একগুচ্ছ কবিতা
ইউসুফ মুহম্মদ।। পুবাকাশ
দহন
বৃষ্টি ভেজা জামার ভেতর ওরা যখন দহনে জখম হাচ্ছিল অকস্মাৎ সমুদ্রবাহিত হাওয়া
তাদের উড়িয়ে নেয় নীলাচল পাহাড়ের চঞ্চল সবুজে। মেঘের দেয়াল এসে ঘিরে রাখে
পার্থিব চোখের দৃষ্টি। তারা সাক্ষি রাখে বন্যগন্ধ, সাক্ষী রাখে মেঘ ফুঁড়ে ছিটকে পড়া
একচিলতে আলো। সাক্ষী থাকে বনের হরিণ-বাঘ, মেঘালয়ে ঝরে যাওয়া শামুকের গান।
অতঃপর তারা বিবাহ বিবাহ খেলে। প্রতি অঙ্গের চুমুতে ডোবে প্রতি অঙ্গের চঞ্চল রেখা
পায়ের তালুতে ঠোঁট এঁকে তারা গেয়ে ওঠে গান…সেই
থেকে প্রেমের নতুন সূত্র লেখা।
প্রশস্তি
আমাকে ছুঁয়েছে আগুন, আগুনেরে ছুঁয়েছি আমিও
আলজ্বিব পরাস্ত হলেই বাউলেরে একা ডেকে নিও
আগুন চিনেছে পুরুষ, তাকে নিয়ে একাকী বেরিয়ে
পাথর-পরাগ-শেওলা, ঝুলে থাকে কুপিন জড়িয়ে
কলহে মাতিয়া যেমন, ঢেউয়েরা আনন্দে বিলীন–
বাতাস কখনো বুঝেনা ঝরা পাতা কতটা স্বাধনি।
আগুন নিজেকে পুড়িয়ে ফুলকিতে জমা রাখে জল
জ্বলন্ত শিখারা জানে না অবণত নৃত্যের কৌশল।
উড়াল
পরিশ্রান্ত পূজারীরা দিগন্ত রেখায় বিষণ্নতা এঁকে এঁকে
নয়নের জলেরে কাজল করে যখন দুর্গাকে বিসর্জন শেষে
স্তুতি পাঠে মগ্ন। আমরা তখন আমাদের ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছি…
বৃত্তের বাইরে এসে ঝুলন্ত রুমালে মাখি বিতর্কের সুখ–
খাজুরাহো যেভাবে এঁকেছে শিল্পিত-সঙ্গম, জীবন্ত চুম্বন-কাম।
সান্ধ্য-ক্যানভাসে আঁকতে চেয়েছি সকালের সুর। সুন্দরের কক্ষে
আমরা কে কাকে কোন কোন গল্প শোনাবো তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল…
একদিন পরিশ্রান্ত সূর্য অন্ধহলে… অর্ধেক শরীর অন্তহীন শূন্যে
দোলাতে দোলাতে তুমি দাম্পত্য ব্যস্ততা ঢাকো চাঁদের আলোয়,
প্রণয়ের সকল আরতি, পথে ঘুরে ফিরে গেলে সঙ্গের নিঃসঙ্গ ঠিকানায়
দুঃখের বসন্ত জ্বালে ঝরো ঝরো চোখ, ঝুলন্ত বিকেল, নিখিলের রঙ।
অস্পষ্ট আলোর সাথে নেচে নেচে সন্যাস বৃক্ষের কাছে ফিরে
যায় অনিন্দ্য সুন্দর…। সে সব যখন স্মৃতির পাতায় হাত নাড়ে,
সবুজ আঁচলে সঞ্চিত রঙিন গল্প তখন চোখের কালিতে একাকী লিখি…
যাদের স্মৃতির ব্যাংক ততটা সবল নয় তাদের তো মুঠোভর্তি ধূলো–
‘চাঁদপনা পাখি রোদ ফুঁড়ে উড়ে গেলে কোনো গল্প আর গল্পই থাকে না’।
বসন্ত ডেকেছি
কয়লা দিয়েই লেখা, মুছে দাও। লেগে থাকবে শ্রীঅঙ্গের দাগ
যাকে আমি বসন্ত ডেকেছি কার অঙ্গে ফুটিয়াছে তার অনুরাগ।
বাতাসে গুঞ্জন তুলে চুপ অসমাপ্ত সঙ্গমের মায়াময় ফুটন্ত দুপুর
জলজ পাখিরা দেখতে যায় দূরে মেঘদল বিভাবে বাজায় নূপুর
নিতম্বের ঢাল বেয়ে নেমে আসে চুম্বনের সুরা, বিষাদের সুর
বেলা শেষে বাতাসের স্রোতে উড়ে জীবকলা সখ, সাধের পুকুর।
কাঁটা কম্পাসের পিনে জলাশয় কাঁপে, রেখে যায় মধুর দংশন
পাঠশালা ছেড়ে গেলে চিহ্ন কুড়িয়ে রাখে না কারো রমনীয় মন।
কয়লা দিয়েই লেখা, মুছে দাও। লেগে থাকবে শ্রীঅঙ্গের দাগ
যাকে আমি বসন্ত ডেকেছি কার অঙ্গে ফুটিয়াছে তার অনুরাগ।
চোরাবালি
কার ঠিকানায়, ভুল ঠিকানায় চিঠি লিখে
পাখি এক কলম ছুঁড়েছে বিদগ্ধ আকাশে!
আকাশ তখন নাইয়রে, মেঘের বাড়িতে।
ঠিকানা বদল হলে মন…
মনের পাথর গলে গলে
মামাদের নদীতে সাঁতার শেখে।
অমর জ্যোৎস্নায় নাও বেঁধে মাঝিরা ঝিমায়
বৈঠার কান্নায় জেগে থাকে ঘাসের সরল
ফেলে যাওয়া গান, দহনের ছাপচিত্র।
শ্রান্ত মধ্যরাতে চিত্রসকল ঘুমিয়ে গেলে
শুকতারা যখন বাবার কবর-কঙ্কালে ফুলেল ছড়ায়
মা তখন পাতার জায়নামাজে কী যেন সাজায়।
ইউসুফ মুহম্মদ : আশিদশকের কবি ও প্রাবন্ধিক।
বেশ কিছু লেখা পড়েছি। ভালো লাগলো। ফারদৌস নাহারের কবিতায় একধরনের ঘোর আছে। চমৎকার।