ইন্দ্রজাল ।। মাহিনুর আক্তার।। পুবাকাশ
অনেক সুযোগ খুজঁলো শরিফ মিয়া কিন্তু সীমাবদ্ধতা আর সামাজিক অবস্থান যে হিমালয় সমান বাধা নিয়ে চল্লিশ বছরে যোজন যোজন দূরত্ব তৈরি করেছে। তা পার হবার শক্তি কোথায় অফিসের দারোয়ানের। ম্যাডাম বের হলেন ঠিক তিনটায় এবং আবার তার দিকে তাকিয়েই গাড়িতে উঠে গেলেন। সে দৌড়ে গাড়ির কাছে যাচ্ছিল বলে পি.এ সাহেব তাকে ঝাঁপটে ধরলো। আর পি.এর হাতের উপরই সে ঢলে পড়ে গেল। অনেকক্ষণ পানি দেওয়ার পর সবাই যখন তার কী অসুস্থতা জানতে চাইলো তখন থেকেই সে নীরব। সামান্য একটা বাক্য বলতে না পারার দুঃখ তার জীবনকে নিঃশেষ করে দিল।
“বুইড়া অফিস থাইক্যা আইসা ঝিম মাইরা রইছে।কথাও কয় না, গানও গায় না। ব্যাপারটা কি? ৩০ বছর বিয়া হইছে কম ঝড় ঝাপটাতো যায় নাই মাথার উপর দিয়া কিন্তু বুড়া কোন দিনতো এমন করে নাই”— করিমন ঘরের কাজ করে আর মনে মনে বলে।
হাতের কাজগুলো সেরে করিমন ভাত খেতে ডাকে শরিফ মিয়াকে। উদাস চোখে জানালায় তাকিয়ে শুয়ে থাকে শরিফ মিয়া। উঠার শক্তি ও তার নেই, যেন জীবনী শক্তি ফুরিয়েছে। অফিসের বড় সাব তারে জানে ফুৃর্তিবাজ মানুষ হিসেবে। সব সময় গান করা মানুষটাকে অফিসের ছোট বড় সবাই হাসতে দেখলেও আজ চোখে জল নিয়ে বিছানায় পড়ে আছে। না, কেউ তাকে অপমান করেনি আর দারোয়ানের চাকরি করে শরিফ মিয়া তাই অপমান হজম করাটা তার ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছিল।
বার কয়েক ডেকে কোন সাড়া না পেয়ে করিমনও চুপ করে ভাতের থালা ঢেকে রেখে অবাক হয়ে ঘরের বাইরে গিয়ে বসে থাকে। ১৫ বছরে বউ হয়ে আসে মানুষটার কাছে। শুরুতেই বুঝে যায় এই মানুষটা অন্যরকম। তার বাপ-চাচা, দুলাভাই বা আশেপাশের ঘরের লোকদের মতো নয়। করিমন দেখে লোকটা শরীর নয়, মন খুজেঁ শুধু— একটু পাগলা ধরনের। এদিকে ঘরে শরিফ মিয়ার মনে চলে উথাল-পাতাল তুফান। “সিডরে যে ঝড় আইছিলো তা যেমনে লন্ডভন্ড করছিল গেরামডারে তেমনি লন্ডভন্ড হইলাম রে আমি, কেমনে বাচুম” — বার বার বিড়বিড় করে সে।
গত দুই মাস ধরে অফিসের ভিতরে কী একটা গন্ডগোল চলছিল যা দারোয়ান হলেও শরিফ মিয়ার কানে আসে। দশদিন পরে ঢাকা থেকে বড়ো টিম আসার খবরে অফিসের কাগজপত্রসহ চেয়ার-টেবিল আর দরজা জানালা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা চলছিল। সরকারি অফিসটা ছিল ময়লার ডিপো আর ঘঁসে মেজে তা হয়ে গেলো নববধূর মতো। কিন্তু এর সাথে যে এতো বড় আজাব তার বুকে নেমে আসবে তা কখনোই ভাবেনি শরিফ মিয়া। একটু আশা তার বুকের কোণায় লুকিয়ে ছিল, ভুমিকম্পে তা ধ্বসে পড়লো, আর বজ্রাহত তালগাছ হলো সে।
কম না চল্লিশটা বছর আগে যে হারিয়ে গিয়েছিল একদিন আজ তাকে দেখলো আর একটু কথাও বলতে পারলো না। পঁচাত্তর সালে কলোনির স্কুলটায় থ্রিতে পড়তো তারা— ছেলে-মেয়েরা একসঙ্গে খেলে দিন কাটতো আর স্কুলের পেছনের পাহাড়টা চষে বেড়াতো । কীভাবে যেন শিউলি নামের মেয়েটি তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু হয়ে গেলো। চশমা পড়া নীরব মেয়েটা শুধু তার হাত ধরেই ঘুরে বেড়াতো। বড় রাস্তার ধারের দোতালা বাড়িটায় থাকতো শিউলি। ওর সঙ্গে বাসায় গিয়ে রবীন্দ্রসংগীত শুনেছে সে, আর এ গানের ভক্ত হয়ে গেছে। দেখেছে পরিবারের সবাই সুন্দর করে ধীরে ধীরে শান্ত ভাষায় কথা বলে যেন এরা অন্য জগতের মানুষ। বাড়িতে তার বাবা বা পাশের ঘরে কোন ভাড়াটিয়া কাকা এমন মধুর সুরে কথা বলে না। তাদের পাশাপাশি ঘরগুলোতে শুধু মারামারি লেগে থাকে। খুব ভালো লাগতো শরিফ মিয়ার শিউলিদের বাসায়। গান শুনে শুনে সে খেত চানাচুর, বিস্কুট। তার ময়লা কাপড়ের জন্য মাঝে মাঝে লজ্জিত হলেও বাসার কেউ তাকে কিছু বলতো না, বরঞ্চ শিউলির মা তাকে আদর করতো। কিন্তু ক্লাস ফোরের শেষে হঠাৎ পূজার বন্ধের পরে দেখে ক্লাসে শিউলি নেই। স্কুল ছুটির পর দৌড়াতে দৌড়াতে ও বাড়ি গিয়ে দেখে ওরা কেউ বাসায় নেই। অন্য মানুষ নতুন ভাবে সাজিয়েছে সংসার আর কেউ তাকে বাসায় ঢুকতেও দিলো না। মোড়ের দোকানদার তাকে জানালো আগের সরকারি চাকরি করা অফিসারের বদলির পর নতুন অফিসার এসেছে। কোথায় বদলি হয়ে গেল তা দোকানদার জানে না। শুরু হলো ছোট্ট ছেলেটির জীবনের কষ্টকর কালো অধ্যায় — একটানা একমাস জ্বর। মন পুড়েছে জ্বরে আর অচেনা কষ্টে কেটেছে দিন-রাত। শেষে বাবাও চিন্তিত হয়ে তাকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিল। কিন্তু জায়গা বদলালেও শিউলির চিন্তা তাকে ছাড়লো না। কাউকে কখনো তার মনের কষ্ট বলতে পারে নি। কিন্তু ধীরে ধীরে স্বভাব বদলে গেল আর হাসি গেল চিরতরে মুছে। গ্রামের স্কুলের বেঞ্চে বসে শুধু মাষ্টারদের দিকে তাকিয়ে থাকতো। স্কুলে কেউ তার বন্ধু হলো না আর এভাবেই এস. এস. সি. কোন মতে পাশ করে আবার শহরে বাবা-মার কাছে ফিরে এলো। আর লেখাপড়া হলো না তার কারণ মনের মাঝে পড়ার কোনো আগ্রহই খুঁজে পেলো না। আসলে সব আগ্রহই তার শিউলির সঙ্গে চলে যায় শুধু কোথাও কখনো রবীন্দ্রসংগীত শুনলেই মনে একটু শান্তি পেত। বাপ মরে যাওয়ার পরেও মা যতোদিন বেঁচেছিল ছেলেকে ভুতে- জ্বীনে ধরেছিল পাহাড়ে, বলে কাদঁতো সব সময়।
আরো বছর কয়েক পরে যখন শরিফ মিয়া পচিঁশ বছরের যুবক তখন “অনন্ত প্রেম” সিনেমাটি নতুন বউরে নিয়ে হলে গিয়ে দেখেছিল। রাজ্জাক আর ববিতার হাত ধরে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরাঘুরি দেখে সে বুঝলো শিউলি এবং তার সম্পর্কটাকে। তার অসুখটা যে বিরহ বেদনা ছিল তা বুঝেও মনে মনে হাসলো আর ভাবলো শিউলিরও নিশ্চয়ই এমন হয়েছে। করিমনের বাপ তাকে একটা টেপ- রেকর্ডার দিলে বাজার থেকে ৪/৫টা রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্যাসেট কিনে রাতে-দিনে বাজাতো আর শিউলির গন্ধে বুক ভরে নিশ্বাস নিতো। তার পাগলামী দেখে বউ হাসাহাসি করতো। এ চাকরিটা পাবার পর দিন ভালোই কাটতেছিল আর মেয়ে তিনটারেও মাশাআল্লাহ বিয়ে দিতে কোন ঝামেলা হয় নি। এখন বুড়া বয়সে ঝিম মেরে রবীন্দ্রসংগীত শুনেই সময় কাটাতে পারে।
অফিসে আজ সকালে বড় স্যারের পি. এ. সাহেব একটা বড় ব্যানার নিয়ে এসে গেইটে লাগাতে লাগলো লোক নিয়ে। শরিফ মিয়ার চোখ আটকে গেল ব্যানারে নামের দিকে চোখ পড়তেই। ফারহানা ইসলাম শিউলি নামটা তার মাথায় ঢুকে গেল আর সারা শরীর ঝিমঝিম করতে লাগলো।
পিএ সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলো- স্যার,এই ম্যাডামের নাম শিউলি? আপনি কি তারে চিনেন?
অবাক হয়ে পি.এ সাহেব বললো ‘তোমার মাথা খারাপ, আমি আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবর আমারে জিগাও’। যাও মিয়া তাড়াতাড়ি কাম করো। আজ আর কারোর রক্ষা নাই। এ ম্যাডাম নাকি অনেক কড়া। যেখানেই ইন্সপেক্শনে গেছে সেখানেই ২/ ৪ জনের চাকরি গেছে’।
শরিফ মিয়া নিরাশ হয়ে টুলে বসে বরাবরের মতোই তার শিউলির সাথে মনে মনে কথা বলতে শুরু করে। শরিফ মিয়া বলে,“ ও শিউলি- আজ তোমার লগে দেখা হইবো। আমি জানতাম মরার আগে তোমারে নিশ্চয়ই দেখুম। তুমি কি আমার কথা ভাইব্যা কাটাইছো জীবন”।
বিরহী প্রেমিকের মতো আজ আর শরিফ মিয়ার ভাবনা কোন বাঁধ মানে না। নানা কল্পনায় শিউলির সাথে সে এলোমেলো কথা বলে।
দুপুরের দিকে ৪/৫টা গাড়ি এসে থামে শরিফ মিয়ার সামনেই। ফুল আর মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে লাইনে অফিসের সবাই। গাড়ি খুলে খুলে নামছে অনেক মানুষ। ক্যামেরাম্যানদের ছুটাছুটিতেই সবার শেষে নামলো বড়ো ম্যাডাম, গলায় পড়লো অনেক মালা। দূরে দাঁড়িয়ে শরিফ মিয়া দেখলো তার শিউলিই- সেই মুখ, চশমাসহ নীরব চেহারা। খোদার কী কুদরত! নেমেই তাকালো তার দিকে আর চোখ কুচকে গেল তার। পরক্ষণেই নীরবে হেঁটে বড় সাহেবের সাথে অফিসে ঢুকে গেল। শরিফ মিয়া নিশ্চিত হলো যে তাকে চিনেছে শিউলি। কারণ শিউলির সব চাহনিই তার চেনা। তিন ঘন্টা সময় ম্যাডাম থাকবেন এবং কোন খাবারই তিনি খাবেন না একথা অফিসে ঘোষিত হলে সবাই আরো তটস্থ হয়ে উঠলো। শরিফ মিয়া বার বার খোদারে মনে মনে মিনতি করতে লাগলো “ তুমি শুধু আমারে একটা কথা জিগাইবার সুযোগ দিও। হে কি এখনো আমার কথা ভাবে?”
আর কিছুই চায় না শরিফ মিয়া। জীবনতো পার করেই দিছে। কষ্ট সয়ে সয়ে এই বিরহী মন এখন ফরহাদ, মজনুর মতো ধুঁকছে। শুধু মন অবুঝের মতো চাইতো তারে একবার দেখতে। যদি পারতো ছোট বেলায় ফিরে যেতে আর তার হাত ধরে পাহাড়ে ঘুরতে। টুলে বসে কল্পনায় সে প্রেমের সরোবরে ডুবতে থাকে আর অফিসে চলে ম্যাডামের ফাইল উল্টানো ও কাঁটা-ছেঁড়া বিশ্লেষণ।
অনেক সুযোগ খুজঁলো শরিফ মিয়া কিন্তুু সীমাবদ্ধতা আর সামাজিক অবস্থান যে হিমালয় সমান বাধা নিয়ে চল্লিশ বছরে যোজন যোজন দূরত্ব তৈরি করেছে। তা পার হবার শক্তি কোথায় অফিসের দারোয়ানের। ম্যাডাম বের হলেন ঠিক তিনটায় এবং আবার তার দিকে তাকিয়েই গাড়িতে উঠে গেলেন। সে দৌড়ে গাড়ির কাছে যাচ্ছিল বলে পি.এ সাহেব তাকে ঝাঁপটে ধরলো। আর পি.এর হাতের উপরই সে ঢলে পড়ে গেল। অনেকক্ষণ পানি দেওয়ার পর সবাই যখন তার কী অসুস্থতা জানতে চাইলো তখন থেকেই সে নীরব। সামান্য একটা বাক্য বলতে না পারার দুঃখ তার জীবনকে নিঃশেষ করে দিল। কোনমতে বাড়ি ফিরে তাই বিছানাতে পড়ে আছে।
সন্ধ্যা হলে পাশের বাসা ঘুরে করিমন ফের ঘরে ঢুকে আর লাইট জ্বালায়। অনেকবার ডাকে শরিফ মিয়াকে কিন্তু কোন শব্দ না পেয়ে গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা দেয় সে দেখে শরীর বরফের মতো ঠান্ডা, একটু একটু কাঁপছে আর শরিফ মিয়া বিড় বিড় করছে। হতভম্ব হয়ে করিমন মেয়ে জামাইকে ফোন দেয় ডাক্তার নিয়ে আসতে। শরিফ মিয়া অনেক কষ্টে চোখ মেলে তাকায় আর দেখে শিউলি দাঁড়িয়ে সকালের শাড়ীটায়। বলে-“ জানতাম তুমি আসবা। আমার ডাক বৃথা যাইবো না। কিছু না শুধু বলতে চাই- তোমারে আর রবীন্দ্রসংগীতরে আমি ভালেবাসি”।
করিমন বারে বারে বলে,“ কী কন? কিছুইতো বুঝি না। শরীরে কোথায় খারাপ লাগতাছে কন দেহি”।
শরিফ মিয়ারতো করিমনের কথা শোনার সময় এখন নেই। সে আছে ছোটবেলার শিউলির সাথে, সেই অদ্ভূত মাদকতায় চশমা পড়া নীরব মেয়েটির হাত ধরে ঘুরছে পাহাড়ে পাহাড়ে।
ডাক্তার এসে প্রেশার দেখে বলে, “ এ রোগীকে এতক্ষণ ঘরে রেখেছেন। দুপুরে সে স্ট্রোক করেছিল এখন তো যায় যায় অবস্থা। দ্রুত হাসপাতালে নেন”। করিমন আর মেয়েজামাই মিলে অর্ধ-অচেতন শরিফ মিয়াকে টেনে সি, এন. জিতে তুলে রওয়ানা দেয় মেডিকেলের দিকে।
মাহিনুর আক্তার: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা, ফেনী ক্যাডেট কলেজ।