সৈয়দ আবুল মকসুদ ও তাঁর “স্মৃতিতে ওয়ালীউল্লাহ”।। মুজিব রাহমান।। পুবাকাশ

সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর ‘স্মৃতিতে ওয়ালীউল্লাহ’ বইটির শেষ করেছেন এভাবে:

” তাঁর আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব প্রত্যেকের ভাষ্যে একটি অভিন্ন কথাই ধ্বনিত হয়েছে, তা হলো –
ওয়ালীউল্লাহ ছিলেন তাঁর সময়ে অন্যদের চেয়ে অগ্রসর, অধিকতর আলোকিত, মানবিক গুণের অধিকারী, হৃদয়বান, অকপট ও বিশ্ব নাগরিক হয়েও নিখাদ বাঙালি।”

পুরো বইজুড়ে ওয়ালীকে নিয়ে কথা। তাঁর বড় ভাই বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের জুডিশল ক্যাডার কর্মকর্তা নসরুল্লাহ সাহেবের মুখে মেধাবী ওয়ালির কথা। বিমাতার কাছে তাঁর ছোট বেলার কথা, ভাব-প্রবণতার কথা সবই সংগৃহীত আছে সৈয়দ আবুল মকসুদের সুখপাঠ্য এই বইয়ে। ফেনী হাই স্কুল এবং ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে তাঁর সহপাঠী ও বন্ধু ছিলেন বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালিয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক এ কে নাজমুল করিম। ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে অনেক কথাই আমরা তাঁর বরাতে শুনি। তাঁর যৌবন থেকে শেষ পর্যন্ত বন্ধুত্ব অটুট ছিল সাংবাদিক সৈয়দ নূরুদ্দিনের সঙ্গে। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল ছাত্রজীবন থেকে। তাঁর ঢাকা কলেজের জীবন উপস্থাপিত হয়েছে ঢাকা কলেজের বন্ধু পরবর্তীতে কমিউনিস্ট নেতা মোহাম্মদ তোয়াহার বরাতে।
এককথায়, ওয়ালীউল্লাহর নিকট স্বজন, অজস্র বন্ধুজন খুঁজে খুঁজে এক প্রামাণ্য জীবনী রচনা করার দুর্মর প্রত্যয় কাজ করেছে সৈয়দ আবুল মকসুদের ভেতর।
১৯৭১ সাল। দেশের গণহত্যায় খুবই বিচলিত প্যারিসে অবস্থানরত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। আমরা এই বাংলাদেশ পাগল মুক্তিকামী প্রগতিশীল মানুষটির ভোগান্তির ইতিবৃত্ত জানতে পাই বড় ভাই নসরুল্লাহ সাহেবের পুত্র শাহেদ নসরুল্লাহর প্যারিস গমন সূত্রে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মৃত্যুর দিন কয়েক পর শাহেদ প্যারিসে যান। সৈয়দ আবুল মকসুদ শাহেদের ভাষ্য উপস্থাপন করেছেন:

” শাহেদ বলেন, প্যারিসে গিয়ে চাচির ( আন-মারি) কাছে জানতে পারি কাকার মৃত্যুর আগের অবস্থা। পাকিস্তান সরকার তাঁর সঙ্গে খুবই শত্রুতামূলক আচরণ করেছিল। ইউনেসকো থেকে তাঁকে চাকরিচ্যুত করার জন্য পাকিস্তান সরকার জাতিসংঘের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। শেষ পর্যন্ত তাঁর চাকরি যায়। আয় না থাকায় তাঁর মানসিক অবস্থা ভেঙে পড়ে। তিনি যে জীবনযাপন করতেন, তাতে প্যারিসের মতো ব্যয়বহুল শহরে বিনা উপার্জনে থাকা কঠিন। যেমন-তেমন চাকরি করা তাঁর স্বভাবে ছিল না।”

‘সহজিয়া কড়চা’ ও ‘বাঘা তেঁতুল’-এর জনপ্রিয় কলামিস্ট ছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি চমৎকার মেলবন্ধন তৈরি হতো তাঁর লেখায় যা আমাকে মুগ্ধ করতো।

তাঁর জীবনীভিত্তিক সাহিত্যকর্ম একজন সত্যান্বেষী সাধক-গবেষকের অনন্য পরিচয় বহন করে। একজন অঙ্গীকৃত সামাজিক আন্দোলনকারী হিসেবে দেশের সমস্যাগুলোকে বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে রাষ্ট্র ও সরকারের সামনে তুলে ধরার কাজে সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল তাঁর।

একটানা ১৮ বছর শ্বেত-শুভ্র থান কাপড় পরিহিত সৈয়দ আবুল মকসুদ ৭৫ বছর বয়সে অনেক বড় বড় কাজ সম্পাদন করে অন্যদিকে অনেক বড় বড় কাজ অসমাপ্ত রেখেই আকস্মিকভাবে চলে গেলেন।

সমাজ, সংস্কৃতি, সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার নির্যাস, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, তাঁর চমৎকার ভাষিক উপস্থাপন যেকোনো শিক্ষিত-সজ্জন-সচেতন মানুষের জন্য ছিল অবশ্য পাঠ্য।

স্বভাব কবি গোবিন্দচন্দ্র দাসের অসামান্য জীবনী লিখেছেন তিনি।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন:
“ওয়ালীউল্লাহকে আমি একদিন মাত্র দূর থেকে দেখলেও তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি। তাঁর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী ও পরিচিতদের কাছ থেকে তাঁর সম্পর্কে অনেক কথা জানতে পারি।” বাঙলা সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শীর্ষ ঔপন্যাসিক সুদর্শন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে একদিন দূর থেকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ এবং এই মুগ্ধতা চোখেমুখে মেখে সাহিত্যকর্ম ও জীবনী নিয়ে রচনা করেছেন অসামান্য গ্রন্থ “সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য”।

ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে তাঁর গবেষণা ও স্মৃতিকথাধর্মী অনবদ্য গ্রন্থ “স্মৃতিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ” পাঠে ওয়ালীউল্লাহর ব্যক্তিজীবন, সমাজ ও সমকাল এবং মানস জগত সম্পর্কে নানা বিশিষ্ট জনের বরাতে অনেক দুর্লভ তথ্য প্রথমবারের মত আমরা জানতে পারি। উল্লেখ্য, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর সম্পর্কে আলাদাভাবে কিছু লিখে যাননি। তাঁর পক্ষে এ কাজ করেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ এবং এ কাজের জন্য দীর্ঘ দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবেন তিনি।

“স্মৃতিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ” গ্রন্থে সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন:
ঢাকাকেন্দ্রিক নতুন সাহিত্যের অভিযাত্রা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মাইলফলক উপন্যাস “লালসালু” থেকেই শুরু হয়েছে।

তিনটি ব্যতিক্রমী উপন্যাসের লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। ব্যক্তি ও মানুষ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে জানতে হলে প্রথম ভরসা সৈয়দ আবুল মকসুদের ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে রচিত বইগুলো।

এদেশে খায়রুন্নেসা খানম নারী মুক্তির পথিকৃৎ ছিলেন। তাঁকে নিয়েও তাঁর অনুসন্ধানী রচনা অনন্য মর্যাদা পাবার দাবী রাখে।
প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদের বিশ্লেষণে রবীন্দ্রনাথের ধর্ম ও দর্শন অভিন্ন। মানুষ যে কেবল ঐহিক নয় আধ্যাত্মিক জীবও এই রাবীন্দ্রিক ভাবনা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।

তাঁর সেলাইবিহীন সফেদ কাপড় পরিধানের সিদ্ধান্ত তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তাকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। নিউইয়র্কে ভাসানী যাদুঘর দেখতে গিয়ে লাইনে দাঁড়ালে দুই আমেরিকান তরুণ-তরুণী তাঁকে ভারতীয় সন্ত জ্ঞান করে প্রণাম করতে আসলে তিনি তাদের ভুল শুধরে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন তিনি সাধু নন, সন্ত নন। ভারতীয় নন, তিনি বাংলাদেশি।

‌ইরাকে আমেরিকার আক্রমণ। ২০০৩ সালে পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার বিরুদ্ধে বর্বরোচিত বিধ্বংসী মার্কিন আক্রমণের প্রতিবাদে পাশ্চাত্যের পোষাক শার্ট-প্যান্ট ছেড়েছেন তিনি। সেই থেকে শেষ দিন অবধি টানা ১৮ বছর সেলাইবিহীন দুই টুকরা কাপড় ছিল তাঁর পরিধেয় পোষাক।।মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলন, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অহিংস অবাধ্যতা প্রদর্শন ছিল তাঁর রাজনৈতিক সংস্কৃতি।

‌তাঁর “স্যার ফিলিপ হার্টগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য” বইটি একটি অনালোকিত অজানা অধ্যায়কে আজকের নবীন পাঠকের সামনে যথাযথ ঐতিহাসিক গুরুত্বে উপস্থাপন করেছে। এই বইটি আমাদেরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্নের উপাচার্য ‘বিশপ বার্কলে স্কলার’ SOAS-এর মুখ্য প্রশাসক, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক রেজিস্ট্রার, ম্যানচেস্টার এবং ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি-দ্বয়ে অসামান্য ভূমিকা পালনকারী কৃতবিদ্য পণ্ডিত -প্রশাসক স্যার ফিলিপ হার্টগ সম্পর্কে অসংখ্য অজানা তথ্য ও সত্য জানিয়ে দিয়েছে। সৈয়দ আবুল মকসুদ বইটির ‘প্রবেশক’-এ মন্তব্য করেছেন –
“ড. হার্টগ অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে চেয়েছেন পূর্ব বাংলায় একটি জ্ঞানবিভাসিত মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠুক, বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে।”
দ্বিধা করেননি একথা বলতেও:
“গত ১০০ বছরে আধুনিক বাংলাদেশের যাঁরা নির্মাতা, স্যার ফিলিপ হার্টগ তাঁদের প্রথম সারির একজন।”
বইটির “উপক্রমণিকা”য় তিনি মন্তব্য করেছেন:

” হার্টগ পরিবার ধর্মীয় পরিচয়ে ছিলেন ইহুদি। এখানে তাঁদের কোন উপাসনালয়ও ছিল না। সেই নিঃসঙ্গতা তাঁরা ভরিয়ে দিয়েছিলেন কর্মব্যস্ততা দিয়ে। পাঁচটি বছর ফিলিপ দিনে অন্তত ১৮ ঘণ্টা কাজ করতেন বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তুলতে।”

সৈয়দ আবুল মকসুদ বইটি রচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সখেদ মন্তব্য করেছেন:
“বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ ও আমেরিকার নাগরিক উপমহাদেশে মানুষের জন্য কাজ করে স্মরণীয় হয়ে আছেন। পাদ্রি উইলিয়াম কেরি, উইলিয়াম জোনস, উইলিয়াম ডব্লিউ পিয়ারসন, সি এফ এন্ড্রুজ, জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন, উইলিয়াম ওয়ার্ড, অ্যানি বেসান্ত, ভগিনী নিবেদিতা প্রমুখ। সেই সব নামের সঙ্গে ফিলিপ জোসেফ হার্টগের নাম যুক্ত না থাকা তাঁর প্রতি খুব বড় রকমের অবহেলা। বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি তাঁর কাছে অশেষ ঋণের দায়ে আবদ্ধ। এ বই সেই ঋণ স্বীকারের সামান্যতম প্র‍য়াস।”

সৈয়দ আবুল মকসুদের আরেকটি বিখ্যাত গ্রন্থ “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা”। গ্রন্থের শিরোনাম থেকেই গ্রন্থের সূচিপত্র আঁচ করা যায়। ৩৯২-পৃষ্ঠার বৃহদায়তন কলেবরের শ্রমসাধ্য গবেষণা-ঋদ্ধ এ বই বিশ্লেষণ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মবৃত্তান্ত ও ধারাবাহিক বিকাশের আদ্যোপআন্ত।
গ্রন্থটির শেষের পাতা হতে দু অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করে সৈয়দ আবুল মকসুদের জাগতিক জ্ঞানগত সাধনাকে অভিবাদন জানিয়ে শেষ করছি:

” বাংলার গভর্ণর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর স্যার আলেকজান্ডার লিটনের ভাষায়, ঢাকা নামাঙ্কিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল The national university of Eastern Bengal – পূর্ব বাংলার ( বাংলাদেশের ) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর মতে, অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ যেমন ব্রিটেনে সন্তানোচিত মমত্ববোধ ও দেশাত্মবোধ সৃষ্টিতে প্রেরণাদায়ক ভূমিকা পালন করবে, সেরকমই – ‘Filial devotion, a patriotic sentiment, in the hearts of her sons similar to those which Oxford and Cambridge have so far long inspired’ – এ বিশ্ববিদ্যালয়ও পালন করে। তাঁর সে প্রত্যাশা অনেকটাই পূরণ হয়েছে, তার প্রমাণ সেকালের Eastern Bengal-এই একালের স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যদিও তা সীমাহীন রক্তের বিনিময়ে।
স্যার ফিলিপ হার্টগের ভাষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল an ideal university – একটি আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের অনেককেই বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো Oxford of the East। কেউই বিশেষ বাড়িয়ে বলেননি। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডের মতো একটি আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিল এবং শুধু সম্ভাবনাই ছিল না, সেরকমটি হওয়ার প্রস্তুতিও ছিল। তবে উপনিবেশিত দেশ হওয়ায় অর্থনৈতিক সংগতি ছিল না। প্রথম পর্যায়ের পরিচালকদের প্রচেষ্টায় ঘাটতি ছিল না। তবু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতিকে যা দিয়েছে, তার তুলনা দ্বিতীয়টি নেই।”

মুজিব রাহমান: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ। চট্টগ্রাম কলেজ।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন