গুচ্ছ কবিতা।। আবু জাফর সিকদার।। পুবাকাশ

১. নীল রক্তের খোঁজে

কাশফুল সাদা শুভ্রতা মেখে আশ্বিনী আয়োজন
আকাশী রঙে আঁকে হেঁয়ালিপনা মেঘের আলপনা
সীমাহীন দিগন্তে জমিয়ে তুলে গোধুলি লগন
রঙধনু সাতরঙ বুননে ছেঁড়া জমিন কাঁথা।

লালদীঘি জলে ভিজিয়ে করোটি হয়নি কভু লাল
লাল কণিকা সেঁচে নীলের নব উদ্যমে হয়নি আবাদ
কার রক্তে নীল পদ্ম ফুটে, কে এমন নীল নয়না জননী
কার উদোম শরীরে নাচে কেউটে সাপের নীল বিষ ফণা?

খুঁজে ফিরেছি সেই অণুজীব সরোবর
গ্রহজুড়ে খুঁজেছি এক পেয়ালা নীল
হেমলকের মতো গরলে দু’ঠোঁট ভিজালে
আকণ্ঠনীলে বুজে আসবে আমুদে চোখের পাতা।

নিযুত বছর করতলে লুকিয়ে একলক্ষ তারার আগুন
ফুটালে নিষিক্ত নীলরক্ত বীজ জ্বেলে অজস্র প্রোটন কণা।

২. যুগলবন্দী

সুখের ফোরাতে হৃদয় জ্বালাতে দিয়েছো আগুন অথৈ
হাসি হাসি মনে নীরবে ভেসেছি অতল সাগরে কতোই
শীতে ঝরে পাতা বসন্তকালে ফুটে বনে কতো ফুল
কষ্ট বেড়েছে বাড়ুক দ্বিগুণে আমি তো করিনি ভুল।

জোনাকী আলোয় পথের পথিক খেলছে নিপুণ খেলা
কেউ কি দেখেছে যুগলবন্দী সন্ধ্যা তারার মেলা?
আকাশে ফুটেছে পূর্ণিমা শশি মনোলোভা শোভা অতি
নদীর জোয়ারে ভাসালো দুকূল করেনি কাহারো ক্ষতি।

ভুলের মাসুল হিসাব কষেও পারোনি মিলাতে শেষে
তবুও হিংসার অনলে শিকল পরালে নিঠুর বেশে।
তাজমহলের মর্মরে নুড়ি আজও ঝিলিক মারে
যমুনারতীরে বহে নদী ধীরে লুকিয়ে নজর কাড়ে
হেরেমে রাখিনি রেখেছি যতনে মনের মন্দির ঘরে
মাটির কলিজা গলে গলে মাটি হবে না মরণের পরে ।

৩. আলোর তিয়াসা

লাল কাঁকড়ার ঝাঁক সাক্ষী
নাফের বহমান স্রোত সাক্ষী
গাঙচিল ডানার উড়াল সাক্ষী
রাত বিরাতে ভয়াল আর্ত চিৎকারে
খানখান ভেঙ্গে পড়ে- নৈঃশব্দ্য।
হিমছড়ি ঝর্না থেকে ইনানির পাথুরে বুক
শাপলাপুর থেকে শাহ পরীর দ্বীপ
আছড়ে পড়ে হাঙ্গর নদীর পাশে তৃষিত জলধি।
আর দুঃসহ স্মৃতি বুকে নিয়ে পড়ে থাকে
প্রদীপের নীচে জমাটবদ্ধ এক ঘুটঘুটে অন্ধকার।

৪. ফেরা

আমার যাত্রা পথে কাঁটা পুষ্প বিছিয়েছো তুমি
কাঁটার আঘাতে ঝরছে অভিরাম রক্ত বৃষ্টি
তবু পাপড়ি দলনে হয়েছে অরুচি
পরম্পরা এক ঘৃণালব্ধ মুখোশের মমতায়
আগুন ও বাতাসের প্রেমের মাঝে ঢেলে ঘৃত চন্দন
তুমি উচ্চারণের শৈল্পিক সৌন্দর্য খুঁজে বেড়াও
আমার গ্রীবায়, মাথায়, বুকের পাঁজরে
এঁকে দিয়ে তোমার যুগল পায়ের চিহ্ন ।
তুমি এতটাই স্বাধীনচেতা, এতটাই মুক্ত বিহঙ্গ
আমাকে নিয়ে করছো যত খুশি রঙ্গ ব্যঙ্গ ।
আমার বোবা কান্না, আমার ঘৃণা, আমার ক্রোধ
আমার একদলা উগ্রে দেয়া থুথুর মতো
তোমাকে বেষ্টন করে আছে সর্বত্র
আমার আর ফেরার পথ নেই। তবে একদিন ফিরবই।

৫. শাশ্বত প্রস্থানের অনিবার্য শব্দধ্বনি

শরতের শিশির মাখানো ঘাসফুলে
হিম হিম ভোরের স্নিগ্ধ বিভাস
নদীর দুকূল উপচে পড়া শুভ্রতায়
দুলে উঠে মায়াবি গোলক।
কোন এক বিহগের একটানা আর্তনাদ শুনে শুনে
মরুময় তপ্ত বালুকা সময় হেলে পড়ে দুপুরে
জানালার কার্নিশে ঝুলে পড়ে গোধুলি আবির
রাঙানো আঙ্গিনায় শেষ বিকেলের মহরত।

বৈরী বাতাসে থেমে গেছে বসন্ত রথ
পলকে পলকে নাচে তারা ভরা ছায়াপথ
উমেদারির এক ক্লান্তিময় পথ পেরিয়ে
কফি কাপে ঝড় থামে যায় , ধোঁয়াশা দুচোখে
গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে জেগে উঠে
শাশ্বত প্রস্থানের অনিবার্য শব্দধ্বনি।


৬.উপদ্রুত উপকূলে

গাংচিল ডানায় কারফিউ, লাল পতাকা ওড়ে উপদ্রুত উপকূলে
উপেক্ষিত কাঁটা কম্পাস কিংবা ট্রানজিস্টারের তরঙ্গ সংকেত
আস্থা বিশ্বাস নির্ভরতার খোলস ছেড়ে উলঙ্গ চিত্তে নটবর নৃত্যশালা
ঝড়ের পূর্ভাবাস যে নাবিক বোঝে না
তাকে তাণ্ডবনৃত্যের অনুকূলে দাঁড় টানতে হয়
সুনামির জলে ভাসে জীবন, মরণ তখন অদৃষ্ট লিখন।

৭.যুদ্ধ

শত্রু ঘেরাও করেছে আকাশ
অগ্নি নৈর্ঋত।পূর্ব পশ্চিম থেকে আসছে
সাগরের বুকে ছিঁড়ে আসছে
পাহাড়ের চূড়া ডিঙ্গিয়ে আসছে
উপত্যকাগুলো ঘিরে ফেলেছে
জালের মতো বিছিয়ে দিয়েছে চকলেট বোমা
ড্রোন,আর্জেস গ্রেনেড আর
একে ফোর্টিসেভনের
ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে ছুটে আসছে
জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে সৈন্যরা
পোড়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি
ধর্ষিতা হচ্ছে নারি।
না,ওসব কথার কথা!
পুকুরের তরঙ্গবিহীন জলের মতো
শান্ত সুবোধ বালকের মতো,
‘শান্তি’ দাঁড়িয়ে আছে
জলপাই রঙের ট্যাঙ্কের সামনে
অজস্র ফুল নিয়ে এসেছে
অবুঝ ভীত বিহ্বল কন্যারা
শিশুরাও পিছিয়ে নেই
অশীতিপর বৃদ্ধ, যৌদ্ধারাও এসেছেন
সাদা পতাকা হাতে নিয়ে
কুম্ভকর্ণের চোখে রাজ্যের ঘুম
বীরশ্রেষ্ঠগণ আগে থেকেই কবরে!
তীর ধনুক হাতি ঘোড়া
ঢাল তলোয়ার
সব গেছে রসাতলে
যার যা কিছু আছে
জং ধরা পরিত্যক্ত,
ভঙ্গুর লৌহদণ্ডের মতো
নির্বিয আছে পড়ে ।
তলে তলে ঘোষণাবিহীন
প্রস্তুতি নিয়ে পঞ্চমবাহিনীর তাবুতে
ওরা ঢুকে পড়েছে
পলাশির আম্রকাননের মতো
নীরবে, নিভৃত, রন্ধ্রে, রন্ধ্রে।

৮.জনম জনম

ফুল বাগানে মনের সুখে গায় গান বিহগ
মিষ্টি মধুর সুরে
রঙের রাজা গন্ধবণিক প্রজাপতি
ডানা মেলে উড়ে।

ঝিঙা মাচায় ফিঙে নাচে ,হলুদ পাখি
দিচ্ছে দারুণ শিষ
সরষে ফুলে মধু থাকে ধুতরা ফুলে
জমে কেন বিষ?

শাপলা ফুটে বিলে ঝিলে কদম ভিজে
টিপটিপ বৃষ্টি জলে
মুক্তো বুকে সুপ্ত জীবন ঝিনুক বাঁচে
গভীর সাগর তলে।

দুপুর বেলা গাছের ছায়ে একলা বসে
ঘুঘু করুণ ডাকে
পুকুর জলে ডুবসাঁতারে ডাহুক ছুটে
কলমিলতা ফাঁকে।

তারায় তারায় জ্বলে আলো মিটিমিটি
জোনাক বুঝি দূরে
জোছনা মাখা চাঁদের হাসি আঁচল বিছায়
মায়াবী রাত জুড়ে!

জনম জনম ঘুরছে গোলক তারই পিঠে
মানব জীবন কাটায়
ঘড়ির কাঁটায় উড়ছে ঘুড়ি বাঁধা আছে
অদৃশ্যে এক নাটাই।

আবু জাফর সিকদার : কবি ও গল্পকার।

১টি মন্তব্য

  1. অভিনন্দন। শুভেচ্ছা নিরন্তর। আনন্দিত হলাম। কবিতার উঠোনে এ অভিযাত্রা অব্যাহত থাকুক।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন