উড়াল পঙ্খিরে ।। মুহাম্মদ মিজানুর রহমান

 
পাখিকে আমি পছন্দ করি, কারণ ওর স্বাধীনতায় আমার বিশ্বাস আছে। তাই ওর প্রতি আমার এত ভালোবাসা। এ পাখি কোনো সাধারণ পাখি নয়, যে মুক্ত আকাশে ভেসে বেড়ায়, এ আমার মনের আয়নায় জুড়ে বসা এক পাখি। পাখি তার ছদ্ম নাম। আর এ নামেই আমি তাকে ডাকি।

পাখি আমার বাল্যবন্ধু। পারিবারিকভাবে দুজনের মধ্যে এক অন্যরকম সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। পাখির বাবা আর আমার মা দুজনে ভালো বন্ধু। চাকরি সূত্রে তারা একই অফিসে কাজ করেন। এখান থেকেই আমাদের পরিচয়।

আমার বাবার কিছু বাজে অভ্যাস আছে। এ নিয়ে মায়ের সাথে প্রায়ই কলহ হতো তার। আর এ সমস্যা সবসময় লেগে থাকত। বাবা কিছুতেই নিজেকে শোধরালেন না। কাজকর্ম সব ছেড়ে দিয়ে নেশায় বুদ হয়ে থাকতেন। মা কিছু বললেই রেগে যেতেন। সারাদিন শুধু ঘুম আর ঘুম। মা কত করে বাবাকে বোঝাতেন, এসব ছেড়ে দাও, ছেলে বড় হয়েছে। বাবা তার কথার কোনো ধার ধারতেন না। মা খুব কষ্ট পেতেন বাবার আচরণে। একসময় মা-ও হাল ছেড়ে দিলেন।

কাজের বুয়ার সাথে আমি আর আমার বোন দুজনে স্কুলে যেতাম। যখন বাসায় স্যার পড়াতে আসতেন এই বুয়াই নিজের সন্তানের ন্যায় আমাদের পাশে বসে থাকতেন। মায়ের ভয় ছিল শবনমকে নিয়ে। শবনম আমার বোন। উঠতি বয়সের মেয়ে। আমাকে নিয়ে যে একেবারে ভয় ছিল না তা কিন্তু নয়। তবে ছেলে বলে অতটা ভাবতেন না আমায় নিয়ে। মা তাই বুয়ার হাত ধরে বলেছিলেন, তুমি আমার ঘরসংসার সবই দেখছ, কোন অবস্থায় আমি আছি তা-ও দেখছ। নিজের মনে করে ওদের আগলে রেখো। ভুল পথে চলে যেতে দিয়ো না ওদের।

পাখির বাবা আমার মায়ের সহকর্মী। অত্যন্ত ভদ্র মানুষ তিনি। মাকে তিনি বোনের মতো জানত। মা-ও তার দুঃখগুলোতে তার সাথে ভাগাভাগি করতেন। আমাদের বিপদে-আপদে সবসময় এগিয়ে আসতেন। এ নিয়ে প্রথম প্রথম পাখির মার একটু-আধটু অমত থাকলেও পরে আর সে বাধাটুকুও রইল না। একসময় আমার বাবাই বাধা হয়ে দাঁড়ালেন। তিনি পাখির বাবাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না। এ বাড়িতে সে আসুক সেটাও বাবা সহ্য করতেন না। একপর্যায়ে পাখির বাবা আমাদের বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিলেন। বাবার সন্দেহের মাত্রা দিন দিন বেড়ে চলল। মা-ও অস্থির হয়ে উঠলেন তার এই উদ্ভট আচরণে। এতদিন যারা মাকে ভালো জানত বাবার কারণে এখন তারাও মাকে এড়িয়ে চলে। মার দিকে আড়চেখে তাকায়।

পাখি আর আমার মধ্যে এখনো কোনো দূরত্ব তৈরি হয়নি। দুজনে একই কলেজে পড়ি। বিকেল হলে ছাদে জমিয়ে আড্ডা হয় দুজনার। পাখির প্রতি আমার প্রচণ্ড ভালোবাসা। পাখি অন্য মেয়েদের মতো নয়। চিন্তা-চেতনা ও আচরণে মার্জিত রুচিত অধিকারী মিষ্টভাষী একজন সহজসরল মেয়ে । পরিচ্ছন্ন চিন্তা ও কর্মে তার অগাধ বিশ্বাস। পাখির ব্যাপারে এখনো ওর পরিবার থেকে কোনো বাধানিষেধ আসেনি।
ওকে না-দেখলে আমার ভালোলাগে না। আমি ওকে সবসময় মনে করতাম, ও আমার পরিবারের একজন। এতদিন আমরা সেভাবেই চলেছি। কিছুদিন হলো পাখিকে আমি দেখি না। আমি আংকেলকে জিজ্ঞেস করলাম, আংকেল, পাখি কোথায়? তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মুখ গম্ভীর করে বললেন, পাখিতো বেশ কদিন আগেই ওর মামার বাসায় চলে গেছে। ও এখন থেকে ওর মামার বাসায় থাকবে। ওখানে পড়াশোনা করবে।
আমি বললাম, ওতো আপনার একমাত্র মেয়ে, ওকে দূরে না-রাখলে হতো। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মেয়ে বড় হলে বাবাকে অনেক কিছু ভাবতে হয়। তার সবদিকে খেয়াল রাখাই বাবা-মার দায়িত্ব। জীবন গড়ার স্বার্থে ছোট-খাটো অনেক স্মৃতিকেই ভুলে যাওয়া ভালো। তাতে জীবনের মঙ্গল হয়।

আমি বুঝতে পারলাম, আংকেলের এ কথাগুলো আমাকে উদ্দেশ করেই বলা। তবুও আমি এমন একটা ভাব করলাম, যেন কিছুই বুঝতে পারিনি আমি। বরং আমার জি-হ্যা সম্মতিসূচক কথাগুলো তার এ সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করলাম।
আমি বুঝতে পারলাম, সবাই আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করছে। আমার মা অপরাধী না হয়েও অপরাধী। মানুষের চোখে দোষী। কারণ সে একজন মাতালের স্ত্রী। আমি একজন মাতাল পুত্র। আর কেউ এমন একটি পরিবারের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ছোট করতে চায় না।

আমি যেমন বড় হয়েছি, পাখিও তেমনি ছোট নেই। নিজের ভালো-মন্দ সবই সে বোঝে। পাখিকে আমি মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি সেকথা পাখি জানে। তবুও পাখি নিজের ভালো বুঝতে পেরে এখন আমার থেকে একটু দূরত্ব বজায় রাখে। আর এটা সে কেনো করছে তা-ও আমি জানি। তাই বলে পাখিকে কখনো আমি দোষারোপ করি না। কারণ, পাখি ভুল করেনি। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট হওয়া অতি সম্ভাবনাময়ী একজন মেয়ে পাখি। সে কেন আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করবে। তাছাড়া এটা আমি হতেও দিতে পারি না। তার এবং আমার মাঝে এখন অনেক তফাৎ। তাই আমিও নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করলাম। হয়তো পাখি সেকথা জানে না।

একদিন পাখি আমায় ডেকে বলল, দেখো সাদ, তুমি আমার বাল্যবন্ধু। আর আমি এ-ও জানি, এখনো তুমি আমায় ভুলতে পারোনি। মনে-প্রাণে ধরে রেখেছো বাল্যবেলার সেই স্মৃতিগুলো। কখনো কখনো অপরের ভালোবাসাকে সম্মান জানাতে নিজের ভালোবাসাকে ভুলে যেতে হয়। দুটো পরিবারের মাঝে সংশয়ের যে জায়গাটি তৈরি হয়েছে তা আর সহজে মুছে যাবে না।
তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি, বাবাকে গ্লানির হাত থেকে বাঁচাবো। আন্টির গায়ে কোনো অসম্মানের আঁচ লাগতে দেব না। যাতে কেউ নোংরা চোখের ইশারায় বলতে না-পারে নিজেদের সম্পর্কে জোড়া দিতে গিয়ে দুটো ছেলেমেয়ের চার হাত এক করে দিয়েছে। তোমার পাখি আজ তোমায় ছেড়ে অনেক দূরে উড়াল দেবে স্থির করেছে । পাখির কথা শুনে আমি হেসেছি, কিন্তু আমি কী হেসেছি? জানে শুধু নিরঞ্জন…
 
 
মুহাম্মদ মিজানুর রহমান: তরুণ লেখক।

10 মন্তব্য সমুহ

  1. মুহাম্মদ মিজানুর রহমান লেখক হিসেবে বয়সে তরুণ হলেও তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত ও চিন্তন শক্তির অধিকারী একজন সহজসরল মানুষ। তাঁর লেখা কলাম বিভিন্ন পত্রিকায় পড়ে থাকি। সাহিত্য বিষয়েও জানি তিনি ভালো লেখেন। ভালো লাগল তাঁর লেখাটি পড়ে।

  2. সাহিত্যিক ও গবেষক মুহাম্মদ মিজানুর রহমান এঁর গল্পটি পড়ে ভালো লাগল। আশা করি আগামীতে তাঁর আরো ভালো কিছু লেখা দেখতে পাব।

  3. সাহিত্যিক ও গবেষক মুহাম্মদ মিজানুর রহমান এঁর গল্পটি পড়ে ভালো লাগল। জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর গল্প ও প্রবন্ধগুলো আমি নিয়মিত পড়ি। এখানে দেখেও ভালো লাগল।

  4. সাহিত্যিক ও গবেষক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একসাথে গবেষণা করেছি) মুহাম্মদ মিজানুর রহমান এঁর লেখাটি পড়ে ভালো লাগল। জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তাঁর গল্প ও প্রবন্ধগুলোও পড়ি। এখানে দেখে ভালো লাগল।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন