অনূদিত একশ কবিতা : ভাব ও ভাবনার রসায়ন।। গিয়াস মামুন।। পুবাকাশ


অনুবাদক মানে প্রতারক”- এ কথাটি

স্বীকার করে আলমগীর মোহাম্মদ-এর অনুবাদ করা বই “পরদেশী ১০০ কবিতা”।সচরারচর অনূদিত বইয়ে মূলভাষার ভাব গাম্ভীর্যতা রক্ষা করতে পারে না বলে অনুবাদক মানে প্রতারক বলে একটা কথা আছে।

‘পরদেশী ১০০ কবিতা’ বইয়ের কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে একটুও বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়নি।
অনুবাদকের স্বকীয় স্বাধীন প্রকাশের পাশাপাশি যথা-উপযুক্ত শব্দচয়ন, ভাষার সারল্যে সম্পূর্ণ বইটি সুখপাঠ্য। বেশিরভাগ অনুবাদক সুখপাঠ্য করতে গিয়ে মূল কবিতার ভাব গাম্ভীর্যতা অক্ষুণ্ন রাখতে পারেন না।
এক্ষেত্রে আলমগীর মোহাম্মদের অনূদিত বইটির কবিতাগুলো সুখপাঠ্য ও ভাব গাম্ভীর্যতা একি সাথে রক্ষা হয়েছে।

সাধারণত অনুবাদ সাহিত্য বলতে ইংরেজি,ফরাসী, রুশ, ইটালি, পারসী ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ। কিন্তু এ সংকলনে সে সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে আফ্রিকা, ভারত, আরব, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশের কবিদের কবিতাও অনূদিত হয়েছে। সবকটি মহাদেশেকে ছুঁয়ে ৬০জন এর অধিক কবির প্রায় একশ কবিতার অনুবাদ সংকলিত হয়েছে এই বইয়ে।
সে হিসেবে অনূদিত কবিতা সংকলনটি পেরিয়ে গেছিল সচরাচর অনূদিত কবিতার সীমাবদ্ধতা।


রুমী, গালিব, কাম্যু, ব্রাউনিং,জয়েস,লরেন্স, ডিকিন্স প্রভৃতি বিখ্যাতদের পাশাপাশি সমসাময়িক উত্তরাধুনিক, উত্তর উপনিবেশিক ভাবনাচিন্তা ধারণ করে এমন কবিদের কবিতাও সংকলিত হয়েছে।


কবিতাগুলোর ভাব বিষয়ও বৈচিত্র্যময়, চমৎকার। যেমন এখানে মানব-মানবীর প্রেম, ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্ব সংকট, বর্ণবাদ, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, স্বপ্ন, জাতীয়তাবাদ, প্রভৃতি বর্ণিল থিমের উপর লেখা কবিতাগুলো।

ধারণা করি, আলমগীর মুহাম্মদ কবিতাগুলো ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন বা প্রভৃতি দেশের জার্নাল থেকে অনুবাদ করেছেন।
যেখান থেকেই করুক ভাব, ভাষায়, ছন্দে, শব্দের গাঁথুনিতে এতে তাঁর নিজস্বতা, স্বকীয় বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত।
রুমীর মতো মর্মী,আধ্যাত্মিক কবির কবিতা; উত্তরাধুনিক, উত্তর ঔপনিবেশিক কবিতার ভাব, ভাষা গাম্ভীর্যের তীব্রতা অক্ষুণ্ন রাখার মতো দূরুহ কাজটি সুচারুরূপে করেছেন তিনি।
কয়েকটি কবিতার অনুবাদ দেখলেই বিষয়টা স্পষ্ট হবে—

“তোমাকে ভালোবাসব নীরবতায়..
কারণ নীরবতার কোন প্রত্যাখ্যান নেই,
তোমাকে ভালোবাসব একাকীত্বে..
কারণ একাকীত্বে
আমি ছাড়া আর কেউ থাকে না তোমার মাঝে,…
তোমাকে জড়িয়ে রাখব স্বপ্নে..
কারণ স্বপ্নে তোমার প্রস্থান নেই।”
(আংশিক)
জালালুদ্দিন রুমি: পারসিক কবি।

অথবা,
“বইয়ের মতো জাহাজ আর হয় না
যা আমাদের অন্যভুবনে নিয়ে যেতে পারে,
অন্য কোন বাহন যেমন
তীব্রগতির ঘোড়সওয়ার না।
এই যাত্রা যদিও ধীরতর
ক্ষয়ক্ষতির ভয় নেই এতে ;
কত সাশ্রয়ী বাহন এটা।”—ডিকিন্স।

”তোমাকে পাওয়ার আগে
আমি কবিতা লিখতাম, ছবি আঁকতাম,
এবং বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে যেতাম
ঘুরে বেড়াতে…
এখন, তোমাকে ভালোবাসার পর
কুকঁড়ে গেছি বুড়ো খচ্চরের ন্যায়
আমার জীবন পড়ে রয়, তুষ্ট
তোমার মাঝে…..।”
কমলা সুরাইয়া : ভারতীয় কবি।

উপনিবেশিক শাসন শোষণ থেকে এখনো আফ্রিকা মুক্তি লাভ করেনি। আফ্রিকান কবিদের কবিতায় উপনিবেশিক শোষণ থেকে মুক্তির আর্তির তীব্রতার প্রকাশ অনবদ্য —
কঙ্গোর কবি সেইন্ট আন্তন লে দা’র
‘জন্মেছি আফ্রিকায়’ কবিতায় পরিস্ফুটিত।—

‘আমার জন্ম আফ্রিকায়
যুদ্ধ ও দারিদ্র্যের মাঝে
আমি আমার দেশ আফ্রিকাকে ভালোবাসি
আমি আফ্রিকাকে রক্ষা করব।

আমার জন্ম আফ্রিকায়
ভিনদেশীদের জন্য সবচেয়ে ধনী দেশ
আমাদের মায়েদের জন্য নরক
আমি অবশ্যই আফ্রিকাকে রক্ষা করব।…………….’

ফিলিস্তানের কবি মাহমুদ দরবিশের কবিতাটিতেও একি ভাব পরিলক্ষিত।—

‘আমি একজন আরব
আমার একটি উপাধিহীন নাম আছে
অসুখে পড়ে রই একটা দেশে
যেখানে মানুষ ক্ষেপে আছে
আমার ঠিকানা
দৃঢ়ভাবে গেঁথে আছে ঘড়ির কাঁটা আবিষ্কারের আগে
যুগের উৎপত্তির আগে
পাইন ও জলপাই গাছের ও আগে
এবং ঘাস বেড়ে ওঠার আগে।’

অথবা দরবিশ এর ‘আশা’ কবিতাটির প্রতীকী অর্থ বুঝতে একটুও বেগ পেতে হয় না।—
“তোমার পাত্রে এখনো কিছুটা মধু আছে
মাছি তাড়িয়ে সেটা রক্ষা করো
এখনো বাগানে আঙুর ঝুলছে থোকায় থোকায়
হে প্রহরী, শেয়াল তাড়াও
তারপর, আঙুরগুলো ভালো মতো পাকবে।
তোমার ঘরে এখনো দরজা ও মাদুর আছে
বাতাসের দ্বার রুদ্ধ করে তোমার শিশুদের বাঁচাও”……


যে বিষয়টির কারণে অনুবাদের প্রতি মানুষ আস্থা রাখতে পারেনা সেটি হলো কবি মনের আর্তি,ভাব ভাবনার তীব্রতা, রস অনুবাদে ঠিকমতো আসে না, যার কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনুবাদকে খড়ের তৈরি গরুর বাছুরের সাথে তুলনা করেছেন।
‘পরদেশী ১০০ কবিতা’ আশ্চর্যজনক সেসব ত্রুটি থেকে মুক্


বইটি পড়লে মনে হয়না অনূদিত বই পড়ছি।— যেমন:

” আমি নাম-পরিচয়হীন! তুমি কে?
তুমিও কি তাই?
তাইলে আমরা দুইজনেই এক!
কাউকে বলো না – তারা আবার ছড়িয়ে দেবে-জানো!
পরিচিত হওয়া কত ভয়ংকর!
কতটা নগ্ন-এক্টা ব্যঙের মতো-
সারাটা জনম পার করে দেয়া–
আমি আমি বলে
নর্দমার কীটের কাছে।”—ডিকিন্স।

‘তুমি জানতে চাইবে আমার জন্মদিন কখন
সুতরাং লিখে নাও যা তুমি জানো না।
যেদিন তুমি তোমার প্রেম ঘোষণা করেছিলে
সেদিনই আমার জন্মদিন।’
—’আরবদেশী কবিতা’।

কাব্য ও সাহিত্যগুণ এবং শৈলীগত বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে রচনার শিল্পমানে উত্তীর্ণ অনূদিত কবিতা সংকলনটি।
বৈশ্বিক কবিতার এনসাইক্লোপিডিয়া না হলেও তার স্বাদ কিছুটা পাওয়া যায় বইটি পড়ে।

অনুবাদক আলমগীর মোহাম্মদ তাঁর অনুবাদচর্চার এ-ই ধারা অব্যাহত রেখে বিশ্বসাহিত্যের বিচিত্র শিল্পসাহিত্যের নানাবিধ ভাব ভাবনা রস আস্বাদন করিয়ে দিক সে শুভকামনা রইলো।

গিয়াস মামুন: শিক্ষার্থী- চতুর্থ বর্ষ, বাংলা বিভাগ, চচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন