বিজ্ঞান-ধর্মবোধ-কল্যাণ চিন্তা…
জগলুল আসাদ
বিজ্ঞানকে প্রায়শই আমরা স্বয়ম্ভু মনে করি। অথচ,বিজ্ঞানকে কাজ করতে হয় এক বৃহৎ নেটওয়ার্কের ভেতরে। বিজ্ঞানের জন্যে ল্যাবরেটরিই সব নয়। পরীক্ষাগারেরও আগে ও পরে আছে বহু বিষয় ও প্রসঙ্গ।
সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, মতাদর্শ,পুঁজি ও ক্ষমতার সাথে বিজ্ঞানের যে সম্পর্ক, সেগুলো অনেকেই ভুলে যায়। অনেক সময় বিশেষ ধরণের সমাজ ও সংস্কৃতি বিশেষ বিশেষ বিষয়ে গবেষণা চালায়। অনেক গবেষণা হয় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সমাজের চাহিদা আছে ব’লে। আর, ওই গবেষণার ফলও ভোগ করে ওই বিশেষ সমাজ, যদিও ধীরে ধীরে পূঁজির নিয়মে তা অন্যান্য সমাজেও ছড়িয়ে পরে। কিন্তু এগুলো কেউ বিনা পয়সায় পায়না। যাহোক, প্রথমে সমাজই কোন গবেষণার চাহিদা তৈরি করে, আর ঐ গবেষণার ফলও সমাজেই ফিরে আসে। সে হিসেবে প্রারম্ভ ও প্রান্তে থাকে সমাজ, মধ্যিখানে বিজ্ঞান। অনেক পণ্যউৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নিজেদের পণ্যের পক্ষে গবেষণাকে আনার জন্যে ফান্ডিংও করে থাকে। আবার, তা বৃহৎ বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গেঁথে দেওয়া হয় ভোক্তাদের আবেগে ও বাসনায়। বিজ্ঞাপনের জগত বিজ্ঞান বোঝে না, বুঝে মুনাফা। পিটার সিংগার তাঁর Animal Liberation: A new ethics for our treatment of animals বইয়ে হিসেব করে দেখিয়েছেন, দুধ ও মাংসের জন্যে ক্যাপিটালিস্ট ফার্মিয়ে কী পরিমাণ পশুর উপর কী পরিমাণ নিষ্ঠুরতা চালালে প্রাপ্য ক্যালোরির চাহিদা মিটানোর উপযোগী মুনাফা করা যাবে।
তাছাড়াও, বিজ্ঞানের গবেষণার জন্যে প্রায়শই প্রয়োজন হয় রাষ্ট্রীয় বরাদ্দের, যেখানে আছে আবার নানা রকম আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। রাষ্ট্রীয় বা বৃহৎ করপোরেশনের আর্থিক প্রণোদনার উপর বিজ্ঞানের বড় বড় প্রজেক্টগুলো নির্ভরশীল। এগুলো Big Science নামে পরিচিত। বিজ্ঞানের এই বৃহৎ প্রকল্পগুলোর পেছনে আছে করদাতাদের অর্থ। তাছাড়াও, বিজ্ঞানীদেরও আছে পেট ও পাকস্থলী, নিরাপত্তার জরুরত। এগুলোর সাথে জড়িত রাষ্ট্র। উদ্ভাবিত কোন তত্ত্বের যদি প্রায়োগিক মূল্য থাকে, তবে তা প্রবেশ করে প্রযুক্তিবিদ্যার জগতে। সেই ক্ষেত্রে তা প্রায়শই বৃহৎ কোম্পানি বা করপোরেশনের মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার হয়। সেগুলোর মালিকানা থাকে বৃহৎ পুজির অধিকারীদের হাতে, আর সেগুলোর সুফলও ভোগ করে প্রথমত ও প্রধানত বিত্তবানেরা। ধরা যাক, করোনার ভ্যাক্সিনের কথা। ভাবছেন, আপনের হাতে আইসা পড়বে তা? অসম্ভব। এইটা নিয়ে বাণিজ্য হবে, মুনাফার খেলা হবে। ভিয়াইপি হাসপাতালের কথাই ধরেন! বিজ্ঞান যাদের হাতে আছে, আপনার জন্যে তারা রেখেছে লবডঙ্কা! আপনি বাসায় ধুকে মরবেন। তাহলে বিজ্ঞানকে পুঁজি ও ক্ষমতার শাসনের বাইরে কিন্তু রাখা যাচ্ছে না, বিদ্যমান ব্যবস্থায় ।
দুটো উদাহরণ দিই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আবহাওয়া ও পরিবেশ বিষয়ক গবেষণার বেশ তোড়জোড় শুরু হয়। কারণ ছিল,কীভাবে আবহাওয়াকে অস্ত্রে রূপান্তরিত করা যায়, শত্রুদেশকে কৃত্রিম বন্যা ও খরা দিয়ে পর্যুদস্ত করা যায়। আবার, ষাটের দশকে আমেরিকায় মঙ্গলগ্রহে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করা যায় কিনা এই উদ্দেশ্যে মঙ্গলগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব বা মাইক্রোবিয়াল লাইফের কোন অস্তিত্ব আছে কিনা তা নিয়ে গবেষণা শুরু হলো ব্যাপকমাত্রায়। অর্থাৎ, বিজ্ঞানকে বিচ্ছিন্ন, মূল্যনিরপেক্ষ ও মতাদর্শ-মুক্ত মনে করার কোনই কারণ নাই।
প্রযুক্তির বণ্টনেও থাকে শ্রেণীগত অগ্রাধিকার। তাছাড়াও, প্রযুক্তির ন্যয্য বন্টনে দরকার হয় নৈতিক-ব্যবস্থাপনার। ধরা যাক,রোগ বালাই থেকে সুরক্ষা সামগ্রীর কথা । নীতিগত ভাবে এটা সবার সাধারণ প্রয়োজন, কিন্তু বিশেষভাবে প্রয়োজন ডাক্তারদের। বিদ্যমান ব্যবস্থায় এই বিশেষ ও সামান্যের হিশাব মিলাতে ঔচিত্যবোধ ও ‘নৈতিক’ বিবেচনার চেয়ে ক্ষমতা-সম্পর্ক ও শ্রেণীস্বার্থই প্রাধান্য পাবে । বিজ্ঞানকেও মানুষের কাজে ঠিকঠাক মতো লাগাতে দরকার হয় নৈতিক কাঠামোর, বা অন্তত নিদেন পক্ষে ব্যক্তিগত শুভবোধ, ধর্মবোধ । প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক সময় অনেক এথিকাল প্রশ্নের জন্ম দেয়, সেগুলোর সমাধান করতে হয় সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মবোধের ভেতর থেকে।
তাছাড়াও, বিজ্ঞানের জগতে আন্তশাস্ত্রীয় লেনাদেনার ব্যাপারও আজকাল বলা হচ্ছে। ধরা যাক, কারো খুব আগ্রাসী হওয়ার স্বভাব৷ এটাকে ব্যাখা করা যাবে জেনেটিক্স দিয়ে, নিউরোবায়োলজি দিয়েও, আবার সমাজ বা মনস্তত্ব দিয়েও। এই ব্যখ্যায় বিজ্ঞানই একমাত্র শুদ্ধ সত্যের দাবিদার হয়ে হাজির হতে পারবে না। আবার, বিজ্ঞানের ভেতরে যে শাখাপ্রশাখা গুলো আছে, সেগুলোও একে অপরকে সাহায্য করতে হয়। ঔষুধ শাস্ত্র নির্ভর করে বায়োকেমিস্ট্রির উপর , মেডিকেল যন্ত্রপাতির জন্যে চিকিৎসাবিদ্যার নির্ভরশীলতা পদার্থবিদ্যার উপর। রোগীকে ডীল করতে জানা দরকার হয় হিউম্যান সাইকোলজি। বিজ্ঞানাগারের বিজ্ঞানীকেও নির্ভর করতে হয় ব্যবস্থাপনাবিদদের উপরও। টাকা-পয়সার হিসাব-কিতাবের জন্যে প্রয়োজন হয় হিসাব-নিরীক্ষকদের। সবাই সবার উপর নির্ভরশীল। সবাই আমরা এক নেটওয়ার্কের অংশ। উই অল আর কন্ট্রিবিউটিং ইন আওয়ার রেস্পেক্টিভ ওয়ে।
তাছাড়াও, সংস্কৃতি ও ধর্মবোধও উৎসাহিত করতে পারে বিশেষ বিশেষ গবেষণাকে । “সকল রোগের চিকিৎসা আছে ” এই হাদিস বা নামাজের সময় নির্ধারণ, চন্দ্র-সূর্যের হিসাব, জমির আইলের হিসাব, শরিয়াত অনুযায়ী উত্তরাধিকার বন্টনের হিসাবের জন্যে মুসলিমরা চিকিৎসাবিদ্যা, মহাকাশবিদ্যা, গণিত ইত্যাদি চর্চা করেছে। তাছাড়াও, আরো অনেক বিষয়ের গবেষণা হতে পারে,ধর্মীয়বিধিবিধান প্রমাণ ও পালনের জন্যে। হবেও, হচ্ছেও। একটা ইসলামি দেশ কোন বিষয়ে গবেষণার ফান্ডিং করবে ও গবেষণার মাকসাদ কি হবে, তা অ-মুসলিম দেশ থেকে ভিন্ন হতে পারে অনেক সময়। জগদীশ বসু যদি ভারতবর্ষের না হতেন, হিন্দু না হতেন তবে গাছের যে প্রাণ আছে (গাছ সাড়া দেয়) এই বিষয়টা নিয়ে গবেষণার “ইচ্ছে” টারই জন্ম হতো কিনা, সন্দেহ। হিন্দুধর্মীয় সর্বপ্রাণবাদের যে-বিশ্বাস, তা যে তার গবেষণাকে উদ্দীপিত করেনি, বলি কি করে।( জগদীশকে নিয়ে আমার দীর্ঘ লেখা আছে)।
বিজ্ঞান একটা মেথড ও ট্যুল। কিসের? প্রকৃতির “সত্য” উদঘাটনের ঘোষিত লক্ষ্য ছাড়াও, ধর্ম বা নীতিশাস্ত্র যে সুন্দর জীবনের কথা বলে, যেমন এরিস্টটল বলেন Eudaimonia বা সুন্দর জীবনের কথা বা ইসলাম বলে আহসানু আমালা বা আমালে সালিহ’র কথা, সেটার । আর ধর্ম কোন টুল না। এটা জীবনব্যবস্থা । ধর্ম বিজ্ঞানকে কাজে লাগায় ; বিজ্ঞানের জন্যে ধর্ম দেয় নৈতিক কাঠামো। ইসলামের ইশারা ধরে বিজ্ঞান-গবেষণার সম্ভাবনাও অসম্ভব নয়। বিজ্ঞান থেকে ধর্মচারীও উপকৃত হয়, আর মানুষের মুল্যবোধ বা শুভবোধ বা ধর্ম, যা-ই বলেন, তা-ও উপকৃত করতে পারে বিজ্ঞানের বন্টন ও ব্যবহারকে । একটা “ন্যয্য” সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হলে বিজ্ঞানও যথাযথ ফাংশন করতে পারে না। যারা বিজ্ঞানকে নিঃসঙ্গ করে ফেলে, তারা সমাজ-রাষ্ট্র ও ক্ষমতা-সম্পর্কে জ্ঞানহীন, অর্বাচীন।
সহজ কথায়, বিজ্ঞান কোন অমুখাপেক্ষী ও স্বয়ম্ভু বিষয় নয়। এর সাথে অর্থনীতি, রাষ্ট্র, পুঁজি, শ্রেণী, সংস্কৃতি,মূল্যবোধব্যবস্থাসহ বহু কিছু জড়িত। বিজ্ঞান একা লড়েনা, সাথে বিজ্ঞানীর স্বপ্ন, আশা,ধর্মবোধও লড়ে। সাথে লড়ে সমাজের অপরাপর ব্যবস্থা ও এজেন্সি। আর দরকার, বিজ্ঞানকে সকলের জন্যে ব্যবহার ও উন্মুক্ত করবার জন্যে একদল “পরিশুদ্ধ” হৃদয়ের মানুষ –যারা লোভ-লালসা,ব্যক্তিগত ও শ্রেণীস্বার্থমুক্ত হয়ে দশের কল্যাণকামী হবে । নফস ও হৃদয়ের চাওয়া, লোভ, কামনা ও বাসনাকে পূরণ বা নিয়ন্ত্রণ করবার জন্যেই তো যতো আইন ও প্রতিষ্ঠান। তাই হৃদয় পরিশুদ্ধির যে-ব্যবস্থাপনা , যাকে দ্বীন-ধর্ম নামেও ডাকা হয়, তাকেও যেন ভবিষ্যতে বিবেচনায় রাখি। অন্তর প্রসারিত হলে দেখবো, আজ লক-ডাউনে যে না খেয়ে আছে, সে-ও কম লড়াকু নয়। যে একা একা অশ্রুতে জায়নামাজ ভিজাচ্ছে, সে-ও লাড়াইয়ের ময়দানেই আছে। যে নির্বেতনে মাস অতিবাহিত করছে , সে-ও আছে লড়াইয়ের ময়দানেই… …
জগলুল আসাদ : লেখক ও চিন্তক। সম্পদাক : চিন্তাযান।