পাঠ অনুভূতি ।। পান্থজন জাহাঙ্গীর।। পুবাকাশ
প্রেয়সী মুখ;বইমেলা২০১৮এ সায়েমাচৌধুরী‘র প্রথমকাব্যগ্রন্থ। সায়েমা চৌধুরী যেহেতু লিমেরিক লিখতে পছন্দ করেন সুতরাং তার ’প্রেয়সী মুখ’বইয়ের চল্লিশটি কবিতাই মূলত লিমেরিক।অর্থাৎ পাঁচলাইনের কবিতাকে সাধারণত লিমেরিক বলে।আর তার ছন্দ হচ্ছে
কক
খখ
ক
পাচঁ লাইনের কবিতার নাম লিমেরিক কেন হল? লিমেরিক আসলে একটা জায়গার নাম, এর নিজস্ব একটা ইতিহাস আছে, সে ইতিহাস লিমেরিকের মতই অদ্ভূত।পাচঁ লাইনের এই ছড়া বহুযুগ ধরেই ছিল
যেমন-
Hickory dickory dock
The mouse ran up the clock
The clock struck one
The mouse ran down
Hickory dickory dock
লিমেরিক আয়ারল্যান্ডের একটি জায়গার নাম, ফ্রান্সের সৈন্যদলের আইরিশ ব্রিগেডিয়াররা ওই লিমেরিকে অবস্থান কালে এই রকম ছড়ার গান গাইত, সেখানে ধূয়োর মত শেষ লাইনে থাকত এই কথাটি “ Let us come up to Limerick”. সূর করে কোরাসের মাধ্যমে, নিশ্চয় কোন অজানা কবির হাতে এই ধরনের গান চালু ছিল। সৈন্যারা হয়ত লিমেরিকের এই ধরনটার অনুকরনে মুখে মুখে ছড়া তৈরী করে মুখে মুখে গান গাইত। যূদ্ব শেষে যে যার বাড়ী চলে গেল গান শুনাল তাদের ভাবী বংশধদের। লিমেরিক থেকে আমদানি বলে এবং “Let us come to Limerick” এ শেষ কথাটি “Limerick” বলে ছড়াগুলোর নাম হয়ে গেল লিমেরিক।
নিজের কষ্ট নিয়ে যিনি কৌতুক করতে পারেন তারা অজানতে দিয়ে যান এক পবিত্র আকাশ। সে আকাশে থাকে রামধনুর শুষমা, রামধনু যদি হয় সে আকাশের হাসি তবে বৃষ্টি হল তার চোখের পানি, আর বৃষ্টির পানি নিয়েই তো রামধনুর যত চোখের রং।
কি জীবনে কি সাহিত্যে এডোয়াড’ লিয়র ছিলেন সে রকম একজন। তার মজার উৎসটুকু ছিল তার বেদনাবোধ। নিজের বেদনাটুকু নিছক হাসিতে রুপান্তরিত করে গেছেন, কেনা পড়ছে তার পঞ্চদশী সেই সব ছোট আকারের তৃতীয় ও চতুথ’ আকারে লাইনে মিল এবং অপেক্ষাকৃত বড় আকারের প্রথম, দ্বিতীয় এবং পঞ্চম লাইনে মিল। লিমেরিক ছড়া ছাড়াও তার আছে লিরিক ছড়ার সম্ভার। আর আছে তার চিত্রকর রুপে বিরাট পরিচয়। তার “ননসেন্স” এর অজানা দিকটি থেকে যাবে যদি না তার লিরিক গুলোর সাথে পরিচয় থাকে। যেমনঃ
There was an old man in a barge,
Whose nose was exceedingly large;
But in fishing by night,
It supported a light,
Which helped that old man in a barge.
আরও শুনবেন?
The Good-natured Grey Gull,
who carried the Old Owl, and his Crimson Carpet-bag,
across the river, because he could not swim.
There was an old man in a tree,
Whose whiskers were lovely to see;
But the birds of the air,
Pluck’d them perfectly bare,
To make themselves nests on that tree.
লড’ ষ্টানলির ছেলেমেয়েরা লিয়রকে খুব ভালবাসত, তিনি লিয়রকে কি ভাবে যেন জোগার করে এনে দিয়ে ছিলেন একটি ছবির সঙ্গে ছড়ার বই নাম “Anecdotes and Adventure of fifteen gentlemen”. প্রকাশকাল সম্ভবত ১৮২২। লেখকের নাম আজ গবেষনার বিষয়। এছাড়াও ছিল “The history of sixteen wonderful women”. প্রথম ছড়াটি শুনুন
There was a sick man on Tobago
Liv’d long on rich gruel and sago
But at last to his bliss
The Physician said this –
To roast leg of mutton you may go.
কি দক্ষ হাত লিমেরিকের একনাম না জানা এই কবির, এই নাম না জানা কবির লিরিকের সাথে ছবি আকলেন লিরয়।
একেবারে জন জীবনে প্রতিষ্টা পেয়ে গেল লিমেরিক। উনবিংশ শতাব্দির ইংরেজী “light verse” ইতিহাসে এই সব কবিতা “Nonsense” আখ্যা পেল। লিয়রের লিমেরিক আর লিরিক, যা তিনি গান গেয়ে শুনাতেন এর অনাস্বাদিত রুপ আর রস নিয়ে। লিরয়ের ‘A book of Noonsense” অবশ্য প্রকাশিত হয়েছিল ষ্টানলির বাড়ির সেই ঘটনার ১৩ বৎসর পর ১৮৪৬ সালে, এখানে লিয়র এক অদ্ভুত ছদ্মনাম নিয়েছিলেন। Derry Down Derry. এই বই লেখার পেছানে অমরত্ব কোন চিন্তা ছিল না লিয়রের কিন্ত অমরত্ব নিজে এসে ধরা দিল লিয়রের কাছে।
লিয়র বাবা মার বিংশতম সন্তান। ছোটবেলে থেকেই অভাব অনটনের বিরাট জ্বালা সইতে হয়েছে বড় বোন অ্যান এর কাছে মানূষ হয়েছেন লিয়র। মায়ের বংশধারা থেকে তিনি পেয়েছিলেন মৃগী রোগ, হাপানি এবং ব্রঙ্কাইটিসের মত মূল্যবান উপহার। ক্ষীন দৃষ্টিশক্তি ও ছিল আজন্মসঙ্গী। অভাব জন্ম থেকে। এই সব অভিসম্পাত তার স্পশ’কাতর মনটাতে চাপ ফেলে। বিরল এক প্রতিভার অধিকারী অথচ স্বচ্ছল একটি জীবন যাপনে এত প্রতিবন্ধকতা। ১৫ বৎসরে স্কুল এর পাট চুকান ভাল লাগেনি বলে। অথচ চিত্রকলায় ছিলেন ভীষন পারদশী’। কমপক্ষে ১২ টি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। রাগে অভিমানে বিয়েই করলেন না। নিসংগতা ঘুচাতে ঘুরে গেচেন ভারতে। Bombay Times এ তার বিখ্যাত ননসেন্স কবিতা প্রকাশিত হয়ে ছিল ১৮৭৪।
বাংলার আবোল তাবোল এর লেখক সুকুমার রায় আর লিয়র এর মধ্যে খুব বেশি পার্থক্যো আমি পাইনা খালি আর্থিক দিক ছাড়া।
চলুন সুকুমার দিয়ে শেষ করি
সৎপাত্র- সুকুমার রায়
শুনতে পেলাম পোস্তা গিয়ে—
তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে ?
গঙ্গারামকে পাত্র পেলে ?
জানতে চাও সে কেমন ছেলে ?
মন্দ নয় সে পাত্র ভালো
রঙ যদিও বেজায় কালো ;
তার উপরে মুখের গঠন
অনেকটা ঠিক পেঁচার মতন ;
বিদ্যে বুদ্ধি ? বলছি মশাই—
ধন্যি ছেলের অধ্যবসায় !
উনিশটিবার ম্যাট্রিকে সে
ঘায়েল হয়ে থামল শেষে ।
বিষয় আশয় ? গরীব বেজায়—
কষ্টে–সৃষ্টে দিন চলে যায় ।
মানুষ তো নয় ভাইগুলো তার—
একটা পাগল একটা গোঁয়ার ;
আরেকটি সে তৈরী ছেলে,
জাল করে নোট গেছেন জেলে ।
কনিষ্ঠটি তবলা বাজায়
যাত্রাদলে পাঁচ টাকা পায় ।
গঙ্গারাম তো কেবল ভোগে
পিলের জ্বর আর পাণ্ডু রোগে ।
কিন্তু তারা উচ্চ ঘর,
কংসরাজের বংশধর !
শ্যাম লাহিড়ী বনগ্রামের
কি যেন হয় গঙ্গারামের ।—
যহোক, এবার পাত্র পেলে,
মন কি আর মন্দ ছেলে ?*
এই যদি হয় লিমেরিক তাহলে সায়েমা চৌধুরীর কবিতায় আসি।
চারদিকে হাহাকার;’নাই নাই ‘রব!
ভেজালেতে ভরে গেছে বাজারের সব!!
চাল ডাল নুন তেল
মাছ ডুমি কদবেল
তবু দেশে হিতকারী দেখে বসে খব!
-নাই নাই পৃষ্ঠা,৯
বেশ ভালোই তো। যেখানে ভোক্তা অধিকার আইনও ফেল মেরেছে। সেখানে সায়েমা চৌধুরীর জয়। কিন্তু জয়েও তার বিস্বাদ। তাই
বিষাদের কষ্ট মেখে সুখপাখি উড়ে উড়ে ছাই!
নীলীমা দেখার মুগ্ধচোখ এ জীবনে ললাটে নাই!!
আহা হৃদয় শুধু পোড়ায়
স্বপ্নের ভিতরে স্বপ্ন কুড়ায়
কজনি বা দেখে হৃদয়ের জ্বলন্ত অঙ্গার পোড়া ছাই!!!
-সুখপাখি, পৃষ্ঠা-২৫
কেউ দেখেনা। দেখেও না দেখার ভান করে। আর তারাই গণতন্রের অধিকারকে গ্রাস করে। তাই তিনি লিখেছেন-
নির্লজ্জ নেতাগুলোর দিকে তাকাও;মুখে ন্যায়ের ফুলকি/গণ মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণ-হাতে প্রতীকের উলকি/
অথচ চোখ বারবনিতার নাচ
হৃদয়ে রয়েছে পাংশুল ধাঁচ
গণতান্ত্রিক অধিকার করেছে গ্রাস- এ আমাদেরই ভুল কি!!!
-ভুল,পৃষ্ঠা-২৭
আমাদের কোন ভুল নেই। আমরা ভুল করবো কেন ভুল তারাই করে যারা সার্থের অন্ধ হয়ে বিশ্বজিত কে কোপায় মারে। তাই বিশ্বজিতের রক্ত কবিকেও রক্তাক্ত করে-
বিশ্বজিতের শরীর রক্ত ঝরে হাড় খসে
চাবুক মারে একতরফা বলতো শালা কার দোষে/ এসব কথার চাইলে জবাব/তুইও হবি কিমা কাবাব/জানে সবাই কে বা কারা এইদেশে খুনি পোষে!!!
-বিশ্বজিত, পৃষ্ঠা ৩১
খুনি তো তারাই পোষে যারা তেল বিদ্যুৎ
গ্যাস কিংবা পদ্মাসেতু নিয়ে মানুষকে ধোকা মারে-
বিদ্যুৎ তেল নিয়ে রোজ নমরুদি খেলকি
পদ্মাসেতু নিয়ে আর কত চালবাজি ভেলকি
চলবেনা ধোকা আর
নইতো রে বোকা আর
দেখ চেয়ে জনতার হদয়েতে আগুনের ফুলকি!!!
-স্ফুলিঙ্গ,পৃষ্ঠা ৩২
জনগনের হৃদয়ে আগুনের ফুলকি ছোটে তারপরও দুর্নীতি ও ঘুঘুর ফাঁদ রয়ে যায়-
নির্যাতিতের কান্না শুনি নিপীড়তে আর্তনাদ
দূর্নীতিতে দেশ ভরেছে শেষ করেছে স্বপ্ন সাধ
বক্তৃতা বোল শুনছি মুখের
জলছে আগুন হাজার বুকে
আশায় আলোয় গুড়েবালি-শেষ হবে কি ঘুঘুর ফাঁদ!!!
-ঘুঘুর ফাঁদ:পৃষ্ঠা-৩৩
দুর্নীতিতে পুঁজিপতিরা কালো টাকার পাহাড় গড়লেও এদেশের জনগণ কিন্তু কোনদিন প্রতিবাদ করেনি কিংবা প্রতিবাদের কোন সুযোগ পায়নি। তারপরও সায়েমা চৌধুরী লিখেছেন-
তোমার আমার শ্রমের টাকায় ভরছে পকেট কারা/রাজনীতিবিদ,সমাজসেবক এ দেশেতে তারা/কালো টাকায় বানায় বাড়ি/সাদা করে হাকায় গাড়ি/ আমজনতা গর্জে ওঠে দুশমনদের তাড়া!!
-দুশমনদের তাড়া: পৃষ্ঠা-৩৬
প্রেয়সী র মুখ গ্রন্থের শেষ লিমেরিকটি রোহিঙ্গাদের সাথে তুলনা করে সাঁওতালদের নিয়ে। তবে কবি সায়েমা চৌধিরী চাইলে এই কবিতাগুলোতে আরো ভাবগভীরতা বা শ্লেষ্মাযুক্ত করে কবিতার বিষয় বা চরিত্রকে ধুয়ে দিতে পারতেন। ভরে দিতে পারতেন ধুয়োতে। এরকম আরো কয়েকটি যেমন বসন্ত,নামছে,আধার দ্রুত এবং নারী দিবসের কাব্য ইত্যাদি কবিতাগুলো।
সায়েমা চৌধুরী। জন্ম ৩১ জুলাই চৌধুরী বাড়ী নাটোর।প্রাণীবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর।১৯৯৪ সাল রোজি মোজাম্মেল মহিলা কলেজ গুরুদাসপুর নাটোর এ অধ্যাপক হিসেবে আছেন।স্কুল জীবন থেকে লেখালেখি শুরু।শিশুতোষ পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন।লিমেরিক ছন্দে লিখতে ভালোবাসেন।
সায়েমা চৌধুরীর এ কাব্যগ্রন্থটিতে মোট চল্লিশ টি লিমেরিক ছন্দের কবিতা রয়েছে।প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর।কবিতাগুলো সুখপাঠ্য।কবি নিজেই বলেছেন লিমেরিক ছন্দ আমার মনে আচড় কাটে শিশুবয়সে সে হিসেবে এই বয়সে কবির শব্দের গাথুঁনি শ্লেষ্মা, ধুয়ো আরো পাকাপোক্ত হওয়ার কথা ছিল।তারপরও কবি তার প্রচেষ্টা ও সম্ভাবনায় যথেষ্ট আন্তরিক। বইটির উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।
বই।। প্রেয়সী মুখ
কবি ।। সায়েমা চৌধুরী
প্রচ্ছদ ।। মোস্তাফিজ কারিগর
প্রকাশক।। অগ্রদূত এ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা
পৃষ্ঠা ।।৪৮
মূল্য।।১০০ টাকা
সূত্রপাঠ:
*শায়েরী,সামহোয়্যার ব্লগ।
*প্রেয়সীর মুখ সায়েমা চৌধুরী।
পান্থজন জাহাঙ্গীর : কথাশিল্পী ও প্রাবন্ধিক।
এই লেখাটির ট্যাগ দেয়া হয়নি। ভুলে গেছেন মনে হয়।