দারিদ্র্যের অর্থনীতি।। মাঈন উদ্দিন জাহেদ।। পুবাকাশ
ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে বাংলাদেশ কখনো ‘সোনার বাংলা ‘ ছিল না। – আকবর আলি খান
অমর একুশে বইমেলা- ২০২০ এ প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খান এর ‘দারিদ্র্যের অর্থনীতি অতীত: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ বইটি।
এ লেখক ইতিহাসে অনার্স ও এমএ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ ও পিএইচডি । মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন; পাকিস্তানি জান্তা তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে । তিনি বাংলাদেশ সরকারের অর্থসচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। উপদেষ্টা ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। তাঁর জনপ্রিয় প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে : পরার্থপরতার অর্থনীতি, আজব ও জবর আজব অর্থনীতি, অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি, বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য : একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ: চাবিকাঠির খোঁজে: নতুন আলােকে জীবনানন্দের বনলতা সেন: দুর্ভাবনা ও ভাবনা : রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে Discovery of Bangladesh; Gresham’s Law Syndrome and Beyond a Friendly Fires, Humpty Dumpty Disorder and Other Essays.
এ বইয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ‘দারিদ্র্য ‘ কবিতার পটভূমি উল্লেখ করে শুরু করলেও, তিনি জীবনের কাব্যময়তায় থাকেন নি, চলেগেছেন মানব সভ্যতা প্রাচীন ও মধ্যযুগ থেকে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক হালহাকিকত নির্ধারনের গদ্যময়তায়।
৪৪৮ পৃষ্ঠার এ বইটি ছয় খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে দারিদ্র্য সম্পর্কে সাধারণ আলােচনা এবং বইটির রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে অতীতে ও বর্তমানে দারিদ্র্যের প্রবণতা সম্পর্কে আলােচনা হয়েছে। এই খণ্ড দুটি অধ্যায়। দ্বিতীয় অধ্যায়ে অতীতে বিভিন্ন সমাজে মাথাপিছু আয়ের প্রবণতা ও গড় আয়ুর প্রত্যাশা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে বাংলাদেশের অতীতের অর্থনীতি সম্পর্কে পর্যালােচনা কার হয়েছে ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে বাংলাদেশ কখন সােনার বাংলা’ ছিল না।
চতুর্থ অধ্যায়ে দারিদ্র্যরেখার ভিত্তিতে দারিদ্র্যের পরিমাণগত এবং গুণগত মাপের সূত্রসমূহ এবং এর ত্রুটিসমূহ আলােচনা করা হয়েছে। তবে এসব একমাত্রিক, বাস্তবে দারিদ্র্য বহুমাত্রিক। তাই পঞ্চম অধ্যায়ে দারিদ্র্য পর মাত্রিক সূত্ৰসমূহ সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে। বিশেষ করে মানব উন্নয়ন সূচক (Human Development Index), বিশ্ব ক্ষুধার সূচক (Global hunger Index), সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রা (Millennium Development Goals) এবং টেকসই উন্নয়ন (Sustainable Develo Goals) নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে বিংশ শতাব্দীতে এবং বাংলাদেশে দারিদ্র্য নিরসনে কী অগ্রগতি হয়েছে, তা পর্যালােচনা হয়েছে। বিশেষ করে কোথায় কোথায় সাফল্য অর্জিত হয়েছে এবং কোথায় কোথায় এখনাে দুর্বলতা রয়েছে, তা চিহ্নিত করা হয়েছে।
” তৃতীয় খণ্ডে দারিদ্র্য নিরসনে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে। সপ্তম থেকে দশ অধ্যায়ে বিস্তৃত আলোচনা। নারী-শিশু, বেকার সমস্যা, সামাজিক নিরাপত্তা, পল্লি উন্নয়নসহ ভৌত ও সামাজিক কাঠামো নিয়ে বিশ্লেষণ রয়েছে।
চতুর্থ খণ্ডের উপজীব্য হলো দারিদ্র্য নিরসনে বেসরকারী খাতের ভূমিকা। একাদশে অধ্যায়ে স্যার ফজলে হোসেন আবেদের ব্র্যাকের কর্মসূচি নিয়ে পর্যালোচনা। দ্বাদশ অধ্যায়ে ড. মুহাম্মাদ ইউনুসের গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি সাফল্য ও দুর্বলতা আলোচনা হয়েছে।
দারিদ্র্য নিরসনে সুদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয়েছে ত্রয়োদশ অধ্যায়ে। সুদ ব্যবস্থা নিয়ে নানা ধর্মের মতগুলো পর্যালোনা হয়েছে। ধর্মপ্রান মুসলমানেরা মনে করেন ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব। ইসলামী ব্যাংকের সম্ভাবনা ও দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা রয়েছে চতুর্দশ অধ্যায়ে।
পঞ্চম খণ্ডে অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত দারিদ্রের ধারণার যে পরিবর্তন ও দারিদ্র্য নিরসনে যেসব সাফল্য অর্জন করা হয়েছে, তা বর্ণনা হয়েছে। এই বিশ্লেষণে দারিদ্র্যের ধারণা যে ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে, তা পষ্ট করা হয়েছে। আজকে আমরা যাকে দারিদ্র্য বলি, আগামী দিনে তা দরিদ্র্যের সঠিক সংজ্ঞা হবে না। নতুন নতুন দারিদ্র্যের কালাে ছায়ার প্রভার মানুষের জীবনের ওপর পড়তে পারে।
এ ক্ষেত্রে খ্যাতিমান কবি তারাপদ রায়ের দারিদ্ররেখা কবিতাটি খুব প্রাসঙ্গিক-
দারিদ্র্যরেখা // তারাপদ রায়
আমি নিতান্ত গরীব ছিলাম, খুবই গরীব ।
আমার ক্ষুধার অন্ন ছিল না,
আমার লজ্জা নিবারণের কাপড় ছিল না,
আমার মাথার উপরে আচ্ছাদন ছিল না।
অসীম দয়ার শরীর আপনার,
আপনি এসে আমাকে বললেন,
না, গরীব কথাটা খুব খারাপ,
ওতে মানুষের মর্যাদা হানি হয়,
তুমি আসলে দরিদ্র ।
অপরিসীম দারিদ্র্যের মধ্যে আমার কষ্টের দিন,
আমার কষ্টের দিন, দিনের পর দিন আর শেষ হয় না,
আমি আরাে জীর্ণ আরাে ক্লিষ্ট হয়ে গেলাম ।
হঠাৎ আপনি আবার এলেন, এসে বললেন,
দ্যাখাে, বিবেচনা করে দেখলাম,
দরিদ্র শব্দটিও ভালাে নয়, তুমি হলে নিঃস্ব।
দীর্ঘ নিঃস্বতায় আমার দিন রাত্রি,
গনগনে গরমে পুঁকতে ধুকতে,
শীতের রাতের ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে,
বর্ষার জলে ভিজতে ভিজতে,
আমি নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে গেলাম।
আপনার কিন্তু ক্লান্তি নেই,
আপনি আবার এলেন, আপনি বললেন,
তােমার নিঃস্বতার কোনাে মানে হয় না,
তুমি নিঃস্ব হবে কেন,
তােমাকে চিরকাল শুধু বঞ্চনা করা হয়েছে,
তুমি বঞ্চিত, তুমি চিরবঞ্চিত।
আমার বঞ্চনার অবসান নেই,
বছরের পর বছর আধপেটা খেয়ে,
উদোম আকাশের নিচে রাস্তায় শুয়ে,
কঙ্কালসার আমার বেঁচে থাকা।
কিন্তু আপনি আমাকে ভােলেননি,
এবার আপনার মুষ্টিবদ্ধ হাত,
আপনি এসে উদাত্ত কণ্ঠে ডাক দিলেন,
জাগাে, জাগাে সর্বহারা ।।
তখন আর আমার জাগবার ক্ষমতা নেই,
ক্ষুধায় অনাহারে আমি শেষ হয়ে এসেছি,
আমার বুকের পাঁজর হাপরের মতাে ওঠানামা করছে,
আপনার উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে।
আমি তাল মেলাতে পারছি না।
ইতিমধ্যে আরাে বহুদিন গিয়েছে,
আপনি এখন আরাে বুদ্ধিমান,
আরাে চৌকস হয়েছেন।
এবার আপনি একটি ব্ল্যাকবাের্ড নিয়ে এসেছেন,
সেখানে চকখড়ি দিয়ে যত্ন করে
একটা ঝকঝকে লম্বা লাইন টেনে দিয়েছেন।
এবার বড় পরিশ্রম হয়েছে আপনার,
কপালের ঘাম মুছে আমাকে বলেছেন,
এই যে রেখা দেখছাে, এর নিচে,
অনেক নিচে তুমি রয়েছে।
চমৎকার!
আপনাকে ধন্যবাদ, বহু ধন্যবাদ!
আমার গরীবপনার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার দারিদ্র্যের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার নিঃস্বতার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার বঞ্চনার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার সর্বহারাত্বের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আর সবশেষে ওই ঝকঝকে লম্বা রেখাটি,
ওই উজ্জ্বল উপহারটির জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।
কিন্তু,
ক্রমশ,
আমার ক্ষুধার অন্ন এখন আরাে কমে গেছে,
আমার লজ্জা নিবারণের কাপড় এখন আরাে ছিড়ে গেছে,
আমার মাথার ওপরের আচ্ছাদন আরাে সরে গেছে।
কিন্তু ধন্যবাদ,
হে প্রগাঢ় হিতৈষী, আপনাকে বহু ধন্যবাদ!
পঞ্চদশ অধ্যায়ে এই বইয়ের সামগ্রিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে দারিদ্র্য নিরসনের জন্য বাংলাদেশে কী কী জরুরি বলে প্রয়োজন, সে সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে।
সামগ্রিক ভাবে এ বইয়ে দারিদ্র্য নিয়ে সুসংবাদ রয়েছে, আবার দুঃসংবাদও রয়েছে। সুসংবাদ হলাে ১৯৯০ সালে বিশ্বে ৫৫.১ শতাংশ মানুষ সহনীয় দারিদ্র্যরেখার নিচে ছিল; ২০১৫ সালে এই হার ২৬.৩ শতাংশে নেমে আসে। দুঃসংবাদ হলাে ২০১৫ সালে পৃথিবীতে ১৯৩.৪ কোটি দরিদ্র ছিল । ১৯০০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ১৬৫ কোটি; ১৮০০ সালে ছিল ১০০ কোটি। সম্পূর্ণ দারিদ্র্য নিরসন এখনাে অনেক দূরে । যাঁরা আশাবাদী, তাঁদের প্রত্যাশা হলাে বিশ্ব থেকে দারিদ্র্য নির্মূল হয়ে যাবে; দারিদ্র্যের নিদর্শন শুধু বেঁচে থাকবে জাদুঘরে। যারা আশাবাদী নন, তাঁরা মনে করেন যে শুধু বর্তমান অর্জনের ভিত্তিতে দারিদ্র্য নিরসনের চূড়ান্ত মূল্যায়ন করা যাবে না । দারিদ্র্য নিরসনকে অতীতের প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে এবং ভবিষ্যতের দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখতে হবে। তাই এই বইয়ে দারিদ্র্যের পরিমাপ ও সংজ্ঞা সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে। দারিদ্র্যের সংজ্ঞার পরিবর্তনও বিশ্লেষণ করা। হয়েছে। যারা ক্ষুধার্ত শুধু তারাই দরিদ্র নয়। আজকে যারা বেকার, তারাও গরিব । ধনবৈষম্যের ত্রিভুজের সর্বনিম্ন ৪০ শতাংশ মানুষও দরিদ্র। বইটি লেখা হয়েছে সাধারণ পাঠকের জন্য, দারিদ্র্য নিরসনের জন্য যারা কাজ করছেন, তাদের জন্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে দারিদ্র্য নিয়ে যারা পড়ছেন, তাঁদের জন্য।
দারিদ্র্যের অতীত থেকে মানুষকে শিক্ষা নিতে, দারিদ্র্য নিরসনের সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে এবং ভবিষ্যতে দারিদ্র্য মােকাবিলা জন্য প্রস্তুতি নিতে বিদগ্ধ লেখক আকবর আলি খান মহামতী গৌতম বুদ্ধের একটি বাণী স্মরণ করে দিয়েছেন-
No one save us but ourselves. No one can and no one may. We arselves must walk the path.
—————————————
দারিদ্র্যের অর্থনীতি : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
গ্রন্থস্বত্ব : ২০২০ আকবর আলি খান।
প্রথম প্রকাশ : অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০
ফাল্গুন ১৪২৬, ফেব্রুয়ারি ২০২০
প্রকাশক : প্রথমা প্রকাশন
প্রচ্ছদ : মাসুক হেলাল
মূল্য : ৭২০ টাকা।
মাঈন উদ্দিন জাহেদ : কবি ও প্রাবন্ধিক। সম্পাদক: পুবাকাশ।