গুচ্ছ কবিতা।। আলাউদ্দিন কবির।। পুবাকাশ
মাতৃভাষা
যখন আমরা হিন্দি বলি, কিংবা উর্দু, কিংবা ইংরেজি
আমরা কিন্তু অনুবাদ করেই বলি;
হিন্দিতে, উর্দুতে, ইংরেজিতে কিংবা বিশ্বের যেকোনো ভাষায়
কোনোকিছু বলার আগেই কিন্তু আমরা মস্তিষ্কের অনুবাদকেন্দ্রে যাই,
আশ্রয় নিই মাতৃভাষার !
মাতৃভাষার ছাড়পত্র নিয়েই আমরা
বিদেশী ভাষায় কথা বলি, গান শুনি, সিনেমা দেখি এমনকি আমরা
উচ্চপর্যায়ের বিবিধ প্রশংসাবাক্য অথবা গালি উদ্গীরণ করি !
মায়ের মুখের ভাষাই মূলত আমাদের পরিচয়
মানুষ হিসেবে আমাদের শ্রেষ্ঠ হওয়ার মূল মাধ্যম, আর
অভিধানের ঐতিহাসিক রূপান্তরে এরই নাম আজ ‘বাংলা’ !
চাইলেই কিন্তু আমরা বদলাতে পারি আমাদের বাইরের বুলি
কেমন আছেন না বলে ‘হাউ আর ইউ’
ধন্যবাদ না বলে থ্যাঙ্ক ইউ; এমনকি আমরা নিজ-নিজ প্রেমিকার চোখে চোখ রেখে
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ না বলেও বলতে পারি ‘আই লাভ ইউ’ !
বুলি বদলের প্রতিবাদে যদিও গুলী খেয়েছেন আমাদের পূর্বসূরী বহু তরুণ
আমরা তবুও হরহামেশাই ব্যস্ত আজকাল দৈনন্দিন বুলি বদলেই…;
আমাদের নিয়ে তবু কেউ-ই মাথা ঘামায় না;
না সরকার
না প্রশাসন
না পুলিশ !
আমরা কি জানি, বাইরে আমরা বিদেশী ভাষায় বললেও
বিদেশী অক্ষরে লিখলেও, বিদেশী উচ্চারণে সুখ খুঁজলেও
ভেতরে-ভেতরে আমরা কিন্তু
একটা ভাষাই শুধু জানি
একটা অক্ষরই শুধু চিনি
একটা উচ্চারণেই শুধু প্রকৃত সুখী!
সেই ভাষাটাই আমাদের মাতৃভাষা
সেই অক্ষরই আমাদের অ-আ
সেই উচ্চারণই আমাদের বাংলা, আমাদের আট ও একুশ, আমাদের গৌরবের ফাল্গুন আর ফেব্রুয়ারি!
পথের সাথীরা শোনো
বুদ্ধির বয়সের আগেই শিখে গিয়েছিলাম পছন্দের মানুষটির
পিছু-পিছু হাঁটা
এখানে আমার প্রথম পছন্দ ছিলেন জন্মদাত্রী মা… তাইতো আমি
আট বছর বয়স পর্যন্ত আম্মার কোলে ও আঁচলে আরাম খুঁজেছি।
ভরামুহূরীর মেঠোপথ ধরে আম্মার গা ঘেঁষে হাঁটতে-হাঁটতে চলে গিয়েছি
বাঁশঘাট নানার বাড়ি; গিয়েছি পোকা-ধরা দাঁতের চিকিৎসার্তে
চিরিঙ্গা যোগীপাড়া।
মনে পড়ে,
মেঝোভাইয়ের পিছু ধরেছিলাম এক ঈদের সকালে… মগবাজারে কানাইয়ার দোকানে
ভিসিআরে সিনেমা দেখার লোভে।
তারপর বহুদিন কারো পিছু ধরিনি।
প্রেমিকা আসে, প্রেমিকা যায়। বন্ধুরা আসে, বন্ধুরা যায়। বেড়ে উঠি
দিনে-দিনে নিম্নমধ্যবিত্তের বিদিত রুটিনে।
চকরিয়া, চন্দ্রঘোনা, পটিয়া, চন্দনাইশ, কুমিরা কি বানিয়ারপুল
কতো স্মৃতি, কতো মুখ, কতো প্রীতি, কতো ভুল…
অবশেষে করোনার বিশের বিদায়ে বিশ্রাম চায় আজ ক্লান্ত দু’টি পা !
পথের সাথীরা শোনো, আপাতত আমি বিশ্রামে আছি;
দয়া করে ক্ষমা করো, সহসা আর হাঁটা হচ্ছে না; তোমরা এগিয়ে যাও।
মানুষেরা ফেরে না
থাকবো বললেই যেমন সবাই থাকে না
আসবো বললেও তা-ই
অধিকাংশ মানুষই আর আসে না;
চোখ বুঁজলেই দেখা যাবে
পথে-পথে এমন অসংখ্য মানুষ।
মানুষেরা আসলে নদীর মতো
যাপনের ঢেউয়ে-ঢেউয়ে মিশে যায় সময়ের মহাসমুদ্রে
মানুষ মূলত একবার চলে গেলে আর ফেরেই না !
হৃদয়ের জনপদে লকডাউন
কেউ-কেউ কাছে আসে, ভোরের হাওয়ার মতো ভালোবাসে আর
নৈকট্যের কষ্টিপাথরে পরখ করে চেহারা
পরখ-পর্ব শেষে কেউ আরো কাছে আসে; আর কেউ সরে যায়
খুব চুপিসারে।
পরিচিত মুখের অপরিচিত অভিযোগ বিক্ষত করে কারো-কারো বুক
ভাষা বদলায় খুব-চেনা চোখ, মনের মানুষ হয় জনৈক লোক আর
হৃদয়ের জনপদে লকডাউন পালিত হয় ঘোষণা ছাড়াই !
প্রতিশ্রুতি
কাছের হলে কষ্ট লাগে
দূরের হলে ছাই
আবার নাহয় হয়ে যাবো
যেমন ছিলাম তাই।
খুনসুটি আর মশকরাতে
খুঁজবো না আর সুখ
আবার নাহয় হয়ে যাবো
সেই সে ভদ্রলোক।
কারো কাছে থাকবে না আর
কারো কোনো দায়
একই গ্রহে বাঁচবো দু’জন
পৃথক আঙিনায়।
আলাউদ্দিন কবির : তরুণ কবি।
আলাউদ্দিন ভাইয়ের কবিতাগুলো সবসময়ই পড়ে মুগ্ধ হই
তার “পথের সাথীরা..” অসংখ্য। তাদের মধ্যে আমিও একজন।
🌻🌻🌻