়ের কোন শিশুকে দিনের বিভিন্ন অংশের নাম বলতে বলেন তাহলে সে হয়তো সকাল-দুপুর-বিকেল সন্ধ্যা ও রাতের কথা আপনাকে জানাবে। এসময়ের শিশুরা জানেও না ঊষা দেখতে ঠিক কেমন হয় অথবা ভোরবেলাটা দেখতেইবা কেমন। তাদের কাছে ঊষা বা ভোরবেলা থেকেও মধ্যরাত অনেক বেশি চেনা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই মধ্যরাত তাদেরকে চেনালোইবা কে আর চিরায়ত সেই উষা ও ভোরবেলা কে তাদের ভুলে যাওয়ার পেছনে কারাইবা দায়ী। এর সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বেশ কিছু বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
প্রথমত, বিজ্ঞান ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উৎকর্ষতা। দ্বিতীয়তঃ পশ্চিমা সংস্কৃতির বিরূপ প্রভাব। তৃতীয়তঃ অনিয়মের স্রোতে গা ভাসানোটাকে আধুনিকতা মনে করা। সর্বশেষ এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ হলো পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় অর্থের পেছনে ক্রমাগত পাগল ঘোড়ার মত ছুঠে চলা অভিভাবক শ্রেণী।
যদি বিজ্ঞান ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উৎকর্ষের কথা বলতে হয় তবে এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, বিজ্ঞান ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উৎকর্ষ আমাদের কাছে এক স্বর্গীয় আশীর্বাদ কিন্তু এই আশীর্বাদকে অভিশাপ হিসাবে পরিণত করেছি আমরা নিজেরাই। বর্তমান প্রত্যেকটি পরিবারের শিশু সন্তানদের কাছে মা-বাবার কাছ থেকে একান্ত সময় পাওয়া একটা দুর্লভ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিভাবকরা সন্তানদের নানাবিধ বায়না ও শিশুসুলভ জ্বালাতন থেকে বাঁচতে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ এবং টিকটক, ইউটিউব ও ফেসবুকের মত কৃত্তিম অস্তিত্ব সম্পূর্ণ বিভিন্ন মাধ্যম। পরিণতিতে সন্তানদের বিভিন্ন শিশুসুলভ বায়না ও জ্বালাতন থেকে অভিভাবকরা বাঁচলেও নিজের সন্তানদেরকে ঠেলে দিচ্ছেন এক অন্ধকার এবং কৃত্তিম জগতে যেখানে নেই প্রাকৃতিক সৃষ্টিশীলতা বা মেধার উৎকর্ষ সাধনের কোন সঠিক উপায়। এসব আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার চাকচিক্যপূর্ণ অবাস্তবতায় দীর্ঘ সময় অভ্যস্ত হয়ে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের রোগে। অল্প বয়সে তারা চোখের স্বাভাবিক দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলছে। অনেকের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা এসকল যন্ত্রপাতি বা সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় তারা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে যে মধ্যরাতের আগে বর্তমান শিশুরা ঘুমায়না বললেই তা সবার কাছে শুনতে স্বাভাবিক মনে হবে।
দ্বিতীয়তঃ পশ্চিমা সংস্কৃতির বিরূপ প্রভাবের কথা বলেছিলাম। প্রত্যেকটি সংস্কৃতির কিছু ভালো এবং মন্দ দিক থাকে। আমরা পশ্চিমা সংস্কৃতির খারাপ দিকটাকেই সবার আগে গ্রহণ করে থাকি। তাদের হাজার বছরের লালিত সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বা জলবায়ুগত অবস্থানের কারণে তাদের কাছে যে আচরণ সঠিক তা আমাদের কাছে যে সঠিক হিসেবে বিবেচিত হবে তা মোটেও যুক্তিযুক্ত বক্তব্য হতে পারেনা। তাই সন্তানদেরকে দেশীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত করা বা অভ্যস্ত করা অভিভাবকদের একান্ত দায়িত্ব হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে ধর্মীয় নীতিতে ভোরবেলার যে প্রার্থনা করার নিয়ম তা সন্তানদেরকে অবগত করা এবং অভ্যস্ত করে তুলতে হবে
উত্তরাধুনিকতার প্রভাব একেক দেশে একেক রকম। অধিকাংশ মানুষ অসভ্য শব্দের ব্যবহার, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বহির্ভূত পোশাক পরিধান, পশ্চিমা সংস্কৃতি থেকে ধার করা অনুষ্ঠান পালন করাকে আধুনিকতার কাতারে বিবেচনা করেন। অর্থাৎ যা কিছু নিয়মের কাতারে পড়ে তার সবকিছুই বর্তমান আধুনিক সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রে গেঁয়ো বা প্রাচীন বলে আখ্যায়িত করা হয়।
যে পশ্চিমা সংস্কৃতি কিছুমাত্র অপসংস্কৃতিকে সুসংস্কৃতি বলে আমরা বুকে জড়িয়ে নিয়েছি ; সেই পশ্চিমা সাহিত্য আমাদেরকে শিখিয়েছিল “আর্লি টু বেড এন্ড আর্লি টু রাইজ /মেকস আ ম্যান হেলদি ওয়েলদি অ্যান্ড ওয়াইজ।” কিন্তু আমরা সে শিক্ষাকে বুকে লালন নাকরে তাদের যত দোষ সেগুলোকে মাথায় তুলে সম্মান করা শুরু করেছি।
সর্বশেষ কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলাম পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার ঘোড়ার মতো ছুটে চলা অভিভাবকদের কথা। বর্তমান অভিভাবক শ্রেণী অর্থ উপার্জনে এতটাই ব্যস্ত যে নিজের সন্তানদের কে কোনভাবে ব্যস্ত রাখতে পারলেই যেন তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। তাই অধিকাংশ সন্তান তাদের অভিভাবকদের সরাসরি আদর স্নেহ না পাওয়ার কারণে এসকল কৃত্তিম যন্ত্র এবং কৃত্রিম মেধাসম্পন্ন সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় নিজেদেরকে অভ্যস্ত করে তুলছে। তাই প্রত্যেকটি অভিভাবকের উচিত অর্থ অর্জনের পাশাপাশি তাদের সন্তানদের সুন্দর একটি ভবিষ্যত অর্জনে সহায়তা করা।
বর্তমানে অধিকাংশ শিশু সকাল বলতে আটটা-নয়টা সময়টাকে বুঝে থাকে। অনেকের কাছে যেটা সকাল হিসেবে বিবেচিত হয় চিরায়ত নিয়মে সেটা অপরাহ্ন হিসেবে পরিচিত। একটা প্রচলিত কথা আছে যে “সূর্যোদয়ের পূর্বে জেগে সূর্যকে জাগানোই সর্বোৎকৃষ্ঠ।” ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠার উপকারিতা সম্পর্কে আমরা আমাদের সন্তানদেরকে অবগত করতে হবে যাতে তারা সকালের স্নিগ্ধ বাতাস এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে এবং সঠিক সময়ে তাদের দিন শুরু করতে পারে।
এ প্রেক্ষিতে আমাদের সন্তানদের কাছে ভোর শব্দটাকে রূপকথায় পরিণত করতে না চাইলে আশা করি অভিভাবকরা ভোর হলেই দোর খুলবেন এবং তাদের খুকুমণিরা জেগে উঠবে। সকালে উঠে তারা মনে মনে বলবে যেন সারাদিন তারা ভালো হয়ে চলে। এভাবে আমরা হয়তো এ অন্ধকার জগত থেকে আমাদের সন্তানদের জীবনে সফলতার ঊষার আলো তাতে সক্ষম হব। তাই বলতে চাই “ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন না দেখে ঊষার আলোয় চোখ মেলে স্বপ্ন দেখাটা অনেক বেশি সফলতা বয়ে আনে। ”
সবুজ ভট্টাচার্য্য : তরুণ লেখক ও সম্পাদক
: ত্রৈমাসিক ঊষাবার্তা।