গল্প
শিরতাজমহল ও তার সোনালি চশমা
রেদওয়ান খান
পুবাকাশ
মায়ের চোখে সোনালি ফ্রেমের চমশাটা বাবা কিনে দেননি– এটা এখন বুঝতে পারে তারা- রিফাত, রানা। ওই চশমা পরে মা যখন বাইরে বেরোন বা বাসায়, তখন মাকে নিজের মা মনে হয় না তাদের। খুবই পর পর মনে হয়। আর খুবই অচেনা।
একটানা ঘুমিয়ে শিরতাজমহল যখন চোখ মেলে, তখন বাইরে ভাদ্র মাসের গুমোট রোদটা ঝাঁ ঝাঁ করছিল। বিছানায় শুয়ে থেকে আরও কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করল সে। তার উঠতে ইচ্ছে করছে না। শফিকুল চলে গিয়েছিল রাত দুটোর পর। শরীর খুবই দুমড়ানো মোচড়ানো। ঘুম আসতেও দেরি হয়েছিল। ঢাকা শহরের আযান খুব একটা শ্রুতিমধুর না হলেও ফজরের আযানটা মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুনতে ঘুমটা জেঁকে বসেছিল তার। তারপর ঘুমের পাতালে তলিয়ে গিয়েছিল শিরতাজ।
ক্ষিধেটা পেটের ভেতর সাপের মতো কষে প্যাঁচ না মারলে হয়তো সুখনিদ্রাটা আরেকটু বিলম্বিত হতে পারতো। সূর্যের হেলে পড়াটা টের পেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে শিরতাজ। তার সারা শরীরটা ব্যথায় বিষ হয়ে আছে।
নসুর মা টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখে নিজের অন্ধকার ঘরে ধর্ম চর্চায় বসেছে। এ বাড়িতে শিরতাজের সব কাজ করে দেয় নসুর মা। অনেক কাল ধরেই আছে। তিনকুলে কেউ নাই তাঁর। এখন প্রায় বৃদ্ধদশা চলছে তাঁর। কাজও তেমন করতে পারে না আজকাল। কিন্তু রান্নাটা ভাল। এখন তিনি নিজের মতো যা পারেন, করে টরে এক হাজার গোটা দিয়ে বানানো তসবিহর মালা নিয়ে আল্লাহর নাম জপতে বসেন।
ঘর মোছা আর অন্যান্য ধোয়ার কাজটা করে ছুটা মেয়েটা-রোখসানা। তার সাথে আবার বনাবন্তি নাই নসুর মায়ের। রোখসানার সাথে মাঝে মাঝে ক্যাট ক্যাট করা ছাড়া প্রায় নিরুপদ্রব, বিশ্বাসী একজন মানুষ নসুর মা। শিরতাজমহলের ছেলেরা নসুর মাকে ফুপু সম্বোধন করে। এদের সবারই জন্ম দেখেছেন তিনি, কোলে পিঠে করে মানুষও করেছেন। এ বাড়িতে নসুর মায়ের দাবি আর অধিকার তাই প্রশ্নাতীত।
বিছনা ছেড়ে ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় চুল ঠিক করতে গিয়ে নিজেকে সহসা চিনতে পারে না আজ শিরতাজমহল। খানিকক্ষণ নিজেরই চেহারা দেখার পর, মাই গড- এই শব্দ দুটি ব্যতীত আর কোনও সাবলীল কথা বা উচ্চারণ খুঁজে পায় না সে।
তার দেহে প্রচুর মেদ জমেছে। চোখের নিচে কালছে দাগ। ঠোঁট রীতিমত ঝুলে পড়েছে।ঠোঁটের পাতায় লিপস্টিকের রঙচটা গুড়ো লেগে আছে। সামনের দিকে কপালের দুপাশে মেহেদী লাগানো চুলের স্টাইলটাও আর শিরতাজমহলকে খুকি খুকি করে রাখেনি- এটা স্পষ্ট। তলপেট ভারি হওয়াতে চালকুমড়ার পুটকির মতো মরা নাভি বাইরে উগরে দিয়েছে যেন বা। সেই পেট এতোটা কিম্ভূত মনে হতো না, যদি তার পা জোড়া মানানসই রূপে স্বাস্থ্যবান হতো। নিজের পাকে তার রাস্তার সর্বহারা নেড়িকুত্তার ঠ্যাং এর মতোই মনে হতে থাকে। চকিতে, আয়নায় একবার শয়তানের অবয়ব কল্পনা করে নিজের ভেতরে খানিক নিভে যায় শিরতাজমহল। নিজের কাছেই সে তার বয়স লুকাতে পারছে না।
এ অবস্থায় আত্মহত্যার একটা আকাঙ্খা চিনচিনিয়ে ওঠে শিরতাজমহলের, সে বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দেয়। সারারাতের দুমড়ানো মোচড়ানো শরীরটা পানির নরম আদরে সজীব হয়ে ওঠে নিমেষেইে। এ সময় পেটের ভেতরের ভেতরের ক্ষুধা সাপের মতো ধড়ফড়িয়ে ওঠার প্রেক্ষিতে জীবনের প্রতি একটা মমতা অনুভব করে শিরতাজ। তার ঠোঁট দুটি সামান্য নড়েচড়ে ওঠে। গতরাতে এই ঠোঁট দু’খানি শফিকুলের কাছে গোলাপের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠায় সে তীব্র চুম্বনে-মন্থনে ওগুলো অবশ করে দিয়েছে।
খাবার টেবিলে নসুর মা অনেক কিছুই রেখেছে। রুটি, মাংসভুনা, মিষ্টি, কলা, নিমকি, বাটার-পাউরুটি। ফ্লাস্কে গারম পানি-কফির জন্য।
সামান্য বাটার মেখে একপিস পাউরুটি আর কলা খেল শিরতাজ। তারপর মগভর্তি কফি নিয়ে বসলো। প্রকৃতপক্ষে কফিতে চুমুক দেয়ার পরই সে গত রাতের সম্মোহন থেকে ফিরতে শুরু করে, ঢুলু ঢুলু ভাবটা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করে।
কফি খেতে খেতে ছোট দুই ছেলে রিফাত-সিফাতের কথা মনে পড়ে তার। ওরা হয়তো কখন মাঠে সাইকেল চালাতে চলে গেছে। নসুর মা ভাল বলতে পারবে। ওদের প্রতি কিছুটা অবহেলা হয়ে যাচ্ছে– এরকম মনে হয় শিরতাজের। আজকাল সে বেশিরকম দূরত্ব বজায় চলছে কি ! নিজের কাছে এই জিজ্ঞাসা কিছুটা লতিয়ে ওঠে যেন বা। সে বাড়িতে নিয়ম করে দিয়েছে- দরজা বন্ধ থাকলে কেউ যেন তাকে কড়া নেড়ে ডিস্টার্ব না করে। নসুর মাকেও বলা আছে।
শফিকুলের পীড়াপীড়িতে গত রাতে মদ্যপানটা একটু নয়, মাত্রা অতিক্রম করেছিলো বেশ খানিকটা। শফিকুল বলে ‘লেখক হতে চাচ্ছো, তসলিমা নাসরিন হতে চাচ্ছো- একটু আধটু পান না করলে ভাব আসবে কেন-বলো ! সত্যি বলছি, খেয়ে দেখো-তোমার লেখার হাত আপনা থেকে খুলতে থাকবে-ঠিক যেন ময়ূরের পেখম!’
শফিকুলের বিস্তৃত বাহুর কাঠিন্য আর স্বপ্নমোহের ঘোরের ভেতর তার কথাসমূহ শিরতাজের নিকট সত্যের মতো সরল মনে হয়েছিল।
শফিকুল তাকে সিগারেটও ধরাতে চেয়েছে। শিরতাজের নাকে সিগারেটের গন্ধ-ধোঁয়াটা ঠিকমতো বোধগম্য না হওয়ায় এক্ষেত্রে শফিকুল সাকসেস হতে পারেনি। তবে, মনে হয়, ব্যর্থও হয়নি– একথা ভাবছে শিরতাজ। কারণ, কফি পান করতে করতে, নিজের সম্পর্কে আত্মদর্শনমূলক ভাবনায়-একটা সিগারেট হলে মন্দ হয়না– এরকম চিন্তাগ্রহটা চট করে মাথায় আসে তার।
শফিকুলকে পেয়ে তার ‘লেখক’ হবার স্বপ্নটা, ঢাকা শহরের ঘিঞ্জি, ব্যস্ত সড়কের পাশে জারুল ফুলের মতো ফুটতে শুরু করে। এখানকার নিরেট ভাবলেশহীন মানুষের স্রোত কখনও সেই প্রস্ফুটিত সৌন্দর্য দেখে না।
বহুকাল আগে, প্রায় বিস্মৃতির ওপারে-চাঁদপুর কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিনের নাম ছিল শত ফুল ফুটতে দাও। সেখানে শিরতাজের কচি-নরম হাতের লেখা একটি কবিতা ছাপা হওয়ার পর, তার ভেতর হঠাৎই একটি লেখক সত্ত্বা কিলবিলিয়ে ওঠে। তার পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হতে থাকে। অংকের খাতা, ক্লাশের নোটখাতার পাতায় হাজার কবিতায় ভরে ওঠে। পান্ডিত্যের কন্ঠস্বর চিবিয়ে চিবিয়ে ক্লাশ নেয়া বাংলার স্যার জয়সেন বড়ুয়ার ক্লাশ ভাল লাগতে শুরু করে শিরতাজের। পূর্বে সে জয়সেন স্যারের ক্লাশ প্রায়ই ফাঁকি দিয়েছে। আর ক্লাশমেইট শফিকুল একদিন বলে এ্যাই, ‘তোমার কবিতাটা সুন্দর হয়েছে !’
শফিকুলের সঙ্গে ছিল তার কয়েকজন ইয়ার। সে লম্বা, ফর্শা, চোখ বড় বড়-ভ্রু ঘনকালো। মোটাতাজা গোঁফ ও রেখেছে।
-ধন্যবাদ ! সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে সেদিন সখিগণের সঙ্গে দ্রুত কলেজ মাঠের সবুজ চত্ত্বরে হেঁটে গিয়েছিল শিরতাজ।
সেই হাঁটার ভঙ্গিও ভাল লেগেছিল শফিকুলের। সে কলেজের পরিচিত মুখ। ছাত্রনেতা। সদ্য স্বাধীন দেশে, সুদীর্ঘ পাকিস্তানি বঞ্চনার শিকার জনতার উন্নয়নের শপথ নিয়ে তুখোড় বক্তৃতা দেয়। প্রায়ই নানা উসিলায় চেষ্টা করে শিরতাজের দৃষ্টি আকষণের। ঘনিষ্ঠতা অর্জনের। ফলে ম্যাগাজিনে প্রকাশিত শিরতাজের কবিতার প্রশংসার উত্তরে শুধুমাত্র একটুকরো ধন্যবাদ- এ সন্তুষ্ট হতে পারেনি কলেজ চত্বরের তুখোড় ছাত্রনেতা।
পারিবারিভাবে বিয়ে ঠিক হযে যাবার পর, শিরতাজমহল অনুভব করে, শফিকুল ছেলেটা খারাপ নয়। কিন্তু নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো বীরত্ব তখনও তার মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি। শফিকুলও, তখনকার মতো নারীর বাহুবন্ধনের লোভ আর কবিতার মাধুর্য থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টার পর, গণ-উন্নয়ন নিয়ে নিজেকে ছারখার করে দিচ্ছিলো।
আজ এই বিকেলে, দীর্ঘ ঘুমের, ঘরের ভেতরে একা-আত্মসুলুকে ডুব দিয়ে অকস্মাৎ শিরতাজমহলের মনে পড়ে যায়, তার স্বামী মোহাম্মদ নুরুজ্জামান ভালাভোলা একটি নন্দদুলাল। কথাবার্তায় মিনমিনে হলেও শরীরের ভাষাটা ভালোই জানে। ফলে বিয়ের প্রথম চার বছরের নেট উৎপাদন তিন তিনটি পুত্র সন্তান। যে কোনও হিসেবেই শিরতাজের এই সফলতা তার স্বামীকে মারাত্মক সুখী করে। পরিবারের অন্যরা সপ্রশংস দৃষ্টিতে শিরতাজমহলের দিকে তাকায়। পুত্রবতী শিরতাজ নিজের যোগ্যতার কথা ভেবে কবিতা লেখার অমীমাংসিত ইচ্ছেটাকে ভাসিয়ে দিতে থাকে।
তার বাল্যসখি মিনু, বাপের বাড়িতে বেড়াতে গেলে, চাঁদপুরে, শিরতাজকে জিজ্ঞেস করে, বাচ্চা হইতে কেমন লাগে রে ?
মিনু তখনও পড়াশোনা করছিল। নিজের অসমাপ্ত পড়াশোনা আর কবিতা লেখার কথা মনে করে কিছুটা নিরুৎসাহিত বোধ করলেও শিরতাজ বলেছিল, বাচ্চা হইতে খুবই আরাম ! বিয়ে কর, তারপর বুঝবি।
এইভাবে নন্দদুলাল স্বামী, সন্তান, পারিবারিক হাজার কাজের ঘূর্ণিতে কেটে যায় বিশ-বাইশ বছর। শিরতাজমহল নিজের দিকে তাকাবার সময় খুঁজে পায় না। ছেলেরা এখন বড় হয়েছে- পাখাগজানোর ফলে এখানে সেখানে উড়ে বেড়াচ্ছে তারা। নুরুজ্জামানকেও কিছুটা পলিটিক্যাল ধান্ধায় পেয়ে বসেছে। সে আর আগের মতো শরীর খোঁড়ায় আগ্রহ দেখায় না। সকালে বেরোয়। ফেরে যখন ইচ্ছা তখন। রাতবিরেতের বালাই নাই। কেয়ারও করে না আজকাল।
তবে কি তারা পরস্পর সুখী নয়- একরম একটা ভানা উড়িয়ে দিতে পারে না শিরতাজ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বয়স আসলেই বাড়ছে। বয়স বাড়লেও মনটা এখনো তরতাজা কবিতা অথবা বৃষ্টিস্নাত জারুল ফুলের মতো সতেজ ও সৃষ্টি-ব্যাকুল-তা এতোদিনে টের পায় শফিকুলের ফোন পাবার পর!
প্রথমে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনি শিরতাজমহল। নিজের কানকে অবিশ্বাস্য মনে হলেও পুরুষালী ভরাট এক কন্ঠস্বর যেন কোনো এক প্রাচীন প্রাসাদে প্রতিধ্বণিত হয়ে গমগম করছিল। আর খুলে খুলে পড়ছিল যেন ইট-সুরকি-কড়িকাঠ।
চলমান একঘেয়ে সাংসারিক কাজের ভেতরেই একদিন সেই অপ্রত্যাশিত কিন্তু কল্পনাতীত নয়, হয়তো কাঙ্খিত ছিল না-সেই ফোনটি আসে। ফোনটি করে বসে শফিকুল ইসলাম, এককালের ক্যাম্পস নায়ক।
‘হ্যালো, কে ?
’‘আমি শফিকুল ইসলাম। চিনতে পারার কথা না। কেমন আছো ?’
প্রথমতঃ বিস্ময়ে কিছুতা নির্বোধ অনুভূতির পর শিরতাজ বললো, হঠাৎ ! আ– আপনি-তুমি ? সম্পর্ক তো এক সময় তুমি-তেই ছিল। সামলে ওঠে ব্যাপারটা শিরতাজ। প্রায় বিস্মৃতির অতল থেকে এক পুরুষ হঠাৎ ফোনকল করেছে, শিরতাজ তাকে তুমি বলে ফেলে নিজেই সামান্য বিব্রত-বিস্মিত।
‘আমার নম্বর পেছো কোত্থেকে ?’
‘ও নম্বর ? সেটা কোনও অসম্ভব ঘটনা না। ইচ্ছে থাকলে একটা সামান্য নম্বর জোগাড় করা শফিকুলের কাছে বিরাট কিছু না। শফিক খুবই আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে ফোনের ওপার থেকে গমগম করতে থাকে। মানে আছে চাঁদপুরের কথা? কলেজ বিল্ডিং ? এ্যাসেম্বলি হল? সেই বিশাল মাঠ আর নাজিরপাড়ার চিপা গলি ? জয়সেন বড়ুয়ার বাংলা নোট সংগ্রহ করে, কে এনে দিত তোমাকে ? কলেজ ম্যাগাজিনে তোমার কবিতা !’ শফিকুলের কন্ঠে এখনো পলিটিক্যাল কথা-চতুরতার ফুলঝুরি শিরতাজের কানে বাজতে থাকে।
‘তা এ্যাতোকাল পর সেইসব কথা বলার জন্যই কি নম্বর জোগাড় করেছো নাকি, মিস্টার পলিটিকস ?
‘শিরতাজ, এভাবে বলো না। তোমার তিন পুত্র কেমন আছে পুত্রবতী ?
‘তাও জানো দেখছি ! আর কি কি জানেন স্যার ?
‘ইচ্ছে থাকলে আরো অনেক কিছুই জানা সম্ভব, মিসেস নুরুজ্জামান।
‘হইছে ! এবার নিজের কথা বলো। তোমার বাচ্চাকাচ্চা কয়টা ? আছে কেমন তারা। তুমি যে চাঁদপুরে বড় নেতা হইছো-এটা জানি।’
‘ওয়েল ! আমাদের এক কন্যা-ঋভু। বয়স এগারো। ক্লাশ ফোর।’
‘বউ-বাচ্চা নিয়ে আসো এদিন। বেড়িয়ে যাও।’
এরপর আর কথা এগোয় না সেদিন। কারণ, শিরতাজের স্বামী নুরুজ্জামান ততক্ষণে বাসায় চলে আসে।
বহুদিন পর মনটা ভোরের রোদে হেসে উঠল যেন- এরকম মনে হয় শিরতাজের- ফোনে শফিকুলের সঙ্গে কথা বলার পর। মন যে কখনো ভোরের রোদের মতো ঝলমল করে ওঠে, সম্ভবত এ ব্যাপরটাই ভুলে গিয়েছিল সে। তার স্বামী মোহম্মদ নুরুজ্জামান কখনো শিরতাজের মনটা খুলে দেখার চেষ্টা করেননি। সে তো শুধু শরীরের কর্তা-মন তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয় না।
মোহাম্মদ নুরুজ্জমান কোনও কাজেই দীর্ঘইদন টিকে থাকতে পারে না। ফলে সংসারে যাকে বলে স্বাচ্ছন্দ-তা আসেনি এতো বছর পরও। বড় ছেলে রাতুল টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার্স–এ সেকেন্ড ইয়ারে। ছোট দুটি– রিফাত আর রানাও স্কুল ছাড়ি ছাড়ি করছে। হু হু করে সংসারের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে অভাব দূর হচ্ছে না। প্রাচীন ভাঙ্গা বাড়িটা টাকার অভাবে মেরামত করা হচ্ছে না। কুকুরের লেজের মতো অভাবটা শিরতাজের আঁচলে আটকে আছে।
শিরতাজ চোখ বুঁজলে স্পষ্ট মনে করতে পারে, শফিকুল তাকে এই বয়সে ঘরের করে ছেড়েছে। প্রথম প্রথম একটা সুক্ষ্ম নৈতিকতা, স্বামী ও বাচ্চাদের প্রতি সততা-দায়বোধের প্রশ্ন করোটির ভেতর উঁকিঝুঁকি মারলেও বেশিদূর শিকড় গাড়তে না পেরে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
আসলে শফিকুল শিরতাজকে ঐশ্বর্যের সন্ধান দিয়েছে। পুনঃপুনঃ দুঃখতাড়িত শিরতাজমহল চিচিনফাঁক– এ উঁকি মেরে দেখে– ঝলমলে জীবন। আর জীবন তো একটাই। শফিকুল পলিটিক্স করে শেষ পর্যন্ত বড় নেতা হয়নি; বড় নেতা হওয়ার মতো নৈতিক শক্তি তার কম ছিল, সে ভোগে বিশ্বাসী, ফলে হয়েছে পাঁতিনেতা। পলিটিক্যাল লিডারদের ক্ষমতার পা চেটে নিজেকে টাকা-পয়সায় ঘুচিয়ে নিতে পেরেছে। এ্যাডফার্ম দিয়েছে একটা। পত্রিকা অফিসের সম্পাদকদের সঙ্গে কোলাকুলি সম্পর্ক। আবার উন্নয়ন-মাতাল এনজিওদের সঙ্গেও ভালো যোগাযোগ। মাইক্রোক্রেডিট আর পরিবেশ উদ্ধারে দেশে-বিদেশে নানা ধান্ধা, কনফারেন্স করে বেড়ায়।
সম্প্রতি বেইজিং প্লাস সম্মেলন থেকে ফিরে শফিকুল ফোন করে শিরতাজমহলকে।
‘কবে দেখা হচ্ছে ? তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে।’
প্রথমত বাইরে বেরোতে শিরতাজের আপত্তি শেষাবধি নিমরাজিতে গড়ায়। তেবে কোথায় বেরোনো যায়, এটা একটা বড় প্রশ্ন। একই প্রশ্ন শফিকুলেরও। তার রাজনৈতিক পরিচয় থাকার কারণে ইচ্ছে থাকলেও যেখানে সেখানে দেখা করা বিশেষতঃ নারীদের সঙ্গে বিড়ম্বনা বৈ কি।
এরকমই একটা ধূ ধূ সময়ে শিরতাজের ঘরে মন বসে না। কাজে মন বসে না। মন কেমন কেমন করে-সময় যেন নষ্ট দেয়াল ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো স্থির হয়ে আছে।
নড়ে না চড়ে না। নুরুজ্জামান সারাক্ষণ বাইরে বাইরে থাকে। তার সেঙ্গে এটা সেটা নিয়ে আজকাল ঝগড়াও করে যায়। তখন শিরতাজের ইচ্ছে করে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে। ছেলেগুলোও স্কুল কলেজ আর বন্ধুদের আড্ডায় চলে যায়। তখন খুব একা একা লাগে তার। সে কি আবার কবিতা লিখবে-ভাবে মনে মনে শিরতাজমহল। খাতা কলম নিয়ে বসেও মাঝে মাঝে; নাঃ ! কবিতা আর আসে না। কবিতা তাকে ছেড়ে গেছে।
সময় কাটানোর জন্য প্রতিবেশী ফরাশ আলীর কিন্ডারগার্টেনে ক্লাশ নিতে থাকে সে। টাকা পয়সা নেই, কিন্তু সময় কাটানোর জন্য এর চেয়ে ভাল কোনো উপায় নেই। স্রেফ সময় কাটানো। মোহাম্মদ নুরুজ্জামান তেমন আপত্তিও করে না অবশ্য।
ফরাশ আলীর স্কুলে সহকর্মী মুরাদ, সুলেখা, কঙ্কন-এদের সঙ্গে ভাব হয়। সময় বেশ ভাল কেটে যায়। ১১টার মধ্যে সব ক্লাশ শেষ। স্কুল ফাঁকা। ঘর সামলায় নসুর মা। ছুটা মেয়ে রোখসানা তো আছেই।
একদিন ফরাশ আলীকে একজন গেস্ট আসবে- একথা বলে স্কুলের চাবি রেখে দেয় শিরতাজমহল। আর ফোনে জানিয়ে দেয় বুভুক্ষু শফিকুলকে। বুয়াকে বলে দেয় পরে এসে চাবি নিয়ে যেতে।
প্রথম দেখায়, উভয়ে উভয়কে ফোনে যতটা চেনার কথা, তার চেয়ে বেশি অচেনা বোধ হওয়ায় লজ্জিত হয়। শিরতাজ একটি রক্তগোলাপ এনেছিল শফিকুলের জন্য।ব্যাগ থেকে সেই রক্তগোলাপ বের করে দ্বিধাগ্রস্থ শফিকুলকে দেয় শিরতাজ।
শফিক বিশাল গোঁফ রেখেছে। পেটখানি বেরিয়ে এসেছে নাভির নিচ দিয়ে। প্যান্টের বেল্ট দিয়ে টাইট করে বাঁধলেও ভূড়ি আটকানো যাচ্ছে না। তার বড় বড় চোখ যেন রাতজাগা রক্তজবা। সম্ভবতঃ শফিকুল মদ্য পান করে।
শফিকুলও কিছুটা শঙ্কিত হয়ে ওঠে। শিরতাজও যে সেই কলেজ পড়ুয়া বালিকা-কিশোরীটি নেই- এটা চকিতেই বুঝলেও কিছুক্ষণ পরই টের পাওয়া যয় সময় এখন ফেলে আসা এক অতীতেরই নাম।
‘কি কবিতা লেখো ?’ জিজ্ঞেস করে শফিকুল।
‘না ! তবে এখন থেকে আবার লিখব।’
‘লিখো। আমি ছাপিয়ে দেব। এ লাইনে আমার অনেক জানাশোনা আছে।’
‘আচ্ছা। সহসা যেন অকূল দরিয়ায় তীর খুঁজে পায় শিরতাজ।’
শিরতাজের এ ধরনের আকুলতা প্রকাশিত হওয়ার পর, র্যাপিং পেপারে মোড়ানো একটি প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে শফিকুল বলে, ‘তোমার জন্য। বেইজিং থেকে এনেছি।’
সঙ্গে সঙ্গে প্যাকেটের ভাঁজ খুলে দেখে শিরতাজ। সুতোর মতো চিকন সোনালি ফ্রেমের চশমা। সোনালি কলম। হাতে নেয়ার পর সোনালি রঙ-এর নরম আলো-আঁধারিতে ঝিলিক দিয়ে ওঠে উপহার বস্তুগুলো। অসম্ভব সুন্দর, স্বচ্ছ। ভীষণ আপ্লুত হয়ে ওঠে শিরতাজ। সে লক্ষ্য করে- শফিকুলের চোখ কেমন কুকুর ছানার মতো ক্ষুধার্ত। সে যেন কুঁত কুঁত করছে।
আমি যাকে বিয়ে করেছি তার সঙ্গে সুখি হইনি শিরতাজ। হয়তো সেও হয়নি। যতোই বলো, শরীরকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। মেয়ে হওয়ার কিছুকাল পর ফাহমিদার ভ্যাজাইনাতে ক্যান্সার ধরা পড়ে। ছত্রাকের মতো সেই ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়বে বলে ডাক্তাররা জরায়ূ ছেঁচে কেটে নিয়েছে। মেয়েও বের করতে হয়েছে পেট কেটে, কারণ, সমস্যাটা নাকি আগেই ছিল। ভাবতে পারো একবার… জানো, ফাহমিদার জন্য কষ্ট হয়। কিন্তু আমি আর পারছি না। আবেগরুদ্ধ শফিকুল এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলে তারপর থামে।
এসময় শিরতাজ শফিকুলের জন্য একধরনের মায়া অনুভব করে। তার মনে হয়, এইখানে, এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষেরই রয়েছে বিচিত্র সব সমস্যা। এখানে কেউ সুখি না।
কিন্তু এতোকাল পর, শফিকুলের সঙ্গে এই ধরনের যোগাযোগ অস্বভাবিক। এই সোনালি ফ্রেমের চশমা-কলম যেন জারুল ফুলের মতো কবিতার পুনরাবির্ভাব-হাতছানি, পত্রিকায় সাহিত্য পাতায় জ্বলজ্বলে নিজের নামের যাদু-শিরতাজমহলকে কিছুটা ব্যাকুল করে তোলে।
পরেরবার, শফিকুল কলকাতার ধর্মতলা নিউমার্কেট থেকে শিরতাজকে কাশ্মিরী শাল এনে দেয়।
ইদানিং রাত ১১টার পর, কখনও বা, ২টার সময়ও তাদের ফোন সচল হয়ে ওঠে। তখন নুরুজ্জামান নাক ডেকে ঘুমায়। তার কঠিন ডায়াবেটিস। খুব ভোরে উঠে ৬ কিলো হেঁটে এসে নাস্তা খায়। আর রাতে নাক ডেকে ঘুমায়। তখন শিরতাজ টেবিলে খাতা কলম নিয়ে কবিতানুশীলন করে।
বিষয়টা নসুর মার কাছে স্বস্তিদায়ক নয়। মাইয়া মানুষ হচ্ছে বজ্জাতের জাত নিজে মেয়ে হয়ে নসুর মা আজকাল এমনটাই ভাবে আর তসবিহর গোটা টপাটপ করে গোণে।
এরই মধ্যে এক শুক্রবারের ‘দৈনিক নতুন সকালে’র সাহিত্য পাতায় ‘সোনালি চশমা’ শিরোনামে কবিতা ছাপা হয়ে যায়। এটা শফিকুলেরই কান্ড। সে-ই ফোন করে বলে, ‘তোমার কবিতা দেখলাম ! ভালোই তো লেখো এখনও।’
সেই লেখা দেখে শিরতাজের ছোট ছেলে রানা সবচেয়ে খুশি হেয়। সে-ও স্কুলের খাতায় কয়েকদিন যাবৎ ছড়া লিখে ভরিয়ে দিতে থাকে। এভাবে নিজের স্ত্রীর রচনা পত্রিকায় দেখতে পেয়ে নুরুজ্জামানও, একে ওকে ফোন করে বলে–
‘আপনার ভাবির লেখাটা দেইখ্যেন !’ কাউকে কাউকে আবার কাটিংও ফটোকপি পাঠায়।
এসময় শিরতাজমহল প্রায় কাব্যপ্রতিভা প্রকাশের জন্য উন্মাদ হয়ে ওঠে। সে হঠাৎ খুবই অনুভূতিপ্রবণ হয়ে ওঠে। সে বুঝতে পারে, শফিকুল অসুখি এক পুরুষ হলেও করিৎকর্মা।
সেদিন ফোনে শফিকুল শিরতাজকে বলে তোমার ঠোঁটজোড়া আজও গোলাপের পাপড়ির মতো নরম স্নিগ্ধ আর সুন্দর।
‘পলিটিক্স করতেছো না ? দেখো ওভাবে বলো না। আমার স্বামী সন্তান আছে।’
‘অবশ্যই তোমার স্বামী সংসার থাকবে ! কিন্তু যেহেতু যোগাযোগ হলো সেটি আরো একটু গাঢ় হতে দোষ কি শিরু! আমার কন্যাটিও তোমাকে দিলাম। বুঝতেই পারছো ফাহমিদার দিন ফুরিয়ে এসেছে। শফিকুল তার ক্যান্সারাক্রান্ত স্ত্রীর আসন্ন বিদায়ের কাল কল্পনা করে অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।
‘এভাবে ভেঙ্গে পড়লে চলে ? সে ভাল হয়ে যাবে। সে বেঁচে থাকুক। তুমি আবার বিয়ে কর। এমন কি হয় না, হতে পারে না।’
‘না ঐ কাজটি আর করছি না। এই বয়সে সেটা শোভনও মনে করছি না। ইচ্ছেও করে না। তুমি একটু হৃদয়বান হলে আপাতত বেঁচে যেতে পারি।’
‘তোমার বিশ্বাস কি? তুমি রাজনীতিবিদ।’
‘এর সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক কি ?’
‘দেখো ইচ্ছে করলেই হুটহাট কোনও কিছু করা যায় না।’
এরকম কথাবার্তার ভেতরে ভেতরে শিরতাজ বেশ উত্তপ্ত আর বাহিরে লালাভ হয়ে ওঠে। নুরুজ্জামান এভাবে কথা বলে না কোনও দিনও। একটা নিরেট পাথরের সঙ্গে জীবনটা শেষ হয়ে গেল। ছেলেগুলোও বাপের মতোই উড়নচণ্ডী হবে বলেই শিরতাজের ধারণা। এখনই বেশ বেয়াড়া হয়ে উঠেছে। নির্বোধ নুরুজ্জামান নিয়েছে শরীর। এরা তিনজনও একে একে শরীরটাই চুষে চুষে শেষ করে এখন পাড়া বেড়ায়। নিজের এককালের দুগ্ধবতী বুকটাকে এক মৃত নদী বলে বোধ হতে থাকে। শুকনো বালুচর। শিরতাজকে একটি বারের জন্য, একটি দিন, একটি রাতও এরা দেয়নি কবিতা লেখার জন্য।
আর নুরুজ্জামান আজ পর্যন্ত একটা মনের মতো শপিং করে দেয়নি। নিয়েও যায়নি। ঈদে উৎসবে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যায়নি। ঘরের ভেতর আবদ্ধ পাখির মতো ডানা ঝাপটিয়ে কেটে গেল এতোগুলো দিন-রাত্রি-মাস-বছর। সব ষড়যন্ত্র।
একটা হতাশাজনিত বিদ্রোহ দানা বাঁধতে থাকে শিরতাজের বুকের ভেতর। ফলে এই সময় স্বনির্মিত যুক্তির ধার তাকে শাণিত করে; সে মনে মনে ঘরছাড়া নারীর অবয়বে নিজেকে কল্পনা করে একটা প্রশান্তি অনুভব করে। শফিকুল তাকে এক সম্পূর্ণ নতুন জগৎ নির্মাণে প্রায় হাত ধরে টেনে বাহির করে। নবতর মুক্তির আনন্দ অনুভব করে শিরতাজ বালিকাবেলায় দেখা বাবুই পাখির বাসায় দোল খায় যেনো।
শফিকুলের স্ত্রী কলকাতায় নাকি ভেলোরে সর্বশেষ কেমোথেরাপি নিয়ে এসে মায়ের বাসায়, ধানন্ডিতে। ফাহমিদার মুখের দিকে তাকানো যায় না। শরীরের সমস্ত রঙ চুষে নিয়েছে ক্যান্সার, কেমোথেরাপি। মাথার চুল সব ঝরে গেছে, যেন এক জীবন্ত কঙ্কাল। এ দৃশ্য সত্যিই দেখা যায় না, সহ্য করা যায় না। তবু শফিকুল প্রতিদিন একবার যায়। মাঝে মাঝে ল্যাবএইডে নিয়ে যেতে হয়। কাজের মহিলাও আছে ফাহমিদাকে দেখার জন্য। তাদের কন্যা ঋভুও রয়েছে মায়ের সঙ্গে। নানাবাড়িতে নানা-নানি, মামাতো ভাই-বোনদের সঙ্গে এনজয় করছে সে। মায়ের আসন্ন সময়টা সে হয়তো ঠিক অনুভব করে উঠতে পারছে না।
ঝুমঝুমপুরে, শফিকুলের বাড়ি এখন ফাঁকা। ছুটা কাজের লোক জরুরি এটা সেটা করে দিয়ে যায়। মাঝে মাঝে ফাহমিদা তার মার বাড়ি থেকে শ্বাশুড়ির রান্নাকরা খাবারও পাঠিয়ে দেয়।
শফিক যখন ধানমন্ডি যায়, ফাহমিদা কিছু বলে না। কোটরে দেবে যাওয়া চোখে তাকিয়ে থাকে, কখনও বা ইশারায় বসতে বলে। তার মুখখানি আসন্ন মৃত্যুর ভারে ক্লান্ত-অবসন্ন আর প্রশ্নহীন।
এমতাবস্থায় শফিকুলের শক্ত না হয়ে তো উপায় থাকে না।
শিরতাজমহল এখন এই বিধ্বস্ত বিকেলে নিজেকে খুবই নিঃসঙ্গ অনুভব করে। সে কি তার একূল-ওকূল সবই হারাতে যাচ্ছে !
সুযোগ পেলেই শফিকুল আজকাল শিরততাজকে তার ঝুমঝুমপুরের বাড়িতে ডেকে আনে।
প্রথম শরীর ধরাধরি হয়েছিল ফরাশ আলীর কিন্ডারগার্টেনে। স্কুল ছুটির পর কেউ ছিল না। শফিকুল এসেছিল। আগেই এ ব্যাপারে কথা হয়েছিল দুজনের মধ্যে।
‘তোমার শরীরে কলার থোড়ের গন্ধ। খুব মিষ্টি লাগছে।’
‘একদিনও তোমার ফাহমিদাকে দেখাবে না ? বলেছিল শিরতাজমহল।’
‘না। তোমার কাছে সে কিছু না। তাকে দেখতে চেয়ো না, প্লিজ। তাছাড়া জানো তো সে খুবই অসুস্থ’– একথা বলে শফিকুল আলতো করে শিরতাজের শরীরের খুব নিকটে চলে এসেছিল। তার চোখে আগুন লকলক করে উঠলে শিরতাজমহলের করোটির ভেতর একটি সম্পূর্ণ নতুন কবিতার লাইন ছলকে ওঠে।
সেই আত্মসমর্পনের পর, এখন প্রায়ই পরস্পর মিলিত হয়। বরং শফিকুলের তুলনায় শিরতাজ-ই দুঃসাহসী হয়ে ওঠে। একদিন শিরতাজ তার কিন্ডারগার্টেনের সহকর্মী মুরাদের রুমের চাবি নেয়। মুরাদ থাকে ফ্ল্যাটে কয়েকজন ব্যাচেলরের সঙ্গে থাকে। সে শিরতাজমহলকে মুখের উপর না করতে পারে না। কিন্তু পরস্পর মিলিত হবার পর, যখন ওরা বেরুবে, তখন, শিরতাজের নজরে আসে, বেচারা মুরাদের বিছানার চাদরটি, তারা, বেকুপের মতো ক্লেদাক্ত করে রেখে যাচ্ছে ! তারপর কিছুদিন শিরতাজ প্রায় তার ছেলের সমবয়সী মুরাদের চোখের দিকে তাকাতে পারেনি।
শফিকুল শিরতাজকে সোস্যাল ওয়ার্ক করার পরামর্শ দেয়। কয়েকটি সেবাধর্মী সংগঠনের ঠিকানাও দেয়।বিভিন্ন সেমিনারের কার্ড পাঠিয়ে দেয় অংশগ্রহণের করার জন্য।
চিরবঞ্চিত শিরতাজমহল ভাবে, মন্দ কি ! প্রায় কিছু না করে বসে থাকার চেয়ে পত্রিকায় কবিতা লেখা বা সোস্যাল ওয়ার্ক করা-খারাপ কি, ভালোই তো। অনেকের সঙ্গেই আলাপ-জানাশোনা হচ্ছে। নিজেকে তুলে ধরার, প্রকাশ করার একটা ভালো উপায়ও বের হয়েছে। এতে বাড়ির কাজেরও যে খুব একটাক্ষতি হচ্ছে তাও না।
শিরতাজমহল এক ধরনের মুক্তির স্বাদ অনুভব করে শরতের কাশফুল হয়ে ওঠে। এ ধরনের প্রাপ্তি তার চিন্তার বাইরে ছিল এতকাল।
শিরতাজমহল সেজেগুজে শফিকুলের দেয়া সোনালি ফ্রেমের চশমাটা চোখে লাগিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে সোস্যালওয়ার্ক করে বেড়ায়। এভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে প্রায়ই রাত করে বাড়ি ফেরে সে। মাঝে মাঝে ছোট ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে যায়। হাতের লাঠি-হেল্পিং হ্যন্ড। এতে মোহাম্মদ নুরুজ্জামনের চোখকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা সহজতর হয়।
ব্যাপারটা মাঝে মাঝে না দেখার ভান করে শিরতাজের স্বামী নুরুজ্জামান। তবে শিরতাজমহল তার স্বামীকে বলেছে, একটা এনজিওর সঙ্গে তার ভালো যোগাযোগ হয়েছে। সেখান থেকে নুরুজ্জামানকে তার ঠিকাদারি ব্যবসার জন্য দু’লক্ষ টাকা ঋণ এনে দেবে সে। কথাবার্তা চলছে। সেই টাকা প্রাপ্তিতে শফিকুলের সহযোগিতা দরকার, কারণ, তার হাত অনেক লম্বা-এটা সে নুরুজ্জামানকে বোঝাতে পেরেছে।
শফিকুল যে চাঁদপুরের লোক-এটা ভালো করেই জানেন নুরুজ্জামান। দীর্ঘ কাল আগে যোগাযোগও ছিল। এখন নেই। শফিক ভালো অবস্থায় আছে-এটা জানেন তিনিও। এখন নতুন করে শোনেন নিজের স্ত্রীর কাছে থেকে। পার্টির বড় নেতার পাশে শফিকুলের ছবিও যে দেখেনি তা নয়। দেখেছেন। ইদানিং শিরতাজও পেপারকাটিং দেখায়।
এনজিও থেকে পাওয়া দুই লক্ষ টাকা পেয়ে নুরুজ্জামান নতুন ঠিকাদারির ধান্ধায় সুসং দূর্গাপুর চলে গেলেন। এবার নাকি চুনাপাথর সাপ্লাইয়ের কাজ। লাভজনক হবে-এই আশা তার বুকে। বড় ছেলে রাতুল অবসর থাকায় তাকেও কাজে শেখানোর জন্য সুসং-এ নিয়ে জান তিনি।
এ অবস্থায় শিরতাজের বাড়িও কিছুটা ফাঁকা হওয়ার ফুরসৎ পায়। সকালে ছোট দুই ছেলে রাতুল-রানা স্কুলে যায়; ফেরে পাঁচটা-ছটায়। নসুর মা বসে থাকেন তসবিহর মালা নিয়ে তার অন্ধকারাচ্ছন্ন কুঠরিতে।
বাড়িটা উদাস, ফাঁকা, ক্ষুধার্ত।
এরকম একটা চৌম্বক প্রেক্ষিত রচিত হওয়ার পর, শিরতাজমহলের বাসায় খানিকক্ষণের আতিথ্য গ্রহণ করা শফিকুলের পক্ষে অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠা দুষ্কর নয়। বরং সে প্রায়ই আসা-যাওয়া করতে থাকে। এই ঘনিষ্ঠতার ভবিতব্য সম্পর্কে শিরতাজমহল সম্পূর্ণ নিরুদ্বিগ্ন হতে পারে না। ফলে সে কিছুটা শঙ্কাতাড়িত হলেও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
ছোট দুই ছেলের কাছে একদিন প্রায় ধরা পড়েই গিয়েছিল শিরতাজ। ‘ইনি তোমাদের আংকল’– এই বলে পরিচয় করিয়ে দিয়ে রক্ষা পাওয়ার দুর্বল চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু নসুর মার চোখ তো চিলের চোখ। শফিকুলেরও যে বুক ধক্ করে ওঠেনি তা নয়। মুখে চোখে পাপ বোধের অবিমিশ্র একটা প্রলেপ লাগিয়ে বাড়ি যায় সে। শিরতাজের ছেলেদের কাছে এই নতুন আঙ্কেলের আগমন বালকসুলভ বিস্ময়ে ভরা। কেমন কেমন যেন মনে হয় তাদের!
শফিকুল ওদেরকে যা খুশি সেভাবে খরচ করার জন্য পাচশ করে টাকা দেয়। চকচকে নোট এই বয়সের বালকেরা বড়ই আমোদে গ্রহণ করে। শফিক বলে,‘ তোমরা একদিন এসো আমাদের বাড়ি !’
ওরা বলে, ‘আচ্ছা আঙ্কেল !’
ছেলেরা মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে টের পায়, মা কার সঙ্গে যেন টেলিফোনে লংটাইম গল্প করে। সে গল্পে নূপুরের ঝুনঝুন বাজনা আছে।
বাবা বাড়ি না থাকলে মা অনেক রাত করে বাড়ি ফেরেন। প্রায়ই। এতে ওদের মন খারাপ হয়। রাতের খাবার সাজিয়ে দিতে দিতে বৃদ্ধ নসুর মা-ও বিড়বিড় করতে থাকেন।
মায়ের চোখে সোনালি ফ্রেমের চমশাটা বাবা কিনে দেননি– এটা এখন বুঝতে পারে তারা-রিফাত, রানা। ওই চশমা পরে মা যখন বাইরে বেরোন বা বাসায়, তখন মাকে নিজের মা মনে হয় না তাদের। খুবই পর পর মনে হয়। আর খুবই অচেনা।
ঝুমঝুমপুর দোয়েলচত্বরে ঘুরতে ঘুরতে শফিকুল একদিন ঠাট্টা করে বলে, ‘চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি !’
সেই সময়ে, পড়ন্ত বিকেলের অধরা সময়ে প্রস্তাবটি বাস্তবতাবর্জিত মনে হলেও শিরতাজমহল এর সম্ভাবনা ক্ষতিয়ে দেখে নিজের অন্তরে।
কিছুদিন আগে, সাংসারিক কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে নুরুজ্জামান রক্তচক্ষু রাগের অনুকূল এক চড় দিয়ে বসে শিরতাজের গোলাপি কুমকুম-মাখা গালে। ফলে, শিরতাজের পক্ষ থেকেও প্রতিশোধের একটা যুক্তিসিদ্ধ ক্ষেত্র নির্মিত হয়। পরে অবশ্য সেই সমূহ সম্ভাবনা নিজেই বাতিল করে দেয় শিরতাজমহল। কারণ, এখানে, শফিককে বিয়ে করার কোনও আলাদা কিছু খেুঁজে পায় না সে। সে তো যেভাবে চায়, সেভাবেই পায় শফিকুলকে।
উপরে ওঠার একটা নিরাপদ সিঁড়ি হয়ে আবির্ভূত নায়ক। সুতরাং এই সমাজে, যেখানে স্বামী সংসার তিন ছেলে আছে, সেখানে এর চেয়ে বেশি চাওয়া একটু বাড়াবাড়ি যে হবেই- এটা অনুধাবন করে শিরতাজ মিইয়ে যায়।
শিরতাজ কাব্যচর্চা, সোস্যালওয়ার্ক্, মহিলা সমিতি, শফিকুল ইত্যাদি করার ফাঁকে টের পায়, ছেলেরা, তার স্বামী, নসুর মা-ও তাকে আজকাল আড়চোখে আড়াল থেকে নতুন করে দেখে। অবশ্য এরা কেউই তার অন্তর্গত ক্ষরণ দেখবে না।
বাইরে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। ডাইনিং টেবিল থেকে পুনরায় ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে এসে দাঁড়াতে গিয়ে শরীরের দুর্বলতা টের পায় শিরতাজ। মাথা ব্যথা করে ওঠে। তবু দাঁড়ায় সে। সোনালি ফ্রেমের চশমাটা চোখে পরে। সাজায়। নিজের প্রতিবিম্ব তাকে নিজের কাছে ভীষণ অচেনা করে তোলে– সে বাস্তবিক নিজেকে চিনতে পারে না। তার শরীর এবং একই সঙ্গে মনটাও কাঁপতে শুরু করে। শিরতাজের মনে হতে থাকে,তার এক পা সংসারে,আরেক পা শফিকুলের বুকের ওপর। কবিতা ও কদর্যতা একই সঙ্গে যথাক্রমে অন্তর-বাহির দগ্ধ করে, কুরে কুরে খায় যেন বা। ফলে আসন্ন সমুদ্রে তার দুই নৌকা দুলে উঠছে। ভালোবাসা কি অন্যায় ?
– শিরতাজের আত্মজিজ্ঞাসার এই নিরীহ প্রশ্নের উত্তর ঐ আয়নার প্রতিবিম্বটি দিতে পারে না; তবে সোনালি চশমাটার ফ্রেমে একটা নিরেট ঝিলিক উসকে দেয়।
রেদওয়ান খান : কবি ও কথাকার।
গল্পটি কম্পোজ করা ও সম্পাদনার পরও কিছু বানান ভুল রয়ে গিয়েছে।
পাঠক ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।
গল্প পড়ুন। মতামত দিন। পুবাকাশ আরও সমৃদ্ধ হোক।