নাজমুন নাহার
শেষের দিন
যতদিন মন্ত্রণা দিয়েছো যুদ্ধে যাবার
ততদিন চোখ উপড়ে
ফেলে দিয়েছি-
ফেলে দিয়েছি আমার কাবার্ড
আমার বহু ব্যবহৃত রুমাল
আর নিমক দান –
সম্বর্ধনার শেষের দিন
পাশে হেঁটে হেঁটে
যখন সবগুলো তারের পাশে আমাদের পা
সবগুলো রিকশার প্যাডেলে আমাদের চোখ
যতটা জরুরী আমাদের বিচ্ছিন্ন হওয়া
ততটা জরুরী আমাদের প্রেম
ততটা আমাদের আঁচড়ে
ফালি ফালি হওয়া হৃদপিন্ড –
আহা আর কিছু নেই –
তবু শেষ দিন
ব্যারাক ফেলে অথই সমুদ্রে ভাসার দিন
সেদিন শুধু একটুকরা নিম পাতাই শরাবের নিমক
ততটাই শবের মর্মযাতনার শোক
ততটাই আমাদের ঘর দুয়ারের
হা হা করা খোলা দরোজা –
আহা শেষ দিন –
সব দিনই আজ শেষের দিন —
আমি তোমারি শোক
ঘাস ছিল যারা অনাবাদী জমি
পুড়ে গেছে সবুজ বুক
জেনেছি সেদিন
আমি ঘুমহারা পথিক’ ‘
তবু শোনো বলি কানে কানে
চুপচাপ জামা ভিজে যায়
গভীর চোখে জাগে
মেঘ দুপুর –
কোথাও কেউ নেই
শুধু বুঝে যাই
আমি তোমারি শোক –
দ্যুতিময় প্রাজ্ঞ বালক
যখন তুমি দাঁড়ালে রাজার মতন
বুক বেঁধে নিলে আকাশের সাথে
যখন তুমি আদতে হয়ে গেলে
এক দ্যুতিময় প্রাজ্ঞ বালক —
যখন তোমার পায়ের কাছে
নেমে এসেছে সমুদ্র
তখুনি নূপুরের ধ্বনি হলাম —
রিনঝিন নিক্কন আমার
ওগো মেঘ বালক
চুপি চুপি আজ হরিণ হও
অরণ্য হতে চাই —
ঘন এক বনের ভেতর সাদা বাড়ি
তার দিঘীর জলে অবগাহনে অবগাহনে
কাটাব সন্ধ্যা দুপুর রাত –
তোমার কালো রাত্রি
ঝকঝকে দুপুর করে দেব –
আহা কতকাল বৃষ্টি নেই এই গ্রহে !!
পাখি জীবন
পথ পার হতে গিয়ে শুয়ে গেছি রাস্তার জেব্রা ক্রসিং এ ।
তিনটা গাড়ি আমার উপর উবু হয়ে দেখে হার্টের ভেতর পাখি বসে আছে ।
অতএব তারা ইতিবৃত্ত জানতে গিয়ে জেনে গেলো আমার জীবন ছিলো পাখি জীবন –
মেঘের ভেতর পুড়ে পুড়ে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দেখেছি তোমার গড়িয়ে যাওয়া
জীবন । আঁকাবাঁকা ট্রেনের সাথে তুমি দৌড়ে সীমানা পার হতে গিয়ে আটকে আছো মাঝনদীতে ।
বুকের ভেতর থেকে পাখিটা উড়ে গেলে দৌড়ে ধরেছি তার পালক ।
তুমি কেন হে কাঁদ দাঁড় করায়ে পথিক সব !!
কৃতজ্ঞ হে ঈশ্বর
তীব্র ব্যথায় রাত গভীর হলে বুঝেছি
মৃত্যু হয়েছে আজ আটদিন ।
তোমার মৃত্যুর কিঞ্চিত আগে –
রিকসার পা দানিতে পা রেখেছ যেদিন
সেদিনই বলেছি মৃত্যু গ্রহীতার মতন –
সুফি গানের রিদমের সাথে ওঠানামা করে আবেগের সুতো ।
রোদের ভেতর রোদ আকাশের ভেতর দড়ি পাকানো তুলো –
উপুর হয়েছে আমাদের কবরে ।
আমরা শুধু বলেছি সুরা মনে করে
আর কোনো অকৃতজ্ঞতা নেই ঈশ্বর হে –
অনন্ত জীবনে আর একবার ক্ষমা করে পাঠাও
অপার্থিব প্রেম পাঁজরে –
তোমাদের ওখানেই মানায়
একদিন এই শহর জানবে
আমরা প্রেতাত্মা ছিলাম ।
ভালোবাসার খেলায় বুকের নুন
সমুদ্রে ছেড়ে দিয়ে
চোখে চোখ রেখে বলেছি
‘ ভালোবাসি’ ।
আঁধার পার হলে
সময়কে অতিক্রম করে বলি
‘আসলে সব মিথ্যে ছিলো’ –
পাথরের গায়ে যে পাথরকুঁচি গাছ
সে ঠায় দাঁড়িয়ে দেখেছে –
আমাদের এক চুমুক হাসি ০০০
শিল্পকলায় তাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস –
আহা এতোক্ষণে সময় হলো বুঝি !
প্রেতাত্মাদের তো রাত থাকে না , না দিন
তবু আমাদের বেড়াল জীবন ০০
একদিন আমার সহ-প্রেতাত্মার সাথে
বনের ভেতর হালকা পায়ে চলতে দেখে
এক বালক স্ন্যাপশটে আমাদের মানব মানবী বানিয়ে
আকাশের গায়ে লেপ্টে গিয়েছিলো —
বলেছিলো –
‘তোমরা ঐখানে থাকো – তোমাদের ওখানেই মানায় ”
আমাকে তুলে নাও হে ঈশ্বর
থাকবে যত পরমায়ু ঈশ্বরের পায়ে সঁপে দিবো
অনন্ত শুন্যতায় পৃথিবীপৃষ্ঠে আমি কীটমাত্র –
হে ঈশ্বর ! খুলে দাও সবগুলা জানালা ,বার্তাকক্ষ
দুপুরের আগে ভিজে গেছে হুরির ওড়না
আদম ঈভের গন্দমবৃক্ষ –
বিন্দু বিন্দু জল,সাথে হাম্মামখানা
শকুন্তলার চুল
আমাকে তোমার প্রিয় বোরাকে বসিয়ে দিয়ো
গিন্সবার্গের অগ্নির সাথে আফিমের তীব্র নেশা
আমাকে তুলে নাও হে ঈশ্বর
আঁধারে আলোয়
প্রায়ান্ধকার হতে জামাটা ঝুলতে ঝুলতে নেমে এসেছে আলোক গহবরে ।
ছুঁতে ছুঁতে মাটিতে শুয়ে গেলো , জল হলো ।
জামাটাতে ফিরে যাই ।যদিও অনাদিকাল ধরে আমি লিওর এক ক্যাক্টাস ,
একদিন মানুষ হই
ফের নিবিড় জঙ্গলে পুরনো ছাতিম গাছের নীচে শুয়ে ঈশ্বরকে দেখি ।
আহা ! কমনীয় ঈশ্বর ।
হাতে তার গোল ঠান্ডা বাটির মত চাঁদ । বুকের ভেতর আমার বাউড়ি বাতাস –
ঈশ্বরকে বলি ফিস ফিস করে – লোকালয়ে কতজন ঈশ্বর থাকেন বলে দেবেন নাথ ?
চতুর্দশ প্রজন্ম
মার্চের এক বিকেলে আপনি হারিকিরির উপত্যকায় বসে ভাবলেন – এই অচূর্ন বিয়োগ ব্যথায় উপশমের মলম লাগালেও ব্যথা যাবে না । অতএব হে ভগিনী এবং ভাই সকল আসুন পতাকা তলে সমবেত হই – কাঁচা মাংস ভক্ষন করে সংহতি প্রকাশ করি । পাখির ডানায় লুকিয়ে রাখি নারী পতিতাদের । পুরুষ সকল তাদের চতুর্থ স্তন নিয়ে বন্দনা করুক ‘হারানো পৃথিবীর বাসে চড়ে যে নারী ইজ্জ্বত হারায় তার নিতম্বের ‘ । যে খোলা কমলা ফেরিওয়ালার কাঁধে চড়ে পৃথিবীর ওজন মন্ডলে ভাসছে তারা আজ বলুক – নারী পুরুষ মিলিত হয়ে জন্ম নেবে নতুন এলিয়েন – ওরা আমাদের চতুর্দশ প্রজন্ম — —
শিব বালক
হে চন্ডাল – রুদ্র
ফিরে যাও আদিম নিবাসে
শুয়ে আছি ইস্কাপনের
ওম ওম আরামে
বিকল হাত – মস্তিষ্ক
এবং হিম শীতে
শ্রেণী সংগ্রামে বিধ্বস্ত নদী –
ক্লান্ত প্রাণ তুমি শিবের বালক –
আগুন জ্বালিয়ে অংগার করে দিলে
মোহময় স্বর্গের দরজা –
সেখানে আজো ভোর হয়নি –
নাজমুন নাহার : কবি ও প্রাবন্ধিক। অস্টেলিয়া প্রবাসী।