‘এই দীর্ঘ ব্যাধি, জীবন আমার’
মুজিব রাহমান
আলেকজান্ডার পোপ-কে নিয়ে অল্পস্বল্প
প্রাথমিকভাবেই তাঁর সময়টা ছিলো গদ্যের। কিন্তু তিনি লিখতেন, লিখেছেন প্রায় সবই পদ্যে – কবিতায়। তা সত্ত্বেও তাঁর প্রভাব তাঁর সমসাময়িক লেখকদের এবং পরবর্তীদের উপর এতটাই ব্যাপক ছিল যে আজও আমরা পোপের নামেই ওই যুগটাকে জানি, চিনি এবং উদ্ধৃত করি। একজন কবির নামে সাহিত্যের একটি যুগ কম কথা নয়। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধ যাঁর নামে তিনি কবি আলেকজান্ডার পোপ ( জন্ম: ১৬৮৮ ; মৃত্যু: ১৭৪৪)। সংস্কৃতিমান এ-কবি ছিলেন সুরকানা, সুরবধির। কিন্তু কি আশ্চর্য তাঁর কবিতা কখনো বেসুরো ছিল না। প্রথমদিকের ইংরেজ কবিদের যে-কজন পেশাগতভাবে নাটককে নয় কবিতাকে নিয়েছিলেন তাঁদের মাঝে যাঁরা আর্থিক প্রাচুর্য অর্জন করেছিলেন পোপ ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
বিরুদ্ধবাদিরা যে যাই বলুক স্বশিক্ষিত ও মানসিকভাবে দ্রুতপরিণত আলেকজান্ডার পোপ টিকে আছেন তাঁর কবিতার জন্যে, ব্যঙ্গ রচনার জন্যে। প্রটেস্টান্ট বিপ্লবের বছর ১৬৮৮ সালে তাঁর জন্ম।
মাত্র আট বছর বয়সে তিনি স্থানীয় এক যাজকের কাছে শিখেছিলেন ল্যাটিন আর গ্রিক। পরবর্তীতে গভীর আগ্রহে ফরাসি ও ইতালিয় ভাষাও। ভার্জিল এবং স্পেনসার পড়ে সেই স্কুল জীবন থেকেই ধ্রুপদী কেতায় তাঁর সৃজনশীলতার হাতেখড়ি।
তাঁর রচনাকর্মকে তিনটি যুগ বা সময়পর্বে ভাগ করা হয়। জীবনের প্রথম পর্বে নব্য ধ্রুপদী ঢঙে লেখা বইগুলো তাঁর কবিখ্যাতি বিস্তৃততর করেছিল।
প্রথম জীবনে কবির ষোলো বছর বয়সে ১৭০৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর Pastorals নিসর্গ নিয়ে রচিত কাব্য। ১৭১১ সালে প্রকাশিত তাঁর Essay on Criticism – নব্যধ্রুপদী কাব্যধারার ইশতেহার হিসেবে নাম কুড়িয়েছিল। ১৭১৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রকৃতি বিষয়ক কাব্য উইন্ডসর ফরেস্ট এবং ১৭১৪ সালে কবির চব্বিশ বছর বয়সে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর বিখ্যাত The Rape of the Lock –দুই যুযুধান উচ্চবিত্ত রোমান ক্যাথলিক পরিবারেকে পুনর্মিলিত করার পরিকল্পনায় রচিত ব্যঙ্গ-মহাকাব্য। এ-কাব্যটি লন্ডন সমাজে তাঁকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়েছিল।
তাঁর জীবনের মধ্যপর্বটি ছিল প্রাচুর্যভরা। এটি ছিলো তাঁর অনুবাদ প্রকল্পের পর্ব। বত্রিশ বছর বয়সে তাঁর আর্থিক সমৃদ্ধি এসেছিলে অনুবাদের হাত ধরে। ১৭১৫ সালে বেরিয়েছিল পোপ অনূদিত ইলিয়াডের প্রথম খণ্ড। প্রকল্প শেষ হয়েছিল ১৭২০ খ্রিষ্টাব্দে। ১৭২৫-২৬ সালে তাঁরই অনবদ্য তরজমায় বেরিয়েছিল হোমারের বিশ্বনন্দিত মহাকাব্য ‘অডিসি’। এবং অনুবাদে প্রকাশিত ইলিয়াড ও অডিসির কাটতি তাঁর জীবনের অভাব-দারিদ্র্য হটিয়ে দিয়েছিলো। তাঁর জীবনে অর্থনৈতিক মুক্তি ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছিল মহাকাব্যের অনুবাদ। ওই বছরই ১৭২৫ সালে পোপের সম্পাদনায় বেরিয়েছিল শেক্সপিয়রের রচনাবলী।
তৃতীয় পর্বে কবি লন্ডনের শশব্যস্ত জীবন ছেড়ে তাঁর উপার্জিত টাকায় কেনা টেমস নদী তীরবর্তী Twickenham-এর নিসর্গ-নিবিড় বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। এবং ওই বাড়িতে প্রিয় সব বন্ধু নিয়ে তাঁর আনন্দময় সময় অতিবাহিত হতো বাগান করে আর কবিতা লিখে। এখানে বসেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর সমসাময়িকদের নিয়ে তীব্র, তীক্ষ্ণ, হুলফোটানো আর ব্যঙ্গাত্মক কবিতা Dunciad। তাঁর শত্রুরা তখন তাঁকে ‘টুইকেনহ্যামের পাজি ভিমরুল’ বলেই ডাকতো। কিন্তু তাঁর শেষের দিকের সহৃদয় ও সুবিবেচনাপ্রসূত অসাধারণ An Essay on Man (১৭৩৩-৩৪)প্রকাশিত হবার পর তাঁর অনেক শত্রুও তাঁকে সম্মান দেখাতে এসেছিলেন। মূলত তাঁর Opus Magnum-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল Essay on Man; Dunciad; Moral Essays or Ethics ইত্যাদি রচনাবলী।
যক্ষ্মারোগ আর হাঁপানি দুটো রোগের আক্রমণে কৈশোরেই কবি নাকাল হয়ে পড়েছিলেন। এমনকি পোশাক পরিয়ে দেবার জন্যেও অন্যদের উপর নির্ভর করতে হতো তাঁকে। এ-জন্যে নিজেকে নিজে আধা-উপহাস করে বলতেন :
‘This long disease, my life’.
শেইকসপিয়র আর মিলটন ছাড়া কোন লেখকই ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এতো এতো উদ্ধৃতিযোগ্য চরণ আর শব্দগুচ্ছ ছড়াতে পারেননি যতোটা ছড়িয়েছেন আলেকজান্ডার পোপ। তাঁর নিটোল নিপুণ দ্বিপদী বা যুগ্মকের ভেতর জীবন এবং শিক্ষার নির্যাস অল্প কথায় গভীর অর্থময়তার বাঙ্ময় হয়ে আছে। তাঁর কোনো কোনো চরণ প্রবাদের মর্যাদায় সারা দুনিয়ায় সমান উচ্চারিত ও সমধিক জনপ্রিয়।
উদাহরণস্বরূপ গোটাকতক প্রবাদপ্রতিম চরণ উল্লেখ করা যেতে পারে:
1.
Too err is human, to forgive is divine.
2.
For fools rush in where angels fear to tread.
3.
A little learning is a dangerous thing.
4.
Expression is the dress of thought.
5.
The proper study of mankind is man.
তাঁর কলমে সৃজিত হয়েছে অসংখ্য স্মরণযোগ্য দ্বীপদী:
1.
We think our fathers fools, so wise we grow;
Our wiser sons, no doubt, will think us so.
2.
Hope springs eternal in the human breast:
Man never is, but always to be blest.
3.
A wit’s a feather, and a chief’s a rod;
An honest man’s the noblest work of God.
4.
Honour and shame from no condition rise;
Act well your part, there all the honour lies.
5.
‘Tis education forms the common mind:
Just as the twig is bent the tree’s inclined.
উল্লেখ্য, আমাদের সময়ে নবম-দশম শ্রেণির ইংরেজি প্রথম পত্র টেক্সট বইয়ের কবিতাংশে প্রথম কবিতাটি ছিল পোপের Ode on Solitude কিন্তু তা ছিল ‘হ্যাপি দ্য ম্যান’ শিরোনামে। শেষের স্তবক এখনো মনে গেঁথে আছে।
‘Thus let me live, unseen, unknown ;
Thus unlamented let me die;
Steal from the world, and not a stone
Tell where I lie.’
অন্ত্যমিলের প্রাঞ্জলতা তাঁর কবিতাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। ইংল্যান্ডের ভূমিলগ্ন এ-কবি দেখতে ছিলেন ছোটখাটো, জীর্ণশীর্ণ, কুঁজো আর দৈহিক উচ্চতায় ছিলেন পাঁচ ফুটেরও কম। অন্যদিকে, কবি হিসেবে ছিলেন অতিকায়, যুগন্ধর, উজ্জ্বলতমদের একজন। শৈশবেই মেরুদণ্ডের ক্ষয়রোগ তাঁকে বাঁকিয়ে দিয়েছিল। একটা পা আরেকটা পা থেকে ছোট হয়ে গিয়েছিলো।
এই বিকৃতি তাকে জীবনভর উপহাসের পাত্র বানিয়ে রেখেছিল। ক্যাথলিক বিরোধী আইন তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে দেয়নি। অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ তাঁর ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসটাকেই আমলে নিয়েছিল কাব্যপ্রতিভাকে নয়। বৈষম্যের শিকার ছিলেন জীবনভর। শারীরিক খুঁত এবং ধর্মীয় বৈষম্যকে তিনি তাঁর পথে দাঁড়াতে দেননি। বিস্ময়কর প্রতিভাসম্পন্ন পোপ মাত্র বার বছর বয়সে রচনা করেছিলেন তাঁর অসামান্য Essays on Man। ষোলো বছর বয়সে লিখেছিলেন, Pastorals; তেইশ বছর বয়সে লিখেছিলেন তাঁর স্পষ্ট তীক্ষ্ণ যুক্তিপূর্ণ নীতিগর্ভ বিখ্যাত কবিতা An Essay on Criticism। চব্বিশ বছর বয়সে তাঁকে বিস্তৃততর খ্যাতি এনে দিয়েছিল তাঁর The Rape of the LockLock। আর বত্রিশ বছর বয়সে পোপ ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর প্রথম ভালোবাসা গ্রিক কবিতার কাছে।
এবং আধুনিক কাব্যভাষায় অনুবাদ করেছিলেন হোমারের ইলিয়াড ও অডিসি। এবং এ অনুবাদের কাটতি তাঁকে বিত্তবান করে তুলেছিল। অর্থ-বিত্তের এ-প্রাচুর্য-পর্বে কবি লন্ডনের ব্যস্ত জীবন ছেড়ে টেমসের তীরে অনিন্দ্যসুন্দর টুইকেনহ্যাম ভিলার জমিদারি লিজ নিয়ে বসবাস শুরু করেন। তাঁর প্রিয় বন্ধুদের আপ্যায়নে, বাগানের পরিচর্যায় আর কবিতা রচনায় কবি তখন সুখদ সময় কাটাতেন।
মাটি ও মানুষের কবি। জগৎ-জীবন, শিল্প-সাহিত্য সকল বিষয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ অতুলনীয়। তিনি দুচরণের অন্ত্যমিলে কতো শতো সত্যকে ধরে রেখেছেন তা স্পষ্ট হয়ে উঠে যখন আমরা তাঁর “সমালোচনার ওপর প্রবন্ধ” “মানুষের ওপর প্রবন্ধ” “নৈতিক প্রবন্ধাবলি” ইত্যাদি বিষয়ক কাব্যকথায় মনোসংযোগ করি।
তাঁর প্রতি দুচরণ এক একটি অনবদ্য epigram – সংক্ষিপ্ত কিন্তু জ্ঞানগর্ভ ও বুদ্ধিদীপ্ত পয়ারপ্রতিম।
স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ এপিগ্রাম-কে সংজ্ঞায়িত করেছেন অসামান্য ছন্দবদ্ধ শব্দমালায়:
“What is an epigram? A dwarfish whole,
Its body brevity, and wit its soul.”
অনুবাদে হতে পারে:
এপিগ্রাম কী? এ এক পুঁচকে লা পাত্তা
সংক্ষিপ্ততা কায়া তার, বুদ্ধি তার আত্মা।
চূর্ণ অনুবাদে পোপের দু’চরণ:
শিল্প থেকে অনায়াস লেখা, দৈবচক্র বৃথা খোঁজা
দক্ষ যারা নৃত্যকলায় চলন তাদের কী যে সোজা।
[ True ease in writing comes from art, not chance,
As those move easiest who have learned to dance.]
লেখাটি দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। শেষ করতে চাই তাঁরই সমসাময়িক সুইফটের কথা দিয়ে। পৃথিবীর সেরা ব্যঙ্গ-লেখকদের একজন এই জোনাথন সুইফট। আলেকজান্ডার পোপকে নিয়ে লিখেছেন:
“In Pope I cannot read a line,
But with a sigh, I wish it mine:
When he can in one couplet fix
More sense than I can do in six:
It gives me such a jealous fit,
I cry, ‘Pox take him, and his wit!”
মুজিব রাহমান : সহযোগী অধ্যাপক -ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ।