গল্প
পালকি ও একটি নাকফুলের কাহিনী
রেদওয়ান খান ।। পুবাকাশ
বটগাছে দু’একটি কাক। তারা পালকি ও রুমালমুখি, পায়ে লাল মোজা পরা জামাই দেখে বিস্ময়ে বার কয়েক কা কা করেছে।বেহারাদের সঙ্গে পালকির পিছু পিছু যে ক’জন যাত্রী- তাদের মুখে কথা নাই। বউটির ছোটো বোনটি ‘বুজির লগে যামু’
মধ্য দুপুরে শিরিষ গাছের ডালে তার পাতাগুলো জনপদটির গহীন নিরবতায় কান পেতে স্তব্ধ হয়ে আছে।কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে, উঁচু ডালে, বোবা পাতার আড়ালে লুকিয়ে থেকে যে ঘুঘুটি ডাকছিলো, তার কণ্ঠ থেকে ঝ’রে পড়ছিলো একটি বিদায় বেলাকার বিষণ্ন-করুণ সুর।সুতরাং সেখানে ইহলৌকিকতার বদলে সপ্তম আসমানের রহস্য থমকে থেকে অবসন্ন। সেই সুরের বিলাপে চরাচর ভাষাহীন এক বায়বীয় আবেশে কান পেতে আছে।লোকবিদায়ের পর, কিছু পূর্বে শিরিষ গাছটির তলে একটি মাটির চুলা জীবনের প্রয়োজনে,আগুনের ব্যস্ততার পর অবসর পেয়েছে। ছাইগুলোর ভেতর এখনও আগুন নিভে নাই।গত রাত থেকে যা কিছু রান্না হয়েছে- সবই কেমন অচঞ্চল,গম্ভীর, সতর্ক।একটু আগেই আতরবানুকে বিদায় দিয়ে এ বাড়ির গৃহিনী অযুফা, ঘুঘু পাখিটির মতোই কাঁদছেন।চারিদিকে চৈত্রমাস- ‘নিন্দাপতি’ পোকার মতো একটানা সেই ক্রন্দন পরকালের প্রতিভূ হয়ে নিরানন্দ-শঙ্কিত কিছু লোকজ অন্তরে বাজছে।
চৈত্রমাসের কাঠফাটা রোদের ভেতর একটি একলা পালকি বহন করে নিয়ে গাঁয়ের এ-বাড়ি ও-বাড়ির ফাঁকে ফাঁকে বনজ সুনসান স্তব্ধ জমিনের আইল ধরে দু’জন মাত্র বেহারা হেঁটে চলেছে।তাদের ঘর্মাক্ত শরীরের নিম্নাঙ্গে মলিন লুঙ্গি,উর্ধ্বাঙ্গ খালি।মাথায় তেলতেলে গামছা।পালকির পেছন পেছন জনা কয়েক যাত্রী।তাদের ঠ্যাং-এর চলমান বিক্ষেপে অনিচ্ছুক ভাব স্পষ্ট,সেখানে যৌথ গতির কোনও আনন্দ নাই।রুমাল মুখে,লাল মোজা পায়ে,দূর থেকেও জ্বলে-ওঠা সেই রঙ- হেঁটে চলেছে সদ্য বিয়ে করা জামাইটি, লিকলিকে কালো মুখ,তবে একটা লাজুক ভাব রুমাল-চাপা মুখটিতে রোদ পড়ে ঝলকে উঠছিলো। তার মুখ ভর্তি গোল গোল দেবে যাওয়া দাগ,এককালে হয়ে যাওয়া বসন্তের ক্ষতগুলো স্থায়ী হয়ে রফিক মিয়ার মুখটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।ফলে তার লাজুক হাসিটি সর্বদা নির্মল।পালকিতে তারই নয়াবউ আতুরি।
আলপথে হাঁটতে হাঁটতে রফিক মিয়া ভেবেছে, পালকির ভেতর টুকটুকি বউটা না জানি কি করছে!কিছুদিন পূর্বে,গরুর জন্য ঘাস কাটতে যাওয়ার পথে,সে,খাঁ বাড়ির পাশ্ববর্তী যুগি বাড়ির কালো গাব গাছটির তলে,জীর্ণ মন্দিরটির সামনে ক্ষণিক দাঁড়িয়ে থেকে,দুর্গা মূর্তি দেখে বিস্মিত হয়েছিলো।একবার অপলক ভেবেছিলো- কী সোন্দর!ক্যামনে বানাইছে!
পালকির ভেতর যে কন্যা বসে আছে,রফিক ভেবেছে লাল টাঙ্গাইল শাড়িতে পেঁচানো সে যেন একটা ‘দুর্গা।’ মাইয়াডা নাকি শাড়িও পড়তে জানে না।বিবাহ আসরে এইসব কথা দু’একজন কানে কানে বলে ঠাট্টা করেছে তাদের বাড়ির নতুন জামাইকে।রফিক রুমাল মুখে হয়তো সামান্য এক টুকরো হেসেছিলো।
বেহারাদের চলার গতি মন্থর, পালকি কাঁধে নিয়ে মুখে ‘আল্লাহা বোল’- গান নাই।বরং যতোটা সম্ভব সকলেই যেন এক অজানা আশঙ্কায় সন্তর্পণে ত্রস্ত।অন্য সময় বেহারারা তো নিজেরাই ঘুঙুর পায়ে নেচে, গ্রাম নাচিয়ে পালকি কাঁধে প্রতিটি ঘরের আগদুয়ারে, বকশিসের আশায় গান গেয়েছিলো- ‘লা ই লা হা কলমা পড়ো ভাইরে, নানুপুরের মাইয়্যা আনছি ঢকের গুষ্টি নাইরে! লা ই লা হা কলমা পড়ো ভাইরে!’ তবে লাল-সবুজ রঙিন পাতলা ঘুড়ি-কাগজে নকশা কেটে পালকিটি সাজানো।যে নকশা কেটেছে,তার শিল্পরুচি সরল গাঁয়ের মতোই নির্ভেজাল- যেন বা হাশরের ময়দানে এইটুকুই জীবনের আশালতা হয়ে পালকিটির কাষ্ঠনির্মিত দেহের সঙ্গে দুলে দুলে চলছে।
কৃষকদের ফসলী ক্ষেতে চৈত্র মাসের আগুন।কিছু কিছু গম-তিল-তিশির জমিন।কিছু কিছু মুগডাল। সরিষাও ঝুনা-ঝরঝরা হয়ে নুয়ে পড়েছে।তাছাড়া কিছু কিছু জমিনের ফসল এখন, মনে হয় ক্ষত-বিক্ষত এক কেয়ামতের ময়দান।পদতলে পিষ্ট, থেঁতলানো।
ডাকাতিয়া নদীটির তীর দিয়ে, সর্দারবাড়ি পেরিয়ে হেমা মাঝির খেয়া পার হয়ে, পালকিটির গন্তব্য-টুগ্গি। টুগ্গির অতি উঁচু মোঘলাই ব্রিজটি থেকে বেশি দূরে নয়, রফিক মিয়ার বাড়ি। ব্রিজের কঙ্কালসার শাদা রেলিংটি দেখা দিতে এখনও অনেক দেরি।হেমাঙ্গ মাঝির খেয়াঘাটে, সাপখোপের পদচারণায় পূর্ণ যে বয়স্ক বট গাছটি- এখানকার ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষী,তারই ছায়ায় পালকিটি রেখে, এখন বেহারাগণ ক্লান্তি নিবারণে নদীতে নেমে কচুরির জমাট আবরণ সরিয়ে, কুঁজো হয়ে দু’হাতের অঞ্জলিতে কয়েক ঢোক পানি খেয়েছিলো।তবু নির্বাক কচুরির তলে কিছু জীবন বেহারাদের কর্দমাক্ত পায়ের চঞ্চলতায় নড়ে উঠেছিলো। যাত্রীগণের মনে কী জানি কি এক অজানা ভয়।
খেয়াঘাটে হেমা নাই।নৌকাটি ওপারে ঝিম মেরে আছে- এপার থেকেও ঝিমঝিম কম্পমান রোদের আবহে বেশ দেখা যায়।হেমাঙ্গ দাসের বাড়িটি ওপারেই, নদীর দিকে নুয়ে পড়া বাঁশঝাড়টির আড়ালে।হয়তো বহুক্ষণ যাত্রী পায় নাই,কিংবা ক্ষুধার্ত, তাই খেতে গেছে, এক্ষুণি এসে পড়বে। নদী ও নৌকা ব্যতীত হেমাঙ্গ মাঝির আর কোনও জীবন জিজ্ঞাসা নাই।তবে এখনকার জীবন এখন গুমট, থরথর আতঙ্কের দৃশ্যমান ছায়া খুবই দীর্ঘতর হয়ে উঠেছে। কদাচিৎ যে ক’জন যাত্রী আসে,তাদের শঙ্কিত মুখে-চোখে ইহলোকের চিহ্ন অনুপস্থিত, যেন ঘটিবাটি-পোলাপান-বউ-ঝি’রা ‘লেইত’ বেঁধে পরকালের উদ্দেশেই পারাপার হয়, নদীর কোন পাড়ে তাহাদের সেই মহপ্রস্থান পরবর্তী তীর্থ-গন্তব্য- হেমা মাঝি তাহা জানে না।।কখনও বা দল বেঁধে অতি সতর্ক যুবকেরা যায়- তাদের কারো কারো হাতে ত্যানা পেঁচানো ভারী কিছু হেমা অনুভব করে তাঁর নিরাকার বিশ্বাসের নিকট বলে, ‘মা তুই রক্ষা করিস!’ কিন্তু হেমা এখন নাই।ফলে নদী ও খেয়াঘাট হেমার নৌকার মতোই পরিত্যক্ত।
বটগাছে দু’একটি কাক। তারা পালকি ও রুমালমুখি, পায়ে লাল মোজা পরা জামাই দেখে বিস্ময়ে বার কয়েক কা কা করেছে।বেহারাদের সঙ্গে পালকির পিছু পিছু যে ক’জন যাত্রী- তাদের মুখে কথা নাই। বউটির ছোটো বোনটি ‘বুজির লগে যামু’ বলে আনাড়ি করেছিলো, কেঁদেও ছিলো। পালকি ছোটো, জায়গা কম।তাই পুতলিকে অন্যদের সঙ্গে হেঁটেই আসতে হয়েছে। এখন বটতলে সকলের থমথমে মুখভাব তার বুজির লগে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার আগ্রহে ঘুম নেমে আসে।তাকে বৌটির পালকিতে তার কোলে দেয়া হয়।তখন পুতলির মুখ যেন এক অমল হাসির কুয়া,গালে দু’টি টোল।
লাজুক বৌ আতরবানু- আতুরি। বয়স তেমন হয় নাই। চোদ্দ-পনের। গায়ে গতরে বাড়ন্ত। দেশকাল ভালা না। শকুনের চোখ পড়ার আগে বিবাহের তড়িগড়ি। আতরের বাপ-মা এই ক’মাস ধরে দুঃশ্চিন্তায় রাত কাটায়। তাহাদের রাত্রিকালীন ঘুম হারাম, দু’চোখের পাতা এক হয় না দুঃস্বপ্ন-কল্পনায়। গাঁয়ে আরো যাদের কন্যা সন্তানের সবে মাত্র বুক উঠেছে কি উঠে নাই, সেইসব কন্যাদের সবারই বিবাহের একটা গুঞ্জন শোনে এ পাড়া ও পাড়া।
আতুরিকে নিয়ে কয়েকদিন নিজের বাপের বাড়ি ইসলামপুরে কাটিয়ে এসেছিলেন তার মা অযুফা। সেখানেও অবস্থা গুম গুম।লোকজন যেন নিজেদের ভিটেমাটি বাসন কোসন ফেলে কোথাও পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচে।অযুফার আরো দুই বোন বাপের বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছে।গাদাগাদি অবস্থা। বেশিদিন থাকা যায় নাই।
বাপের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কাঁচা তরতাজা শোক,পালকির ঝাঁকুনি, জনপদের মেঘ-গুম-গুম গুমট ভাব – এসবের কারণে ঘোমটার ভেতর আতুরি ঘেমে একাকার।তবু নিয়ম মাফিক বিবাহোত্তর ‘লাজে’ চোখ বুঁজে রয়েছে।যেন রাজ্যের লোক বউ দেখে ফেলেছে।দেখে ফেলাটা বড়োই শরমের বিষয়। ‘নিলাজ’ -‘বে-লাজা’ হতে চায়না আতুরি। পালকির ভেতর যথাসম্ভব ঝুঁকে থাকে- কলাবউ। লাজে।
পুতলিকে পেয়ে ঘোমটার ভেতর এতক্ষণে কিছু প্রাণ খুঁজে পেলো লজ্জাবতী আতুরি। বাপের বাড়ি ছেড়ে যেতে তার বুক ছিঁড়ে যাওয়া কষ্ট হচ্ছে। মায়ের ডুকরে ডুকরে কান্না এখন তাকে বড়োই বিমর্ষ করে তুলছে।জগতের অগোচরে ক’ফোঁটা অশ্রু বিসর্জ্ন করে বালিকা বউটি।
খেয়া নৌকার মাঝি হেমাঙ্গ দাসের কোনও খবর নাই।নদীর ওপারে,বিধবার শাদা বেশধারী কোনও এক নারী বার দুই তিন মাটির ঠিল্লা ভ’রে পানি নিয়ে গিয়েছিলো।তার ঘোরতর কালো গায়ের রঙটি সূর্যের তপ্ত আলোয় জ্বলে উঠলে এপারে বসা পালকি বেহারা আর কয়েকজন যাত্রী- যারা সম্প্রতি নবাত্মীয়- সেই দিকে চেয়ে থেকে হেমাঙ্গের উপর খুবই বিরক্ত।কেউ কেউ হয়তো ভেবেছে, ওটা হেমাঙ্গেরই কালা বউ।
দিনকাল ভালা না, হেমা হারামজাদা কখন আইবো- এ কারণে সকলেই দীর্ঘ হাঁটার পর অন্তরে অস্থির।তাহাদের মনে শঙ্কাও কম নয় বরং অত্যন্ত প্রবল। বেশিক্ষণ বটতলে বসে থাকা এ সময় বোকামি, যখন পালকিতে আছে আতুরি- আতরবানু। হেমা মাঝি এই ‘খেইনের সময়’ কি পূজা করতে গ্যাছে- একথা ভাবে কেউ কেউ। মূলতঃ পথশ্রমে ক্লান্ত ক’জন যাত্রী নিজেদের নিরাপদ বোধ করছে না। যে কোনও সময় একটা অঘটন ঘটবে বা ঘটে যেতে কতক্ষণ- এই চিন্তায় তাদের কোটরাগত চোখ কোনও গন্তব্য খুঁজে পায় না।
তাছাড়া গ্রামের পর গ্রাম এখন বিরান।বিশেষ করে যুবকেরা শেখ সাব-এর ভাষণ শোনার পর, গোপনে, নিয়মিত ‘আকাশবাণী’ শুনেছিলো।তারপর দলে দলে এরা গ্রামছাড়া।তাহাদের মুখ ও মূখরতার অভাবে গ্রামগুলো এখন ভৌতিক ভয়ের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
দুই গালের পাশে দুই হাতের তালু ‘কোশ’ করে চোঙ্গা বানিয়ে রণজিৎ বেহারা হাঁক ছাড়ে,যদিও অন্তর দুরুদুরু,বুক তৃষ্ণার্ত- ‘ও ও ও হে মা রে..।’
তার ডাক অন্য সময় হলে নির্লিপ্ত খেয়ামাঝি হেমার কান ‘বরা’ করে দিত।কিন্তু এখন রণজিৎ-এর নিজেরই মনে হলো তার ভেতর থেকে কোনও শব্দই বের হয় নাই।বরং কানের ভেতর টুংক্কর টুংক্কর করে কী এক পোকা যেন বেজে ওঠে,যার সাথে তুলনীয় বাজনা তাহার ক্ষুদ্র জীবনের লৌকিক ইতিহাসে কখনও শোনা হয় নাই।একারণে,নিজেকে আর রণজিৎ বাছাইড়া বলে মনেই হয় না এখন, অচেনা লাগে সবকিছু।
অন্যরা শুনেছিলো, ডাকাতিয়া নদীটির ওপারে ধাক্কা খেয়ে রণজিৎ বেহারার ‘হেমা’ ডাক কেঁপে কেঁপে প্রতিধ্বণিত হয়ে তাহাদের কর্ণকুহরে ‘ও ও ও হে মা রে-’ করে পুনরায় বেজে উঠছে।
নববধূটির স্বামী, রফিক মিয়া, লাল কটমইট্টা রঙের মোজা পায়ে- খুবই অদ্ভূত, তথাপি মুখের লাজুক ভাবটি অক্ষুণ্ন রেখে, আতর মাখা রুমালটি নাক থেকে নামিয়ে এখন বাম হাতের মুঠোতে পুরে, একটু আড়ালে নেমে, তিল ক্ষেতের ফুলে মৌমাছি- মুরব্বিরা সঙ্গে আছে, তাই ডান হাতের আঙ্গুলে চেপে একটা সতর্ক বিড়ি ধরায়।অনুসরণপ্রিয় তার বাল্যকালের ইয়ারের দোস্ত মুজাম্মেল ওরফে মুজা পাগলাও তিলক্ষেতের আড়াল থেকে মুতে এসে, বিড়িতে ভাগ বসায়। নতুন জামাইয়ের দিল উদার,সে মুজার হাতে বিড়ির প্যাকেটটি তুলে দেয়।
মুজা তার স্বভাবসুলভ নির্মল হাসিটি নিরবে ছড়িয়ে দিয়ে বলে ‘নে,খা,আত্মা ভইরা বিরি খা, হেমা আইজ আর আইব না! তুই বউ নিয়া এইহানেই শুইয়া পড়। কার বালে কইছে তোরে যুদ্ধের গণ্ডগোলের মইধ্যে বিয়াডা করতে? অহন ঠ্যালা বুঝ!’
এতে, রফিকের লাজুক মুখখানিতে অদ্যকার, বিবাহের দিনটির ইতিবৃত্ত ফুটে উঠছে।সে এখনও বউটিকে দেখে নাই।রাইতে একবার দেখার আগ্রহ জেগেছে। বিড়ি টানার আবশ্যকতাহেতু মুজা পাগলাকে সেকথা বলতে পারে নাই।কোত্থেকে যোগাড় করে সে একটা ‘বাইচা’রঙা পিরান পরেছে,মুজাকে ত দেখতে ভালাই লাগতেছে- একথা ভাবে রফিক মিয়া। সে বলে, ‘রাখ,এ্যাত ক্ষেপিছ না, হেমা আইবো রে, আইবো না কা?সে ত ইণ্ডিয়া যায় নাই।’
রফিক মিয়া অন্যের বাড়িতে রাখালের কাজ করে।চরমেশা অথবা সাহেব বাজারের অবারিত চর, ধানক্ষেতের আইলে আইলে গরু চরানো ব্যতীত চাষবাসের কাজে খাঁ বাড়ির অবস্থাপন্ন রাজ্জাক খানের সংসারে তাঁর স্ত্রীর রসুইঘরে ফাই ফরমায়েশ খেটে বালক বেলাটি অতিক্রম করে এসে,সে এখন ঝড় -তুফানের মধ্যে সহসা বিবাহযোগ্য হয়ে উঠেছিলো। পিতৃহীন সংসারে রফিকের দিনকানা মা এক গাদা পুত্র নিয়ে হিমসিম অবস্থা,তাঁহার কোনও ‘কইন্যা’ নাই- এই দুঃখে প্রায়ই ট্যারা-কানা চোখে কাঁদেন।রফিক মিয়ার অন্য ভাইরাও,পরের সংসারে কামকাজ করে।বাপ নাই, বড়ো ভাই পিতার সমতুল্য-শুক্কুর মিয়া,রফিকদের নিজ গাঁও দশানির বিখ্যাত গাছি। সে তাল, নারিকেল, সুপারি, কাঁটাওয়ালা খেজুর গাছের লম্বা-উঁচু শিখরে চড়ে অনায়াসে পুরনো পাতা কেটে পরিস্কার করে। কৃষিকাজের ফাঁকে এটাই তার শখের পেশা। শুক্কুর যখন লুঙ্গিটি গোঁচ দিয়ে কালো কুঁচকুঁচে থুতনিতে ক’গাছি ছাগল-দাঁড়ি, মুখে চুনের দাগ, ঠোঁট দিয়ে চেপে, ধারালো দা নিয়ে তরতরিয়ে তালগাছের চূড়ায় প্রায় হেঁটে উঠে যায়, সে এক দেখবার মতো দৃশ্য। লোকেরা বলে,শুক্কুর নাকি পা উল্টা করেও,অর্থাৎ পা উপরের দিকে দিয়ে গিরগিটি কিংবা কাঠঠোকরার মতোই গাছ বেয়ে উঠতে পারে। শুক্কুরের ভেলকিবাজীর এই কিংবদন্তী অনেকেই নিজ দেখে নাই।শুনেছে।তবে আশা করেছে কোনও একদিন সেই অসম্ভব বৃক্ষারোহণ দেখে একটুখানি বিস্ময়ে বলবে, ‘বড়োই আচানক!কী তাজ্জুক কারবার!’ ক্লান্তি, ক্ষুধা ও খেয়াঘাটে এতক্ষণ অপেক্ষার অজানা আশঙ্কায় বিপর্যস্ত শুক্কুর বলল, ‘ও রণজিৎ,হেমা কি মরছে রে?’
‘কী জানি শুক্কুর ভাই,আমার ত ভালা লাগতেছে না। অহন পালকি নিয়া করি কি কন ত?’ এটুকু বলে চারিদিকে একটু চেয়ে নিয়ে,গামছায় মুখটা মুছে পুনরায় রণজিৎ বলে,‘দেখছেননি শুক্কুর ভাই,দুনিয়াডা কীরম ঝিম মাইরা আছে? নদীডার কচুরিগুলিও য্যান দম আটকাইয়া মইরা রইছে।’
এসময় গুমট, থমকে থাকা বাতাসেরও একটা দহন টের পাওয়া যায়, নাক চোখ পোড়ায়,তাতে পঁচা লাশের গন্ধে খেয়াঘাটের পাড়ে,বটতলাটি থেকে থেকে অসহনীয় হয়ে ওঠে।কিন্তু গন্ধের সূত্রটি চিহ্ণিত করা যায় নাই। কয়েকটি কাক ও শকুন কচুরির জটিল স্তূপের ওপর দিয়ে বার কয়েক চক্কর দিয়েছে, আবার উড়ে গিয়ে কোন গাছের ডালে বসেছে খেয়াল করে নাই কেহ।
যাত্রীগণ নিজেদের সাধ্যমতো নাকে কাপড় চেপে ভেবেছে,কোথায় কার সর্বনাশ হয়েছে কে জানে!
এতক্ষণ চুপচাপ থেকে নিজের ভেতর একটা ভয়-ডর অনুভবে একটু নড়ে বসলো রণজিৎ-এর সঙ্গী অহিদুল বাছাড়। অহিদুলই পালকির মালিক।বাপ-দাদার স্কন্ধের ভার- চারকোণা ‘পালকি’ এখন তার নিজের কাঁধে। জোড় পালকি আছে,কিন্তু মানুষ আছে আতঙ্কের মইধ্যে। ডাক পড়ে না।জোড় পালকির দিন শেষ।যারা বিয়া করতে যায়,সেই জামাই বাড়ির লোকেরা এখন এক পালকি ভাড়া কইরা কইন্যা তুইল্যা আনে।আকালের উপর আকাল।জীবনই বাঁচে না, তার আবার বিয়া-ই কি পালকি-ই কি!এইভাবে কয়দিন যাইবো কে জানে।দ্যাশ কি স্বাধীন অইবো?-এইসব চিন্তায় অহিদুল বাছাড় দিন দুপুরে চোখে ‘জুনি’ দেখে। তারপর চোখ বন্ধ করেই বলে,‘কিয়ের পঁচা গন্ধ রে?বোটকা গন্ধে ত ‘মনুরা’ উল্টাইয়া নাড়িভূড়ি প্যাঁচ লাইগা যাইতেছে আমার!ও-য়া-ক থুঃ!’
ও-য়া-ক কইরা একদলা থুতু ফেলে অহিদুল। গলা খাঁকারি দেয়ার পর, জিহ্বাটা কেমন তিতকুটি তিতকুটি লাগে তার।মনে হয় পিত্তগলা পানি বার হয়ে মুখ বিকৃত, পেট মোচড়ায়।
শুক্কুর বসেছিলো প্রাচীন বটগাছটির নেমে আসা ঝুরির ফাঁকে। সেখানে কিছু ঝরা হলদে পাতা শুয়ে আছে। তাদের শরীরে পাখিদের চুনা হাগার শুকনো দাগ।শুক্কুরেরও দিনকাল ভাল না।গাছির কামে ভয়াবহ ভাটা। মানুষেরই জান বাঁচে না,তা-ও আবার গাছের ছাল-বাকলের ‘ক্ষৌর’ কর্ম!সে তার ছাগইল্যা দাড়িতে আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে বলল, ‘অহন উপায় কি, হেমা ত আইতেছে না। পালকি নিয়া কি সাঁতার কাডমু?’
অন্যান্য যারা পালকির সঙ্গে যাত্রী, তারা হেমাঙ্গ মাঝির আক্কেল দেইখ্যা বিরক্ত।ফলে তারা নিজ নিজ আক্কেল অনুসন্ধানে এখন গুড়ুম।এমনিতে সকলে আতঙ্কের মধ্যে আছে- কখন জানি কি হয় কি হয়!
পালকিতে ঢুলুঢুলু আতুরি সকলের কথাই শুনেছে।কখনও বা চকিতে, চুরি করে,কেউ দেখে নাই- ঘোমটা তুলে বাইরের পৃথিবীটাও দেখে নিয়েছিলো।সবই কেমন জানি অচেনা অচেনা লেগেছে- এইরকম পৃথিবী সে আগে দেখে নাই।
তার বড়চাচা খুবই রাগী লোক।দশ গেরামের মানুষ জানে তাঁর বদমেজাজের কথা,তবে মনটা বড়োই নরম।বিবাহে ‘কবুল’ কইতে দেরি করায় চোখ লাল জবাফুলের লাহান কইরা ধমকাইছেন, ‘তোরা দ্যাশের অবস্তা জানছ না!ঘোমটার তলে বইয়া কি ঘুমাইতাছোস নাকি, হ্যাঁ? শয়তানি কায়কারবার যতো!তরাতরি কর..অনেক দূরের পথ..এক্ষুণি পালকি ছাড়তে অইবো।’
আতুরির কোনও দোষ ছিলো না। তার বয়স্ক ভাবি-ভাউজরা মশকরা কইরা শিখাইয়া দিছিলো, ‘ওই ছেমড়ি, বকশিস না দিলে কিন্তুক কবুল কইবি না, বুঝলি?’ সে কিছু বলে নাই। সোঁতা-মেথি-হলুদ বাটার রঙ-মাখা হাতের নখ খুটতে খুটতে চিন্তা করেছিলো- তরাতরি কবুল কওয়া একটা লাজ।
চাচার ধমক খেয়ে কবুল বলার পর, মুরব্বিরা বউ-জামাই দু’জনকে সোন্দর লাল-নীল-কউচ্চা রঙের খোপ খোপ খাঁজকাটা চিনির গেলাসে শরবত দিছিলো।
পালকি ছাড়ার আগে, পায়ে ধরে কদমবুসি করার সময় বড়চাচা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন,‘ভালা থাইক্য গো মা, বংশের ইজ্জত রাইখ্য।’ তারপর মোনাজাতের মতো হাত জোড় করে স্বগতঃ বললেন, ‘ও মা’বুদ তুমি হেফাজত কইরো।’
আতুরি শুনেছে, জামাই মিয়া কালা, মুখে বসন্তের ‘খাইট’- পুরনো শিলপাটার মতো খোপ খোপ!সে ঘোমটায় নত।ফলে ভেবেছে,না জানি কেমন ভূত!
পালকির ঝাঁকুনিতে তার বমি-বমি, মাথাও ঘুরঘুর ঢুলঢুল- বিবাহের ধকল।এখন পুতলিকে কাছে পেয়ে মনে মনে ভেবেছে,আহারে বইনডারে অহন কে দেখবো? মায়ের কথা স্মরণে এসে আতুরিকে আরও একটু ব্যথিত করে।শাড়ির পাড়ের জরিতে ক’ফোঁটা অশ্রু মোছার লৌকিক ছলনায় তার চোখের কাজল লেপ্টে গিয়েছে, যেন সে এক ‘ওলাবিলি’ – তবে পালকির ভেতর কেউ উঁকি মারে নাই।
হেমা মাঝি কেন আসছে না, কি হইছে- এইসব বৃত্তান্ত পালকিতে বসে শুনতেছে আতুরি। তয় পালকির দুয়ারে হাত রেখে আতুরি ভাবে, তার জামাইটা বেশরম, ক্ষেতের আইলে বইসা বিড়ি টানতেছে- লাল মোজায় চেনা যায়, শরবত খাওয়ানোর সময় একঝলক লালমোজা সে দেখেছিলো- মুখ দেখা যায় না। আতুরির নিজের পেটেও একটু চিনচিন ‘বেতা’ অনুভব হওয়ার মধ্যে সে চিন্তা করে কূল-কিনারা পায় নাই,পালকিতে চইড়া বউ-ঝি’রা হাগামুতার কি উপায় করে।অবশ্য নিজের বে-শরম চিন্তায় নিজেই সামান্য লজ্জিত না হয়ে পারে না।
তারপর, ঘুমে নেতিয়ে পড়া ছোটো বোন পুতলি’র চুলের কিলিপটি ঠিক করে দিতে দিতে আতরবানুর ইচ্ছে করেছে,পালকি থেইক্যা এট্টু বার অইতে পারলে দম ডা ফেলা যাইতো। মা গো মা!কি গরম পড়ছে!
বিবাহের নাকফুলটি- একরত্তি ‘সন্ন’ – আতুরিকে এখন ভোগান্তিতে ফেলেছে। নাক চুলকাচ্ছে তার। খুব ছোটকালে, সুঁই দিয়ে ফুটা করার পর তার দাদি সুতা-চুন লাগিয়েছিলো। ছিদ্র যেন বুঁজে না যায়, এইজন্য আতুরির মা নারিকেলের শলা পরিয়ে রেখেছিলেন। সন্নের নাকফুল সে আগে পরে নাই।
ব্যথা করছে, তাই আঙ্গুল দিয়ে সন্ননির্মিত সূক্ষ্ণ শলা-চুঙ্গি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাকফুলের ভার সহনীয় করার অমোঘ প্রচেষ্টায় মনোযোগী।ঠিক তখনই কার যেন বাঁন্ধা গাইটি ‘হা ম্বা’- ডেকে উঠে চরাচরের নিস্তব্ধতা সহসা খানখান করে দেয়।এই আকস্মিকতায় আতুরি, নাসারন্ধ্রে নিজেরই নখের গুতো খেয়ে ‘উঃ!’ করে ওঠে।তখন অন্যান্য সকলেই সচকিত হয়ে উঠে দেখে- ঘাস খাওয়া ছেড়ে একটা কালো রুগ্ন গাই উদাস নয়নে কি যেন ভাবছে। সকলেই জেনেছিলো- পশুপাখিরা সব কিছু আগেভাগে টের পায়। উদাসী গাইয়ের ‘হাম্বা’ ধ্বনির ভেতর খেয়া নৌকার জন্য অপেক্ষমান অধীর, পালকি অনুগামী যাত্রীরা আসন্ন বিপদের সংকেত মনে মনে টের পেয়ে নিজ নিজ বিধাতাকে স্মরণ করেছিলো। নিরাকার বিধাতার স্বরূপ কল্পনায়,কখনও বা শিউরে উঠেছিলো।শরীরের রোমকূপ ফুলে উঠেছিলো।
অনেক দূরে, চরমেশার চরের বাঁকে একটা গুনটানা বজরা দেখতে পেয়ে শুক্কুর গাছি বলে,‘ও অহিদ ভাই,অহন কি করা বলেন ত,হেমা ত আইতাছে না।’
‘কি করমু আমরা কন শুক্কুর ভাই! গাঙখান ত কম বড় না যে সাঁতরাইয়া পার হমু। লগে আছে বউ- ‘নববধূ!’- কথাটি এমনভাবে বলে অহিদুল বাছাড় যেন তার অর্থ হয়- এই জন্মে বাছাড়িগিরিটাই ছাইড়া দিমু।
আভাস পাওয়া বজরাটিও বহুদূরে। যারা প্রায় ন্যাংটা হইয়া, জীবনের সমস্ত ধ্যান একত্রিত করে গুণ টানতেছে, তাদের অবয়ব শুক্কুরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গোচর, কিন্তু এইমাত্র বজরাটি নদীর অন্য গতিপথে মোড় নিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে গলুই ঘুরিয়ে দিল।ফলে শুক্কুরের হতাশা এক্ষণে বিরক্তিতে পরিণত।‘ধূরও- গণ্ডগোলের মইধ্যে বালের বিয়া শাদি’- মনে মনে বিড় বিড় করে সে।
কয়েকটি বড়ো খয়েরি-কালো মাছি ভোঁ কইরা শুক্কুরের কানে বাজনা তুইলা বটের ঝুরি-জটে মিলিয়ে গেলে,সে ভাবে, মিলিটারিরা যারে পাইতেছে তারেই মাইরা ফালাইতেছে, লগে আছে মরার পালকি, নয়াবউ।
এতক্ষণেও হেমা মাঝির টিকিটির আভাস না পেয়ে বৈবাহিক স্বপ্নচারিতা বিঘ্নিত-ক্ষুণ্ন হওয়ায়, রফিক জামাই, বিড়ির গোড়ায় শেষতম সুকটান মেরে ভেবেছে, মুজা পাগলার কথাই সইত্য অইবো। তিলক্ষেতেই রাইত কাটবো আইজ । বাড়িতে তার মা-জননী কাঁসার কলসী ভইরা গাইয়ের দুধ নিয়া হয়তো বইসা আছেন, পালকি থেকে নামিয়ে নয়া বউয়ের পা ধোয়ানোর জন্য- একথা মনে করে রফিক অস্থির।
প্রায় দুধের শিশু, সেদিনও চিঁকুতকুত খেলেছে- সেই আতুরিকে বিদায় দিয়ে ঘুঘুপাখির মতো যে বিলাপটি শুরু করেছিলেন অযুফা বিবি, তা এখন কিছুটা থিতিয়ে এসেছে।সময় ভালো না, তথাপি বিবাহের তো একটা ঝক্কি থাকেই।তাতে তার শরীরটাও কেমন ভেঙ্গে আসছে।‘আল্লা রে,তুমি রহম করো’- এই স্বগতঃ বাক্যের ভেতর পাশের বাড়ির আক্কাসের বউটার কথা মনে পড়ায় ব্যথাতুর হয়ে ওঠেন তিনি।আলী আক্কাসরে সেদিন আয়াতুল্লার দল মেলেটারি দিয়া মাইরা ফালাইছে। আহহা রে কাঁচা হলুদের মতো নয়া বউটার নাকফুল খুলে নেয়ার কালে ফেরেশতারাও কেঁদেছিলো- বিধবার নাকফুল পরা নিষেধ।যুদ্ধ শুরুর কয়দিন আগেই,যেদিন শেখ সাব ঢাকায় ‘বাসন’ দিছেন, সেদিনই আক্কাসের বউটা পালকিতে কইরা এসেছিলো।সেকথা মনে কইরা আতুরির জন্য অজানা আশঙ্কায় মায়ের বুকটা ভেঙে যায়, পশুপাখির আগে মা টের পায় বিপদ- আতুরির পালকি কি নদী পার অইছে?খবর নেয়ারও কোনও উপায় নাই। মাইয়ারে বিদায় দিয়া কাঁচি হাতে আতুরির বাপ গেছে জমিতে।মুগ ডাইলগুলো তুলে আনতে। কখন আবার আকাশ ভাইঙ্গা মেঘ নামে।
হেমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে রফিকও এখন, তার লাল মোজা কিছুক্ষণের খুলে সকলের সঙ্গে সমতা নির্মাণ করার প্রয়োজন অনুভব করে, বটগাছের তলে মাটিতেই বসে পড়ে। খেয়া নৌকায় চড়ার আগে পুনরায় মোজা জোড়া পরে নেবে- একথা ভাবতে ভুলে নাই রফিক।
পালকিতে নয়া বউয়ের মা, রফিকের শ্বাশুড়ি, মাটির ‘খোবায়’ কি কি পিঠা দিয়েছেন। রফিকের বন্ধু মোজাম্মেল সেই নকশাকরা খোবা হাত বাড়িয়ে পালকির ভেতর থেকে নিয়ে এসে বলে, ‘নেন ত খান।অবস্থা বেগতিক। হেমা আইজ আর আসবো না।’
প্রবল আগ্রহে মোজাম্মেল পিঠা খায়,অন্যরা কিছুটা অন্যমনস্কতায়,কিন্তু পেটের টানে দু’একটা পিঠা হাত বাড়িয়ে তুলে নেয়।পুতলিকে দিয়ে নতুন বউটাকেও দু’টি পিঠা দেয় মুজা পাগলা। তবে বউ ঘোমটার ভেতর থেকে না-সূচক মাথা দুলিয়েছে।নতুন বউয়ের এভাবে কিছু খেতে ‘শরম’ থাকাই নিয়ম।
অভিসম্পাতকারীদের সঙ্গে অন্তরের গূঢ় যাদুমায়া স্থাপিত হওয়ার প্রেক্ষিতে, অবশেষে, হেমাঙ্গ মাঝি, যেন তার পা চলে না- এমনভাবে,খুঁড়িয়ে,নদীর ওপারের বাঁশঝাড়টির আড়াল থেকে উঁকি দেয়।তবে সেখানে জীবন ছিলো না।
এতক্ষণ আসমানের নিঃসঙ্গ সূর্যটি ঘড়া ঘড়া তাপ বিকিরণ করে এখন ক্লান্তিবসতঃ থমথমে। বটতলার পালকি ও পালকিটি ঘিরে অসহায় ক’জন যাত্রী তাদের পুলসিরাতের পারানি- হেমাকে, নদীটির ওপারে, বৈঠাটি তুলতে দেখে,‘শুকুর আলহামদুল্লিাহ’ বলার পর, কর্তব্যবোধে ভারী হয়ে ওঠা শুক্কুর তার ভাইকে ডাক দেয় ‘ও রপিক, তরাতরি আয় , হেমা আইসা পড়ছে। ও রণজিৎ ও অহিদুল্লাহ,পালকি তোল তোরা।’
কচুরির বরজ ঠেলে ঠেলে,যেন সমস্ত জগতের সঙ্গে এক যুদ্ধ- হেমা এপারে এসে তার বহুযুগের খেয়ানৌকাটি ঠেক দেয়ার পর রফিকের বন্ধু মুজা পাগলা বলে, ‘কি ও হেমা কাগা,আপনেরে কি মেলিটারি ধরছিলো না আয়াতুল্লা রাজাকারে জল্লাদখানায় লইয়া গেছিলো?’
একথায় যদিও রূঢ় বাস্তবতা প্রকাশিত হয়েছিলো, তবু মনুষ্যস্বভাবে কেউ কেউ তাদের অমার্জিত ঠোঁট ব্যাদান করে একটুখানি না হেসে পারেনি। বিবাহের ঠাট্টা-তামাশা এতক্ষণে, নদীর তীরে, হেমা মাঝির কাঙ্খিত আগমন প্রহরে সার্থক হয়ে উঠলো।কিন্তু বটগাছটির পাতার আড়ালে আশ্রয় নেয়া পক্ষীকুল মানুষের হাসির কারণ বুঝে নাই। ফলে তারা হাস্যরসের কারণ অনুসন্ধানে একটু উড়াল মেরে পুনরায় বৃক্ষে ফিরে এসেছিলো।
আতুরি ততক্ষণে পুতলিকে জাগিয়ে দিয়ে, তার ‘সন্নে’র নাকফুলটিতে আরেকবার আঙ্গুলের গুতো দিয়ে, চকিতে একটু না ভেবে পারেনি, ‘ওই বাড়িতে’ গিয়ে কতখানি লম্বা করে ঘোমটাটি টেনে দিয়ে লজ্জায় ধূলায় মিশে যাওয়া লক্ষী বউ হয়ে বসতে হবে।একথা তার সখি-চাচি-ভাবি সকলেই নিজ নিজ গুরুত্ব প্রকাশের প্রয়োজনে বলে দিয়েছিলো।তাছাড়া সে দেখেছে, অন্ধকার ঘরে নতুন বউ বসে থাকার রীতি।
পালকিটি নৌকায় তোলার পর, এতক্ষণে, সকলের ভেতর এক ধরণের স্থিরতা প্রকাশিত হয়। সেখানে চঞ্চলতা এসে বিষন্নতার ছায়া দূর করে। সকলে মনোযোগ দিয়ে হেমাঙ্গ মাঝিকেই দেখে।
হেমার চোখের দৃষ্টি এমন ছিলো না। হলদে হয়ে আসা চোখ দু’টি ভূতুমের মতো স্থির, কর্কশতায় রুক্ষ্ণ, খিটখিটে শুষ্ক। নদীর ভেজা স্বভাবের সঙ্গে যাত্রীগণ হেমাঙ্গ মাঝির বর্তমান বিশুষ্ক চৈত্রদগ্ধ রূপ কল্পনা করে নাই।তার নেংটি ধূতির গিরো ঢিলা।পেটে ভাত পড়েছে কি পড়ে নাই- ঠাওর করা কষ্টকর।বিবাহের যাত্রীগণ হেমা মাঝিকে দেখে ক্ষণিকের চঞ্চলতা ভুলে এখন, খুবই মুষড়ে পড়ে। মুখে কথাও খুঁজে পায় না, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে নিরব। নদী পার হওয়াই একমাত্র বিবেচ্য।
বাঁশের লগি ও শ্যাওলা ধরা পিচ্ছিল বৈঠায় জমাটবাঁধা কচুরির দ্বীপ ঠেলে ঠেলে হেমার খেয়ানৌকাটি ত্রস্ত গতিতে চলতে শুরু করলে পালকিসহ তার দুলুনিতে স্থিতিশীলতা আসার অপেক্ষায় কারো মুখেই তেমন কোনও কথা সরে নাই।সকলেরই মৌলিক উদ্দেশ্য এখন যথাসম্ভব দ্রুত নদীটির এই ‘পুলসিরাত’ পার হয়ে ওয়াপদার রাস্তার ওপাশে, চরবাগাদির কোণাকুণি আইল ধরে এগিয়ে যাওয়া।পথ তো এখনও কম বাকি নাই। সঙ্গে আছে পালকির চেয়েও এক ভয়াবহ কঠিন বোঝা- পুতলি।সে না পারছে হাঁটতে, না পারছে পালকিতে চড়তে, এমনকি কেউ যে তাকে কোলে নেবে- সেই পরিস্থিতিও এখন দূরাশা।পুতলি তার কোলে ওঠার বয়সটা পার করে এসেছে আগেই। শরীর ভারী। সুতরাং এই ‘আজদাহা পুতুল’ কারোরই বিশেষ আগ্রহের বস্তু নয়। সকলে বরং বিরক্ত, অনুতপ্ত তাকে সঙ্গে আনার জন্য।আনাড়ি কাঁনলে বাড়িতেই কাঁনতো- এখন তারে নিয়া আরেক ঝামেলা।
বাক্যহীন গুমট ভাব-এ গলা ধরে আসে রণজিৎ বাছাড়ির। দীর্ঘ সময় কথাহীন থাকা তার স্বভাবজাত নয়।নিজের উপস্থিতি প্রমাণের আকুলতায় উঁচু ক’খানা ময়লা দাঁত বার করে গালের চাপার উত্থান-পতনে বলে,‘ও হেমা, তোরে আবার কোন ব্যাধের ব্যারামে পাইছিলো রে!তোর তুলসী দাসী কালার মা’য় বুঝি দিনদুপইরা খিড়কি আটকাইয়া তোরে কেঁচকি দিয়া ধরছিলো? হা হা হা।এ্যাতো দেরি করলি ক্যান?’
অন্যরা চুপ, মুজা পাগলা আচমকা তার স্বভাবসুলভ খসখসে খিকখিক হাসিটি না হেসে পারে না। সে রণজিৎ-এর কথাটি প্রলম্বিত করার অনুপ্রেরণা বোধ করে- ‘না ও রণজিৎ, হেমা কাকারে জোঁকে ধরছিলো মনে অয়,চিনা জোঁকে!’
এই কথায় সকলেই মুখ চেপে হাসি গোপন করার চেষ্টায় সচেষ্ট। তবে, শুক্কুর গাছি ধমকে ওঠে,‘থামবি তোরা হ্যাঁয়? আজাইরা কতা বাদ দে ত।আল্লা আল্লা কর।’
শুক্কুরের ধমকে মুজাম্মেল একটুখানি থতমত। সে ভেবেছিলো ঠাট্টা-তামাশা বিবাহের আবশ্যিক একটা কর্তব্য। তাছাড়া হেমাঙ্গ মাঝিকে তার দীর্ঘ সময় পর, অহেতুক দিশাহারা- এই আগমনের একটা সমুচিত জবাবও তো দেয়া দরকার।‘শুক্কুর ভাই এট্টু বেশি বেশি।’
হেমা গোঁয়ারের মতো ঘাড় ত্যাড়া করে নাওটিকে কচুরির জমাট আজাব থেকে বার করার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। তারপর অকস্মাৎ নিরবতা ভেঙ্গে বলে ওঠে, ‘আন্নেরা হুনছেননি, ইচলির আয়াতুল্লা নাকি রাজাকার অইছে? ঘাসিপুরের হরিরে তো গুল্লি করছে পাইক্যারা, কল্লাডাও কাইট্টা ফালাইছে। কি দোষটা করছিলো হরি, কন ত?মাইনষে কয় আয়াতুল্লা নাকি হরিধনের বাড়িডা দেখাইয়া দিছে।ও ভাই ও,পরানডা হাতে নিয়া নাওডা বাই।অহন হাত-পাও-রথ আর চলে না, ভাইঙ্গা আসে। হায় হায় আমার জীবনডা রে!যুদ্ধ কতদিন চলবো?’
অকস্মাৎ হরিধনের মৃত্যুর খবর শুনে যাত্রীগণ হেমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় নাই। তার কণ্ঠের কম্পনে অজানা গন্তব্যের আঁন্ধারটি অনুভব করে।তারা ভাবে, দ্যাশটা কি স্বাধীন অইবো? তারা কেউ কেউ শুনেছে,শেখ সাব আর জীবিত নাই।
পাইক্যা অর্থাৎ পাকিস্তানি মিলিটারি যে এইদিকে ঢুকে পড়েছে- এতোটা জানা ছিলো না নয়া জামাই রফিক মিয়া বা তার সঙ্গে থাকা যাত্রীদের কারোরই্। তাহারা বিবাহের জায়-জোগাড় করতে ব্যস্ত ছিলো।তবে সকল কর্তব্যের প্রয়োজনীয়তার অবসরে তারা যে চিন্তান্বিত ছিলো না এমন নয়,কখন পাকিস্তানিরা হানা দেবে তার সঠিক সময়টা অনুমান করে নাই। অনুমান করার জো নাই- এরা কখন কার বাড়ি আগুন দেয়,কখন কারে গুল্লি কইরা জান বার কইরা দেয়- তার ত কোনও ঠিক-ঠিকানা নাই।এমন গজব তো আগে কেউই দেখে নাই।
হরিধন ঘাসিপুরের অবস্থাপন্ন কৃষক। প্রচুর চাষের জমিজমা তাঁর। সেসব ছাইড়া দিয়া হরি যেন ইণ্ডিয়া চইলা যায়-এ রকম কান কথা যুদ্ধের বহু আগে থেকেই প্রচলিত। তবে ছোটোখাটো গোলগাল গোবেচারা হরিধন ভেবেছিলো জন্মভূমিতে প্রাণ গেলে সেও স্বর্গ প্রাপ্তির সমতুল্য। শোনা গিয়েছিলো খালেক মেম্বরের ভাই ছত্তর মিজি, মদ-খাওয়া লালচক্ষু তবিউল্লাহ- এই দলটিই হরিকে বহুবার হুমকি দিয়েছে,আর হরিধনের বাড়িটিও ঘাসিপুরের শেষপ্রান্তে- একলা, নিঃসঙ্গ। স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনীতি খুনিদের পক্ষে।লক্ষ্য- হরির ধানী জমি।বিশাল সব ধান ক্ষেত একমাত্র হরিধনের ছাড়া আর কারো নাই। খুনিরা যুদ্ধের এই ‘ক্ষণ’ টাকেই ব্যবহার করেছে চতুরতা আর দক্ষতার সঙ্গে। হরিধনকে কারা মেরেছে- এ নিয়ে একটা ধোঁয়াশা রটাতে দক্ষ লোকের অভাব হয় না।রাজাকার-পাকিস্তানি নাকি ছত্তর-তবি গং তাকে খুন করেছে- এ নিয়ে ‘কুত্তা-বিলাই’ পক্ষপাতিত্ব রচিত হয়।
হেমার মুখ থেকে হরিধনকে কিভাবে গুলি করার পর, গলা কেটে মেরে ফেলা হয়েছে, রক্তের ঢল নেমেছে ঘরের মেঝেতে- সেই বর্ণনা নিজেদের ভেতর আত্মস্থ করা মানুষের পক্ষে অসম্ভভ। এক্ষণে যাত্রীগণের ভেতর জীবনের লক্ষণসমূহ বিভ্রান্তিতে বিচলিত।তারা হরির সম্পর্কে জানে,নিরুপদ্রব ভালো লোক ছিলো হরিধন।আহা রে!মানুষ কি কইরা মানুষের গলা কাটে- একথা কল্পনা করে কেউ কেউ অন্তরে ডুকরে উঠেছিলো।
মনের ভেঙ্গে-পড়া শক্তিতে হেমাঙ্গের লগি যেন নদীটির তল খুঁজে পায় না। কচুরির অচলায়াতন নড়তেও চায় না।তাই হেমা মাঝি তার উদাম লিকলিকে ঠ্যাং দিয়ে,হাঁটু দু’টি ভেঙ্গে ক্রমাগত নৌকার পাটাতনে দুলুনি দেয়।এতে কিছুটা অগ্রগতি হয়।তবে পালকির ভেতর আতুরি নামের বধূটি আতঙ্কে প্রায় অজ্ঞান। হেমার মুখে হরিধনের গলাকাটা লাশের বর্ণনা সে শুনেছে। ‘রাজাকার’ কি- বুঝে নাই। সে তার বোন পুতলিকে ডেকে বলে,‘ও পুতুল তুই আমার কাছে আয় ।’
দুই বোন পরস্পকে ধরে রেখে নৌকাটির দুলুনিতে জীবন-মরণের বিভ্রান্ত-ধোঁয়াশা অনুভূতিতে পালকির ভেতর চোখ বুঁজে আছে।
এতক্ষণে হেমা মাঝি কিছুটা সফলতা পায়। লগি-বৈঠার যুদ্ধে কচুরির দলাটা ভাঙ্গে। সেখানে,পাতালের অন্ধকার থেকে ভূরভূরিয়ে বুদ্বুদ উঠে আসলে একটা অসহ্য দুর্গন্ধে যাত্রীরা নাকে কাপড় দেয়।নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে ক্ষণকাল তাহারা চোখ বার করে বুঝার চেষ্টা করে- লাশটি কার?এসময় মাথার উপর যে নিরাকার নীল আসমান, সেখানে কয়েকখণ্ড মেঘ আর কয়েকটি শকুন সন্তুষ্টচিত্তে বার কয়েক ঘুরপাক খেয়েছিলো।
বুদ্বুদের ভেতর থেকে ভুস করে ভেসে ওঠা গলিত লাশটি হরিধনের নয়। কারণ তাকে তো আজকেই বিহানের আগে গলা কাটা হয়েছে,ফুলে ওঠা লাশটির কোমরে শাড়ির জরি ঝিকমিকিয়ে উঠেছে।
ডাকাতিয়া নদীতে এরকম ভেসে ওঠা লাশ আরও দেখেছে হেমাঙ্গ মাঝি।অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলেও জৈবিক প্রয়োজনে হেমাঙ্গ মাঝি মানুষ,গরু-ছাগল,বোচকা-বুচকি পারাপার নো করে পারে নাই। নদী ও নৌকাই তাঁর নিয়তি।
শুক্কুর বলল, ‘ও হেমা তরাতরি কর ত।এরা সবে ডরাইতাছে।’
সকলে নাকে সাধ্যমতো কাপড় চেপে স্থির করে কিসের গন্ধ এতক্ষণ তাদের অন্তরাত্মাটি টেনে হিঁচড়ে বার করে আনছিলো। শকুন ও কাকেরা মিছেমিছি ওড়াউড়ি করে নাই।
নৌকাটি যখন নদীটির মাঝখানটা অতিক্রম করেছে,পাতাল থেকে ভেসে ওঠা লাশটি কোন মায়ের সন্তান,অথবা কার বউ কার জননী- এই থমথমে ভাবনায় সকলেই নিজ নিজ অন্তরে সকরুণ হয়ে উঠেছে- মৃত্যুকে বড়োই ভয়, পুতলিও হৃদয়ঙ্গম করে কূল পায় নাই ‘আয়াতুল্লা রাজাকার’ মানে কি, সে তার ক্ষুদ্র কল্পনায় ভেবেছে ওটা একটা ‘কচ্ছপ’ জাতীয় কিছু!
তবে ওয়াপদার রাস্তার আড়ালের কারণে এতক্ষণ দেখা যায় নাই- সত্যই কচ্ছপের খোল মাথায় পরা অনেকগুলি লোক বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে- এখন দৃশ্যমান। এরাই সেই জীবন্ত আজরাইল যাদের ভয়ে জনপদের মানুষ নিজেদের চোদ্দ পুরুষের ঘর-বাড়ি-ভিটে-মাটি-লেন-দেন ফেলে রেখে এখন উদ্দশ্যহীন গন্তব্য খুঁজে দৌড়াচ্ছে দিনের পর দিন,মাসের পর মাস।সারা দেশ যেন এক বিস্তীর্ণ আঁন্ধাইরা কবর।
এমন সময় মেঘহীন চৈত মাসের খরখর আকাশে ঠাটা পড়ার ভয়ানক আওয়াজে জীবিত সকল প্রাণীর শ্রবণেন্দ্রীয় চৌচির হয়ে যায়।গুলি করতে করতে একদল মিলিটারি হনহনিয়ে এই দিকেই,নদীর দিকে আসতেছে। পেছনে, হেমার বাড়ির অদূরে, মুন্সি বাড়িটা হঠাৎ দাউ দাউ আগুনে ঝলসে উঠতে দেখে সকলেই হতবাক।
মুন্সি বাড়ির ছেরাজুল- ছেরা মুন্সির নিরীহ মুখখানি মনে পড়ে শক্কুরের।মানুষের ঘরে জলসার মিলাদ ও মোনাজাত পরিচালনা করে,হাতে কয়েকটি টাকা, পাঞ্জাবির পকেটে মিঠাই-বাতাসা নিয়ে জীবন কেটেছে, তারই বাড়িটি জ্বলছে।কিন্তু ছেরা মুন্সির কথা ভাবার সময় এখন কই?
বাছাড়ি অহিদ, রণজিৎ, শুক্কুর, মুজা হঠাৎ বেকুপ- তাহারা কি করবে- জীবিতকালে থেকে মরণের এই অভিজ্ঞতা কখনও ভাবেনি কেউ- এই মহূর্তে জীবনের অসীম বাসনা তো এই- বউটির পালকি কই রাখবে, কোথায় লুকাবে, পারলে মাটির সাত হাত নিচে লুকায়- এইরকম ভাবনার ভেতর হতচকিত, এরই মধ্যে কয়েকজন, ডাকতিয়া নাম নদীটির- বুকের উপর থমকে থাকা কচুরির তলে ঝাঁপ দেয়। তার আগেই দীর্ঘদেহী অচেনা লোকগুলোর হাতের মেশিন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বেরিয়ে আসে।কিছু বুঝে ওঠার আগেই লুটিয়ে পড়ে লগি নিয়ে সংগ্রামরত জীর্ণ মাঝি হেমাঙ্গ দাস। ঝাঁৎ করে আসা কয়েকটি গুলি হেমার মাথার খুলিটি উড়িয়ে নিয়ে গেলে হৃদপিণ্ড বার-হওয়া-ভয়ে একটু আগে যারা কচুরির তলে,শুধুমাত্র নাকের ছিদ্র দু’টি বার করে রেখে সমস্ত শরীরটি পাতালে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলো,তাদের মধ্যে মুজা পাগলাকে আর দেখা গেল না। সম্ভবতঃ সে গুলি খেয়ে তলিয়ে গেছে মুহূর্তে।অথবা নদীর তলদেশের ‘বাইছা’ শ্যাওলা তারে টান দিয়ে নিয়ে গেছে।
পালকির ভেতর বালিকা বউটি, ক্ষুদ্র জীবনে ঠাটা পড়ার শব্দ শুনেছে। কিন্তু এই শব্দ আসমানের ঠাটা পড়া শব্দ না।লা ই লা হা ইল্লালাহু- পুনঃপুনঃ উচ্চারণর্পূবক আতুরি পালকির ভেতর থেকে ঘোমটা তুলে মুখটি বার করেছে কি করে নাই- সে দেখলো মাঝিটি ছিটকে পড়েছে নৌকার গলুইয়ের উপর। ছোট বোনটিকে বুকে আগলে সে কোনও কিছু ভাবারও সময় পায় নাই। তখন, এরই মধ্যে পুরুষেরা নদীতে ঝাঁপ দেয়ার পূর্বক্ষণে, নাকফুলে হাত দিয়ে বোধগম্যহীন ফেনানো একটা গোঙানির শব্দ তুলেছিলো, আতুরি হয়তো ভেবেছিলো- একরত্তি সন্ন- মেয়েদের সধবার চিহ্ন।
নৌকাটি কাৎ হয়ে ঢুলে ওঠার পূর্বক্ষণে সবুজ-লাল ঘুড়ি-কাগজের নকশায় সাজানো চারপেয়ে নিরীহ পালকিটি ঝাঁঝরা হয়ে যায়।ভয় পেয়ে উড্ডীন, পলায়নরত কাকের দল থেকে, পক্ষীজীবনে তাহারা এই রকম শব্দের সঙ্গে কখনও পরিচিত ছিলো না- ঝুপ করে একটা কাক- নিঃসাড় ডানা- ঝ’রে পড়ে নৌকাটির পাটাতনে, থুবড়ে-পড়া পালকির ক্ষুদ্র দুয়ারের পাশেই।
তখন হেমাঙ্গের চিরসাথী, কিছুকাল আগেই কচি গাবের কষে যত্নের প্রলেপ দেয়া খেয়া নৌকাটির আত্মা জেগে ওঠে।সহসা কিংকর্তব্যবিমূঢ় নৌকাটি, দ্রুততম সময়ের ভেতর একটি পালকি,তার ভেতর এক স্বপ্নকিশোরী বধূ,লাল মোজা পরা জামাই রফিক মিয়া,পাগলা মুজা,গাছের জাদুকর শুক্কুর গাছি, দুই বাছাড় রণজিৎ-অহিদুল্লা,অবুঝ বালিকা পুতলি, মহূর্তকাল পূর্বে ভেসে ওঠা গলিত নারীর শাড়িতে জরির ঝিলিক আর কয়েকটি শকুনের আনাগোনা দেখে ভেবেছে- মানব জীবন বড়ই ঠুনকো,তবে তাহাদের বিস্ময়কর আবেগময় ভাষাটি মহাকালের এক যাদু-মায়া!নৌকাটি আরো ভেবেছে,তাহার জন্মের পর থেকে লোকস্রোতের সেইসব ভাষা-গল্প সহসা ঝাঁঝরা করে দিল কে?এরা আর কথা-সংলাপ করছে না কেন? কিন্তু নৌকাটির আত্মা এখন হতবিহ্বল।
এসময় কয়েক খণ্ড কালো-ধূসর মেঘ কোথা থেকে ভেসে এলে ক্ষণকালের জন্য আকাশের সূর্যটি হঠাৎ কানা হয়ে যায়।ফলে এপার-ওপার জনপদের মাঝখানে বহমান একটি নদী- ডাকাতিয়া- অন্ধ জগতে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে না পেয়ে স্রোতহীন এক মহাস্থবির- সেখানে কালের সকল চিহ্ন অবলুপ্ত।
গুলি থামার পর,কচুরির জমাট থেকে বেরিয়ে এসেছিলো রফিক। তার লাল মোজা তখনও পায়ে ঝুলে আছে,পানি ঢুকে ঢোল।টেনে টেনে নিজের অচেনা পা দু’টি নৌকায় তুলতে পেরেছিলো সে।নদী ও নৌকার মতোই, রফিক মিয়া অনন্তকালের কোনও শব্দ শোনে নাই।
অনেক অপেক্ষার পর রণজিৎ বাছাড়ও, মস্তকে কচুরির নুড়ি নিয়ে, ভৌতিক- বেরিয়ে আসে। নৌকায় হতবম্ব জামাইটিকে আবিস্কার করতে পেরে, রণজিৎ বাছাড়ের মনে পড়ে,কচুরির ভেতর থেকে নাক বার করে রেখে,জীবনের তীব্র আকাঙ্খায় শুধুমাত্র আকাশের ভগমানকে ভেবেছিলো সে। সে আশা করেছিলো অহিদুল ভাইছাব কচুরির তল থেকে এক্ষণি ভুস করে উঠে আসবেন।সেহেতু দৃষ্টিতে একধরনের অব্যক্ত তৃষ্ণা মন্দিরের ঘন্টার মতো বেজে ওঠে।
একসময়, সত্যই,গুলি থেমেছিলো।কতক্ষণ পর থামে, কর্ণকুহরে স্তব্ধতা ঝিম মেরে থাকার কারণে, স্মরণে আনতে পারে না রফিক মিয়া- কতো যুগ সে পানিতে নাক ভাসিয়ে বেঁচে ছিলো- জানে না। কচুরির ভেতর ডুব দিয়ে, নাকের ডগাটি ভাসিয়ে রাখার এই কৌশল, সব গাঁয়েরই,বিশেষতঃ মিলিটারি আইতাছে- মাছিবাহিত এই সংবাদের আনাগোনা এমনকী গন্ধ পেলেও, যুবকেরা কাউকে কিছু না বলে,শেখ সাব-এর ভাষণের পর থেকেই, সূক্ষ্মতার সঙ্গে করে এসেছে।
কিন্তু ‘বাইল্যা’ পাখির ধান খাওয়ার মতো ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির সমুখে এখন,সামান্য আগে, কচুরিপানার ভাসমান গুহা সকলকে রক্ষা করে নাই।
ততক্ষণে রফিক মিয়ার শরীরটি ঠাণ্ডা-হিম হয়ে কাঁপতে শুরিু করেছে।সে বস্তুত ইহজগতে নাই।
শুক্কুর গাছি আর মুজারও খবর নাই। নৌকার ওপর পড়ে আছে ছিন্নভিন্ন পালকি, হেমাঙ্গের মুণ্ডুহীন বীভৎস দেহ।পালকির ভেতর থেকে বেরিয়ে রয়েছে একটি লাল শাড়ি পরা নতুন বউ। বউটির পাশে তারই ছোটো বোনটি।মুহূর্তের কালবৈশাখে নিশ্চিহ্ণ জনপদ-চরাচর যেন নৌকাটির পাটাতনে এসে এক নতুন বিমূর্ত স্থাপত্য।
রফিকের মনে হয়েছে, এইমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনাটিই বাল্যকাল থেকে শুনে আসা, মাথার ঘিলুর ভেতর অঙ্কিত সেই ‘কেয়ামত।’ সুতরাং সে আর তার পরিচিত পৃথিবীতে নাই। সে কোনও দিনও খাঁ বাড়িতে রাখালের কাজ করে নাই। হেমা মাঝির নায়ে কখনও পার হয় নাই। বিবাহের সাধে পায়ে লাল মোজাও পরে নাই। অলৌকিক জগতের এক ঘোরতর আঁন্ধার সুড়ঙ্গে তলিয়ে থেকে শরীরের একমাত্র অঙ্গ- ‘নাক’- ব্যতীত আর কিছুই মনে নাই তার।
কচুরির তল থেকে, ভাসানো নাকের দু’পাশের দুই চক্ষু মাঝে মাঝে আসমানের রহস্য দেখার প্রয়োজনে একটুখানি মিটিমিটি খুলেছিলো রফিক, ভেবেছিলো, আজরাইল বুঝি এবার এসেই গেলো।সে যে অন্যদের মতোই পালকি ফেলে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে- নিজেকে একটা কাপুরুষ, হিজড়াসম তুলনা করারও সময় পায় নাই- এতো দ্রুত ঘটনা ঘটতে শুরু করলে জীবন বাঁচানোই চিন্তায় এসেছিলো।কিন্তু জ্ঞান ফেরার পর, এখন, মনুষ্যসুলভ পাপের ভারে শরীরটা পাতালের দিকে যেন কেউ টান মেরে নিয়ে যাচ্ছিলো। পালকিতে তারই নতুন বউ আর পুতলি ছিলো,তাদেরকে রেখে নিজের এভাবে বেঁচে ওঠা কবিরাহ গুনাহ- এই চিন্তাও রফিককে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলো।
অতি কষ্টে নিজেকে কচুরির জলকাদার ভেতর থেকে টেনে তোলার পর, নৌকায় বসা বিহ্বল, রফিকের অন্তরে কে যেন বলে ওঠে- সে ছাড়া জগতে আর কেহ নাই। বাবা আদমের মতো সাড়ে তিনশ’ বছর একাকিত্ব ভোগ করছে সে।তবে চক্ষু স্থির হয়ে এলে দেখে তীরে ওঠার চেষ্টায়- রণজিৎ বাছাড়।
মিলিটারিরা চলে যাওয়ার পর, সারা গ্রাম হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।
পালকিটি পড়েছিলো নৌকায়। আতুরির শরীরে পেঁচানো বিবাহের লাল টাঙ্গাইল শাড়িটি তখনও, রক্তে আরো রঙিন। গলুই থেকে ছিটকে হেমাঙ্গ মাঝির শরীরটা পানিতে ঝুলছিলো, শুধু বেকায়দা একটি ঠ্যাং নৌকার পাটাতনের পাশ দিয়ে আটকে রয়েছে। বোনের সঙ্গে তার শ্বশুরবাড়ি যাবে বলে বায়না ধরেছিলো যে পুতলি,তার হাতে কয়েকগাছা কাঁচের চুড়ি।হাতের তালুতে গোল করে আঁকা মেহেদীর রঙ। আতরবানুর গায়ে হলুদে নিজেও সেজেছিলো পুতলি। কিন্তু এখন দুই বোন পরস্পরকে ধরে আছে- প্রাণ সেখানে নিথর।
গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া আতুরির শরীরের একমাত্র চিহ্ণ- সন্নের নাকফুল- সামান্য ঝিলিক মেরে সমাগত মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, পালকিতে চড়ে আতুরি শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলো।
বিধ্বস্ত পালকিটি নৌকার পাটাতনে পরস্পর আত্মার মিলনে চুপ।নৌকায় চড়ে বসে আছে লাল মোজা পরা জামাইটি,রফিক মিয়া। তখন তিন ভুবনের মাঝে ঘুরছিলো হেমাঙ্গ মাঝির খেয়া নৌকাটি।
রেদোয়ান খান : কথাকার।