গুচ্ছকবিতা ।। শাকিল রিয়াজ ।। পুবাকাশ

নব্বই দশকের বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর কবি শাকিল রিয়াজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে যোগদেন দৈনিক জনকণ্ঠ ‘র সম্পাদনা বিভাগে। জীবনের নানা বাকঁ পেড়িয়ে এখন বিদেশ বিভূঁই। জীবন গদ্যের পাশাপাশি যাপনের কাব্যগুলো গ্রন্থিত হয়েছে চারটে মলাটে।

কবিতায় শাকিল রিয়াজ আধুনিক দৃষ্টিভংগির। স্বদেশ ও বিশ্ববোধ নানা মাত্রায় শব্দে উপমায় উৎপ্রেক্ষার দ্যোতনায় ভাস্বর হয়েছে তার শিল্পীত চেতনায়। ১৭ অক্টোবর ‘২০ কবির সুবর্ণ জন্ম জয়ন্তীতে পুবাকাশ পাঠকের জন্য উপস্থাপন করছে তার একগুচ্ছ কবিতা। কবি ও কবিতার জন্য ভালোবাসা নিরন্তর।

কাফকার কাছে

তোমার চিবুকে গাঁথা চুম্বনের চতুরতা থেকে
খসে পড়তে পড়তে
অদৃশ্য হয়েছিলাম একটি তিলের গভীরে।
এই তিলের সৌন্দর্যে লুকিয়ে ছিল
সর্বগ্রাসী ব্ল্যাকহোল। সুনসান অন্ধকারের
বাঁকল আঁচড়ে কিছু কালি নিয়ে
তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি কাফকা,
কতো জটিলতা পাড় হয়ে বলো
ফিরে আসা যাবে আগের জীবনে?
বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকার মতো নিরাসক্ত
সেই এক ভোজবাজি জীবন!
রোদের ভেল্কিমারা কাঁচা আলো
কেটেকুটে খাওয়ার মতো টক টক জীবন!

অক্ষর থেকে অক্ষরে
মেঘ ফেটে নেমে আসা বিদ্যুৎ
তার স্ফুলিঙ্গ ঢেলে দিলে
খুব নিচু নিঃশ্বাসও ফুঁসে ওঠে ঝড়ের মতো।
বিশ্বাস করো, আমি ফুঁ দিইনি
আমি কোনো দীর্ঘ নিঃশ্বাস রাখিনি আশেপাশে
তবু তোমার কানের দুল নড়ে উঠলো বলে আমি আজ দায়ী হয়েছি সীমা লঙ্ঘনের!

কঠিন কংক্রিটে ঘাসফুল হয়ে ফুটেছিলাম
তুমি শুধু তাকিয়েছিলে বলে
তুমি জল দিয়েছিলে বলে ফুটেছিলাম লাল।
জলজ্যান্ত এক মানুষ
তোমার রাতজাগা আঙুলে
একবার গুম হয়েছিল সারারাত
আজ ঘাসফুল হয়ে ফিরেছে মেঠোপথে
পাথরের নুড়ি, ইঁটের খোয়ার ফাঁকে ফাঁকে
ফুটে আছে তোমার ভ্রূক্ষেপহীন পায়ের আশেপাশে, নির্মোহ আপেল তলায়
ফুটে আছে দিশাহারা ঘাসফুল হয়ে।

তোমার পায়চারি বেণী হয়ে যেদিকে যাচ্ছে
সেদিকে জ্বর ছুঁই ছুঁই গ্রীষ্ম নামে
ক্ষরা ও দাহনে পোড়া বিকলাঙ্গ গাছপালা থেকে
কয়লা কুড়িয়ে নিয়ে
তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি কাফকা,

এই আরসোলা জীবন আর ভালো লাগে না
আমাকে ফের রূপান্তরিত করো।

অর্ধেক মাছ

গতকালের অর্ধেক খাওয়া মাছ সাঁতরে চলে গেল।
মাছের কোন ভাগ খেয়েছিলাম মনে নেই।
মাথা নাকি লেজের ভাগ? নাকি পুরো এক পাশ?
এটা খুব বিবেচ্য বিষয় নয়।

খাবার টেবিলে অন্ধকার ছিল খুব
বাইরে হেমন্তের ডাকে সূর্য নিভেছিল আগেভাগে।
শুধু এই বুকে আলো ছিল
এই বুক জ্বলেছিল ব্যথার ঘর্ষণে।

গতকালের অর্ধেক খাওয়া মাছ
একটি কাঁটা রেখে গেছে আলজিভে।
এটাই বিবেচ্য।
এই মাছ আধা খাওয়া মাছ সাঁতরে গেল আহা
সাঁতরে গেল সে গলায় বিঁধে রেখে মনে পড়ার ছুরি।

এই অর্ধেক মাছই পাতে চাই আজ।
বাইরে অন্ধকার থাকবে যথারীতি
ভেতরে অন্ধ টেবিলে জ্বালিয়ে রাখবো গলা ব্যথা।
আমার ব্যথাতুর মুখে একটি কাতর লোকমা হয়ে নিজেকে পূর্ণ করো মাছ।

আমি এখন অর্ধেক মাছের তালাশে
নেমে যাবো অনিশ্চিত নদীগুলোতে।
একটি মাছ পূর্ণতা পাবে আমার পাতে, এই ভরসায়।

লুমিনিতা

এই গলিতে কোনো কবির বসবাস নেই
এই মহল্লায় কোনদিন কেউ এক পঙক্তি স্বপ্ন লেখেনি
কিছু মানুষ অযথাই বসে থাকে নিঃসাড় বারান্দায়
কিছু মানুষ কখনো তাকায় না গৃহে, ভালবাসায়
কিংবা সামনের জানালায়
যেখানে কার্নিসে ঝুলে আছে এখনো কিছু বরফ
পাখির তায়ের মতো ঝিরঝিরে রেশমী রোদ এসে বরফ গলালে
চুয়ে পড়া পানির ফোঁটায় যে বসন্ত উঁকি দেয়
কেউ খেয়াল করে না এই মহল্লায়।

এই সরু গলি গিয়ে মিশেছে গাড়ির রাস্তায়
ফুটপাত ধরে হেঁটে হেঁটে কিছু লোক যেদিকে যাচ্ছে
সেখানে শহরমুখী রেল জড়ো হয় যথারীতি
তার পাশের দোতলা স্নিগ্ধ বাড়িটি
ভেঙেচুরে কেমন এক বাইশ তলা হলো।
উন্নয়নের এই চূড়ায় তাকালে আমাদের মাথার টুপি পড়ে যায়, ঘাড় মটকে যায়, চক্কর লাগে চোখে।
মিষ্টি এক স্বৈরাচারীর মতো আমাদের জীবনে
আবহমান হয়ে যায় এই অযাচিত উচ্চতা।

এখানের রাতজাগা টোবাক শপে কোনো কবি এসে জ্বালাতে চায়নি কিছু আকাঙ্ক্ষা
ঝড়ো বাতাসের ফুঁয়ে শূন্যে স্কেচ করতে করতে
কী সব আঁকছে দূর্বাঘাসগণ
এ পাড়ার কেউ মোহিত হয়না এমন অঙ্কনে
এ পাড়ায় কেউ কবি নন।
না আমি না তুমি না সতেরো নাম্বার বাড়ির হেলেনা
যে দোলনায় দুলে দুলে তার ট্যাটুখচিত ফর্সা পা নাড়ায় বিকেল হলে,
না নিচতলার রিকার্ড যার অনিশ্চিত জীবন
নৈরাশ্যের ব্যাকপ্যাকে ভরা থাকে ছয়মাস।

এই মহল্লায় যারা ঘুমোতে আসে রাতে
তারা অর্ধেক হৃদয় রেখে আসে কোথাও
এই মহল্লায় যারা জেগে ওঠে ভোরে
অর্ধেক হৃদয়ের খোঁজে তারা উধাও হয়ে যায় কোথাও।
এই বিপন্নতাকে কেউ ছুঁতে পারে না বলে
আমাদের গলিতে কোনো কবি নেই।

বাইশ তলার নিচে এক রুমানিয়ান ভিখারিনী
তার দুস্হ পরিবারের ছবি দেখিয়ে পয়সা চায় প্রতিদিন
ঝনঝন করে ওঠা কফির মগ এগিয়ে দিলে
আমার কন্যা তার জমানো আধুলিগুলো রেখে আসে মগে।
ভিখারিনী একদিন একটি খাতা এগিয়ে দিয়ে
আমার কন্যাকে বললো,
— একটি নাম লেখো, ‘লুমিনিতা’। বড় বড় করে।
লুমিনিতা আমার মেয়ে। অনেকদিন দেখিনা ছোট্টিকে।
ওর জন্য কেনা ফ্রকের বুকে সেলাই করে তুলবো নামটি।

শাদা কাগজে বড় বড় করে লেখা হলো, লুমিনিতা।

একটি সুচ আজ লিখে যেতে পারে
এই মহল্লার প্রথম কবিতাটি।

ঘুমের ভেতর

ঘুমের ভেতর আবছা করে তুমি
আবার এলে ঘুম ভাঙাতে ফের
আবার তুমি হাত দিয়েছো গায়ে
তাপ খুঁজেছো জ্বরের মানুষটায়।

এই যে দেখো কতো বছর পর
জাগলে তুমি ঘুমের শহরটিতে
জানলা খোলা, উড়ছে পাতা কাঁচে
নক করেছে আমার ছোটকাল।

তুমি তখন খুব অসুখি ছিলে
বাড়ির দিকের রাস্তা ছিল ভারী
তোমার পায়ে মদ্যদোলন ছিল
তোমার পায়ে ছিল পদস্খলন।

বেঁচে আছো? কোথায় কেমন আছো?
কোন শাড়ীতে প্যাঁচাও দেহের লাজ
আমি এখন বরফঢাকা বাঁশি
শিস দিয়েছি ঘুমের দিকে ফিরে।

হঠাৎ তোমার কান্না শুনি ঘোরে
কাঁদো তুমি আগের মতই মৃদু?
কেমন আছো হু হু হৃদয় তুমি
কেমন আছে কলেজ ফেরা পথ?

জুলাই মাসের আকাশ জ্বলা রোদে
আজো হাঁকে বিষ্যুদবারের ছায়া?
তোমার নামটি ওই বিকেলের কোলে
রেখে এসে হাত ধরেছি মায়ার।

ঘটা করে প্রেম দিয়েছো গালে
শুষ্ক চোখে চোখ মেরেছো কতো
ভালবাসার দাগগুলো সব রেখে
কেমন আমি দীর্ঘ অভিবাসী!

বেঁচে আছো? কেমন বেঁচে আছো?
কোন সড়কের কোন তালাতে ঘর?
ফরিদপুরের ঝিলটুলিতে আজো
তোমার হাসির চিহ্ন পাওয়া যাবে?

তিরিশ বছর আগের ধূলিগুলো
ফুঁ দিয়েছো হঠাৎ ঘুমে এসে
হঠাৎ তোমার হাত রেখেছো জ্বরে
গাল রেখেছো এমন অন্ধকারে!

নামটি তোমার ভুলেই গেছি মেয়ে
ছদ্মনামে ডায়রি ছিল ভরা
ডায়রিগুলো কোথায় আছে আহা
নামগুলো ঠিক কোথায় মানানসই!

মাসুদ রানার মাঝ পাতাতে ভরে
ছোট্ট করে চিঠি দিতে খুব
ছোট্ট ছোট্ট জীবন আঁকা স্বর
তুলে রাখতাম নিঃসঙ্গ গিটারে।

কোথায় আছো? কোথায় এখন থাকা?
চায়ের চুমুক ঠাণ্ডা করেই দাও?
বুকের ব্যথা পুষেই রাখো বুকে?
ভীষণ মায়ায় হাত রাখেনা কেউ?

ঘুমের ভেতর আসলে তুমি মেয়ে
পাঁজরজুড়ে ব্যথার অভিমান
ঘুমের ভেতর আসলে ব্যথা নিয়ে
পাঁজর তোমার রাখলে আমার গায়ে।

তোমার পাঁজর খুলছি যেন খাতা
একটি করে লাইন লিখেছি তাতে
ঠিক যেখানে তীব্র ব্যথার সুর
ঠিক সেখানে টান দিয়েছি দাঁড়ি।

কাঁদছি আমি কাঁদছি আমি দেখো
তোমার মতই কাঁদতে আমি পারি
তোমার কবি কাঁদছে অবিরাম
এই জীবনে আর পাবে না খোঁজ।

ভালবাসার ছন্নছাড়া পা
যেমন হেঁটে আসে তেমন যায়
দুইটি হৃদয় দু‘দিক ঠেলে দিয়ে
ছন্নছাড়া হাওয়ায় মিশে যায়

হাওয়ায় মিশে যায়
হাওয়ায় মিশে যায়।

বৃত্ত

বেলুনে বেলেছো মন, অনিশ্চিত রুটি হই দিন দিন।
আয়ু বাড়ে গোল হয়ে, শীর্ণকায় হতে থাকে অভিলাষ।

দক্ষ সদালাপী হাতে গুণগুণ করে রুটি নয়, বেলেছো আমাকে হায় অবিরাম, মথেছো আমাকে।

এ এক অদ্ভুত বৃত্ত হয়ে বাড়ে আমার জীবন।
এমন উন্মুক্ত রান্নাঘরে,
এই ধোঁয়াময় সেঁতসেঁতে স্বাদে
আমাকে যে সেঁকা হয় অবশেষে গরম তাওয়ায়।

একবার খুব বৃষ্টি হলো এই রান্নাঘরে
ফোটানো ছাতার মত টানটান হয়ে খুলে গেল তোমার শরীর। ফুলে গেল শেমিজের নকশাকাটা নজর।

চোখ নেমে যায় বারবার ভুলের উনুনে
কতক অভিসম্পাত হয়েছিল সেঁকা তাতে আর
ফেঁপে উঠেছিল সাংসারিক তাপে আর দ্বিখণ্ডনে!

ছোট্ট জানালার কাঁচে হৈচৈ করে কিছু বৃষ্টি নামে
ভেতরে তখন খুলে থাকা ছাতার মতন
টানটান করা তোমাদের দেহে
টোকা দিয়ে বাজাই আক্রোশ।
জ্বলে ওঠা আগুনের মত রাগান্বিত ক্ষোভ
রুটির ধরনে ঘোরে। ঘুরে ঘুরে ক্রমাগত সূর্য
যখন উত্তর গোলার্ধের দিনগুলো বড় করে দেয়
তোমরা তখন কাঁদো শুয়ে শুয়ে আঁধারের কাছে।

তার পাশে পড়ে থাকি রুটি উত্তপ্ততা নিয়ে।
বৃত্তহীন হতে গিয়ে এই আমি শুধু বৃত্তে পুড়ে যাই।

শীতকে নিয়ে

শাদা কাপড়ের শীত এসে থেকে যায়
ধরণীর ঋতু থেমে গেল এই দেশে!
তুষার মাথায় ঘরগুলো যেন
হুজুরের মত টুপি পড়ে আছে
আর শোনা যায় মিলাদের ধ্বনি কুলখানি কুলখানি।

এ শহর খুব মরে গেল হৃদরোগে
সিঁড়ির গোড়ায় কাফনের মত স্নো
বসে থাকে ঠিক গোরের আশায় চুপ
কাফনের পাশে আমরা একেক আগরবাতির মত
নিঃশ্বাস ঠিক ধোঁয়ার আকারে বাতাসে লুটিয়ে মরে

গাড়ির বনেটে হার্ট এঁকে তুই
লিখেছিলি প্রিয় নাম
নতুন তুষারে চাপা পড়ে গেল তাও।

তোমাদের দেশে পৃথিবীটা কত লাল
তোমাদের রঙবালাদের দেশে ঋতুগুলো বদলায়
তোমাদের দেহে কার্তিক আসে ফাগুনের রস জাগে
তোমাদের ঋতু চির বহমান তোমাদেরই ভঙ্গিতে

ধরণী এখানে বৃদ্ধা হয়েছে ভঙ্গিটা জবুথবু
এইখানে শীত আলঝেইমারে ভোগে
এইখানে শীত এসেছে কিন্তু পথ হারিয়েছে যেতে

এই শহরেই ধরণী তোমার ঋতু থেমে গেল, হায়!

সহজ ঘুম

রাত চলেছে রূঢ় ট্রেনের ছাদে
স্পর্শহীন নিঝুম এক দ্বীপে
আঁধার থেকে ডেকেছে রাণী, এসো
কল্পনার নরম কোনো পথে।

চিরদিনের অন্ধকার ঘেঁটে
অযুত দানা নিয়েছিলাম দেহে
চোখের পানি শিখেছে গুঞ্জন
বিরান হুইসেলের সুর থেকে।

মুখভর্তি উষ্ণতার লালা
বরফ বেঁধে নিজেই গলে যাই
ঝরনা থেকে অবহেলার নদী
ফিরে যাচ্ছে হিমালয়ের দিকে।

নিবিড় বোধে ছোট বিবাদ এক
বাঁধিয়ে দিয়ে কোথায় যাও ট্রেন?
আলো পড়েছে নক্ষত্র থেকে
একটি অনাবিষ্কৃতের চাঁদে।

শরীর থেকে ভাঁজের রেখা নিয়ে
অবলীলায় আঁকি অন্ধকার
কালো দেহের সেদ্ধ দানা লুটে
বসে আছেন যে অপরূপ শাদা,

তারই কাছে হাত পেতেছি, দাও
রূপোর ঘুমে সোনার কাঠি নেড়ে
অদেখা সেই সহজ ঘুম আজ
নদীর মতো চলুক অন্তিমে।

দুটি মুঠ

মৃত্যুর সামনে এসে জীবনটা বেঁকে বসে আছে।
কীভাবে ফেরাবে তাকে?

অটামে এমন হয়, পাতা ঝরে রাতের গভীরে
কমলা রঙের পাতা, শয্যাশায়ী, সেখানে করুণ জ্যোছনা
কিছু সুর রেখে যায়।
এমন মেলোডি আমি তুলে রাখি গিটারের তারে।

গিটারে তোমার চোখ, মৃত্যুকামী তুমি
ডাগর অনুসরণ।
স্ক্রুর মত ঘুরে ঘুরে তোমার অবাধ্য চোখ আলগা হয়ে গেলো
মৃত্যু পষ্ট হয় এই অন্ধতায়।

মৃত্যুর সামনে এসে জীবনটা বেঁকে বসে আছে।
দোয়ার ভঙ্গিতে আমি তাই
দু’হাতে এনেছি বয়ে দশটি আঙ্গুল
তুমি ধার নেবে দু’টি মুঠ এই ভরসায়।

দু’টি মুঠ! তুমি ধার নেবে এই ক্ষুধা?
অনাহারী এক প্লেটে পড়ে আছি সামান্য খাবার।
কীভাবে ঠেকাবে?

আমার কন্যা ঘুমের মধ্যে হাসে

আমার কন্যা ঘুমের মধ্যে হাসে
খুব বেশি না, মুচকি হাসি। মাঝেমধ্যে
ঠোঁট বাঁকিয়ে কায়দা করে হাসতে গিয়ে
ঘুমে ঢাকা চোখদুটো ওর তিরতিরিয়ে কাঁপে।
আমার কন্যা ঘুমের মধ্যে হাসে।

মেঘের ফাঁকে হরিৎ বরণ চাঁদ
পথের পাশে শাদা ফুলের গায়ে
নরম করে আঘাত করার মতো
ঘুমের মধ্যে হেসে ওঠে মেয়ে।

শাদা মেঘের কুসুম কুসুম আঁশে
রোদের তরল হাত রয়েছে ঝুলে
একটি বহুরঙা ঘুড়ি হঠাৎ
মেঘকে বলে এবার তুমি নামো!

মেঘ নেমেছে জানলা দিয়ে ঘরে
আমার মেয়ের গালের ফোলা ভাগে
এক ফোঁটা জল ঢেলেই বলে, চলি
এই এতোটুক বিরক্তকে ক্ষমা করে দিয়ে
ঘুমের ঘোরে আমার কন্যা হাসে।

স্বপ্নে এখন দৌড়ে কোথাও যাস?
বেগনি রঙের প্রজাপতির ডানায়
ছোট্ট করে ফুঁ দিয়ে তুই উড়াবি কি হাওয়ায়?

স্বপ্নে এখন গ্রিসের পথে মেয়ে
কিংবা আলানিয়ার বীচে স্নান
মিশর গিয়ে দেখে আসা নেফারতিতির মালা
নিজের গলায় পরে হঠাৎ হাসি পেলো খুব?

আমার মেয়ে আড়াল করে আয়না দেখে হাসে
ঘুমের মধ্যে এখন কি সে আয়না নিয়ে আছে?
হাসছে যে খুব? কী লাগবে ওর?
নাকের নোলক? কানের ঝুমকা? মেকাপ বাক্স?
ছোট্ট একটি অগোছালো নিজের মতো রুম?

পরীর গল্প শুনে শুনে হাসতো আমার মেয়ে
স্বপ্নে এখন পরী দেখছে সে
পরীর সঙ্গে কথা বলে হাসি পাচ্ছে খুব
আমি জানি হাসি পাচ্ছে খুব।

আমার মেয়ে ঘুমের মধ্যে হাসে
ঘুমের মধ্যে চোখদুটো ওর কাঁপে
একলা আমি বসে থাকি
ঘুমের দিকে চেয়ে
আমার মেয়ের ঘুমসিক্ত হাসির দিকে চেয়ে।

স্বপ্নতে তোর কী কী ছিল চাওয়া?
কোন অধরা ধরতে গিয়েও ধরতে পারিসনি?
কোথায় যাবি? তারা ধরতে? নদী ধরতে?
ঘুমের ভেতর ভাইটি কি তোর সঙ্গে থাকে?
স্বপ্নেও ওর কাণ্ড দেখে হাসি পেলো?
খেলার ঘরে তুলে রাখা হলুদ রঙের ডানাদুটো
ঝেড়ে মুছে পরতে গিয়ে হাসি পেলো খুব?

আমার মেয়ে স্বপ্ন দেখে হাসে।
হাসি দেখে স্বপ্ন পড়া যায়?
কোন হাসিটার পেছনে যে লুকিয়েছে কোন চাওয়াটা!
কোন আশাটা ভাবতে ভাবতে উবে গেল —
বুঝার জন্য কেউ আমাকে ধার কি দিবেন
ম্যাজিক খোয়াবনামা?

রাত্রি জেগে বসে আছি
এই জগতের সকল কিছু হাতের কাছে নিয়ে
আমার মেয়ে উঠলে জেগে সবকিছু সে পাবে।

চিঠি

নামের চেয়ে বেশি প্রিয় তোমার ছিল যে চিরকাল ছদ্মনাম
ঝড়ের ঠিকানায় চিঠি পাঠাই সে-ভাষা কখনই পদ্য না
নিজেকে লিখে লিখে অন্তরাতে কোন সে অসুখের ভাসাই ভেলা
সঞ্চারীতে এসে অন্ধকারে, নিজেই খাম হই ইনভেলাপ।

তোমার পিছে পিছে ইনভেলাপে নগ্ন নারীদের সর্বনাশ
ডেকেছে যারা, আজ তারাই বীর। তারা কি মিছিলের গর্ব না?
এ গেল শ্লেষ শুধু; মূল কথা যা, বাসনাবিহ্বল যৌনতা
গভীরতম পথে আকাশচারী বিষণ্ণবিধুর মৌনতায়।

তবে কি বুননের মুদ্রা, ঢঙ, শস্যক্ষেত সব অশ্লীল?
প্রেমের উছিলায় তাম্র, লোহা, প্রস্তরযুগটা চষলি?
মাটির গভীরতা কে জানে কত, কতটা ভেজা জমি উর্বর
কতটা পিড়ামিড, কেমন মমি, রোগের কতদূর খুঁড়বো?
কতটা তল তার কয়টি ক্ষত, একা একাই জল সিঞ্চি
বুকের বাম দিক ক্লান্ত, হত, জটিলতার ব্যথা চিনচিন।

তোমাকে মনে পড়ে বর্ষামেঘে শাড়ির ভিজেছিল অঞ্চল
তোমাকে ভুলে যাই রৌদ্র দেখে রোদেরা হননের সঞ্চয়।
চিঠি তো খটমটে ভাষায়, তাই তোমার নাম রাখি উহ্য
ছদ্মনাম খুঁজে পাইনি আজো ভেঙেছি তালাশের উদ্যোগ।

লিখেছি এতকিছু অথচ জানি একাকীত্বের এ আর্তনাদ
ছাড়া তো নিয়মের শিল্পগুণে কবিতা নিজে হতে পারতো না।

জর্জের শ্বাস

আমার বাঁ পকেট এখনো ফুলে আছে
আন্ধারমানিক নদের এক ফুঁ অপূর্ব বাতাসে
কবে একদিন এই তীক্ষ্ণ মিহি বাতাস
ঢুকে পড়েছিল পকেটে! তারপর
পকেটেরই পোষা হয়ে গেছে পুরোটা জীবন।
এইটুকু অতিরিক্ত বাতাস আমি জমিয়ে রেখেছিলাম জর্জ
শান দেয়া তীব্র শিসের মতো প্রস্তরভেদী
এক মুঠো বাতাস তোর শ্বাসে ফেলবো বলে
আমি জমিয়ে রেখেছিলাম এই কালো বুক পকেটে।
তোর শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল জেনে
আন্ধারমানিকেও থেমে গেছে ঢেউ।
জর্জ, তোর কণ্ঠ থেকে উপচে পরা আয়ু
যদি আবার ফুঁ দিয়ে ঢুকিয়ে দিতে পারতাম
তোর নিচু জীবনের দমে,
ঘটা করে দীর্ঘশ্বাস পালা দরিদ্র ফুসফুসে!
যদি পারতাম, মাটি থেকে তুলে আনতাম ব্রিথ।
তোর বন্ধ হয়ে যাওয়া চোখের পাতার বাইরে
পৃথিবীটা ধীরে ধীরে শাদা হয়ে যায়,
তোর বন্ধ হয়ে যাওয়া চোখের পাতার ভেতরে
এক অদৃশ্য জীবন আছড়ে পড়ে কালো হয়ে যায়
শাদা-কালোর এই ছানিপড়া ঘোলাটে পৃথিবীতে
তোর মৃত্যুটাই শুধু রঙিন হয়ে গেল।
এখন একজোড়া বোজা চোখ
আমাদের আত্মার দিকে ভীষণ তাকিয়ে আছে
এখন হৃদয়ের সর্বশেষ পালস থেকে
জন্ম নেয়া একটি রূপকথার ভাণ্ড
উপুড় হয়ে পড়েছে পিচঢালা কালো সড়কগুলোতে।
এই প্রবাহমান বাতাস সাক্ষী
স্বাক্ষী এই রৌদ্রোজ্জ্বল দিন
মিহি বিকেলে হাত উঁচু করা স্ট্যাচু অব লিবার্টি স্বাক্ষী—
এখানে একজনের শ্বাস-ভিক্ষা ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল।
এভাবেই নিতে না-পারা একটি শ্বাস
পুলিশের হাঁটু থেকে মোচড় খেয়ে খেয়ে
আমার দুহাতে এসে প্রাণভরে শ্বাস নিতে চায়।
আমি মোনাজাতের মত হাত তুলে
তোকে আগলে রাখবো জর্জ।

ভিলনিউস

ভিলনিউসে সন্ধ্যাগুলো মরা
তার উপরে মেঘ করেছে খুব
একটু পরে বৃষ্টি যদি নামে
একটু পরে রাস্তাটা নিশ্চুপ।

ইট বিছানো গলির মোহনায়
লাইট ফেলেছে মধ্যরাতের বার
ভুতের ভয়ে চমকে ওঠার মতো
রাতের হাতে নাচছে শনিবার।

চারদিকে খুব সটান নিরিবিলি
মুখোমুখি পরীটা উদ্দাম
নিঃসংকোচে বৃষ্টিরা তার হাতে
আমার আগেই দিচ্ছিল নীল খাম।

রাগ করে কেউ ফিরেছে রাত্রিতে
গৃহগুলো স্বপ্নভাঙা আজ
মেয়ের চোখে একটু কাঙালপনা
টেনে টেনে আঁকছিল সেই সাজ।

ডিস্কোথেকের একঘেয়েমি নাচ
মুখ ভেংচিয়ে বাইরে ঝুঁকেছিল
নাকের নথে জ্বলছে অসভ্যতা
সভ্যতাকে খানিক ঝলসে দিলো।

পুরান দেয়াল গ্রাফিত্তিতে মোড়া
চক দিয়ে নীল কবুতরটা এঁকে
কানে কানে বলে দিলাম, পাখি
পালিয়েছি ঘৃণার শহর থেকে।

ভিলনিউসে সন্ধ্যাতারাগুলো
একে একে ঝাপসা হয়ে গেলে
ইট বাঁধানো পুরান সড়কটিতে
খুব ভীরু হয় একটি দুঃখী ছেলে।

তোমার কাছে কথা লুকাই ভ্রমে
তোমার কথাই ভীষণ মনে পরে
এই শহরে থার্মোমিটার পাবো?
ভিলনিউসের গা পোড়ে যে জ্বরে।

মৃত্যু

এখন একটুতেই মাটিতে পড়ে যাই
হু হু বাতাসের টানে হুমড়ি খেয়ে পড়ি
পাথরে হোঁচট খেয়ে উল্টে পড়ি
ভারসাম্যহীন দেহে বিকেলের শেষ রোদ এসে পড়েছে
আমি বারবার নৈসর্গের বিপদে পড়ি।

এখন একটুতেই ভেঙে পড়ি
স্বদেশের জন্য কান্নায় লুটিয়ে পড়ি
সন্তানের আদরে বিগলিত হয়ে পড়ি
মৃত পিতার জান্নাত কামনায় অথবা
জননীর দীর্ঘায়ু চেয়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়ি।

আরও কিছু পড়ে যাওয়া অবিচ্ছেদ্য হয়ে যায় খুব

তোমার নীলবর্ণ চোখে খুব সহজেই পড়ে যাই
তোমার নিস্পৃহতার গভীরে পড়ে যাই
অস্পষ্ট হাতছানির প্রেমে পড়ে যাই
কিছু অদ্ভুত ঘোরের ফাঁদে পড়ে যাই
মুগ্ধ শৈশবের স্মৃতিতে পড়ে যাই
অতীতের কিছু বিক্ষত রমণীর মনে
দগদগে ঘায়ের মতো পড়ে থাকি
তোমাদের মনে পড়ে যাই ক্রমাগত।

সিঁড়িতে নামতে গিয়ে পড়ে যাই
বাসে উঠতে গিয়ে কিংবা
রিকশা থেকে পিছলে পড়ে যাই
পড়ে যাই নিজেরই দুঃসহ বেদনার ভারে
ভারসাম্যহীন জীবনের অসীম পথের ধাক্কায়
চূর্ণময় ভেঙে পড়ি সড়কগুলোতে।

দু’ফোঁটা আদরের মোহে পড়ি
এক পঙক্তি আলিঙ্গনের মোহে পড়ি
ব্যর্থতার চূড়ায় দাঁড়িয়ে ক্রোধে ফেটে পড়ি
আমি ঘুমিয়ে পড়ি আমি ঘুমিয়ে পড়ি।

এখন একটুতেই আমি পড়ে যাই।
এই পতনের আর কি মানে আছে দয়াল?
মাটি ডাকছে।

কবির বালিশ

আপনি মারা যাচ্ছেন কবি?
আপনার তুলতুলে গাল হারিয়ে যাবে এই বালিশের স্পর্শ থেকে?
সোনালী আঙুলগুলো বোবা হবে এখনই?
বাইরে সূর্যের শেষ আলো গুঞ্জন তুলছে।
আপনার মায়ের নামে এখনই খুলে যাবে কোন ভেজানো কপাট।
এভাবে কান পেতে তবে কেনো শুয়ে?
মায়াবী পর্দার ওপার থেকে যে ডাহুক
শিস দেয় আস্কারা দেয় প্রলভিত করে
তাকে কবুল কবুল বলেই নিথর হবেন?
একখানি কবিতার বই শুয়ে আছে মৃত্যুর বালিশে।
কবিতা বোঝেনা বালিশ, কিছু ছন্দ থেকে যায় শুধু বালিশের ভাঁজে।
আপনার আঙুল ধরে ধরে, মাত্রা গুণে গুণে ঠিক ফুলে যাবে ফের বালিশ।
আপনি মারা যাচ্ছেন কবি?

আপনার শিয়রে যারা তারা কাঁদে। তারা চোখ নিভিয়ে রেখেছে ভয়ে। আপনি তাকিয়ে আছেন মৃত্যুর দিকে তির্যকভাবে, আপনি মেনেছেন, পরাজিত হয়না কবিরা।

কবিরা পরাজিত হয়না, তবু কেন আপনারা জানালা বন্ধ করে দিলেন মৃত্যুদূতের ভয়ে? আজরাইলের পথ ঠেকাতে কেন খিড়কি এঁটে দিলেন সমবেতগণ?

হাজার হাজার মাইল দূরে বসে
সোনার নোলকের মত জ্বলে থাকা
আকাশের নক্ষত্রের দিকে চোখ রেখে
শরতের এই শীতল ধূধূ অন্ধকারময় রাত্রিতে
একা একা আমি জানালা খুলে দিলাম।
আমাদের কবি মারা যাবেন। আমার মাথার
বালিশ ভিজে গেল দু’ফোটা কবিতায়।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন