গল্প
সম্পর্ক।। রওশন রুবী।।পুবাকাশ
বৃষ্টির ঝাপটা বারান্দা পেরিয়ে জানালার শার্সি ছোঁয়। রিজান বড় করে “হাই” তুলে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ভাল্লাগছে ঘোলা হয়ে ওঠা কাঁচ। বিছানায় উঠে বসে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো। বাতাস আর বৃষ্টি একাকার। ঝড়ের রূপ নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বারান্দায় টবে রাখা গাছগুলোর কথা মনে পড়লো। কয়েক প্রজাতির ক্যাকটাস্, এলোভেরা, পুদিনা, মরিচগাছে পানি জমে যাবে। রিজান উঠে গাছগুলোকে বারান্দার সাথে রুমের দেয়ালের পাশে গাদাগাদি করে রাখল। যদিও বৃষ্টির ছাট আসছে। কিন্তু পানি জমে যাবে না। এক মগ কফি করে ভেজা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কফিতে চুমুক দেয় সে।
গুনগুন করে “আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম…..” মুঠোফোনে ভ্রাইপেশন হচ্ছে। নিশ্চিত সুমনার ফোন। পাগলি একটা। মনে মনে কথাটি বলে ফোন রিসিভ করে। এই একটা মেয়ে যাকে তার তন্ত্রের প্রতিটি কোষ রেসপেক্ট করে। মুঠোফোনের অন্যপাশে হিহিহি করে হাসছে সুমনা।
-হাসছিস্ কেন? হাসি শোনাতে ফোন করেছিস্?
জানতে চাইলো রিজান।
-আরে না! হাসছি অন্য কারণে। কারণটা বলছি, একটু দাঁড়া না?
হাসতে হাসতেই জবাব দিলো সুমনা।
-এমন হাসির কী হলো বলবি তো?
জানতে চায় রিজান। তার ধৈর্য কম নয়। কিন্তু সুমনার যে কোন বিষয়ে সে অস্থির হয়ে উঠে। অধির রিজান মুহূর্তে ঘর বাহির পয়চারি করে। রহস্যময়ী সুমনাকে মাঝে মাঝে ভেদ করতে পারে না। নিশ্চিত সুমনা রিজানের এই অস্থিরতা জানে। তাই কথা ঝুলিয়ে রাখে। ফোনের ওপ্রান্তে সুমনার কণ্ঠ রিমঝিম করে,
-শোন, বিকেলে স্বপ্নে তোকে দেখেছি। তুই আমাদের আমানত চাচার ভূমিকায়।
-মানে কী?
রিজান প্রশ্ন করে।
-আরে তুই আমাদের আমানত চাচাকে চিনিস না?
-চিনি তো। তাহলে?
জবাব দেয় রিজান।
-আবার জিগায়!
সুমানা কেমন ঢং মেশা গলায় বলে।
-আরে তুই আসলটা বলবি না?
রিজান ধমকে উঠে।
-আমানত চাচা একজন অসম্ভব সাবধানি লোক। সেই আমানত চাচার ভূমিকায় তুই। তার আধময়লা বয়সী গামছাটা তোর কাঁধে। রোশম ডান হাতে তুই গরুর মুখে মাক্স পরিয়ে দিচ্ছিস্। গরুর ঘাসগুলোকে জীবাণু মুক্ত করতে লবণ ও কুসুমগরম পানি দিয়ে চাঙারিতে বিশ মিনিট ভিজিয়ে রাখছিস। গরুগুলোকে সেভলন পানি দিয়ে গোসল করাচ্ছিস্। গোয়ালঘরটাকে ভালো করে ব্লিসিংপাউডারের পানি দিয়ে ধুয়ে তকতকে করছিস্। তোর মাক্সপরা মুখটা ঘামে চ্যাটচ্যাটে হয়ে উঠেছে। আমি দিয়ে মুছে দিতে দিতে ঘুম ভেঙে গেল। তারপর থেকে হাসি থামাতে পারছি না। তোকে যা লাগছিল না! হিহিহিহি….
সুমনা আবার হাসতে থাকে। যেন টলকে টলকে উঠছে।
মেয়েটা অদ্ভুত। গম্ভীর হলে অসম্ভব ব্যক্তিত্ব। আবার হাসলে একেবারেই বাচ্চা… বাচ্চা!! ওফ্! মাইড! ও বাচ্চাই… কথাটা মনে হতেই রিজানেরও হাসি পায়। সে হো-হো-হো করে হেসে ওঠে। হাসি থামিয়ে রিজান আবার একটা হাই তুললো। তার কফি শেষ হয়ে আসছে। সে নতুন করে মগ ভরে নিল। সুমনাকে বলল-
খুব ভালো হতোরে তুই রাখালের বউ, আমি রাখাল। দু’জনে বনে-বাদাড়ে, মাঠে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতাম। আমি বাঁশি বাজাতাম, তুই তন্ময় হয়ে আমার কাঁধে আলতো হাত রেখে মাথা হেলিয়ে রাখতি। তোর বুক থেকে আগ্নিয়গিরি স্ফুরণ ছড়াতো। আমি পুড়ে খাক হয়ে যেতাম। কথাটা বলে সুমনার কাছ থেকে পাঁচ মিনিট সময় চেয়ে নিয়ে রিজান ওয়াশ রুমে গেলো।
-এতো ঘুম কেনরে তোর?
ফিরে এসে রিজান প্রশ্ন করলো।
-কোথায় ঘুম দেখলি!
সুমনা অবাক!
-তবে যে ভিডিও কলে আসিস নাই?
রিজান জানতে চায়।
-ওমা তুইও তো আসতে পারতি! তুই কেন আসিস নাই? অন্য কোথাও ব্যস্ত ছিলি?
ফান করে সুমনা মৃদু হাসে।
-ফাজিল, দড়িবাজ, হারামি তুই জানস না আমি তেমন নই?
অনুরাগে কথাগুলো বলে থামে রিজান।
আজ ফ্রাইডে বিধায় এই বিকেল উপভোগ করছে তারা। সুমনা কলেজে পড়ায়। রিজানও একি কলেজে। দেখা হয় প্রতিদিন। তবু কথা না বলে থাকতে পারে না। ওরা বপন করেছে হিউজ বীজ। এখন সেখানে ঘনসবুজের সমারোহ।
রিজানের মা ব্যাংকার। পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই লতিফার বানু। ভীষণ স্মার্টলী চলা ফেরা করেন। সময় তার কপাল জুড়ে থাকে বড় টিপ। চোখে কাজলের প্রলেপ। চুলে কখনো সখনো ফুল পরেন। তিনি ভ্রু প্লাগ বা ফেসিয়াল করেন না। তবে তাকে দেখলে মনে হবে না এসবের প্রয়োজন আছে। বাবা মারা যাবার আগেও তিনি যেমন ছিলেন পরেও তিনি তেমনি। তিনি বলেন, “এতে মেন্টালী রিফ্রেস থাকা যায়। নিজেকে সুন্দর পরিচ্ছন্ন না রাখলে মনও স্যাঁত স্যাঁতে বিচ্ছিরি হয়ে যায়। মন ভালো রাখা প্রত্যেক মানুষের মানবিক কর্তব্য। এখন তিনি রিজানের রুমের দরজায়। কলিংবেলের শব্দ শুনে রিজান বুঝে মা এসেছে। সুমনাকে বলে,
-মা এসেছে। একটু পর কল করছি।
দরজা খুলে দেয় রিজান। লতিফারের চিরায়ত মিষ্টি হাসিতে মুখ চোখ হাসে। তিনি বললেন-
বৃষ্টিতে তোমার পছন্দের ইলিশ ফ্রাই ডাইনিংএ রেখে এলাম। নিয়ে এসো। আর শোনো তোমার রিটন মামা আসবেন। তুমি কফি শেষে তার সাথে দেখা করে যেও।
রিজান আনমনা হয়। রিটন মামার সাথে মায়ের সম্পর্ক। সে জানে।
রওশন রুবী: কবি ও কথাশিল্পী।