মুক্তগদ্য

বইপড়া ও চসিক’র বইমেলা…।। রেফায়েত কবির শাওন।। পুবাকাশ

জাপানি ভাষায় সুনডুকু বলে একটা কথা আছে। কেউ যখন বই কিনে বাড়িতে স্তূপ করে কিন্তু পড়ে না তারা সুনডুকুতে আক্রান্ত হয়। জাপানিরা অতি ভদ্র জাতি। সেদেশে সুনডুকু কোন খারাপ অভ্যাস নয়। তবে এই দেশে থেকেও আমি সুনডুকুতে আক্রান্ত হয়েছিলাম গত কয়েকবছর। যদিও না পড়ার উদ্যেশ্যে বই কিনি নি, তবে বিশ্রী কর্মঘন্টা আর কিছুটা আলস্যের কারণে তাকের উপর জমেছিল বেশ ক’টা বই।

করোনার বন্ধে সময় কাটাতে কি কি করা যায় এরকম একটা হাস্যরসাত্মক লেখা পড়েছিলাম পত্রিকায় । প্রতিবেদনের শুরুতে টলস্টয়ের চৌদ্দশ পৃষ্ঠার বই ‘ওয়ার এন্ড পিস” এর ইংরেজি অনুবাদের একটা ছবি, আর লেখা এই ছুটিতে এই ক্লাসিক বইটা পুণঃপাঠ করা যায়। আইডিয়াটা ভালই লাগল । তাক থেকে নামিয়ে পড়া শুরু করে দিলাম। যতদূর মনে পড়ে বইটার বাংলা অনুবাদ পড়েছিলাম স্কুল জীবনে, সোভিয়েত ইউনিয়নের রাদুগা প্রকাশনীর বইতে। কিছুদূর পড়ার পর আর পড়তে উৎসাহ পেলাম না। কারণ আগে পড়া বাংলা অনুবাদটা এত ভাল হয়েছিল যে কাহিনীটা মনের মধ্যে গেঁথে আছে। সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ এবং ভারতের বিশেষজ্ঞ লেখকদের মস্কো নিয়ে গিয়ে, রীতিমত প্রশিক্ষণ আর বাস্তব অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে অনুবাদের ব্যবস্থা করত।

ওয়ার এন্ড পিস পড়া মাঝপথে থামিয়ে তাক থেকে আরেকটা বেশ মোটা বই নিলাম। জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির 1Q84। মুরাকামি এই বই লিখেছেন বিখ্যাত ইংরেজ লেখক জর্জ অরওয়েলের 1984 উপন্যাস দিয়ে প্রভাবিত। অরওয়েল দেশে দেশে স্বাধীন মত প্রকাশে বাধা দেয়ার ঘটনায় ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। এই উপন্যাসে ১৯৪৯ সালে বসে তিনি কল্পনা করেছেন ১৯৮৪। তাঁর কল্পনায় সে সময় মানুষের চলাফেরা, কথাবলা সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করবে রাস্ট্র। এমনকি ইংরেজি ভাষাকে পরিবর্তন করে Newspeak নামে একটি নতুন ভাষার প্রচলন করা হবে যেখানে রাষ্ট্র বা সরকারবিরোধি শব্দগুলো বাদ দিয়ে দেয়া হবে।

ভাষার সাথে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বায়ান্নতে তাই ওরা ভাষাকেই আক্রমণ করেছিল প্রথম। এখনও পৃথিবীর অনেক জায়গায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রহিত – ভাষা থাকলেও অরওয়েলের কল্পিত রাষ্ট্র ইওরেশিয়ার মত শব্দগুলো নিয়ন্ত্রিত।

মুরাকামির 1Q84 উপন্যাসে রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হলেও অদৃশ্য কিছু শক্তি নিয়ন্ত্রণ করে মানুষগুলোকে। যাদুবাস্তবতায় চরিত্রগুলো মাঝে মাঝে চলে যায় অন্যজগতে যেখানে দু’খানি চাঁদের আকাশ। এই নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হতে, নিয়ত যুদ্ধ করতে হয় মুরাকামির চরিত্রগুলোকে।

মুরাকামি জাপানি লেখক, তার গল্পের প্রেক্ষাপট জাপান । কিন্তু তাঁর চরিত্রগুলোর ব্যাপারে খোদ জাপানেই অনেক ক্ষোভ। কারণ ওরা ইংরেজি গান শোনে, ওরা ইংরেজি ছবি দেখে, ওদের শেলফে ইংরেজি বই শোভা পায়। এ ব্যাপারে মুরাকামিকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন আধুনিক জাপানের তরুণ সমাজ যেমন, তাঁর উপন্যাসে তেমনটিই দেখিয়েছেন।

ব্যাপারটা এখানেই, ইংরেজি গান শোনা, ইংরেজি ছবি দেখা, ইংরেজি বই পড়া জাপানিরা কিন্তু পৃথিবীতে অর্থনেতিক ভাবে আর প্রযুক্তিজ্ঞানে সমৃদ্ধ নিজ ভাষায় উচ্চশিক্ষার কারণে। জাপান সরকার জাপানিরা কি গান শুনছে আর কি মুভি দেখছে সে ব্যাপারে দুশ্চিন্তা না করে তাদের উচ্চশিক্ষা মাতৃভাষায় করার জন্য বিশাল বাজেট রাখে। ইংল্যান্ড আমেরিকায় কোন বই ইংরেজিতে প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে জাপানে তা জাপানি অনুবাদে প্রকাশিত হয়। নিজ ভাষায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বশেষ জ্ঞান জানতে জাপানিদের একদিনও অপেক্ষা করতে হয় না। একইভাবে নিজ ভাষা কাজে লাগিয়ে জার্মানিও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করছে অনেক ক্ষেত্রে।

একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে পত্রিকায় শহিদ মিনারে ফুল দেয়ার খবরের পাশে আরেকটি খবর। জেলা প্রশাসনের অভিযান – ইংরেজি সাইনবোর্ডওয়ালা দোকানদারদের শাস্তি। উচ্চশিক্ষা, আদালত সব ইংরেজিতে চলে। এমনকি সরকারি শিক্ষাব্যাবস্থারও এখন ইংরেজি মাধ্যম আছে। দোষ শুধু দোকানদারদের। জেলা প্রশাসন জ্ঞান বিজ্ঞানের সর্বশেষ তথ্য সমৃদ্ধ কয়টা বই অনুবাদ করেছে, আমাদের সভ্যতা সংস্কৃতি বিশ্বসভায় তুলে ধরার জন্য কয়টা বাংলা বই বিদেশি ভাষায় অনুবাদ করিয়েছে। দুর্গম গ্রামের গরীব মানুষটাকে আইনের কঠিন ইংরেজি মাতৃভাষায় বুঝতে কি সাহায্য করেছে? এসবের কোন উত্তর নেই। যত তর্জন গর্জন সাইনবোর্ডের উপর।

আজকাল মেলা বললেই ভয় লাগে। একসময় চট্টগ্রাম শহরে বাণিজ্য মেলা হত, যেখানে দেশ বিদেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠান আসত। আন্তর্জাতিক ক্রয় বিক্রয়ের চুক্তি হত। এখন চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা রেয়াজুদ্দিন বাজার থেকে জিনিষ কিনে কিছুটা বেশি লাভে বিক্রির জায়গা হয়ে গেছে। জব্বরের বলি খেলার সাথের বৈশাখি মেলার বড় অংশ দখল করেছে অশ্লীল সার্কাস। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলাও এখন ম্লান হয়ে গেছে মেলার মাঠ ছোট হয়ে যাওয়া আর জুয়ার আসরের কারণে।

এত দুঃখের ভেতরও গত বছর আমাদের শহরে চমৎকার একটা মেলা হয়। বই মেলা। প্রথমবারের মত চট্টগ্রামে একটি সমন্বিত বই মেলা। সারাদেশের বড় বড় সব প্রকাশকরা আসেন। চট্টগ্রামবাসি পরিবার নিয়ে বারবার যান সেখানে, বই কেনেন।

গত বছরের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনার এই বইমেলাটা টানেলের শেষে আলোর মত। অরওয়েলের 1984 এ বর্ণিত Newspeak এর মত নিয়ন্ত্রিত না হয়ে বই পড়া, লেখা আর অনুবাদের চর্চায় সমৃদ্ধ হবে বাংলা ভাষা। রাদুগা প্রকাশনী যেমন অনুবাদের মাধ্যমে রুশ সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিয়েছিল সারা বিশ্বে, আমাদের প্রভাতফেরিও একদিন বাংলা ভাষা নিয়ে হাঁটবে বিশ্বের প্রতিটি পথ।

রেফায়েত কবির শাওন: প্রভাষক, ইংরেজি। সানশাইন স্কুল এন্ড কলেজ।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন