ছোটগল্প


ভাঙ্গন।। মাসুদুর রহমান মাসুদ।। পুবাকাশ


মিনিট পাঁচের পরেই বাইরে কান্নার শব্দ! লােকজন দৌড়া দৌড়ি করছে।
ফুলবানু বের হয়।
শুনে নুরু আর নেই।
ঢাকা থেকে আগত দ্রুতগামী কোচ রিক্সাসহ নুরুকে পিষে চলে গেছে! ফুলবানু পাথর হয়ে যায়! গােটা আকাশ মাথার উপর ভেঙ্গে পরে! সােহাগী মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে।
বাপরে ধরে চিৎকার করে বলছে ও বাপ কথা কও


বড় পাকা সড়ক। সড়কের পার্শ্বেই বড় একটি গােড়স্থান। এই সড়কের পাশ্বেই নুরু মিয়ার ঘর। প্রায় ত্রিশ বছর আগে নুরুর বাপ এসেছিল নদী ভাঙ্গন এলাকা থেকে।

এদের কে এই এলাকার লােকজন রংপুরিয়া হিসাবে চিনে। বাপের কাছে নুরু শুনেছিল, নদী ভাঙ্গন তাদের সবকিছু হ্রাস করেছিল।এলাকায় তখন খুবই অভাব। নুরু মিয়ার বাবা তাদের নিয়ে চলে এসেছিল ঠাকুরগাঁও এর এই এলাকায়। ধুধু ফাঁকা মাঠ। ঐখানেই মাথা গােজার মতাে তাবু করে মাস তিনেক ছিল। তারপর এলাকার মানুষের সহযােগিতায় বাঁশ ও খড় দিয়ে ঘর করে নুরু মিয়ার বাপ। ধিরে ধিরে রংপুর নদী ভাঙ্গন এলাকার বহু মানুষ এখানে এসে বাড়ি করে।

এখন বড় একটি বস্তিতে পরিণত হয় । সবাই ডাঙ্গি বস্তি নামে চিনে। বস্তির বেশির ভাগ পুরুষ রিক্সাচালক।
মহিলাদের অনেকে ইট ভাটায় কাজ করে। কেউ কেউ এলাকায় কারাে বাড়িতে ঝি এর কাজ করে।
বস্তি থেকে শহর মাত্র দু-কিলােমিটার। বস্তির মেয়ে ফুলবানুকে দিয়ে নুরুর বাপ, নুরুকে বিয়ে দেয়। এক বছরের মধ্যে নুরুর বাপ ও মা অসুখে মারা যায়।
নুরু ও ফুলবানুর কোলজুরে জন্ম হয় একটি কন্যা সন্তান। আদর করে নুরু নাম রাখে সােহাগী।

নুরু শহরে রিক্সাচালায়। খুবই কর্মঠ। অভাব দুর হয়ে আর্থিক সচ্ছলতা যথেষ্ঠ হচ্ছে । খরের ঘর পরিবর্তন করে টিনের ঘর করেছে। টাকা জমিয়ে এই বছর একটি গরু কিনেছে।

ফুলবানু ও সােহাগী গরুটিকে খুব যত্ন করে। প্রতিদিন ভাের বেলা নুরু রিক্সা নিয়ে শহরে চলে যায়। স্টেশনে তখন ঢাকা থেকে ট্রেন আসে। যাত্রী পাবার আশায়। ভাের বেলা যাত্রীর কাছে ভাড়া বেশি পাওয়া যায় রিক্সা ও কম থাকে।
আজ ভােরে সােহাগী বাপরে ডাকে।
ও বাপ উঠ। যাবিনে?
নুরু মিয়ার শরীরটা ভাল নেই। তবুও উঠে।
রিক্সা বের করে। ফুলবানু খাওয়ার জন্য পাউরুটি ও পানি দেয়। সােহাগী বাপের দিকে চেয়ে থাকে। বাপরে দেখলে সােহাগীর মনটা ভরে উঠে। বাপ, সেই দুপুর বেলা আসবে, ভাত খেতে।সােহাগীর জন্য ললিপপ, কোনদিন মটর ভাজা নিয়ে আসে। নুরু মিয়া সােহাগীর মাথায় হাত বুলিয়ে রিক্সা নিয়ে বের হয়ে যায়। সােহাগী আবার শুয়ে পরে। ফুলবানু গরুটিকে খাবার দেয়। মিনিট পাঁচের পরেই বাইরে কান্নার শব্দ! লােকজন দৌড়া দৌড়ি করছে।
ফুলবানু বের হয়।
শুনে নুরু আর নেই।
ঢাকা থেকে আগত দ্রুতগামী কোচ রিক্সাসহ নুরুকে পিষে চলে গেছে! ফুলবানু পাথর হয়ে যায়! গােটা আকাশ মাথার উপর ভেঙ্গে পরে! সােহাগী মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে।
বাপরে ধরে চিৎকার করে বলছে ও বাপ কথা কও
আমার জন্য আর ললিপপ নিয়ে আসবেনে। আমি আর কারে বাপ করে ডাকুম। আমারে কে আর আদর করবে।
উপস্থিত লােকদের সবার চোখে পানি! ফুলবানু অজ্ঞান হয়ে গেছে!
মেয়েটির আহাজারি আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে।
কয়েক মাস কেটে যায়। ফুলবানু শক্ত হয় । মনটারে স্থীর করে ।মেয়েটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। তাকে লেখা পড়া শিখিয়ে অনেক বড় মানুষ করবে। বিয়ে সংসার সে আর করবেনা। বাড়িতে অভাব দেখা দেয়।
বস্তির অনেক মহিলা ইট ভাটায় কাজ করে । ফুলবানু সিদ্ধান্ত নেয় সে ইট ভাটায় কাজে যাবে। পরের দিন বস্তির মহিলা জোহরার সাথে,ভাটায় যায়। ম্যানেজারের সাথে দেখা করে । ম্যানেজার দুঃখের কথা শুনে, কাজে আসতে বলে।
রাতে সােহাগীকে বুঝায়। মা আমাগাে সংসারে কামাইয়ের মানুষ নেই। যে ছিল সেতাে চলে গেল।
আগামীকাল থেকে সকাল সাত টায় ইট ভাটায় পৌছতে হবে। বিকেল পাঁচটায় ছুটি। সােহাগীর চোখ পানিতে ভরে উঠে। ফুলবানু ও কাঁদে। মাকে ছাড়া সে কেমনে বাড়িতে থাকবে।
মা আমি কার লগে থাকুম।
বস্তির পােলাপানদের লগে খেলবে।
দুপুর বেলা গােসল করে ভাত খেয়ে নিবে।
ফুল বানু ফজরের আজানের সময় ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে। ভাত তরকারী রান্না করে, ব্যাগে ভরে নেয়। সােহাগী ঘুম থেকে উঠে । মায়ের দিকে চেয়ে থাকে ।
ফুলবানু সােহাগীর মাথায় হাত বুলিয়ে, চোখ মুছতে মুছতে কাজে চলে যায়।
ফুলবানু সকাল বেলা কাজে যায় সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে। গােসল করে শরীর পরিষ্কার করে। ক্লান্ত শরীরে আবার রান্না বান্না করে। ভাত খেয়ে তাড়াতাড়ি মা ও মেয়ে শুয়ে পরে।
একদিন সােহাগী মাকে বলে।
মা জান, বাপের কত স্বপ্ন ছিল আমারে নিয়ে । আমি লেহাপড়া কইরা অনেক বড় হইব।
ও মা আমি স্কুলে যাবাে। বস্তির শেফালি,ঝিনুক ওরা স্কুলে যায়।
আমিও ওদের সাথে কাল থেকে স্কুলে যাবাে।
ফুলবানু ভাবে বাড়িতে একা না থেকে স্কুলে যাওয়াই ভালাে হবে। লেখা পড়ার প্রতি ওর অনেক ঝােক।
রাতে ফুল বানু সােহাগীকে নিয়ে শেফালী ও ঝিনুকদের বাড়িতে যায় ।
শেফালির মা বলে ও ফুলবানু, কেমন আছােগাে? ভাটাই কাজ কইরা শরীরডা কেমন হইয়া গেছে।
কি করবাে খালা আম্মা। খেয়ে বাঁচতে তাে হবে।
কি কাজে আইছাে?
শেফালির লগে দেখা করার জন্য ।
আমাগীকাল থেকে সােহাগী তাদের সাথে স্কুলে যাবে। সােহাগী আনন্দে হাঁসতে থাকে। শেফালি ও খুশি হয়। সােহাগী খুব ভাল মেয়ে ওর একজন ভালবন্ধু ।
পরের দিন ফুলবানু ভাটায় চলে যায়। শেফালি,ঝিনুক ও সােহাগী তিনজনে স্কুলে রওনাদেয়। স্কুলে যাওয়ার আনন্দে সে কথায় কথায় হাসতে থাকে।
হঠাৎ একদিন সন্ধ্যা বেলা। প্রাইমারী মডেল স্কুলের শিক্ষিকা সালমা আপা বাড়িতে হাজির । বাইরে থেকে ডাকছে।
ফুলবানু ও ফুলবানু বাড়িতে আছাে?
ফুলবানু বলে কে গাে?
এই সন্ধ্যা বেলায় এমন করে ডাকছাে? ঘরের বাইরে বের হয়, দেখে সালমা আপা। খুব ভালাে মানুষ। নুরু মিয়া মাসিক ভাড়া হিসাবে স্কুলে পৌঁছে দিত। আবার সময় মত স্কুল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসত।
নুরু মিয়া মারা যাওয়ার পর বাড়িতে এসে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিল ফুলবানুর হাতে, কেঁদেছিল।
ফুলবানুকে আশ্বাস দিয়েছিল। কাঁদিসনে, তাের মেয়ের দায়িত্ব আমি নিব। ওকে লেখা পড়া শিখিয়ে অনেক বড় করব।
নুরু সব সময় সােহাগীর কথা বলত। আপা মেয়েটারে লেখা পড়া করাইয়া অনেক বড় মানুষ বানাবাে। কথাগুলাে বলতে বলতে সালমার চোখে জল আসে।
চোখ মুছে বলে। তােমার বাড়িতে আসার কারণ, সােহাগীর দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলাম। সেই জন্য এসেছি। তুমিতাে জান আমার একমাত্র সন্তান রিয়ান সেতো ঢাকায় লেখাপড়া করে। রিয়ানের বাবা, রংপুরে সােনালী ব্যাংকে চাকুরী করে। সপ্তাহে ছুটির দিন আসে।
বাড়িতে আমি একাই থাকি।
সােহাগী আমার সাথে থাকলে আমার একাকিত্ব ঘুচবে। আমার তাে মেয়ে নেই। তাকে আমার মেয়ে বানাবাে।
আমার স্বামী ও ছেলের সাথে আলাপ করেছি। তারা সম্মতি দিয়েছে।
আমার ছেলে রায়ান ভীষন খুশি । সােহাগীর কথা বলতেই, সে বলে মা?
নুরু কাকার মেয়ে, আমি তাে তাকে দেখেছি। ও খুশি হয়ে যায়। মা আমার তাে বােন নেই। সােহাগীই হবে আমার ছােট বােন। সােহাগীর চোখ ছলছল করে উঠে। সালমা জিজ্ঞেস করে কি সােহাগী?

আমার মেয়ে হবে। সােহাগী চুপ করে থাকে। ফুলবানুকে দুই হাজার টাকা দেয় চাল,ডাল কেনার জন্য।
ফুলবানু তুমি সিদ্ধান্ত নাও।
আমি কিন্তু আগামী শুক্রবার সন্ধ্যায় এসে সােহাগীকে নিয়ে যাবাে। বলে ঘর থেকে বের হয়ে, ভাড়া অটোই উঠে চলে যায়।

সারারাত ফুলবানু ঘুমাতে পারেনি।
মেয়েটির ভবিষ্যৎ চিন্তা করে,পড়াশুনার কথা ভাবে। মেয়েটিকে ছেড়ে কিভাবে থাকবে সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগতে থাকে।সে ইট ভাটাই কাজে যায়।
সারাদিন বাড়িতে থাকে না। মেয়েটা বড় হচ্ছে। দিনকাল খুব খারাপ। বাইরে কত কি ঘটনা ঘটছে।

সালমা আপা তাে কইছে, তার লেহা পড়া সহ সব দায়িত্ব নিবাে। মেয়ে হিসাবে সােহাগীরে গ্রহণ করবাে। ফুলবানু সােহাগিকে ডাকে।
সােহাগী, ওমা ঘুমাইছাে? না মা। ঘুম আহেনা। চিন্তা করছ বুঝি।
হ্যাঁ?
মা সত্যিই তুমি কি আমাকে সালমা খালা আম্মার লগে দিবা। ফুলবানুর বুকটা শূন্য হয়ে উঠে। মেয়ের নিরাপত্তা ও মঙ্গল চিন্তা করে বলে সালমা আপা তােমারে নিজ মাইয়া হিসাবে গ্রহণ করবাে। খুব ভালােমানুষ।

তােমার বাবার স্বপ্ন পুরনের লগে, যাওনে ভালাে হবে মা। সােহাগী ও স্বপ্ন দেখে বড় হওয়ার । চুপ থাকে।
পরের রাতে মা ও মেয়ে শুয়ে আছে। সারাদিন পরিশ্রম করে ক্লান্তিতে ফুলবানু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেছে। আগের রাতে ও তার ভালােমতাে ঘুম হয়নি।
সােহাগী ফুলবানুকে ডাকে। ওমা ঘুমাইছাে? ফুলবানু ঘুমিয়ে আছে।
সােহাগী এপাশ ওপাশ নড়ে। ঘুম আসেনা। আবার মাকে ডাকে।
ওমা ঘুমাইছাে?
ফুলবানু বলে কি?
এহনাে ঘুমাওনি।
ঘুম আহেনা মা। আচ্ছা মা, তােমার লগে না থাকলে, তুমি একা থাকতে পারবে? কষ্ট পাবেনা।
অন্ধকার ঘরে ফুলবানুর দমকে কান্না আসে। মেয়েকে বুঝতে দেয়না।
আমরা গরিব মানুষ। গরিবের আবার কষ্ট।
সারাদিন ভাটায় কাজ করি, বাড়িতে থাকিনা । তাের জন্য ভয় হয়।

দিনকাল ভালাে না, বড় হচ্ছো।
সালমা আপা তােমারে নিজের মাইয়ার মতাে মানুষ করবে। তার মেয়ে নেই। তােমারে মেয়ে বানাবে। আমি
মাঝে মাঝে তােমারে দেখে আসবাে।
বাপের স্বপ্নের কথা মনে হয় সােহাগীর। তােরে লেখা পড়া কইরা অনেক বড় মানুষ হতে হবে সােহাগী………..।
আমি যামু মা ।
সালমা খালা আম্মার বাড়ীতে।
আমি লেখাপড়া শিখা অনেক বড় হমু।
ফুলবানু নিরবে কাঁদতে থাকে। শুক্রবার রাতে সালমা আপা অটো নিয়ে ফুলবানুর বাড়িতে আসে।
সােহাগী পূর্বেই প্রস্তুত ছিল।
ফুলবানু ভিতরে ভিতরে কষ্টে গলে পরছে! সােহাগীকে বুঝতে দেয়না।
কিছুক্ষণ গল্প করার পর, সালমা আপা সােহাগীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে।
সােহাগী তােমার দায়িত্ব আমরা নিলাম । এটি আমাদের পরিবারিক সিদ্ধান্ত। ফুলবানু, তুমি মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসবে। থাকার ইচ্ছে হলে রাত থাকবে।
দুঃখ করি ও না। যা করছি সােহাগীর ভালাের জন্য ও ভবিষ্যৎ মঙ্গলের জন্য। নুরুর স্বপ্ন পুরনের জন্য । আল্লাহ যেন অনেক বড় মানুষ করে।
সালমা সােহাগীর হাত ধরে অটোতে উঠায়। অটো অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়।
ফুলবানু ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। বুকের ভীতরে শুরু হয় নদী
ভাঙ্গন!!!

 

মাসুদুর রহমান মাসুদ : কবি ও গল্পকার।পীরগন্জ, ঠাকুর গাও।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন