কবি কাজী জহিরুল ইসলামের ৫৪ তম জন্মদিনে
একগুচ্ছ কবিতা
মাতৃভূমি
হাঁসেরা ছবি আঁকে দিঘির কালো জলে
কবিতা লেখে পাখি গাছের বল্কলে
আকাশে উড়ে উড়ে কী লেখে চাতকেরা
যে পাখি উড়ে গেল হবে কি ঘরে ফেরা?
কাষ্ঠ-লাঙলের রূপালি ফলা দিয়ে
শ্রেষ্ঠ কবিতাটি কৃষক লেখে রোজ
মাটির খাতা খুলে।
বর্ষা ঋতু এলে মেঘের ঘন কালো
পৃষ্ঠা জুড়ে লেখে শুভ্র বলাকারা
আকাশে দুলে দুলে।
নান্দনিকতার চিত্রকল্পটি এভাবে লেখা হয়
বাংলা ভাষা জুড়ে অনাদিকাল ধরে।
শিখছি প্রতিদিন শিল্পকলা আমি
তোমার সারা দেহ নিত্য পাঠ করে।
তেরো’শ নদী-জল ছুটছে এঁকেবেকে
যে মহাকাব্যটি নদীরা লিখে রাখে
সূর্যসেন আর প্রীতিলতার দেশে,
তুমি কী পড়েছ তা প্রার্থনার সুরে
আবেগে দুলে দুলে গভীর ভালোবেসে?
সূর্য-প্রনামে ঘন্টাধ্বনি বাজে
জোহর, মাগরেবে যে সুর ভেসে আসে
মিনার চূড়ো থেকে
সঙ্গীতের বীজ ওখানে প্রোথিত যে
তুমি কী ভুলে গেছ, শিল্পী হে নতুন?
ঘুঘুরা ডেকে ডেকে
নিরাক দুপুরের মগ্ন নীরবতা
ভাঙছে কোন রাগে কখনো ভেবেছ কী?
তেতুল, আম, কলা, বড়ুই গাছে গাছে
আমড়া, ভূতিজাম, চালতা, আমলকি
উপমা কবিতার ছড়ানো দেখো আছে।
কেওক্রাডং আর শৈলপ্রপাতে
চাকমা বালিকারা পাহাড়ে নেচে নেচে
তৈরি করে রোজ ছন্দ কবিতার
মাধবকুণ্ডতে ঝর্ণাকিশোরী গো
বইছে ছলছল দুলিয়ে অঙ্গ তার
সে-ই তো ছন্দ ও কাব্যালংকার।
মাতৃভূমি তুমি শ্রেষ্ঠ কবিতা হে
তোমার দেহ ঘেঁটে রত্ন করি খোঁজ
চোখের জলে আমি এ-দূর দেশে বসে
তোমাকে লিখি রোজ।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৮ জানুয়ারি ২০২১।
বুকের মধ্যে চোখ
একটি লোকের দেখেছিলাম বুকের মধ্যে চোখ
কপাল ফুঁড়ে যে চোখ গজায় তা ছিল না ওর
বুক দিয়ে ঠাঁয় চেয়ে থেকে দেখতো সব এ-লোক
অন্ধকারে সেই যে গেলো আনবে বলে ভোর,
আর এলো না। এখন তো লোক কপাল দিয়ে দেখে
দেখে এবং বুদ্ধি দিয়ে অঙ্ক মেলায় রাতে
ছেলে-ছোকড়া পাড়ার যতো ওদের দেখেই শেখে
মাথা ভর্তি বুদ্ধি ওদের বিশ্বজয়ের গ্রন্থ-কিতাব হাতে।
কত রকম বিদ্যে ওদের বাড়ি-গাড়ি অট্টালিকা ঢের
মাথায় যে চোখ, হবেই ওদের বিশ্ব পায়ের তলায়
বিশ্বজয়ের মেডেল ওরা পড়ছে রোজই গলায়
বুদ্ধিদীপ্ত চোখেরা আজ নেতৃত্ব দেয় সন্ত্রাস ও দ্বন্দ্বের।
সারাক্ষণই ভাবি শুধু বোকা-সোকা
সেই দুটি চোখ ফিরে পেতাম যদি
যে দুটি চোখ বুকে আঁকা
হু হু করে দু’কূল ভাসায়, ভালোবাসার নদী।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১।
নিরঞ্জনের সঙ্গে দেখা
সিভিএস ফার্মেসির লাইনে দাঁড়িয়ে আছি।
ছয় ফুট দূরে, ঠিক আমার সামনে,
পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি উঁচু এক মানুষ, উন্মুক্ত কপালে, হাতের
উল্টো পিঠে, ময়মনসিংহের কাদা;
দুই চোখে বহমান ব্রহ্মপুত্র।
তবু ওকে আমি চিনতে পারিনি
আমার ছেলেবেলার বন্ধু নিরঞ্জন, এই তো একটু দূরে,
মাত্র ছয় ফুট সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
বেশ ক’বার, হয়ত চেনা চেনা লাগছিল,
নিরঞ্জন আমার চোখের দিকে তাকালো;
কিন্তু ও আমাকে চিনতে পারেনি,
আমিও কী চিনেছি ওকে?
চল্লিশ বছর পর আজ এতো কাছে এসেও
নিরঞ্জন দূরেই থেকে যেত
যদি না হঠাৎ ওর বাঁ দিকের কান থেকে
মুখোশের সুতোটা খসে পড়তো।
নিউ-নরমাল জীবনের মুখোশ আমাদের ক্রমশ অচেনা করে দিচ্ছে।
জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১।
দুই রকম উৎসব
আর বলো না কথা
অন্ধকারে বরং জ্বালো
রাতের অসভ্যতা।
ভাজ খোলা রাত্রিকে
বুকের ওপর বসিয়ে রাখি
আগুন চতুর্দিকে।
অগ্নি গলা মোম
ফোটা ফোটা পড়ছে দেহে
উষ্ণ অনুপম।
বাইরে তুষারপাত
ঘরে আগুন ধিকিধিকি
ঘর্ষণে সংঘাত।
ঝড়ের কী তাণ্ডব
ভেতর এবং বাইরে এখন
দুই রকম উৎসব।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১ ফেব্রুয়ারি ২০২১।
পাতাল রেলগাড়ি
ছুটছে অজগর পাতাল রেলগাড়ি
পেটের গহ্বরে স্বপ্ন ঠাসাঠাসি
ছন্দে দোলে তার মাতাল দেহখানি
বিকট হুইসেলে ভীতির শিহরণ
তুলে সে বলে দেয়
আসছে ছুটে এক ক্ষিপ্ত সন্ত্রাসী।
নানান ঘাটে ঘাটে থেমে সে তুলে নেয়
কত না বর্ণের স্বপ্নৈশ্বর্য
ছুটতে থাকো হে সজোরে ছুটে চলো
তাগিদ দিতে থাকে
গতিটা মন্থর হচ্ছে যদি কারো
পেটের ঢাকনা সে বন্ধ করে দেয়
এমনই নিষ্ঠুর ধৈর্যহীন খুবই।
হুমড়ি খেয়ে খেয়ে উল্টে পড়ে কেউ
কঠিন কংক্রিটে
দূরের হুইসেল ধোঁয়ায় মিশে যায়
কেউবা ধুলো ঝেড়ে দাঁড়ায় উঠে ফের
দুচোখে নগরের স্বপ্ন চমকায়।
শীর্ণ দুর্বল সুস্থ নয় যারা
পেছনে পড়ে থাকে ধুলোর নিচে তারা।
বিকট অজগর ছুটছে এঁকেবেকে
আঁধার গুহা থেকে
হঠাৎ উঠে আসে আলোর পৃথিবীতে
উগড়ে দেয় তার পেটের সঞ্চয়
স্বপ্ন-বন্দরে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৩০ জানুয়ারি ২০২১।
এই শহরের কষ্ট
[কবি মাহবুব হাসানের দেশে ফেরা উপলক্ষে]
এই শহরে কষ্টে আছে ফুল
কষ্টে আছে পাতার হুলুস্থুল।
এই শহরে কষ্টে আছে মেঘ
কষ্টে আছে বাতাসের উদ্বেগ।
কষ্টে আছে পথের হাঁটা, বিকেলের উচ্ছ্বাস
কষ্টে আছে বাংলা ভাষা, গান-কবিতার চাষ।
কষ্টে আছে কাশ্মীরি চা, উষ্ণ সমুচা
কষ্টে আছে অট্টালিকা-সমুদ্র উঁচা
এই শহরে কষ্টে কাঁদে মাঠের দূর্বাঘাস
রাস্তাগুলো কষ্টে মৃত সারি সারি লাশ।
কষ্টে আছে মার্কিনী কাক, সবুজ টিয়াপাখি
টেলিফোনের কষ্টগুলো কোন পকেটে রাখি?
শনিবারের কষ্ট আছে সবুজ ঘাসে ঘাসে
শুভ্র হাঁসের ডানায় চড়ে কষ্টগুলো আসে
কষ্টে আছে সকাল-বিকাল, কষ্টে আছে সন্ধা
কষ্টে এখন পার্কগুলোতে বইছে বাতাস মন্দা
ভেবেছিলাম কষ্টগুলো সামলানো সম্ভবই
এখন দেখি কষ্টে আছে বাংলা ভাষার কবি
এই শহরে কষ্টে আছে কাল বোশেখি ঝড়
কষ্টে আছে সমস্ত শহর।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৭ নভেম্বর ২০২০।
হলুদ রঙ
এই যে তোমরা ছল-চাতুরীর সঙ্গে হলুদের এতো মাখামাখি দেখো, এ অন্যায়।
কোন শয়তান এসে
হেমন্তে বুলায় এতো উজ্জ্বল রঙের তুলি বৃক্ষশাখে?
আমি তো বৃক্ষের আর্তনাদ শুনিনি আজও বায়ান্নটি হেমন্তের রেকর্ড বাজিয়ে।
শুনেছি আনন্দ, জীবনের উদ্দীপ্ত প্রতীক্ষা।
লঙ প্লের নির্জন সকালগুলো হেমন্তের মাঠে স্বর্ণশস্য-সঙ্গীত রোপন করে।
ক্যাসেটের ফিতেয় আটকে থাকা কৈশোরোত্তীর্ণ দুপুরে
যে হলুদ বউ-কথা-কও পাখি ডাকে,
কোন নিষ্ঠুরতা শোনো সেই সুরে?
শেষ বিকেলের আইপ্যাডে শুয়ে
আপস্টেটের পাহাড়ে পাহাড়ে যে হলুদেরা বেজে ওঠে
তাকে তো আলবেয়ার কাম্যু কবেই ঘোষণা করেছেন আরেক বসন্ত।
আগুন কী শুধুই পোড়ায়? সীতাকে করেনি শুদ্ধ?
বুঝি ঝরে পড়েনি হলুদ আগুন ইব্রাহীমের দেহে রাশি রাশি ফুল হয়ে?
সকলেই আমরা মৃত্যুর কাছে হেঁটে যাই,
ওখানে যাবার সবচেয়ে ভালো ও উজ্জ্বল পথ জীবনের কাছে থাকা।
ঝরা-পাতার হলুদ কিংবা আগুনের লেলিহান শিখা দেখে
হলুদকে দিও না মন্দের অপবাদ,
আজ থেকে হলুদ উদ্দীপ্ত জীবনের রঙ।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৪ ডিসেম্বর ২০২০।
বৃক্ষ রমনীরা
কাচের গায়ে ঠোঁট রেখেছে লেবুপাতা
ওপাশে রোদ্দুর
সবুজ ছোঁবে বলে মেঘের জামা খুলে
খুশিতে উদ্বেল।
আবহমান কাল থেকেই জানি আমি
নিম্ফোমেনিয়াক বৃক্ষ রমনীরা
খুশিতে খুলে রাখে নগ্ন দেহখানি
ভোরের রৌদ্রকে চুমুকে খাবে বলে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৩০ জানুয়ারি ২০২১।
আমাকে গাছ ভেবে
দিনের বেলা আমি রাতের কথা লিখি
রাত্রি গাঢ় হলে আলোর খেলা শিখি
আমাকে গাছ ভেবে নারীরা ঢালে শীত
পত্র ঝরে গেলে নগ্ন দেহ জুড়ে বাজায় সঙ্গীত।
ভেবেছি মনে মনে গ্রীষ্মকাল এলে
আমার সারা দেহে গজাবে পত্রালি
ফাটল খুলে আমি দিয়েছি আশ্রয় কাতর পাখিদের
অথচ ওরা আজ
বুকের বল্কলে ঠোঁটের ছুরি হানে
বৈরী প্রকৃতিও নিচ্ছে প্রতিশোধ
গ্রীষ্ম ভরা কালে এখনো পাতা ঝরে
দেহের বল্কলে কালের বলিরেখা।
কুকড়ে আছি শীতে, বাতাস উত্তুরে
হাতের কাছে এসে গ্রীষ্ম ফিরে যায়
থাকে সে দূরে দূরে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৮ জানুয়ারি ২০২১।
সমকালীন বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কবি ও কথাসাহিত্যিক কাজী জহিরুল ইসলামের জন্মদিন ১০ ফেব্রুয়ারি। এ বছর তিনি চুয়ান্নতে পা রাখছেন। এই দিনে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার খাগাতুয়া গ্রামে, মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতার নাম সোফিয়া বেগম, পিতার নাম কাজী মঙ্গল মিয়া। শৈশব, কৈশোর কেটেছে পুরনো ঢাকার টিকাটুলি এলাকায় এবং ঢাকার শহরতলী বাড্ডায়। তিতুমীর কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে ইংল্যান্ডে কিছুকাল পড়াশোনা করেন। ব্র্যাকে কর্ম জীবন শুরু করেন ১৯৯০ সালে, ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক এসাইনমেন্টে কর্মরত। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির সদর দফতরে আয়কর বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন। কাজী জহিরুল ইসলাম এই সময়ের সবচেয়ে সচল কবি। ২০২০ সালে রচিত কবিতাগুলো নিয়ে তৈরি হয়েছে ৫টি গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি। নভেম্বরে ঢাকা থেকে বেরিয়েছে “স্থবির আঁধারে স্বপ্নসম্ভবা বসন্ত”। ঢাকার বইমেলায় আসছে আরো দুটি: ” জন্মান্ধ কৌরব” এবং “ওঁ থেকে উচ্চারিত”। এই ফেব্রুয়ারিতেই কলকাতা থেকে বের হচ্ছে দুটি কবিতার বই: ” পারম্পর্যহীন সম্পর্কসূত্র” এবং “মশলারাজ্য”। এ ছাড়াও তার আত্মজীবনী দ্বিতীয় খণ্ড ” উড়ুপ”, ভ্রমণ রচনা “এইডেলভাইজ” মুক্ত গদ্যের বই “কাচের ঘর” এবং সাক্ষাৎকারের বই “কাজীর কাঠগড়ায় আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু” বের হচ্ছে ঢাকার বই মেলায়। প্রতিনিয়ত তিনি কবিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। তিনিই বাংলা কবিতাকে উপহার দিয়েছেন ক্রিয়াপদহীন কবিতা। বইটি ঢাকা, কলকাতা এবং (উড়িয়া অনুবাদ) উড়িশ্যা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ছড়া, প্রবন্ধ, কলাম, ভ্রমণ রচনা, টিভি নাটক, শিশুসাহিত্য সব ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং ক্রমাগত লিখে চলেছেন। তার পয়মন্ত কলম আরো বেগবান হোক। পুবাকাশ কবির জন্মদিনে একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।