ময়ুখ চৌধুরী’র নির্বাচিত কবিতা

[কবি ময়ুখ চৌধুরী: জন্ম : ২২ অক্টোবর ১৯৫০। ছোটবেলা থেকে লিখে গেছেন নিরন্তর। সম্পাদনা করেছেন ছোটকাগজ প্রতীতি ও কবিতা। সন্মিলিত কাব্যসংকলন ‘অসভ্য শব্দ ‘ সম্পাদনা করেছেন ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৪ সালে ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের তত্ত্বাবধানে শামসুর রাহমানের কবিতা বিষয়ে প্রথম গবেষণা করেন। ১৯৭৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ রবীন্দ্রনাথের পোয়েটিক ওরিয়েন্টেশন’ বিষয়ে পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘ঊনিশ শতকের নবচেতনা ও বাংলা কাব্যের গতিপ্রকৃতি’ গবেষণা গ্রন্থ। কবিতা লেখার বয়স যখন ছাপা অক্ষরে চব্বিশ বছর, তখন প্রকাশ করলেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কালো বরফের প্রতিবেশী(১৯৮৯)। এরপর ‘অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে'(১৯৯৯), ‘তোমার জানালায় আমি জেগে আছি চন্দ্রমল্লিকা (২০০০), ‘প্যারিসের নীলরুটি(২০০১),’ আমার আসতে একটু দেরি হতে পারে'(২০০২), ‘পলাতক পেণ্ডুলাম’ ( ২০১৫), ক্যাঙ্গারুর বুকপকেট’ (২০১৬),’পিরামিড সংসার'(২০১৭), জারুলতলার কাব্য'(২০১৮),’ চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডহীন'(২০২০)। কবির জনপ্রিয় ও শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো আমরা এখানে ভুক্ত করিনি। কবির ভালোবাসা সিক্ত কাব্যগ্রন্থনামযুক্ত কবিতাগুলো পুবাকাশ পাঠকের জন্য নির্বাচিত হলো- আশা করি পাঠমুগ্ধতা ছুঁয়ে যাবে। কবিতা পাঠক দীর্ঘ পরম্পরায় কবি ও কবিতাকে সমগ্রতায় অনুভব করতে সক্ষম হবেন। সম্পাদক: পুবাকাশ ]

কালো বরফের প্রতিবেশী

আপাদমস্তক কালো কান্না জমে আছে
বরফকঠিন ঘুমে স্তব্ধ জাগরণ।
নীলিমা-সমুদ্র-মাটি অবিরাম স্বপ্নের এলবাম
তার চোখে তুলে ধরে, হাওয়া লাগে।
কাঁপে ত্রিভুবন।
তিন যুগ স্বপ্নদেখা শেষে,
বামদিকে জোনাকীর সবুজ মাংসের ছোঁয়া পেয়ে
জেগে ওঠে হিমগুল্মলতা,
বিস্ফোরণমুখী এক কালাে নীরবতা।
তারপর শুরু হলাে গাঢ় অন্বেষণ,
হাত-পা বেরিয়ে আসে প্রবাহিত বরফের নামে।
প্রতিবেশী মরুর আকাশ
মেঘলা কষ্টের ভাজে প্লাবনের পটভূমি করেছে সঞ্চয় ।
এইভাবে
ঘনত্রিভুজের মধ্যে জেগে ওঠে আদিম হৃদয় ।
পিরামিড আয়ােজন গলে যেতে দেরি নেই বেশি
কল্লোলিত স্বপ্ন দেখে কাঁদে
কালাে বরফের প্রতিবেশী ।

১৯৮৮

মাছ আর মাকড়সার জাল

জাল কি জলের ওড়না না-কি মাছেদের ?
অনিশ্চয়তার নুনে ভিজিয়ে রেখেছি এই জিজ্ঞাসাকে বহুদিন ধরে ।

প্রথম দেখায় তাই মনে হয়েছিলাে তাকে জেলেদের বংশধর বলে ।
আঁশটে ঘ্রাণের মধ্যে দ্রবীভূত আধময়লা স্মৃতি
লাল নীল ধমনীর প্রবাহিত সুতাে
টানে টানে উঠে আসে ভেজা জাল ফোটা ফোটা জল ।

পােড়া রং গােলাপকে ঢেকে আছে কার্পাসের লাল
ওপরে সমুদ্রনীল–ঢেউহীন–ভয়ংকর চুপ,
উত্তরীয় সাপের মতন।
সেলুনে ছেঁটেছে চুল কালাে মেঘ, সব মিলেমিশে
আদিম উনুন যেন
প্রথমবারের মতাে জ্বলবার নিমিত্ত প্রস্তুত।

পেছনে পেছনে তার আটপায়ে চিন্তাশীল মাকড়সার জাল,
এ জালে পড়ে কি ধরা গােলাপী পেটির নােনা মাছ ?
আদিম প্রশ্নের হাহাকার
জমা আছে মাকড়সার লালার ভেতর।
ফ্লাস্কের ভেতরে আঁটা চা-পাতার গরম নিশ্বাস
ঘুমের ওপর
ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে আকাশের দরজাটা খােলা দরকার ।

যদিও সহজ নয়, সকলেই জানে ;
যতাে আঁকাবাঁকা হােক চাবিদের অগ্রগতি সােজা।
নির্জনতা কেঁপে ওঠে বিকল্প পাতার কণ্ঠস্বরে,
নীলের দরজা খােলে আকাশের বিপরীতে জলের ভেতর।

জালের ওড়না হাতে জলঘাট নেমে যায় জলের ভেতর। সেইখানে
মাছের প্রতিটি আঁশ মানুষের চোখ হয়ে যায়। ভিজে যায়
জলপাইবীথি বিনা জলে ।

এই চিত্রনাট্য জানি, আদিম আদম থেকে আজকের অববাহিকায়
সাপের মতন চলে বুকে ঘষে সিনেমার ফিতে ।
পাতালের খাঁজে, বুনাে ঝােপঝাড়ে একচোখা ভূতের মতন
একটি বােতাম জ্বলে প্রচণ্ড ক্ষুধায়, তার শরীরের যুগল রন্ধ্রে।

প্রচ্ছদের মতাে আলগা হয়ে আসে ক্রমে।
সর্প কিংবা বৃক্ষ কিংবা মানুষের লজ্জার বাকল । ক্রমান্বয়ে
থর থর কেঁপে ওঠে অন্য এক মাকড়সার জাল,
জলের ভেতর মগ্ন প্রশ্নভুক মাছ
ধীরে ধীরে গিলে খায় শিকারী জালের সব সুতাে ।
৩১.৮.১৯৮৮

ঘড়ি ও একজন চন্দ্রমল্লিকা

কেননা, জানালার পাশে গ্রীবা তুলে এভাবে তাকানাে ?
তােমাকে বলিনি আমি পারবাে না, সময় হবে না ? তবু কেনাে

মনে আছে সেই রাত-
চাঁদের আলােতে পুড়ে ছারখার হয়েছিলাে ঘর ?
মনে পড়ে সেই চোখ-
আলাের পিপাসা নিয়ে আগুনকে ভালােবেসেছিলাে ?

মনে পড়ে সে দুপুর-
খোঁপাবন্দী মেঘ থেকে বৃষ্টি চেয়েছিলাে ?
কি এমন ক্ষতি ছিলাে, বলাে,
সেদিন না হয় তুমি ঘড়ির দুইটি ডানা বাতাসে উড়িয়ে দিতে
– পাখি ।

আজ কেনাে এতগুলাে চক্ষু মেলে উদগ্রীব হয়েছে,
ঘড়িটা কি নষ্ট তবে, কষ্ট কেনাে চোখের কাজলে ?
আমি তাে বলেছি – আমি পারবাে না, সময় হবে না ।
তবু কেনাে জানালার পাশে …

১০.১০.১৯৮০

চন্দ্রমল্লিকার বাড়ি

– এই রিক্সা যাবে নাকি ?
– যাবাে স্যার ; কোথায় যাবেন ?
– যাবাে চন্দ্রমল্লিকার বাড়ি।

এই বলে খুব তাড়াতাড়ি
রিক্সায় বসেছি চেপে, দেখছি ঘড়িটা বারবার।
যদিও এখান থেকে কোলকাতার ডায়মন্ড হার্বার
বহুদূর, তবু আমি আরেক কাউকে
খুঁজে ফিরি এ শহরে এখানে ওখানে –
চিত্রপ্রদর্শনী, মিনি সুপারমার্কেটে কিংবা বইয়ের দোকানে ;
ততােক্ষণে চন্দ্রকলা মেঘের আড়ালে।

-এবার কোন দিকে স্যার ?
– সব দিকে যাও । চন্দ্রমল্লিকা যেহেতু নেই কোনােখানে,
তার মানে সব দিকে আছে।
তুমি আরও যেতে থাকো,-
আকাশে আরেক চন্দ্রমল্লিকার ইশারা তাে পাবে!

চন্দ্রমল্লিকার বাড়ি বুকের ভেতরে নিয়ে
পাল্টে দিই সড়কের নাম ;
এইভাবে পথে পথে প্রতিটি গলির মােড়ে
অন্য নামে খোঁজ করি ক্রিসেনথিমাম ।

রেখে যাই প্রণয়প্রণাম।

১৯৮১

এইসব বিধবা হরিণ

সহে না সহে না আর যৌবনের ভার,
চর্যার হরিণ ছােটে বন ফেলে সভ্য লােকালয়ে।
ছায়া হয়ে তাড়া করে নিষাদ যৌবন,
সত্তরের প্যারিসে এখন।
শত্রু তার মাংস আর চিত্রল প্রচ্ছদ,
শত্রু তার মৃগনাভি, অভিশপ্ত গম ।

রাত আসে, জ্বলে নীলবাতি
ভেতরে বাহিরে ।
অকাল বৈধব্য জুড়ে শুয়ে থাকে অবাধ্য সম্ভার,
ড্রয়ারে ঘুমের বড়ি, বিছানায় গম আর গম ।
নীল অন্ধকারে
বিধবা হরিণ তার শরীরের ছায়া পান করে।

সমস্ত শরীরে বিষ, নীল গম, সকাল বেলায়
নীলরুটি পড়ে থাকে একা বিছানায় ।

সূর্যের নরম লাল ঢুকে পড়ে জেলির বােতলে,
ঘুম থেকে জেগে ওঠে নীলচোখা অতিথি যুবক।
অতিথির প্লেটে কাঁপে জন্মান্তরবাদী পাউরুটি ;
তবুও গমের দানা, অনির্বাণ মৃগনাভি,
হরিণীর নেই কোনাে ছুটি।

চিমনির ধোঁয়ার মধ্যে পুড়েছিলাে বেসুমার দেহ –
প্যারিসের নীল চোখা শিকারী যুবক ছাড়া
এ কথা জানে না আর কেহ।

১০.৯.১৯৭৭

হে কবিতা, অপেক্ষা করাে

১.
বুক ঘষে-ঘষে বুক ঘষে-ঘষে পাড়ি দিচ্ছি
পথ।
বুক ঘষে-ঘষে বুক ঘষে-ঘষে বাড়ি যাচ্ছি–
কবিতার।

যেখানে থাকতাম আমি সেইখান থেকে।
কবিতার বাড়ি বহুদূর।
আমি তার বাড়ি যাচ্ছি বুক ঘষে-ঘষে,
আমি পথ পাড়ি দিচ্ছি কবিতার ;
কবিতা অনেক দূরে থাকে। তার
বাড়িতে যাবার পথ বড় আঁকাবাঁকা কষ্টকর।-
কঠিন রক্তের মতাে খােয়াওঠা উঁচুনিচু পথ,
ঝােপঝাড়, কাঁটা, পােকা, সাপ ;
আর-একগুচ্ছ পশ্চাত্তাপ।
বুক ঘষে-ঘষে আমি পাড়ি দিচ্ছি পথ ।
আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু ভাঙাচোরা পথ, তাই
আমার চলায় কোনাে ছন্দ নেই, অলংকার নেই আপাতত ।
২.
অথচ আমার পা ছিলাে, রীতিমতাে দুটো পা ছিলাে, –
আমি মানুষের মতাে হাঁটতে পারতাম। কিন্তু
দ্বিধা ছিলাে : দুই পায়ের মাঝখানে না-ছোঁয়া পথ যদি পেরিয়ে যাই !
আমি তাই
বুক ঘষে-ঘষে বুক ঘষে-ঘষে পথ চলছি; ফাঁকহীন ফাঁকিহীন পথ !
স্কিপিঙের দড়ির মতাে ব্যাঙ-লাফ দিয়ে পেরােতে পারতাম ;
যাইনি । দু’টো উদ্বৃত্ত হাতও ছিলাে। –
নিয়ানডার্থালপূর্ব প্রজাতির মতাে হাত দুটোকেও কাজে লাগাতে পারতাম,
আঁদ্রে ব্রেতাে খুশি হয়ে দেখতাে ; একটা চৌকি হেঁটে যাচ্ছে ।
পৃষ্ঠদেশও ছিলাে,
টায়ারবাধা ভিখিরির মতাে গড়িয়ে-গড়িয়ে যেতে পারতাম ;
যাইনি।
নিজেকে বিক্রি করে দু’টো রণপাও কিনতে পারতাম,
সংক্ষিপ্ত করতে পারতাম মনােরম কষ্টের পথ এবং সময় ।
কিন্তু, আমি তা চাইনি ।

৩.
আমি বুক ঘষে-ঘষে তােমার দরজায় পৌছুতে চাই,
হে কবিতা, হে আমার প্রিয়তমা।
আনাড়ি সরীসৃপের মতাে বুক ঘষে-ঘষে আসতে গিয়ে
আমার অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে,
অনেক দেরি করে ফেলছি আমি। আমি জানি :
আর কিছুক্ষণ বাদে কাকজ্যোৎস্না ; কালাে জর্জেট বাতাস
প্রথমে লালচে তারপর শাদা হয়ে যাবে- কাফনে মােড়ানাে ভাের।

ঘষা লেগে-লেগে ঘষা লেগে লেগে
পুবের আকাশের মতাে লাল হয়ে যাবে অন্ধকার বুক। তাই
রাত্রিমাখা পথের প্রতিটি স্পর্শ গুণে-গুণে ঘষে-ঘষে
আমি আসছি,
আমি আসছি হে প্রিয়তমা, হে কবিতা আমার ।
ক্লান্তিতে রজনীগন্ধার মতাে শরীর নুয়ে পড়তে পারে তােমার,
নীরব অপেক্ষায় চোখের তারা নিভে আসতে পারে,
আধখােলা দরজার বাহু থেকে স্খলিত হতে পারে দুটি হাত।
নাদান প্রেমিকের মতাে চোখে শুকতারার আস্থা পুঁতে রেখেছি,
তুমি আশাহত খিল তুলে দিও না দরজায়,
আমার স্বপ্নের মােহনায়।
নদীর মতাে বুক ঘষে-ঘষে প্রতিটি পাথরের সংগীত আমি বয়ে আনছি,

ভৈরবীর আলাপে আলাপে আমি
বুক থেকে একেকটি পাথর নামাবাে ।
বুক ঘষে-ঘষে আমি আসছি,
তুমি অপেক্ষা করাে;
আমার আসতে একটু দেরি হতে পারে, তুমি অপেক্ষা করাে ;
তুমি অপেক্ষা করাে, আমি আসবােই ;
রাত ফুরােবার আগে আমি আসবােই
তুমি অপেক্ষা করাে, আমাকে আসতেই হবে ; আমি আসবােই …

২.১.৯৮

পেণ্ডুলাম

প্রহরী টহল দেয়—তিনজন একই মহল্লায়,
তাদের জানার কথা নয়—
কখন আকাশ থেকে খসে গেছে উল্কার হৃদয় ।

তােমার নিজের ঘর ফেলে, কোথায় উধাও হয়েছিলে!
সংসারের বােঝা কমাবার প্রয়ােজনে
যে রকম অভিমান
একদা একতারা হয়ে বেজে ওঠে যন্ত্রের শিরায়।

কোন বনে ফলের ভিতর
দোলাচলে তেরােটি বছর
পরিচিত দৃশ্য কেড়ে সাজিয়েছ গােপন কবর?

এখনও তােমার পরিজন –
দৃশ্যহীনতার ভারে চোখে বিস্ফোরণ ।
শূন্যের মাঝারে দেয় হাতছানি যার যার ঘর;
তােমাকে খুঁজছে দ্যাখাে, চক্ষুহীন বারােটি পাথর।

ক্যাঙ্গারুর বুকপকেট

ক্যাঙ্গারু মায়ের সন্তান
একবার কাঁচা রােদে, একবার উষ্ণ মমতায়
একবার কচি ঘাসে, একবার পশমের স্নেহে
সারাবেলা ওঠানামা নামাওঠা খেলা

কখন কোথায় কবে শেষবার থেমে গিয়েছিল
অজান্তে কোথায় কবে আর ওঠেনি আর ওঠেনি বুকের মানিক
কখন হৃৎপিণ্ড খসে পড়ে গেছে পথের ধূলায়
কোন ফাঁকে মমতার আকুল গুহায়
রচিত হয়েছে, বলাে, শূন্য হাহাকার?

জিজ্ঞাসা-চিহ্নের মতাে ক্যাঙ্গারু তাকিয়ে থাকে মানুষের দিকে

শেষ কবে কোল থেকে নেমেছিল মানুষের মায়ের সন্তান
মনে করাে, মনে করাে, মনে করে দ্যাখাে

আমাদেরও মায়েদের মন
সব কিছু মনে রাখে, শুধু এটুকুই মনে নেই

৬.৮.২০১০

পিরামিড সংসার

দায়ভার বলে
বন্ধুকে কান্তার কথা বলেই ফেলেছি।
দায়ভার বলে
শিশুকে উদ্ধার করে বেঁধে দিই মায়ের আঁচলে।
দায়ভার বলে
নদীকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছি মােহনার কাছে।

চারিদিকে কোলাহল,
শুনি।
বারুদের গন্ধে ফুল ফোটে,
দেখি।
তাঁবুকে দোফাল্লা করে শরণার্থী শিশুর ক্রন্দন,
লিখে রাখি।

মনুষ্যজন্মের স্মৃতি আছে বলে মানুষের সঙ্গে দেখা করি,
কবিদের দেখাদেখি আঁধারকে বলেছি শর্বরী।

সমস্ত দিনের শেষে জামা কাপড়ের ভাঁজ থেকে
নিজেকে আলগা করে দেখি
খুব একা।

পাথরে শ্যাওলার মতাে পড়ে আছে মন
পিরামিড সংসারে বেঁচে আছি মমির মতন।

মিছিল, তুমি বাম দিকে যাও

ডান দিকে নয়, ডান দিকে নয়, বাম দিকেতে যাও;
বাম দিকে যাও কাস্তে কোদাল লােহিত পালের নাও।
ডান দিকে সব রক্তচোষা বাদুড় ঝুলে আছে,
বাম দিকে ঐ মুক্তি নাচে শিমুলপলাশ গাছে।

বাম দিকে সব মাটির থালা গরম ভাতের ধোঁয়া,
ডান দিকেতে দালানকোঠা B.B.C আর VOA ।
ডান দিকে পথ হারিয়ে যাবে কুটিল কুয়াশাতে,
ভুল করাে না চিনতে উনুন এবং গরম ভাতে।

ডান দিকে নয়, হাতছানিতে মুক্তি ডাকে বায়
মাটির মানুষ পলির মতন নদীর মােহনায়।
রক্তেঘামে দোআঁশ মাটি সবুজ আঁচলতলে,
সেই দিকে যাও যেইখানে চার প্রহর লাঙল চলে।

শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলাে শােষক-বৃক্ষমূল,
রক্তনদী ছলকে উঠুক উপচে উঠুক কূল।
তা না হলে গ্রাম ভেঙে ঐ অবুঝ সবুজ প্রাণ
ভাসিয়ে নেবে পাঁচ তারকার বিলাস ঐকতান।

ভাঙবে সুখের সিরামিকের তপ্ত শহরগুলি
পুঁজিবাদী টিকটিকি আর সপ্তবহরগুলি।
রক্তে জ্বলে বাঁ-দিক থেকে আদিম বর্ণমালা
ক্ষুধার আগুন জ্বালিয়ে দেবে আগ্রাসী ডালপালা ।

পােড়াবে সব জ্বালাবে সব ডানের লতাপাতা
বাঁ-দিক থেকে বুকের ভাষা খুলবে নতুন খাতা।
বাম দিকে যাও মিছিল তুমি বাম দিকেতে যাও,
সবার উপর মাটির মানুষ তাদেরই গান গাও।

১৯৯৪

চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডহীন

১.
আমার খারাপ লাগে—আমি রােদ পােহাই, অথচ আমার ছায়া তা পারে না। (ওর শীত তাে আরও বেশি)। রােদ প্রচণ্ড হলে আমি আকাশমণির নিচে দাঁড়াই,
সেখানে তাকে আনতে পারি না। ওকে আমি বােঝাতেও পারছি না : একদিন এমন অন্ধকারে যাবাে, যেখানে তাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আজ, জানলা
দিয়ে স্পষ্ট দেখলাম : আমার নিঃসঙ্গ ছায়াটা একা একা রােদ পােহাচ্ছে। এবং আমি নেই।

২.
আমাদের উঠোন অবধি, সুনামি নাকি এসে ঘুরে গেছে। আমরা ঘুমুচ্ছি ভেবে দরজার বেলটাও বাজায়নি আর। ভদ্রলােকের ফিরে যাওয়া—এ রকম অভদ্র কি আমার এ দেশ? সুনামি, কোথায় বলাে, কোন দরজার গায়ে তােমার কলিংবেল বাজে?

৩.
ডাকাতের মতাে ধুমধাম ঢুকে পড়লাে নার্গিস। পর্দা জানলা বিছানা—সবই লণ্ডভণ্ড। দীর্ঘ চুলগুলােকে এমনভাবে আলুখালু করে দিলাে, মনে হচ্ছে আকাশের
ছবি। বৃষ্টিও হলাে। স্নায়ুর এক্যুরিয়াম থেকে নেমে কয়েকটা রঙিন মাছ গরম কড়াইয়ের তেলে সাঁতার কাটছে। তার নিচে জ্বলছে, বন্ধুদের নিয়ে আমার
দীর্ঘদিনের অহংকার।

৪.
কবিতাপীড়িত চাঁদ পালিয়েছে অমাবস্যা রাতে। ফের তাকে ধরে আনি; প্রতি রাতে বড় করি তারে। আলট্রাসনােগ্রাফি শেষে ডিএনএ’র প্রশ্ন যদি ওঠে, -দুই
হাতে মুখ ঢাকি। আমাদের অমাবস্যা নেই!

১২.
মাইকিং— ‘একটি শােক-সংবাদ’, পোস্টার- ‘আমাকে বাঁচান’, পত্রিকা–‘আবার মিছিলে গুলি’। গাছেরা মিছিল করতে পারে না, তাই সারিবদ্ধ এক মিনিট
নীরবতা-পালন। চোখ থেকে ঝরছে শুকনো অশ্রু,পাতা। আমি হাঁটতে পারি, হাঁটি। রেলিঙে ভর না দিয়ে তরতর উঠে যাই তিনতলায়। কিন্তু, সঙ্গে সঙ্গে অক্টোপাসকেও নিয়ে আসি, ডালপালাসহ। শাওয়ারের নিচে ধুয়ে ফেলতে চাই এসিডদগ্ধ মুখ। তারপরও, ভাতের টেবিলে বসে ভাত নয়, অজস্র ধানের লাশ দেখি, শাদা কাফনের রঙে সাজানাে থালায়।

১৬.
ব্লেন্ডারে গুড়িয়ে যাচ্ছে লাল মাংস তরমুজের দেহ। গ্লাস ভরে পান করি আমার নিজের রক্ত আমি। সিসিফাস তুমি কোথায়? -পাথরটা ফেলে দাও, হেমলক তুলে নাও হাতে। আমিই বরং যাই, সে-পাথর তুলে আনি, ব্লেন্ডারের ভিতরে
ঢুকাই।

১৭.
হাতে কি নিয়েছ তুলে আতসকাচের ভােজবাজি? তা হলে হয়েই গেল, দুইয়ে দুইয়ে চার লিখে চারটাকে ইংরেজিতে পড়াে। কোন দেবতাকে ফুল দিতে হবে, শিষ্যকে প্রসাদ, সঠিক ঠিকুজিমতাে ঘড়ির বিষম পায়ে ঘুরপাক খেলে। যদিও বিচ্যুতি ছিল ছন্দ আর মিলে, পাহাড় দেখােনি বলে উটকে পাহাড় ভেবেছিলে ।

১৮.
গােলাপেরা ফুটে আছে বিছানায় খাদির চাদরে। চতুষ্কোণ ঘরে-ঘরে সাজানাে রয়েছে থরে থরে হলুদ বেগুনি রং কষ্টগুলাে, লালনীল পাতা। ডালপালা ছড়িয়েছে, —অর্ধেক জীবন্ত এই বিছানার পুরােনাে চাদরে শুতে গেলে টের পাই কাঁটা। তাহলে গােলাপ কেন প্রাপ্য গন্ধ দিলাে না আমায়!

১৯.
বারােয়ারি গল্পের ঘষায় ঘষায় আমার ছােট ছােট গল্পগুলাে ছিঁড়ে যাচ্ছে। এসাে, তােমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটাই। তােমার গল্প দিয়ে ভরাট করে নিই ক্ষতস্থানগুলাে,
বাড়ি যাওয়ার পথে খানাখন্দগুলাে। একদিন মাইকওয়ালা এক অনুষ্ঠানে তােমাকে নিয়ে যাবাে, আর দেখাবাে—গণ্যমান্য কথকেরা আলকাতরায় বুরুশ
চুবিয়ে—কীভাবে দেয়াল—চমৎকার শাদা চুনকাম! সুধীবৃন্দের একপাশে তােমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কিন্তু সাবধান, টব থেকে লাফিয়ে উঠে প্রতিবাদ করতে
যেও না যেন, পাঞ্জাবির গর্তগুলােতে ভয়ঙ্কর অন্ধকার। শেষপর্যন্ত, দুজনের ভাঙা গল্প মেরামত করার জন্য একটা পেরেকও আর খুঁজে পাবে না।

২০.
ডানপায়ের স্যান্ডেলটা সেলাই করা হলাে, বামেরটাতে লাগবে না। অথচ একই চামড়ার সহােদর ওরা, এমনকি যমজ। দুজনেই হাঁটাহাঁটি করেছে সমান-সমান।
বেড়াতেও গিয়েছে একই জায়গায় (তবে হোঁচট খেয়েছে অন্য কোথাও)। জীবনেরও দুটো পা আছে, এবং একজোড়া স্যান্ডেল। বাম পা-টা মা-বাবার সংসারে, ডান পা-টা ক্যাকটাসের টবে।

২১.
অতাে উঁচু গলায় কথা বলাে না। গাছের ঝুঁকে-পড়া ডালপালাও জানে—তােমাদের মাথা কতাে নিচু হতে পারে। কখনাে দেখেছাে ভেবে—তােমাদের সব কথা জোড়া দিলে কী কথা দাঁড়ায়? দরজা খুললেই দেখি
ভিখারির পাশে দাঁড়িয়েছ—পাঁচ আঙুল দূরে, দুই চোখে বােতাম লাগানাে।

২২.
অহংকারটা একেবারেই মানালাে না। এতােগুলাে মানুষকে পথ ছেড়ে দিল যে পাহাড়, -তাকে দ্যাখাে। শীতের রােদুরকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে সে তার
প্রান্তভাগ নামিয়ে দিয়েছে রাস্তায়। তুমি কিনা প্রতিটি প্রান্তভাগে পুঁতে দিচ্ছ ক্যাকটাস, হেঁটে যাচ্ছে পাহাড়ের বক্ষ চিরে; যে কিনা তােমার জন্যে বুকের
বােতাম খুলেছিল?

২৩.
সেই সকাল থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জ্বলন্ত দুপুরবেলা একলব্য, কী করছাে ওখানে? বুড়াে আঙুলের ডগায় কালি; আঙুলটাও কেন দিয়ে এলে না! তা হলে,
আগামী গনগনে রােদে শামুকের মতাে আর এগােতে হতাে না। তােমাকে খুন করবার অধিকার কোন স্বপ্নের,–এ নিয়ে বন্ধুবিচ্ছেদ হতাে না। তুমি কি জানাে —শেষ পর্যন্ত বুড়াে আঙুলটাই দেখতে হয়!

২৪.
দুঃখের পাশেই আমার নামটা লিখে রেখাে। সিরিয়েলে ডাক পড়লেই দেখবে কষ্টকে সঙ্গে নিয়ে আমি যথারীতি হাজির। তবে, ঘুনপােকাকে সঙ্গে আনতে পারবাে না, ও একটু পর্দানশিন।

২৬.
বন্ধুত্বের মাঝখানে কুণ্ডুলি পাকিয়ে বসে আছে—এ্যাশ-ট্রে। জমে-ওঠা ছাইগুলাে তর্জনির কথামতাে লাফ দিচ্ছে জন্মান্ধ মনের গহ্বরে। প্রায় এভাবেই আগুনের
অগণিত টুকরােগুলাে অনূদিত হচ্ছে ছাইরঙে। সেই রাতে, টেলিফোনের আর্তনাদে ভেঙে পড়লাে ছাইদানি, মুহূর্তেই জ্বলন্ত কয়লার মতাে টুকরাে টুকরাে পড়ে আছে হৃৎপিণ্ড আমার ।

২৯.
আমি কেমন—এটা দেখার জন্যে আরও অনেক উপায় ছিল। কিন্তু তুমি বুক-বরাবর চালিয়ে দিলে ড্রিল-মেশিন। ফুটো দিয়ে টপ টপ করে পড়ছে খর্জুর-বৃক্ষের রক্ত। কেন আমার গায়ে এত কাঁটা ছিল বুঝতে পারােনি। তবু,
আমার শিরস্ত্রাণে জেগে-থাকা চাঁদকে তুমি ঈর্ষা করেছিলে। অথচ, কুয়াশার কণাগুলাে তর্জনিতে ছুঁতে পারলে না!

১১১.
হেঁটে যাচ্ছে চরণেরা মুণ্ডহীন পাতালপ্রবণ, চক্ষুহীন মাতাল রাস্তায়। গলির মােড়েই ছিল নাকফুল-পরা হাস্নুহেনা—কামার্ত গন্ধের ভারে নুয়ে পড়ে পিচ্ছিল শ্যাওলায়। ঘ্রাণহীন চরণেরা বৃষ্টির নূপুর ছুঁয়ে ছন্দ ঠিক রাখে। চন্দ্রসূর্য-গ্রহণের যাবতীয় কারুকাজ অর্থহীন আজ। তবু অন্ধ চরণেরা পৌঁছে যাচ্ছে ঠিক অন্ধকারে, যেখানে অপেক্ষা করে গুল্মলতা পারদের তৃষ্ণাসহকারে। চরণে লুটিয়ে পড়ে পলিমাখা ঢেউ, -অন্ধকারে অন্ধ নয় কেউ।

১৩৫.
দুধে জ্বাল দিলে সর পড়ে। পঙক্তিগুলাে জ্বাল দাও, শিরােনাম ভেসে উঠবে নিয়মমাফিক। জ্বাল দাও শিরােনামগুলােকে এবার। এবার মলাটে দেখাে মাছের
পলকহীন চোখ। তারপর যেটা করতে হবে,—মাটির চুলাের মতাে তিন-স্তনবিশিষ্ট দাউ দাউ আগুনের মধ্যে ফেলে দাও। সেখানে আবার যদি শাদা দুধে কালাে পঙ্ ক্তি ভাসে, -বুঝতে হবে : সঁতার শিখেছে। নইলে অযথা চাঁদ নিয়ে টানাটানি করা ঠিক নয়। সেখানে লেগেছে ক্ষয়; ওটা জানােই তাে পৃথিবীর একমাত্র স্তন।… পঙ্ ক্তিগুলাে সাজাও এখন।

১৫৭.
চারটা হাত, চার পা। এমন বিকাশসূত্রে আমরা দু’জনে মিলে কী কী হতে পারি? নরকে অভ্যস্ত, তাই স্বর্গে রুচি নেই। মহাকাব্য হতে চাও! তা হলে তাে আমাকেই উত্তেজিত নদীর মতন প্রশাখা বাড়াতে হবে, তােমার দায়িত্ব হবে কল্লোলিত হওয়া। এখুনি প্রস্তুত হও, অক্টোপাস হয়ে যাই, -কৃষিকর্ম কৃত্রিমতাহীন। অসহায় প্রদর্শনী প্রচলিত মানববন্ধন, -বিকল্পে আদিম ব্যাকরণ ।
তার কার্যকারিতাকে আরেকবার পরীক্ষণ করি—আটটি প্রহর জুড়ে দেহচক্রে গােপন শর্বরী।

১৫৮.
মাধ্যাকর্ষণের ঠোটে চুম্বনের অনুমতি নেবাে। যখন দেখতে পাবে মুখের ওপরে স্থির মাছি, আমাকে নামিয়ে দিও পাতালের খুব কাছাকাছি। নিমন্ত্রণপত্র আমি রেখে যাবাে ঘাসের ওপর।

১৬৮.
যে যার নিজের কক্ষে, আমি কক্ষপথহীন গ্রহ। আকুল আগ্রহ নিয়ে অগ্নিপূজারীর মতাে ঘুরপাক খাই । জ্যোতির্বিজ্ঞানের বক্ষে অমােঘ নিয়তি কাজ করে। হয়তাে
মানুষ নই—উদ্বাস্তু উল্কার পিণ্ড, পৃথিবীতে ভস্মীভূত ছাই।

2 মন্তব্য সমুহ

  1. সবগুলো কবিতা দারুণ। সুন্দর বাছাই। অভিনন্দন প্রিয় কবিকে

  2. Esob hijxibizi kichu thik bujhlam na vai…
    না রস, না টান। না অনুভূতি
    কোন ফিলিংস ই জাগলো না।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন