বানর রাজা চীনা পুরাণ (উপন্যাসিকা) শেষপর্ব
চীনের এক সুপার হিরোর গল্প (দ্যা জার্নি টু দ্যা ওয়েস্ট থেকে)
অ্যারন শেপার্ড অনুবাদ পান্থজন জাহাঙ্গীরপ্রিরিভিউ:
আপনি যদি সুপারম্যান বা স্পাইডারম্যানের কাহিনী দীর্ঘকাল ধরে থাকবে বলে মনে করেন তাহলে এই বানর সম্পর্কে একবার ভাবতে পারেন সে চীনের সুপার হিরো হিসেবে পাঁচশত বছর ধরে জনপ্রিয় হয়ে আছে। সে আশ্চর্যজনকভাবে শক্তিশালী, সে উড়তে পারে এবং তার এমন কিছু কৌশল জানা আছে যা অন্য সুপার হিরোরা কখনো শুনেইনি। আর সে সবসময় প্রস্তুত, শয়তান, ড্রাগন এবং কখনো দেবতা বা ঈশ্বরের সাথে যুদ্ধ করতে। এই বানর ষোড়শ শতাব্দীর দ্যা জার্নি টু দ্যা ওয়েস্ট নামক এক মহাকব্যিক কমিক ফ্যান্টাসির নায়ক। বানরের যে কাহিনীটি এখানে পুনর্কথিত হয়েছে তা হচ্ছে তার উৎপত্তি ও শুরুর দিককার ক্যারিয়ার-এবং একসময় সে আর উপর থেকে বের হয়ে আসতে পারেনা। অথচ সে অমরত্ব এবং জাদুশক্তি লাভ করার পর স্বর্গকে চ্যালেঞ্জ করে।
ধরণ:ফ্যান্টাসি, সংস্কৃতি:চায়না, থিম:ঔদ্ধত্য।
শেষপর্ব: পাথরে প্রত্যাবর্তন
-আপনি এটা আমার সাথে করতে পারেন না! বানর চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল। আমি বানর রাজা! আমি একজন অমর! আমি স্বর্গের সমান সাধু। আমাকে বের করুন!
তিনি কোনো সদয় বিবেচনা করলেন না। তারপর বানর চিৎকার দিয়ে বলল, দয়া করুন!
স্বর্গের সর্বোচ্চ স্থানে সোনালী দরজার মেঘ প্রাসাদের বাইরে বুদ্ধ জাদি বাদশাহ ভদ্র মহিলা রাণী মা, এবং প্রভু ডাউ টিজু থেকে প্রগাঢ় ধন্যবাদ ও অভিনন্দন গ্রহণ করছেন, কিন্তু অবশেষে তিনি বলেলন, এখন আমাকে অবশ্যই পশ্চিম স্বর্গে আমার শিষ্যদের কাছে ফিরে যেতে হবে।
তিনি দয়া ও সহানুভূতি দেবী জোয়ান ইন এর দিকে তাকালেন এবং বললেন, আপনি কি আমার সাথে যাবেন?
এর পর দুজনই জাদুর মেঘে ভেসে পশ্চিমে চলে গেলেন। গোয়ান ইন মৃদুস্বরে বলেলন, কোনো সন্দেহ নেই যে, বিদ্রোহী অমররা কঠোর শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু চিরস্থায়ী দন্ড হিসেবে একটু কি কঠিন হয়ে গেল না?
তার শাস্তি অনন্ত নয়, বুদ্ধ বললেন। আপনি স্মরণ করতে পারেন আমি একদা আাপনাকে এই বেয়াদব বানর সম্পর্কে বলছিলাম। সে নিয়ত করেছিল যে সে জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত হবে, একজন বুদ্ধ হবে।
এবং কিভাবে আসলো সে, জোয়ান ইন জিজ্ঞেস করলেন।
আজ থেকে পাঁচশত বছর আগে, বুদ্ধ বললেন।
মধ্য রাজ্য থেকে পশ্চিম স্বর্গে আসার জন্য এবং পবিত্র ধর্মীয় স্মারক বহন করার জন্য আমার একজন দূত প্রয়োজন হবে। তোমার দায়িত্ব হবে এই মূল্যবান কাজের এর জন্য একজন পুরুষ বা মহিলা খুঁজে বের করা। এই সময়েই এই দীর্ঘ বিপদজনক ভ্রমণ থেকে দূতকে রক্ষা করার জন্য আপনি আমাদের অনুতপ্ত বানর বন্ধুকে নিয়োগ দিবেন। এটি করতে গিয়ে বানরটি তার পাপের প্রায়চিত্ত করবে এবং জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত হবে।
বুদ্ধের দয়ার কোন সীমা নেই। জোয়ান ই বললেন। বুদ্ধ ও বোধিস্থ দুজনই মুচকি হাসলেন এবং আলতোভাবে একে অপরের হাত স্পর্শ করলেন ।
অনেক দূরে অস্তগামী সূর্যের আলোয় থান্ডারক্লেপ মন্দির জ্বলজ্বল করছে।
গল্পটি সম্পর্কে : সব চীনা সাহিত্যে বানর সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় চরিত্র। শতাব্দি ধরে বানর যুবা,বৃদ্ধ সবার ভালোবাসার পাত্র। ষষ্টদশ শতাব্দির একটি ক্লাসিক উপন্যাসে তার এ গল্প পাওয়া গিয়েছে। দ্যা জার্নি টু দ্যা ওয়েস্ট এবং পরে চীনা অপেরা থেকে কমিকস বইগুলোতে অগণিতভাবে তার এ চরিত্র সন্নিবেশিত হয়েছে। দ্যা জার্নি টু দ্যা ওয়েস্ট উপন্যাসটি লেখা হয় বেনামীভাবে। কিন্তু এটার জন্য প্রায়ই সন্মান জানানো হয় কমেডিয়ান ও চেং এন কে তার এক মহাকাব্যিক ফ্যানটাসির জন্য। আমার পুনর্কথনে মাত্র সাত অধ্যায় সন্নিবেশিত হয়েছে। যার আকার একটি বড় উপন্যাসের ভূমিকার মতোই। উপন্যাসটির পরিধি পরিগণিত করা হয় বুদ্ধের সন্ন্যাসী স্যানজং পশ্চিম স্বর্গের বুদ্ধের কাছ থেকে পবিত্র ধর্মীয় স্মারকগুলো আনা নেওয়ার কাজে সাহায্য করার জন্য বানর এবং কিছু জাদুকরী প্রাণী ব্যবহার করছিলেন। চীনা পুরাণে বানরের এই এডভেঞ্চার বুদ্ধ ধর্ম এবং তাওদের এক সমৃদ্ধ উপাদানে এক রুদ্ধশ্বাস ভ্রমণ প্রবাহ সৃষ্টি করে। নিচে উপন্যাসটিতে ব্যবহৃত কিছু শব্দও চরিত্রের টীকাভাষ্য দেয়া হলো।
জাদি বাদশাহ ও স্বর্গ: জাদি বাদশাহকে স্বর্গ ও মর্ত্যের শাসক বলা হয়। তিনি একজন দোর্দন্ড প্রতাপশালী শাসক হলেও কিন্তু পরম ক্ষমতাবান কোনো দেবতা নয়। বাস্তবে তিনি চীনের সর্বোচ্চ তিন কিংবদন্তি বুদ্ধ, ডাউ টিজু এবং কনফুঁসিয়াসের অধীন। যারা আবার নিজেরাই বিশ্বভ্রমান্ডের পরম শক্তির অধীন।
চীনা স্বর্গের ডিজাইন হচ্ছে চীনা সম্রাটের সরকারি রাজ প্রাসাদের আদলে গড়া। অন্যকথায়, এটা সম্পূর্ণই চীনা বুর্জোয়াতন্ত্র যেখানে অসংখ্য কর্মী জাকজমক পদবী নিয়ে বসে আছেন। যারা আঙ্গুলের ইশারায় পৃথিবীর কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করেন।
ডাউ টিজু, অমরত্ব, ধর্মগুরু, সুবুদ্ধি: শত শত বছর আগে একটি সংগঠিত ধর্ম দ্বারা তাওবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল ভারতের যোগ পদ্ধতির আদলে একটি আধ্যাতিœক মতবাদ । এই তাওবাদের অনুসারীরা এই গল্পে ধর্মগুরু, সুবুদ্ধি ও শিষ্য হিসেবে পরিবেশিত হয় এবং পর্বতের সেই সুন্দর কুটিরে তারা বাস করতো। এ পথের যাত্রীদের লক্ষ্য হলো দেহের চেতন আত্মাকে উন্নয়ন করে অমরত্ব লাভ করা। কিন্তু অধিকাংশ চীনাদের জন্য এটা বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিল যে তাও প্রভুরা শারীরিক অমরত্ব লাভ করেছিল।
তাওবাদের প্রতিষ্ঠাতাকে বলা হয় ডাউ টিজু। তিনি স্বর্গীয় লোক বলে পরিচিত পেয়েছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত তিনি ছিলেন বলে মনে করা হয়। যদিও অমরা নিশ্চিতভাবে জানিনা তিনি আদৌ বেঁচে ছিলেন কিনা। আরো ধারণা করা হয় যে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত চীনা ক্লাসিক তাওবাদের প্রাথমিক বই ÔTao Te Ching (Book of the Way) তিনিই লিখেছিলেন।
তাও সাহিত্যে আধ্যাত্মিক মতবাদের গোপনীয়তাগুলো আলকেমির মেটাফোরিকেল সাংকেতিক ভাষায় প্রতীকায়িত থাকতো। তাই ডাউ টিজু ও অন্যান্য তাও ব্যক্তিদের জীবন রক্ষকারী জাদুর নিরাময়ের অমরত্বের বড়ি তৈরির, আলকেমির মাষ্টার মনে করা হতো। সিন্দুর বা মার্কারিক এসিড যেটি আমি ডাউ টিজুর প্রাসাদের নামের জন্য ব্যবহার করেছি-ওটিই ছিল আলকেমির প্রধান উপাদান।
বুদ্ধ, বোধিস্থ, পশ্চিম স্বর্গ: বুদ্ধ হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা সিদ্ধার্থ গৌতমের উপাধী। এখন স্বর্গীয় মানুষ হিশেবে পরিগণিত হয়। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৫৬৩ থেকে ৪৮৩ তে ভারতে বাস করতেন।
বুদ্ধ উপাধির অর্থ জ্ঞানালোক প্রাপ্তদের একজন। অথবা জাগ্রত একজন। তাই এই উপাধি বৌদ্ধরা প্রায় প্রয়োগ করেন- শুধু সিদ্ধার্থের জন্য ব্যবহার করেন না। অধিকন্তু, যারা তার এ মনের অবস্থা লাভ করেন তাদের জন্যও ব্যবহার করেন। এটা এমন একটা অবস্থা যা বাস্ততবতার প্রকৃত সত্যকে প্রত্যক্ষণ করা এবং অতিরিক্ত জীবনের জন্য প্রয়োজনকে মুক্তি দেয়া। বোধিস্থ হচ্ছে এর সাথে সম্পর্কিত একটি উপাধি যেটি তার জন্য ব্যবহার করা হয় যিনি জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত হয়েছেন কিন্তু মর্ত্য থেকে গিয়েছেন অন্যদেরও সে লক্ষ্যে পৌঁছতে সহযোগিতা করার জন্য ।
পশ্চিমা স্বর্গ হচ্ছে সে জায়গা যেখানে মৃত্যুর পর ভালো বুদ্ধরা বসবাস করেন। এটি এমন একটি সমগোত্রীয় বা সমমনোভাব সম্পন্নদের জায়গা যেখানে তারা বুদ্ধ হওয়ার শিক্ষাগুলো দ্রুত উন্নতি লাভ করে। এটিই একমাত্র বুদ্ধবাদ শিক্ষা দেওয়ার বিশুদ্ধ জায়গা। যেটি পূর্ব এশিয়ায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। ‘Journey to the West’এ পশ্চিমা স্বর্গ হচ্ছে বুদ্ধের বর্তমান দেশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। মনে করা হয় এটি ভারতের কোনোখানে।
জোয়ান ইন: চীনের জনপ্রিয় স্বর্গীয় মানুষেদের মধ্যে বোধিস্থ জোয়ান ইন কে সাধারণত দয়ার দেবতা হিসেবে ধরা হয়। তাদের কাছে তিনি বুদ্ধ, ডাউ টিজু, জাদি বাদশাহ, কনফুঁসিয়াসের চেয়ে অধিক পূঁজণীয় ও ভালোবাসার মানুষ। তার নামের মানে হচ্ছে-কান্নায় মনোযোগি হওয়া। তিনি শুনেন এবং সবাইকে সাহায্য করেন। যারা তার সহযোগিতার জন্য তার কাছে কান্না করেন। এবং সে সব অসহায় শিশুদের তাদের আবার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেন।
চীন সাগরের ড্রাগন রাজা: চীনা পুরাণে ড্রাগন হচ্ছে সবচেয়ে দয়ালু চরিত্র। তারা বড় বড় পুকুর এবং হ্রদের পানির নিচে থাকে। তারা যখন বৃষ্টি নামানোর মতো তাদের প্রধান কাজগুলো করেন তখন তারা উড়তেও পারেন । চীন সাগরে একজন ড্রাগন রাজার অধীনে চারজন ড্রাগন রাজা রয়েছেন। তাদের জাকজমক প্রাসাদ ও সম্পদ কিংবদন্তী তুল্য।
ইয়াহমা,মৃত্যুর রাজা,এবং অন্ধকার রাজ্য:অন্ধকারের রাজ্য হচ্ছে চীনের নরক। এটি মাটির নিচে নয় কিন্তু এক প্রকার সমান্তরাল মাত্রায় রয়েছে। যখন লোকজন তাদের মৃত্যুর জন্য সেখানে স্থায়ীভাবে চলে যায় শয়তানের কর্মকতারা তাদের আত্মাকে গ্রেপ্তার করে এবং তাদের প্রভু ইয়াহমার কাছে নিয়ে যায়। যিনি হচ্ছেন মৃত্যুর প্রথম বিচারক। যদি তাদের পূণ্য তাদের পাপের সমান হয় তাহলে তাদেরকে দশম বিচারকের কাছে পুর্নজন্মের জন্য পাঠানো হয়। আর পাপ বেশি হলে তাদের অবশ্যই খারাপ কর্মের ফল ভোগ করার জন্য অন্য বিচারকের কাছে পাঠানো হয়। বিশেষত: ভালো আত্মাগুলোকে অন্ধকার রাজ্যে আদৌ আনা হয়না । আনা হলেও তা খুব অল্প সময়ের জন্য। তাদেরকে স্বর্গে পাঠানো হয় বিভিন্ন অফিসিয়াল পদ লাভ করার জন্য অথবা কখনো বুদ্ধের পশ্চিমা স্বর্গে বা কখনো কুনলুন পর্বতে তাও অমরদের বাড়িতে।
ভদ্র মহিলা, রাণী মা: ‘Journey to the West’ এ রাণী মা হলেন জাদি বাদশাহর স্ত্রী। তিনিও স্বর্গে বাস করেন। অন্য কোথাও যেমন কুনলুন পর্বতের শাসক, পশ্চিমে তাও অমরদের বাড়িতে তিনি রাণী মা হিসেবে পরিচিত। আবার তিনি বাগানের পরিচর্যাও করেন যেখানে অমরত্বের পিচফল উৎপাদিত হয়।
আমার পুনর্কথনে বানরের গল্পটি সরল ও সংক্ষিপ্তভাবে এসেছে কিন্তু বিস্তারিত ভাবে মূল গল্পের লাইনকে অনুসরণ করা হয়েছে।
-অ্যারন শেপার্ড
[উপন্যাসটি অ্যারন শেপার্ড এর অনুমতি সাপেক্ষে অনুবাদ করা হয়েছে এবং পুবাকাশে প্রকাশিত হয়েছে।] অনুবাদক
পান্থজন জাহাঙ্গীর,জন্ম:১৫অক্টোবর,১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম। আগ্রহ:গল্প,কবিতা,অনুবাদ
প্রকাশিত গ্রন্থ:
১.সক্রেটিসের ভাবশিষ্য (কিশোর গল্প) অগ্রদূত অ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা -২০১৮
২.শহরবানু (বড় গল্প) অগ্রদূত অ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা -২০১৯
৩.বরপাখি ও কনেপাখি (শিশুতোষ গল্প) অক্ষরবৃত্ত প্রকাশন চট্টগ্রাম-২০২০