মুজিব রাহমান
সকল শব্দাবলী ফতুর
আবেগের ধার, ভালবাসার বহু বিচিত্র প্রকাশ
মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের যা কিছু স্মারক
সব সব অনর্থক মনে হয় এই বেলা।
শব্দের এতো ক্ষমতা কোথায় নৈঃশব্দকে ধরবার।
যাদের আগমনে আনন্দ আনন্দ সাড়া পড়ে যেত
গোলাপের পাপড়িতে ছেয়ে যেত প্রতিটি হৃদয়
যাদের উচ্চারণ সভ্যতার পথ-ঘাট চিনিয়ে দিতো
যাদের জাগরণ ছিলো মানুষের জন্য,
দেশের জন্য, পৃথিবীর কালো ও কালিমা মুছে দেবার জন্যে,
নারী ও পুরুষকে মানুষের সুযোগের সমতল মঞ্চে
দাঁড় করানোর স্বপ্নে যাঁরা বিভোর থাকতো দিনরাত,
যাদের ঘুম ছিল মানুষের ভেতরের ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে দেবার রসদ সংগ্রহমাত্র,
যাদের কথা ও কাজ, যাদের সাধ ও সাধনা,
যাদের বেঁচে থাকার দরকার ছিল মানুষের জন্য
সেসব মানুষ আজ বিজনে চুপিসারে কোথায় যায়!
কোনো অদৃশ্য ষড়যন্ত্র আছে নাকি সক্রিয়!
উচ্চারণ ও কলমে পরিস্রুত ইতিহাস যাঁর অন্বেষায় সত্যের মত্য নির্মোহ জ্বলে উঠতেন যিনি তিনিও চলে গেলেন!
যাঁদের চোখ ছেঁকে রাখতো বিগতকাল পরিষ্কার। স্বচ্ছ। বোঝা যেত মানুষের আগামী মানুষ। বোঝা যেত, অতীত বোঝা নয়, অতীত শক্তির নাম। যাদের কলম তৈরি করে দিত পথিকের পথ, বুঝিয়ে দিতো পথ গন্তব্য নয়, গন্তব্যের পথে তুমুল এগিয়ে যাওয়া। মহৎ জন বিস্ফোরক নয়। তারচেয়ে বেশি কিছু। সময়ের জঞ্জাল দুহাতে সরাতে সরাতে যে মানুষ শিখিয়ে দেন, বাতলে দেন মানুষের কাজ। জ্ঞানের স্নিগ্ধ আলোয় তার দেশপ্রেম, দেশ চেতনা, দ্রোহ-বিদ্রোহ, কী প্রশান্ত, কী প্রগাঢ় অনন্ত আনন্দের মতো প্রাণে প্রাণে বিস্তৃত হত। আজ তার যাবার বেলায় শীর্ষ থেকে পাদদেশ অবধি অশ্রুতে কুসুমে আনন্দ ভালোবাসায় প্রাণের উষ্ণতায় অনুমিত যে দৃশ্যমান প্লাবন বহতা জীবনের মোড়ে মোড়ে গীতে-বাদ্যে ছড়িয়ে পড়ার কথা ছিলো রঙধনু রঙ অশ্রুত সুরের মতো আজ সব দিকচিহ্নহীন, নৈঃশব্দ্যে বিলীন। যেন জীবনের চেয়ে বড়, মৃত্যুর চেয়ে প্রবল, প্রগাঢ় এক রহস্য-জিজ্ঞাসা আজ ঘিরে আছে জীবনের সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্ত।
তবু স্পর্শকের মতো তুমি ছুঁয়ে আছো গুঢ় চেতনার নাভিকেন্দ্র।
সমাজ ও সাহিত্যের অবগুণ্ঠন উন্মোচিত করতেন তিনি, উদঘাটন করতেন সাহিত্যে জীবনের সত্যাসত্য। জীবনের বিশ্বস্ত বিকল্প সম্প্রসারণ যে সাহিত্য তা অনাবরিত, উন্মোচিত হতো যাঁর বিশ্লেষণের বিভায়, প্রজ্ঞার প্রোজ্জ্বল উপস্থিতিতে। চলে গেলেন তিনিও।জ্ঞানচর্চাই তো উসকে দেবে কৌতূহল এবং দেখিয়ে দেবে বিকাশের বিচিত্র পথ, শিখিয়ে দেবে মূল্যবোধের মূল্য। অথচ অমৃতে-গরলে কী ভীষণ মাখামাখি আজ!
বেদনা ছিন্নভিন্ন ও এলোমেলো করে দেয় মানুষের অস্তিত্ব। অনিশ্চয়তার অনির্ণেয় কর্কশ দড়ি টান টান প্রসারিত মৃত্যুর দিকে। আচারকে, সময়কে, সক্ষমতাকে শাসন করে কোন অদৃশ্য, নিস্পৃহ নির্বিবেক নিষ্ঠুরতা! ধূসর ধূসর ছাই ছাই সময় সমাচ্ছন্ন করে আছে মানুষের আজ ও আগামী।
প্রিয়জন প্রিয় পদরেখা ধরে শ্যামল মাটির কাছে স্বজনের একান্ত সখ্য-সান্নিধ্য যাচে না আর।
হায়, করোনা সময়! বিষচক্রের কুটিল কেউটে তুমি।
তুমি অগ্রাহ্য করেছো, থেতলে দিয়েছো, দুমড়ে-মুচড়ে একশা করে দিয়েছো মায়ের ভালোবাসা। মানুষের আত্মার আত্মীয়তা। তুমি কেবল ফুল ও পাতাই বরবাদ করোনি। কেবল শাখাই ছিন্ন করোনি। তুমি উপড়ে নিচ্ছো শিকড়-বাকড়।
বিনয়ের কী বিরল অবতার গুণে-মানে তিনি। মনের মাধুর্যে কজন মানুষ এমন শতাব্দের বুক চিরে দেশের হৃদয়জুড়ে থাকেন ভালোবাসায়-শ্রদ্ধায় যেমন ছিলেন থাকবেন স্বপ্ন-মানুষ গণিত অলিম্পিয়াডের মাঠে-মঞ্চে শিশু-কিশোরদের আগামি ঘিরে, স্বপ্ন ঘিরে।
যতোটা অশ্রু প্রাপ্য তোমার, ভালোবাসা যতোটা, কিছুই পারিনি দিতে। চোখবুজে মাথাগুঁজে অসার মানুষ।
সময়ের নামান্তর অসহায়তা। মানুষের অন্য নাম অসহায়তা।
করাল, কালান্তক এই কৃষ্ণপক্ষ কাল। মৃত্যু যখন ছায়াসঙ্গী, চোখে রাখে চোখ, অদৃশ্য হন্তা যখন পিছু নেয়, পিছু নেয় আততায়ী নিরস্ত্র মানুষের – এক মেরু থেকে আরেক মেরুতে। কী হয়, কী হয় দেখো অস্তিত্বের সবটুকুজুড়ে।
সব দিকে নর্দমা ঘিরে আছে। পূতিগন্ধময়। পচনশীল মানুষের। এসব প্রত্যক্ষ করার আগেই জামিল স্যার, আনিস স্যার আপনারা চলে গেলেন। কান্নারও উপযুক্ততা দিয়েছি বিসর্জন। আমাদের অক্ষমতা – আমাদের শূন্যগর্ভ চিৎকার ফিরে আসে প্রতি পলে, অনুপলে আমাদেরই দিকে।
বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের লাশের স্তূপের নিচে সেই কবে পাকিস্তান মরে গেছে অথচ শব বাহকেরা আজও ফুঁসছে নষ্ট চিন্তার নির্মম উন্মত্ততায়।
জায়মান ভ্রষ্ট চিন্তা। বিষভাবনার বাড়-বাড়ন্ত। ঝাড়ে-বংশে রাজনীতির সুতোর গোলা জটিল জটলায় ভীষণ। দৃশ্যমান। টাকাও আর সমস্যা রইলো না। গোলাজলের ঘূর্ণাবর্তে বান ডেকেছে নষ্ট মানুষ ও সহজ টাকা। আগাছার বাম্পার ফলন! হায়রে সংবিধানের সীমার! হায়রে নষ্টের অবতার! ঠিকই বলেছেন কবি – ফসলের চেয়ে আগাছারই সম্ভাবনা বেশি। ফলন তাক লাগানো। অথচ আগাছাও পরিচর্যা পায়! বিস্মৃতি- বিভ্রম আর কাকে বলে! মধ্যযুগ ফিরে আসে দেশে দেশে বারবার।
নীতির কাহাত আজ। নৈতিকতার কম্পাস ঘিরে ক্ষোভ জমে। বিক্ষুব্ধ নিসর্গও। মানুষ, তুমি নূতন করে ভাবো। এক গর্তে আর কয় বার পড়বে তুমি, মানুষ! লোভের শিখা ফুঁসে উঠে চারপাশে তোমাকেই পাবে। ছাইয়ের বরাত তোমার নয়। তোমাকে দারিদ্র ভাগ করতে হবে। ভাগ করতে হবে সমৃদ্ধিও। ঝড়ে-বন্যায় মানুষের দুর্দশা ঘুমুতে দেয়নি পিতাকে। মুখের ভাষা থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সংগ্রাম, পীড়নের বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই জেলখানাকে করে তুলেছিল যাঁর নিয়তি, শেকল ভাঙতে ভাঙতে যাঁকে এগুতে হয়েছিল মরণ-সংকুল সব খাঁড়ি। তিনিই তো পিতা। তিনি চাইতেন, খেটে খাওয়া মানুষের চোখে-মুখে ফুটুক আদি ও আসল হাসি । সোনার দেশে সোনার মানুষে ছড়িয়ে পড়ুক অকৃত্রিম হাসির প্রাণময় উজ্জীবন।
আজ তোমার জন্মশত বর্ষে তোমার স্বপ্নই ধ্বনিত হচ্ছে মুহুর্মুহু। তোমার আক্ষেপই বেজে ওঠছে সর্বত্র। তোমার নির্দেশনা আজও পরম মন্ত্র হয়ে উচ্চারিত,পিতা। সবচেয়ে বড় অর্জনটি আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছ তুমি। তোমার নামে তাই কীর্তিত দেশে দেশে আমাদের লাল-সবুজ। স্বাধীন প্রাণের গরিমাদীপ্ত পতাকা।
পিতা, তুমি তো রাজসাক্ষী, অগ্নিময় অভিজ্ঞতার নিজেই স্মারক। যে মারি ও মৃত্যু ঘিরে আজ দিগ্বলয় তা থাকবে না। তোমার পদ্মা, মেঘনা, যমুনার তীরে বাঙালি থাকবে। ভুবনজুড়ে বাঙালি থাকবে আর তাদের হৃদয়-নদীর নৌকাজুড়ে তুমি থাকবে। তোমার অপরিমেয় রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে এই বিস্ময়, এই অপূর্ব দেশ – বাংলাদেশ। দেশের সুবর্ণ জয়ন্তীতে অগ্রগমনের আলোড়িত ঘূর্ণিজলে এখনো অজস্র আবর্জনা ভাসমান। সমস্ত আবর্জনা থিতিয়ে না পড়া অবধি স্বচ্ছ জল মুকুরের মত প্রতিফলিত করবে না এই নীল ও সবুজ, এই মানুষ ও সৃষ্টি। এই দুঃসময়কে উজিয়ে আসবে স্বর্ণপ্রসূ সুনন্দ সময়। গাঢ়তম অন্ধকার আলোর পূর্বাভাস। সকল রাতই প্রভাতমুখি। রাঙা প্রভাতের কবি তিমির রাত টুটানোর কথা বলেছিলেন। চিরকালের কবি রাত পোহানো অবধি ডানা ঝাপটানোর কথা বলেছেন। বলেছেন, ‘এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা’। আমৃত্যু বলেছেন, জঙ্গমতাই জীবন। গতিময়তাই জীবন।
সূর্য ছিনিয়ে আনার মহাকাব্যিক অভিযাত্রায় তুমি ছিলে উদয়াচলেও অরিন্দম, সায়াহ্নেও সংশপ্তক । হিংস্র নেকড়েদের উন্মাদ অট্টহাসি মিলিয়ে গেছে। স্বদেশের শ্যামলিমা হয়ে কেবল তুমিই আছো, সর্বত্র। তোমার শক্তিশালী স্মৃতিপুঞ্জে কৃষক-শ্রমিক মাঝি-মাল্লার স্বপ্ন।
তাদের মুখে হাসি ফোটানোর মাঝেই তুমি স্থির করেছিলে সকল সার্থকতা। তোমার প্রতিদিনের উচ্চারণে নিপীড়িত মানুষের বেদনা ঘোচাবার ছিল প্রাণান্ত প্রয়াস।
পিতা, আজ তোমার আত্মজার অক্লান্ত প্রয়াসে হাসি ফুটছে ক্রমাগত। এক দুই তিন করে অজস্র সাদা-লাল শাপলা মাথা তুলছে বড় পুকুরের বিশাল ক্যানভাসজুড়ে- বুকজুড়ানো ভোরাই স্নিগ্ধতায়।
মুক্তির কথা, স্বাধীনতার কথা, রক্তের কথা বলতে বলতে তুমি আমাদের পৌঁছে দিয়েছো স্বপ্ন পূরণের কাঙ্ক্ষিত চূড়োয়। আজ তোমার পবিত্র নামের মোহন সৌরভে, তোমার স্বয়ংপ্রভ স্মৃতির শতবর্ষে সোনার বাংলার শ্যামল মাটি হতে লুপ্ত হোক করাপশনের কালিমা। সমাধিস্থ হোক দুর্নীতির দুর্বিষহ দুর্যোগ।
অবারিত থাক মনুষ্যত্ব প্রকাশের সকল পথ।
মানবিকতাই হোক বাঙালির সবচেয়ে বড় শৌর্য ও সম্পদ।
ভাষাই দিয়েছে আমাদের স্বাধীনতার প্রথম সোপান।
স্বোপার্জিত এ দেশ আমার মা।
ভাষার জন্য,
মায়ের জন্য,
রক্তগড়া ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার সুরক্ষার জন্য,
সম্মান ও মর্যাদার জন্য,
সবার উপরে দেশের জন্য,
নিশ্বাস নিঃশেষ হোক,
প্রস্ফুটিত মানব ফুলের সৌরভে সুরভিত হোক
আদিগন্ত।
সযত্ন লালিত কবিতা সমাজের আত্মা।
আত্মা সমৃদ্ধ হোক কবিতার সঞ্জীবনী অমৃতে।
তুমি তো রাজনীতির কবি, তোমার প্রতিটি উচ্চারণ
আজও কবিতার সম্মোহন আনে, সম্মোহক তোমারই মতো।
আমাদের সকল আকাঙ্ক্ষা কি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে?
হিংস্রতায় মানুষ কি ছাড়িয়ে যাবে সকল সীমা?
নাকি স্বাধীনতা সার্থক হবে শর্তহীন দেশপ্রেমের –
মানবপ্রেমের অঙ্গীকৃত অবিরাম সংরাগে-সমর্পণে?
💚
মুজিব রাহমান : কবি-অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক।
সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ।