বই আলোচনা


নূরবানু’ কাহন।। খুকু আহমেদ।। পুবাকাশ


কবি ঝিনুক জোবাইদার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘নুূরবানু’। নামকরণ ‘নূরবানু’ হলেও আমার কাছে ঐ নামের সর্বশেষ গল্পটিকে প্রধান গল্প মনে হয়নি। তারচেয়ে শক্তিশালী গল্পও আছে বইটিতে। হয়তো বৈচিত্র আনার জন্যই এই নাম বেছে নেয়া হয়েছে।

প্রচ্ছদের রং এবং বিষয়বস্তু সামঞ্জস্যপূর্ণ। একজন নারীর মুখের একপাশ, সাথে ইনসেটে একজন মরদ। শিল্পী: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য।

বইটি প্রকাশ করেছে নন্দিতা প্রকাশ [ দাদার আত্মার প্রতি সম্মান জানাচ্ছি]।

এতে আটটি গল্প স্থান পেয়েছে। সূচীপত্র অনুযায়ী যথাক্রমে ১. রেবু ২. মনুর মা ৩. কাশেমের বউ ৪. কেন এই নিঃসঙ্গতা ৫. রাজিয়া ৬. সে আমার পত্রমিতা ৭. ডাকে না দেয়া চিঠি ৮. নূরবানু।


নামকরণে নারী থাকলেও দু’টো গল্পের [সে আমার পত্রমিতা এবং ডাকে না দেয়া চিঠি] প্রধান চরিত্র পুরুষ। বাকি ছ’টি গল্পে অর্ধ শিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত নারীরা তাদের শহুরে জীবন, গ্রামের জীবন, পয়সাওয়ালা, গরীব- এসব সমাজের পটভূমিতে স্থান পেয়েছে। গল্পকারের ভাষায় এরা, ” কখনো হেরে যাওয়া, কখনো জিতে যাওয়া” নারী।


‘রেবু’ গল্পের প্রধান চরিত্র সুন্দরী, শিক্ষিতা, দু’ছেলের মা। বাবা-মা “ডাক্তার পাত্র, দেখতে শুনতে মন্দ না” ভেবেই মেয়েকে তার কাছে বিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর মেয়ের তিরিশ বছরের সংসার চলেছে এভাবে “পাশের বাসার লোকজন কান খাড়া করে থাকবে, চড় থাপ্পড়ের শব্দ শোনার জন্য। ছোট ছেলের রুম থেকে গোঙানো কান্নার শব্দ হবে। প্রতিদিন আমি আরো একটু বেশী করে মরমে মরে যাবো। ডাক্তার সাহেবের মাথা এবং হৃদয় থেকে দূর হবে না কখনো বংশানুক্রমিক বিকৃতির অস্তিত্ত্ব।”

‘মনুর মা’ গ্রামের দরিদ্র পরিবারের বাল্যবিবাহের শিকার। মা মারা যাবার পর বাবা আরেকটি বিয়ে করার জন্যে আট বছরের শিশুকে তার বয়সী একজন পুরুষের হাতে তুলে দেয়। স্বামী মারা গেলে সারাজীবন ধরে দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করা মনুর মায়ের মৃত্যু ভাবনা গল্পটির বিষয়বস্তু।

‘কাশেমের বউ’ গল্পটি একজন দোজবর কর্তৃক নির্যাতিতা একজন নারীকে নিয়ে লেখা। লেখক সরকারি অফিসের পিয়ন কাশেমের বউয়ের জীবনযাত্রা বর্ণনা করেছেন এই গল্পে। খাগড়াছড়ির প্রাকৃতিক বর্ণনা মাঝে মাঝে বেশ আকর্ষণীয় আবহের জন্ম দিয়েছে গল্পটিতে। ” ঝিঁঝি ডাকে তারস্বরে,সন্ধ্যা পোকারা গান ছাড়ে। ডাকে তক্ষক। মাঝেমাঝে শিয়ালের ডাকও। বাংলোর টিনের চালে টুপটুপ ঝরে শরতের শিশির। আশেপাশের কোয়ার্টার গুলো থেকে ভেসে আসে নানা শব্দ। কেউ পড়ছে, কেউ প্রার্থণা করছে। দূরের প্যাগোডা থেকে ভেসে আসে বৌদ্ধ পুরোহিতের প্রার্থনা সঙ্গীত। কুকুর ডাকেদূরে দূরে। ”

‘কেন এই নিঃসঙ্গতা’ গল্পে একজন অল্পশিক্ষিত নারীর নিঃসঙ্গ এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনের হতাশা ফুটে উঠেছে। ” বন্ধুরা কি সুন্দর লেখাপড়া শেষ করে নিজের জীবন উপভোগ করছে। নিজের বাবামার উপর খুব রাগ হয়। অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দায় পূরণ করেছেন।”


‘রাজিয়া’ গল্পটিও অফিসের নিম্নশ্রেণীর কর্মচারীদের নিয়ে লেখা। দুটি চরিত্র রাজিয়া এবং অজিত, একজন মুসলমান, আরেকজন হিন্দু। দুজনের ঝগড়ার বর্ণনা বেশ উপভোগ করার মতো। রাঙামাটির প্রাকৃতিক বর্ণনাও বেশ আকর্ষণীয়। ” দূরে বরগাঁ পাহাড়ের রঙ চা টা দারুন,”শিলার ডাক “পাহাড়ি ঝর্ণাটা তুমুল অস্থির , অসম্ভব সাহসী। নীল জলে সাঁতার কাটা হাঁসটা, গহীন বনের ভিতরে তেরচা হয়ে পড়া আলোটা আমাকে চাঁদগ্রস্ত করে তুলে।” গল্পের শেষে চমক লাগে যখন রাজিয়া বলে,
“আমার পুতের নাম – অজিত”। আমার কাছে এই গল্পটিই বইয়ের প্রধান গল্প মনে হয়েছে।


‘সে আমার পত্রমিতা’ গল্পটি একজন পুরুষের মুখে তার ছাত্রজীবনের পত্রমিতাকে নিয়ে বলা কাহিনি। পত্রমিতাকে হারিয়ে বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করেও [‘হিমাচল’ না ‘হিমালয়’?] ভদ্রলোক সুখী হতে পারেননি। “হেরে যাওয়ার ত্রিশবছর পূর্তি করি আমি ও মিলি। যেন দু’ভাগ হয়ে যাওয়া একটা নদী, শুধু বয়ে চলা। কোথায় যাবে, কেন যাবে না জেনেই।”

‘ডাকে না দেয়া চিঠি’ গল্পের চরিত্রও একজন হতাশাগ্রস্থ প্রেমিক পুরুষের। অনেক চাওয়ার প্রাক্তন সহপাঠীকে [যে এখন বিবাহিতা ] ফেসবুকে পেয়ে তাকে লেখা প্রেমের চিঠিটি লিখেছেন একাকীত্বে ভোগা চল্লিশোত্তর একজন পুরুষ। ” যখন ইচ্ছে তখন প্রেম এসে হানা দেয়। মনের কার্নিশে এসে বসে পড়ে, কুহু কুহু ডাকে, যখন ইচ্ছে তখন।”

‘ নূরবানু’ গল্পের ” লম্বা-চওড়া শরীর, শ্রীহীন অবয়ব” এর অভাগিনী নারী নূরবানু। ‘সরকারি অফিসের বেসরকারি’ পিয়নের চাকরি করে পেটের দায় মেটাচ্ছিল। সাদত এসে স্বপ্ন দেখালে সেও স্বপ্ন দেখল, সংসার, প্রেম, বাচ্চা-কাচ্চার।
সাত মাসের অবয়বহীন রক্তের দলা প্রসব করার পর সাদত অন্য নারীর সাথে ঘর বাঁধে, বাচ্চার বাবা হয়। একদিন বৌ বাচ্চা নিয়ে নূরবানুর বাসায় বেড়াতে এসেছে।
সাদত তাকে বলে, নূরবানু, “তুই হিজড়া”।

কবি ঝিনুক জোবাইদার কবিতার সাথে পরিচিত হয়েছি খুব বেশি দেরি হয়নি। তাঁর কাব্যপ্রতিভারও আমি একজন গুণমুগ্ধ। ‘নূরবানু’র বইয়ের প্রথম তিনটি গল্প দু’হাজার ঊনিশ সালে লেখা। সুতরাং তিনি হুট করে গল্প লিখতে বসেননি, আগে থেকে চেষ্টা ছিল।

প্রথম গল্পগ্রন্থ হিসাবে ‘নূরবানু’ মোটামুটি উতরে গেছে বলা যায়। লেখক ঝিনুক জোবাইদার কবিমনের কল্পনা বর্ণনাগুলো অনবদ্য করে তুলেছে। এদিক সেদিক কিছু বানান বিভ্রাট, মুদ্রণ প্রমাদ রয়ে গেলেও গ্রন্থটি পাঠকের সন্তুষ্টি লাভ করতে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ্বাস।

ঝিনুক’র জন্য ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা।


খুকু আহমেদ: কবি ও প্রাবন্ধিক। আমেরিকা প্রবাসী।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন