একগুচ্ছ কবিতা।। নাজমুন নাহার।। পুবাকাশ
এক. আমি কেমন তুমিময় হয়ে যাচ্ছি
স্মৃতিভ্রম হয়েছে আমার
কিভাবে ভুলে যাচ্ছি লখনৌকে
ভুলে যাচ্ছি গ্রাম আর তোমাকে
ঐ যে দেখো শুভ্র কাফন ওড়াচ্ছে
বাতাসে বাতাসে গুমড়ে গুমড়ে ডাকছে আমাকে
রোদ ডাকে,
আকাশের খন্ড খন্ড তুলার মতো মেঘ ডাকে
আয় আয় –
পথ ভুলে যাই
বিক্ষিপ্ত আচরণ করি
দেখছি ওরকম শীতল পাটির মতো মসৃণ মেয়েকে
হাই বলে কে একজন পথ রোধ করে দাঁড়ায়
তার ওরকম শতরঞ্চির মতো মসৃন চুল দেখে
নাক দেখে চিবুক দেখে থমকে দাঁড়াই
হাসতে হাসতে পাহাড়ে দুলে দুলে পড়ি
আহা তোমাকে মিস করি
কাফনের কাপড়ের দিকে তুলা উড়িয়ে দিই
বেলফুলের পাতায় জল গড়িয়ে দেই
কেমন তুমিময় হয়ে উঠি
তুমি কেমন দুর বাতাস হয়ে যাচ্ছ –
আমি ভাঙতে ভাঙতে ভাবছি
আমি তুমিহীনা কি করে বাঁচি –
তবু হাসছি, কাঁপছি
পাতা উড়ছে
আমি তুমিময় হচ্ছি –
মিলরুমে চোখ কাঁপছে
জল ঝরছে
তোমাকে সহস্রবার দুরে সরিয়ে
ফিরে ফিরে আসছি –
একে কেনো প্রেম বলে –
কাফন কেনো বলে না!
দুই. চলো সিদ্ধার্থ
চলো সিদ্ধার্থ রাজার কুমার
বের হয়ে যাই
দেখো এমন চনমনে বাতাস
আকাশে ঘুড়ি উড়ছে
হিজাব পড়ে দুচোখ আর ভ্রুতে শিল্পের ছোঁয়ায় আরব তরুণী কিনছে অগণিত লাশ
অজিরা ফুরফুরে মেজাজে খালি গায়েই নেমে পড়েছে নগ্ন রাস্তায়
গেরুয়া পোশাক পড়ে হাঁটছে ঝুকে ঝুকে অসি বৃদ্ধ
তার হাজার বছরের দেনায় শনের মত সাদা চুল
পত পত করে উড়ছে
ভালোবাসার জন্যে ওর বুক জ্বলে ছাই হয়ে গেছে
ফিস ফিস করে বলছি
তোমরা সবাই একটু চুপ থাকো –
আজ আমাদের ভালোবাসার রাত ঘনীভুত হয়েছে –
আমরা জমে যাচ্ছি শীতে
আরো ঘন হচ্ছি শীতের দুপুরে –
সিদ্ধার্থ আজ এমন ধোঁয়াশায়
হাত ধরো
ভালোবাসো –
প্রেম করো –
বৃক্ষের গায়ে গায়ে লতিয়ে পড়ছে এমন গন্ধবিহীন লালচে ফুল
সাপের মতো চোখ তুলে তাকায়
আমি হিম হিম শীতে তার গায়ে হাত রাখি
সিদ্ধার্থ যদি শীত থাকে
উষ্ণ হয় বাতাস
আর একবার ঘন হয়ে বসো
সাইরেন বাজিয়ে বলো
আমাদের কত দেরী জীবনের কাছে যেতে
আমরা যে মরে গেছি
সীমানা পার হতে হতে।
তিন. হেঁটে যায়
রাত শুয়েছে সমুদ্রে
আর তুমি এভাবে বরফের মতো
দাঁড়িয়ে থেকো না
আমার ব্যথা হয় –
বৃদ্ধ তার লম্বা সাদা চুল নিয়ে দৌড়ুচ্ছে
ফিসফিস করেছে আমার কানে
কেনো ব্যথা নাও হে —
থরে থরে বৃক্ষ -হাস্নাহেনার সুবাসে
হেঁটে যাই, ঘুরে যাই,
আহারে – আমার বুঝি কেউ নাই —
চার. দূরের বাদ্য
সেদিন ছিল সেই আশ্চর্য বিকেল
তিনি বললেন “ বসতে পারি প্লিজ ?
যদিও পাশের সিট খালিই ছিল
তবু অনিচ্ছাকৃত হ্যাঁ বলে তাঁকে বসতে দিলাম ‘
লাজুক এবং চশমা চোখের ভদ্রলোক
দেখেই ভাল লাগার ঘোর তৈরী হয় ।
উনি সেই যে বসেই মুখে কুলুপ আঁটলেন —
আমি ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখি সবুজ শস্যের গ্রাম আর মাঠ
ছুটে যাচ্ছে তারা আমাদের সাথেই
কতক্ষন চুপ থাকা যায় ?
জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাচ্ছেন ?
উনি ইতস্তত করলেন
ভেতরে সন্দেহের ঘোর কি ?
হঠাতই বৃষ্টি !
আহ !কেন যে আসে বৃষ্টি ?
একেলা সুখের মত পাশে এসে
জানান দেয় সবগুলো ভাললাগার ঘোর –
যিনি আছেন পাশে , ছুঁয়ে দিতে পারেন হাত –
নাহ এটুকু অভদ্র তিনি হতে পারেন না
একাকী বিষণ্ণ হই ফের
কতজনের চোখে আমি নীল নয়না সুন্দরী
তার কি চোখে পড়ে না ?
চা নিয়ে এল ট্রেনের সেবক
তিনি এক কাপ নিয়ে আর এক কাপ আমাকে দিলেন
এরপর ভেঙ্গে গেল সব বাঁধ
গল্পে গল্পে কেটে গেল কতটা বুনো সময় !
ঝিক ঝিক ট্রেনের ঝম ঝম নৃত্য –
এলাম বুঝি ?
এত তাড়াতাড়ি কেন যে সময় যায় ?
নেমে যাওয়ার সময় হল বলে –
তিনি উঠলেন –
লিখে দিলেন মুঠোফোনের আঁকাবাঁকা নম্বর গুলো
বাসায় এসে যথারীতি মনে হল তাঁকে
একটা কল করলেই হয়-
নাহ কি হবে ?
রেখে দিয়েছি মুঠোফোনের সংখ্যাগুলো
সুগন্ধী রুমালের সাথে
মাঝে মাঝে দেখা হয় ওদের সাথে
ইচ্ছে করে ডায়াল করি
জিজ্ঞেস করি
কেমন আছেন ?
হয়নি তাঁকে কল করা
কি হবে দূরের অলীক ভালবাসাবাসি কাছে এনে —
পাঁচ. পুরুষসিংহ
বদলে যাচ্ছেন পুরুষ সিংহ।
যিনি রাজা ছিলেন ত্রিপুরার,
অসাম হয়ে কালকিনী
এবং কিঞ্চিৎ ওজোন স্তরের –
তিনি বদলে যাচ্ছেন তার মত করে –
যেমন বদলে যায় গিরগিটি,
স্বপ্ন দেখে বদলে যান
স্থলমাইন রোপন করা প্রিয় পিতা।
সেবার প্রিয় আংগুর বনে ফুলের সমারোহ
আমাদের ঘরে বেদনার অধিক আবহ –
তথাপি প্রিয় এরিক
নেশারু হতে গেলে পাকজমিনে যে গুল্মের রস আছে
তাতে কিঞ্চিত ঠোঁট রেখো –
উদগ্র কামনার রসে জারিত বাসনার নেশায়
পাতলা হতে শুরু করেছে পাতলুন
তোমার ভ্রমের নেশায়
ঘুম আসেনা হে প্রিয় –
নাজমুন নাহার : কবি ও প্রাবন্ধিক। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী।