ফাঁদ।। রওশন রুবী।।পুবাকাশ

“হায় আল্লাহ্!” আঁতকে ওঠে ববি। পকেট হাতড়ায়। হাতের কব্জি দেখে। ঘড়ি, টাকা, মোবাইল কিছুই পায় না।
ববির মেঝ মামার তন্দ্রা টুটে যায়। তিনি ববিকে বলেন, “কি খুঁজছো?” ববি বলে সে কি খুঁজছে। তিনি বলেন, “সে সব খুঁজে লাভ নেই। প্রাণে বেঁচে গেছো। সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় কর। ভাগ্যিস আমার কার্ডটা ছিল তোমার পকেটে। লোকজন তোমাকে হাসপাতাল ভর্তি করিয়ে ফোন করল। নয়ত খবরই পেতাম না।”
ববি শিউরে ওঠে। ওফ্ কী ভয়ঙ্কর মানুষ এরা! ববির মামা বললেন, “ভাবিও না। আমার বন্ধু তারেক ডিবি অফিসার। ওকে ফোন করে তোমার বিষয়টি বলেছি।”

ববি ট্রেনলাইন দিয়ে হাঁটছিল। মৃদুমন্দ বাতাসে হাঁটতে ভালো লাগছে। ওর পাশ ঘেঁষে চলে গেছে একটি ট্রেন। মানুষ জন কেমন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ঘড়ি দেখল ববি। দুটো বাজবার পনেরো মিনিট বাকি। অন্তঃনগর ট্রেন আসবারও তাহলে পনেরো মিনিট বাকি।
ববি প্লাটফর্মের দিকে এগিয়ে এলো। দোকান থেকে একটি সিগারেট নিল। লাইটার পকেটেই আছে। একটু সরে গিয়ে সিগারেট ধরালো। সামনে এসে দাঁড়ালো নয় দশ বছরের হাড্ডিসার একটি ছেলে। ওর চোখগুলোতে মায়া ঢলে পড়ছে। ওর তামাটে হাতে ধরা মাক্সের একটি প্যাকেট। যার অর্ধেক বিক্রি করে ফেলেছে। তাকে অনেক্ষণ এই প্লাটফর্মে দেখেছে ববি। এখানকার হকার হয়ত। ছেলেটি মাক্সের ভেতর থেকে বলল, “ স্যার একটা সার্জিকেল মাক্স লন। একদম ফ্রি।”
ববি অবাক ছেলেটির কথা শুনে। ছেলেটির হাতে ধরা মাক্সটি বেশ উন্নত। অন্তত তার মাক্স থেকে। এত ভালো মাক্স ফ্রিতে! একটা নিয়েই নিল ববি। ছেলেটি মাক্স দিয়ে শিষ দিতে দিতে অন্যদিকে চলে গেল। ববির পাশে তখন ট্রেনের অপেক্ষায় ক’জন যাত্রি এসে দাঁড়িয়েছে। একজন ভিক্ষুক এসেও চাইল কিছু। ববি দশটাকা দিলো।
সিগেরেট টানা শেষ করে নিজের পকেটের মাক্সটি বের না করে ফ্রিতে পাওয়া মাক্সটি পরে নিল ববি। ট্রেন আসবার ঘোষণা হচ্ছে। ববি গন্তব্যের দিকে এগুলো।
তখন গভির রাত হবে। হাল্কা আলো জ্বলছে রুমে। একশো বোল্টের বাল্ব হবে। আজকাল এই বাল্বের চল প্রায় উঠে যাচ্ছে। কিন্তু এখানে এটিই আলোর উৎস। ববি অনেক কষ্টে চোখ খুলে চাইল। তার মুখের উপর ঝুঁকে আছে ক’টি উদ্গ্রীব মুখ। ও ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। আবার চোখ বন্ধ করল।
“ববি! এই ববি! ববি!”
মেঝ মামার গলা। প্রতিবারই উত্তর দিচ্ছে ববি। মামা কেন তাকে ডেকেই যাচ্ছেন, ডেকেই যাচ্ছেন? বুঝে না ববি। সে আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
ভোরের আলো এসে পড়ছে রুমে। সরগম করছে রুমটি। রুগির চেয়ে ভিজিটার বেশি। ববি চোখ মেলে দেখল, মেঝ মামা তার বেডের পাশে প্লাস্টিকের মোড়ায় বসে ঝিমোচ্ছেন। ও কি জন্য বা কি করে এখানে এলো মনে করার চেষ্টা করল।
সে যাচ্ছিল মেঝ মামার বাসা থেকে নিজেদের বাসায়। ঢাকা টু চট্টগ্রাম। মামার দেওয়া দশ হাজার টাকা ছিল সঙে। ট্রেন আসবার ঘোষণা হলো। সে সিগারেট নিভিয়ে মাক্স পরে প্লাটফর্মের দিকে এগুচ্ছিল। তারপর…
তাহলে ঐ তামাটে হাড্ডিসার ছেলেটির ফ্রিতে দেওয়া মাক্সটিই ছিল ফাঁদ? ঐ মাক্সেই মেশানো ছিল চেতনানাশক ঔষধ? “হায় আল্লাহ্!” আঁতকে ওঠে ববি। পকেট হাতড়ায়। হাতের কব্জি দেখে। ঘড়ি, টাকা, মোবাইল কিছুই পায় না।
ববির মেঝ মামার তন্দ্রা টুটে যায়। তিনি ববিকে বলেন, “কি খুঁজছো?” ববি বলে সে কি খুঁজছে। তিনি বলেন, “সে সব খুঁজে লাভ নেই। প্রাণে বেঁচে গেছো। সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় কর। ভাগ্যিস আমার কার্ডটা ছিল তোমার পকেটে। লোকজন তোমাকে হাসপাতাল ভর্তি করিয়ে ফোন করল। নয়ত খবরই পেতাম না।”
ববি শিউরে ওঠে। ওফ্ কী ভয়ঙ্কর মানুষ এরা! ববির মামা বললেন, “ভাবিও না। আমার বন্ধু তারেক ডিবি অফিসার। ওকে ফোন করে তোমার বিষয়টি বলেছি।”
দু’মাস পর ববি কাজে ঢাকায় গেল। ফেরার পথে গোলাপবাগ বাস স্টপে বাসের অপেক্ষায়। হঠাৎ ববি সেই ছেলেটিকে দেখতে পেল একঝলক। সিউর হতে সে এগিয়ে গিয়ে থামের পাশে দাঁড়ালো। নিজেকে প্রায় আড়াল করে রাখল চা বিক্রেতার দোকানে দাঁড়ানো লোকদের মাঝে।
হ্যাঁ, সেই ছেলেটিই। মামা বলেছিলেন, “আবার চোখে পড়লে, সাথে সাথে ফোন দিবি।” সে দ্রুত তার মামাকে ফোন করল।
আরিফ সাহেব কোটের কাজ শেষ করে সবে বেরিয়েছেন। ববির ফোন পেয়ে তিনি তার বন্ধু ডিবি অফিসার তারেককে ফোন করলেন। অফিসারেরা ফোর্স নিয়ে এলো। ইতিমধ্যে সেই ছেলেটি হাওয়া হয়ে গেল।
সেদিন সকালে মনিংওয়ার্ক করে এসে ফ্রেস হয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল ববি। চমকে উঠলো পেছনের পাতায় একটি ছবি দেখে। ছবিতে সেই মাক্স দেয়া ছেলেটির পাশে গোলাপবাগের চা দোকানদার ও ট্রেন স্টেশনের ভিক্ষুকটার সাথে আরো তিনজন। ছবির উপরে বড় বড় অক্ষরে লেখা “মাক্স দিয়ে ফাঁদে ফেলা প্রতারক চক্র অবশেষে ধরা পড়ল।”
কী মারাত্মক ব্যাপার! ভেবেই শিউরে উঠে ববি। কোথাও মানুষ তবে নিরাপদ নয়? সর্বত্রই ফাঁদ আর ফাঁদ!
রওশন রুবী : কথাশিল্পী।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন