ড. মুঈন উদ-দীন ও জ্ঞানচর্চা।। মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত।। পুবাকাশ
ড. মুঈন উদ-দীন ইসলামের যে পরিকাঠামো বর্ণনা করেছেন তা সমাজ ভিত্তিক, রাষ্ট্র ভিত্তিক নয়। এই পাঠ তিনি কুরআন থেকেই আহরণ করেছেন। ব্যক্তি মানুষের বিবেকী আত্মার স্ফূরণ ও জাগরণের ভিত্তিতে তিনি যে পরিবার, সমাজ, লো প্রোফাইল রাষ্ট্র ও অধিরাষ্ট্রের রূপকল্প উপস্থাপন করেছেন তা এক বিশ্বমানের সমাজ ও রাষ্ট্র চিন্তা। তার এই চিন্তাকে মূর্ত করে সমাজ ও সভ্যতার পুনর্গঠন খুবই সম্ভব।
তার আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হল তার ইসলাম ও কুরআন-ভাষ্যে আপনি আল গাজালী, ইবনে তাইমিয়া এবং শাহ ওয়ালী আল্লাহ’র যুগপৎ চিহ্ন ও ছায়াপাত দেখতে পাবেন। বিবেকী আত্মার প্রাধিকার ভিত্তিক ভাবনায় রয়েছে গাজালিয়ান চারিত্র। আবার কুরআনের টেক্সট থেকে তিনি যেভাবে তার জ্ঞানীয় সূত্র উত্তোলন করেন সেখানে রয়েছে ইবনে তাইমিয়া ও পরবর্তীকালে তার অনুসারী শাহ ওয়ালী আল্লাহ’র রেখাপাত।
আর সবচাইতে বিরল হল তার কুরআন থেকে আহরিত উলুম আত তাজরিবিয়ার প্রকল্পটি। এই অসাধারণ গবেষণা কর্মের মাধ্যমে তিনি ইসলামের বিজ্ঞান-প্রশ্নের সঙ্গে সনিষ্ঠ হয়েছেন। যা আমাদের দেশের সাধারণ উলামা মাশায়েখদের ক্ষেত্রে খুবই বিরল। এটি করতে গিয়ে তাকে আল খোয়ারেজমি, জাবির ইবনে হাইয়ান, আল বেরুনী, ইবন আল হাইছাম প্রমুখ মুসলিম বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞান-ভাবনা নিয়ে গভীর পঠন-পাঠন ও গবেষণা করতে হয়েছে। কুরআন ভিত্তিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি যা চতুর্মাত্রিক তা অনুসন্ধানের মাধ্যমে অনুধাবন ও উন্মোচন করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে তার কাজের সঙ্গে একমাত্র তুলনীয় হলেন প্রখ্যাত সাইয়েদ হোসেইন নসর, ইসমাইল রাজী আল ফারুকী, সাইয়েদ নাকিব আল আত্তাস এবং জিয়াউদ্দীন সরদার।
বাংলাদেশে আধুনিক সমাজ, রাষ্ট্র ও বিজ্ঞানকে ইসলামের জ্ঞানকান্ড দিয়ে যারা মোকাবেলা করেছেন তাদের মধ্যে মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীমের কাজ যেমন বিপুল তেমনি সবল। মওলানা রহীম এসব কাজ করেছেন এক হাতে এবং তা সত্যি প্রশংসার দাবী রাখে। তিনি যে ইসলাম ও কুরআন ভাষ্য দিয়ে এইসব জ্ঞানতাত্ত্বিক দ্বৈরথ চালিয়েছেন সেখানে ইক্কামতে দ্বীন ভিত্তিক সমগ্রবাদী রাষ্ট্র ও জ্ঞানকাঠামোর প্রভাব রয়েছে।
অন্যদিকে ড. মুঈন উদ-দীন যে ইসলাম ও কুরআন ভাষ্য দিয়ে এইসব মহান বুদ্ধিবৃত্তিক দ্বৈরথে নিযুক্ত হয়েছেন তা আল ফারাবি, আল গাজালি, ইবনে তাইমিয়া, ইবনে খালদুন, শাহ ওয়ালী আল্লাহ প্রমুখ ধ্রুপদী মুসলিম জ্ঞানসাধকদের উত্তরাধিকার। এই কারণে বাংলাদেশে মৌলিক ইসলামীয় চিন্তা ও জ্ঞানচর্চায় ড. মুঈন উদ-দীন অনন্য ও অদ্বিতীয়।
কুরআন, মার্কস এবং মুঈন উদ-দীন
আমরা অনেকেই জানি যে কার্ল মার্কস লন্ডনে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ২০ বছর ধরে নিবিড় পড়াশুনা করেছিলেন। কিন্তু আপনারা কি জানেন যে তিনি ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন রকমের কপি ও তাফসির ১০০ বারের বেশি পড়ার জন্য নিয়েছিলেন? হ্যা, তার পঠন-পাঠনের যে রেকর্ড পাওয়া যায় সেখান থেকে এমন একটা চিত্র পাওয়া যায়।
কার্ল মার্কস জন্মেছিলেন তৎকালীন প্রুশিয়ান সাম্রাজ্যের অধীন পূর্ব জার্মানীর একটি ঐতিহ্যবাহী রেবাইনিকাল অর্থাৎ ইহুদী ধর্মগুরু পুরোহিত পরিবারে। কিন্তু সে সময়ের ইহুদী বিরোধী বৈষম্য ও নিপীড়ন থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে মার্কসের পরিবার লুথারান ক্রিস্টিয়ানিটি কবুল করেছিল। তবুও এই ইহুদী বিদ্বেষ থেকে তিনি রেহাই পাননি। এরপরেও তাকে রেবাইনিকাল খ্রিস্টানের পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছিল। একপর্যায়ে তিনি ফ্রান্সে চলে যেতে বাধ্য হন। সেখানেও তার র্যাডিকাল চিন্তা ও কর্মকান্ডের কারণে তিনি টিকতে পারেননি। পরে ইংল্যান্ডের লন্ডনে থিতু হয়েছিলেন তিনি।
ইহুদী রেবাইনিকাল পারিবারিক ঐতিহ্যের সূত্রে মার্কস এব্রাহামিক এবং মোজেইক বিধান ও নৈতিকতার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন। এই নৈতিকতার ভিত্তিতেই তিনি তার শ্রমের মূল্য তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলেন। শ্রমের এই মূল্য তত্ত্ব প্রস্তাবনা কালেই তিনি এই বিষয়ে কুরআনের অবস্থান ও নির্দেশনা সম্পর্কে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গবেষণা করেছিলেন বলে ড. মুঈন উদ-দীন বরাতে জানতে পারা যায়।
ড. মুঈন উদ-দীন মনে করেন মার্কসের বিখ্যাত শ্রমের মূল্য তত্ত্বে মার্কস কুরআনের নির্দেশনা আংশিকভাবে অনুসরণ করেছেন। অর্থাৎ তিনি শ্রমের মূল্যের উপরে কুরআনে উল্লেখিত পরিশ্রমিকের নিরঙ্কুশ অধিকারের ধারণাটি গ্রহণ করেছেন। কিন্তু শ্রমের দ্বিতীয় মাত্রা হিশেবে কুরআনে যে নিয়্যাতের ধারণা রয়েছে মার্কস সেইদিকে কোনোরূপ তাওয়াজ্জুহ আর দেননি। এখানেই কুরআন থেকে মার্কস ও মার্কসবাদের মৌলিক বিচ্যুতি ঘটেছে বলে ড. মুঈন উদ-দীন মনে করেন। আহ, কি অসাধারণ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা!
তার জীবনশৈলী নিয়ে কয়েকটি নোক্তা:
ড.মুঈন উদ-দীন আহমদ খান ঐতিহ্যের দিক থেকে চট্টগ্রামের এক সমৃদ্ধ সুফি পরিবারে জন্মেছিলেন। কাজেই অলি আউলিয়াদের সিলসিলায় বাহিত আধ্যাত্মিক ঋদ্ধি জন্মগতভাবেই তিনি লাভ করেছিলেন।
তাকে চট্টগ্রামের সুফি সিলসিলায় লালিত এক বরপুত্র বললে কমই বলা হবে। সুফি সিলসিলার এই বরপুত্র পরে আধুনিক উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য কানাডার ম্যাকগিল ও আমেরিকার ইউসি বার্কলে-তে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। বলা যায় পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করে আধুনিক শিক্ষাও জয় করেছিলেন। কিন্তু অবশেষে তিনি ফিরে এলেন জন্মভূমি চট্টগ্রামে। সেখানে তাসাউফের সাধনা ও আধুনিক জ্ঞানচর্চা সমান্তরাল গতিতে চালালেন।
তার জীবনযাপন, পোশাক-আশাক, ভাষা, কথোপকথনের শিশুসুলভ সহজ-সরলতা এসেছিল এই সিদ্দিকী সিলসিলা থেকেই। অনাড়ম্বর ও নিরাভরণ ছিল তার জীবনশৈলী। অতিথি ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তার বৈঠকখানায় লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে অনায়াসে মিশে যেতেন। অথচ পেশাগত জীবনে তিনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রথম ডিজি ছিলেন। দুটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছেন। এসব পদ পদবীর যে সাধারণ লৌকিকতা ও ইমেজ মেকিংয়ের দাবী সেসবের প্রতি তিনি কোনো তোয়াক্কা করতেন বলে মনে হয় না।
তিনি অনেক ধ্রুপদী ভাষা জানতেন। কিন্তু কথাবার্তায় তিনি তার অর্গ্যানিক ভাষাই ব্যবহার করতেন। মান বা প্রমিত ভাষায় কসরৎ করতেন না। আবার বাংলা ভাষা লেখার ক্ষেত্রে তিনি মান বা প্রমিত ভাষাই অনুসরণ করেছেন বলা যায়। তার ইংরেজী ভাষা ও গদ্যে একটা আভিজাত্য ও ধ্রুপদী মাত্রা ছিল। লেখ্য ভাষার শুদ্ধতার দিক থেকেও তিনি খুব যত্নশীল ছিলেন সেটা বোঝা যায়। আমাদের দেশে খুব কম ইতিহাস কিংবা যুক্তিবিজ্ঞান-দর্শনের স্কলার ছিলেন বা আছেন যারা তার মত বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী। তিনি সংস্কৃত এবং পালি ভাষায়ও পারদর্শী ছিলেন বোঝা যায়। বৌদ্ধ ও হিন্দু শাস্ত্রের মৌলিক বিদ্যা ও প্রজ্ঞাও তিনি তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের তাগিদে চর্চা করেছেন বলে মনে হয়। তার লেখায় এসবের রেফারেন্স আছে অনেক।
ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে ঘিরে একটি শিক্ষার্থী ও জ্ঞানার্থীদের বলয় গড়ে উঠেছিল। সেখানে অনেক রথী মহারথী শামিল হয়েছিলেন। যেমন সরদার ফজলুল করিম, রওনক জাহান, ড. কামাল হোসেন থেকে পরবর্তীকালে আহমদ ছফা, সলিমুল্লাহ খান প্রমুখ।
অনেকটা তেমনি অধ্যাপক ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খানকে আবর্তন করে চট্টগ্রামে একটি চিন্তা ও জ্ঞান শাখার উন্মেষ ও বিকাশ লক্ষণীয়। বেশ কিছু তরুণ ও উদীয়মান লেখক এবং চিন্তক সেই বলয়ে জ্ঞানসাধনায় সনিষ্ঠ আছেন বলে আমরা বুঝতে পারি।
মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত: প্রাবন্ধিক ও গবেষক।