কবি শাহাদাৎ হােসেনের মুহররমের তিনটি কবিতা
কারবালা
দীর্ঘ রাত্রি অবসান
নিশীথের ঘনকৃষ্ণ বােরখা-নেকাব
সরে যায় খুন-রাঙা অরুণের আসন্ন আভাস।
নিখিলের তন্দ্রাতুর নিমীল নয়ন
খুলে যায় খঞ্জর-ঝঝনে।
আতংক-কম্পনে
সপ্রকাশ দিগন্ত প্রান্তর।
এ যে রে মরণ-পন্থে মদীনার যাত্রী-রাহীদল ।
কুফার মঞ্জেল কোথা— কোথা এ প্রান্তর ?
ধূ-ধূ-ধূ-ধূ-বালুস্থান
কার্বালার অন্তহীন অনির্দেশ বিপুল প্রসার,
অরাতির চক্রব্যুহে-ঘেরা
লক্ষ্যহারা কাফেলার মৃত্যুময় সংকটের দুস্তর পাথার।
একান্তে জীবন-ধারা বাহিনী ফোরাত
ঘেরি তারে রচিয়াছে দুর্ভেদ প্রাচীর
দামেস্কের দাগাবাজ দাজ্জালের দল।
অলক্ষ্যে নিয়তি হাসে অট্ট ক্রুর হাসি,
জটাবন্ধে আজরাইল হাঁকে মহামার
খান্দানে-রসূল আজি জেহাদের সেরা শহীদান
তাজা খুনে লাল হবে কার্বালার বালু-বিয়াবান।
দামামার ডামাডােল মৃত্যুর মাতম
খঞ্জরে চিকুর-জ্বালা হানে জঙ্গী রক্ত-মাতােয়াল,
বিষাক্ত শায়কে হানে শক্তিশেল ক্ষিপ্র তীরন্দাজ।
হানাহানি মহামার
রক্তগঙ্গা একাকার
ভলু-তীর অসি-বর্মে মারণ-সংঘাত।
উচ্ছখল কলরােল, হুংকার গর্জন
দিগন্ত-দুনিয়া দোলে শূন্য চৌচির
শাহাদাৎ হােসেনের ইসলামী কবিতা
পাংশুনীল দিনকর।
সিয়া আসমান
অন্ধকার জ্যোতিলোক—আসন্ন প্রলয় ।
বাড়ে বেলা–
দণ্ড পল প্রহরের জ্বলন্ত জ্বালায়।
আকাশের কেন্দ্ৰপীঠে বহ্নি-গােলা ঝলে
জ্যোতিষ্কমণ্ডল পুড়ে শূন্য ছারখার,
নিম্নে বালু-স্ফুলিঙ্গের প্রান্তর-পাথারে
হাবিয়ার অগ্নি-জ্বালা জ্বলে,
বহ্নিান সিমুম-ঝন্ঝায়
মৃত্যুময়ী পিপাসার প্রাণান্ত দাহনে
জবে-করা কবুতর-পারী।
আছাড়িপিছাড়ি লুটে খিমার জিন্দানে
সর্বহারা মদিনার রিক্ত রাহীদল ।।
মাতমের মহারােল।
কণ্ঠে কণ্ঠে আহাজারি করুণার কাতর ক্রন্দন-
পতিহারা সতী কাঁদে, পুত্রহারা মাতা,
কাঁদে শিশু, বৃদ্ধ পিতা,
কারুণ্যের প্রতিচ্ছবি কাঁদে সহােদরা
অশান্ত কান্নার রােলে কেঁদে ওঠে সারা মরুস্তান—
দিগন্ত – জাহান।
সপ্তস্তর আকাশের মূলে।
আল্লার আরশ কাদে
ফেরেশতার চোখে ঝরে কাদনের স্রোতস্বিনী ধারা।
হুংকারি জাগিল শের ক্ষিপ্ত মহাকাল
বিষক্ষতে দুঃসহ জ্বালায়,
রুদ্রকণ্ঠে হাকিল হােসেন
হায়দারে-কারার আলী-মাের্তজার কেশরী-সন্তান!
ব্যোম-পৃথী আতংকে শিহরি।
বলুন্তান কাপে বিয়াবান
দিক্ হস্তী দিগন্তে লুকায়
মহাত্রাস ত্রাহি ত্রাহি রােল
এস্রাফিল বিষাণ ফুকারে
কেয়ামত সম্মুখে ঘনায়।
তরঙ্গ-তুফান-দোলা রক্তের হাম্মামে।
স্নান করি জাগে রুদ্র মদিনার কালান্ত শার্দুল
ছিন্নশির কবন্ধের তুঙ্গ পিরামিডে
দেখা দিল দুলদুল্-বাহনে।
শিরে শুভ্র আমামার তাজ
করে জুলফিকার
শ্বেত অশ্ব—বােররাকের সিংহ-আসােয়ার
জ্বজ্যোতি মধ্যাহ্ন তপন
দেখা দিল কার্বালার উদয়-শিখরে ।
মহামার জাগিল আবার,
দু’ধারী খঞ্জর চলে
দুর্নিবার নাঙ্গা হাতিয়ার।
খণ্ডে খণ্ডে লুটে শির, কবন্ধ লুটায়,
ঝন্ঝাবাতে উন্মুল বিটপী।
খুনের পিচকারি ছােটে রাঙিয়া আকাশ
মুহূর্তে আবির-লাল জ্যোতিষ্ফলা ভাস্কর-মণ্ডল।
প্রাচীর ধ্বসিয়া পড়ে ফোরাতের কূলে,
মুক্তপথ—তুরঙ্গমে ছােটে আসােয়ার।
সম্মুখে জীবন-ধারা যুগান্ত বাহিনী।
নীল স্বচ্ছ দূর-বিসর্পিনী,
নিথর তরঙ্গে বহে কূলে-কূলে-ভরা।
মৃত্যুময়ী পিপাসার দুর্বার জ্বলনে।
মুহূর্তের আত্ম-বিস্মরণ—
গষে শুষিয়া লবে সমগ্র ফোরাত ।
অঞ্জলি ভরিল জলে
আচম্বিতে জেগে ওঠে হারানাে সম্বিৎ
মরণের পূর্ণপাত্র নিঃশেষে করেছে পান
মহাত্রাস ত্রাহি ত্রাহি রােল
এস্রাফিল বিষাণ ফুকারে
কেয়ামত সম্মুখে ঘনায়।
তরঙ্গ-তুফান-দোলা রক্তের হাম্মামে।
স্নান করি জাগে রুদ্র মদিনার কালান্ত শার্দুল
ছিন্নশির কবন্ধের তুঙ্গ পিরামিডে
দেখা দিল দুলদুল্-বাহনে।
শিরে শুভ্র আমামার তাজ
করে জুলফিকার
শ্বেত অশ্ব—বােররাকের সিংহ-আসােয়ার
জ্বজ্যোতি মধ্যাহ্ন তপন
দেখা দিল কার্বালার উদয়-শিখরে ।
মহামার জাগিল আবার,
দু’ধারী খঞ্জর চলে
দুর্নিবার নাঙ্গা হাতিয়ার।
খণ্ডে খণ্ডে লুটে শির, কবন্ধ লুটায়,
ঝন্ঝাবাতে উন্মুল বিটপী।
খুনের পিচকারি ছােটে রাঙিয়া আকাশ
মুহূর্তে আবির-লাল জ্যোতিষ্ফলা ভাস্কর-মণ্ডল।
প্রাচীর ধ্বসিয়া পড়ে ফোরাতের কূলে,
মুক্তপথ—তুরঙ্গমে ছােটে আসােয়ার।
সম্মুখে জীবন-ধারা যুগান্ত বাহিনী।
নীল স্বচ্ছ দূর-বিসর্পিনী,
নিথর তরঙ্গে বহে কূলে-কূলে-ভরা।
মৃত্যুময়ী পিপাসার দুর্বার জ্বলনে।
মুহূর্তের আত্ম-বিস্মরণ—
গষে শুষিয়া লবে সমগ্র ফোরাত ।
অঞ্জলি ভরিল জলে
আচম্বিতে জেগে ওঠে হারানাে সম্বিৎ
মরণের পূর্ণপাত্র নিঃশেষে করেছে পান
শাহাদাৎ হােসেনের ইসলামী কবিতা
শূন্য-ব্যোম-বায়ুস্তরে করুণার আকুল ক্রন্দন
কাঁদে জিন, হুর-পরী কাঁদে মিকাইল
আকাশের অন্তরালে শিঙা-হাতে কাঁদে এস্রাফিল
দিগন্ত জাহান ভরি কান্না-উতরােল
রােনাজারি ভিন্ন হায় ! হায় !
নূরনবী মােস্তফার নয়নের মণি নিভে যায় ।
সে-কান্নার চিরন্তন করুণার রােল
আজিও গুমরি ফিরে নিখিলের শূন্য
বিয়াবানে।
অনন্তের প্রান্তর-পাথারে
বৃথায় খুঁজিয়া মরে মদিনার সিংহ-শহীদেরে !
(কলিকাতা বেতার কেন্দ্রের সৌজন্যে)
‘মাসিক মােহাম্মদী’, মাঘ ১৩৫০, ১৭ : ৪
শহীদে কারবালা
দামামার দমদম্ ভূর্যের বাজনা
থেমে গেছে, স্তব্ধ সে মৃত্যুর সাহানা।
ছায়াময়ী সন্ধ্যা সে নামে ধীরে বিশ্বে।
নিভে যায় আলাে-রেখা আঁধারের দৃশ্যে।
রক্তে নহর বয় কারবালা-বক্ষে
অশ্রুর ধারা ঝরে প্রকৃতির চক্ষে।
সন্ধ্যার আসমান উঠিয়াছে রাঙিয়া
শহীদের খুন যেন দিয়াছে কে ঢালিয়া ।
ও কে বীর ধেয়ে যায় ফোরাতের কূলেতে
উন্মাদ পিপাসায় কর চাপি বুকেতে ?
মণি-দীপ ও যে গাে হজরত বংশের
দুষমনে খেদায়ে করে ধরি শমশের-
ফোরাতের বারি পানে শীতলিতে পরাণী
চলে দ্রুত, ঘৰ্মেতে সিক্ত সে পেশানী ।
ওকি পুন! স্বাদুনীরে অঞ্জলি ভরিয়া
মুখে তুলি পান বিনা দিল যে ও ফেলিয়া।
কূলে উঠি কেন ওই অঙ্গের বসনে
উন্মােচি একে একে ভূতলের শয়নে
ঢালে দেহ বীরবর বীরসাজ ত্যজিয়া
শ্রান্ত কি কেশরী ও পড়িয়াছে ঢলিয়া।
জন্ধুক সংগ্রামে ? হুঙ্কারি নিমেষে
কে রে তুই নির্মম ধেয়ে এলি কি বেশে ?
কি করিস। কি করিস! রে ঘাতক কেমনে
বসিলি রে নির্ভয়ে ও ছাতির আসনে!
কোন প্রাণে নির্মম নূরানি ও অঙ্গে
বসিলি রে উল্লাসে দানবের ভঙ্গে?
ওকি পুন খঞ্জর রক্তের ফিনকি !
মনে নাই রে—ঘাতক হাশরের দিন কি ?
ওই শােন্ ক্রন্দনে বেজে ওঠে দুনিয়া
হায়! হায়! হা হােসেন! আসমান চুনিয়া
খুন ঝরে প্রান্তরে জান্নাত নিঙাড়ি,
কল্লোলে কাঁদে নদী সৈকতে আছাড়ি।
নূরনবী হজরত নিশিদিন যাহারে
চুমিতেন বুকে ধরি, সস্নেহে আদরে,
সেই আজি প্রান্তরে রক্তের শয়নে।
আছে শুয়ে পাণ্ডুর জ্যোতি-লেখা নয়নে।
করিলি কি নির্দয় ! ফুঙ্কারে নিভালি
প্রােজ্জ্বল দীপখানি, ইসলামে ডুবালি ।
কলিকাতা, ১৩২৭
মহরম
রুদ্র দুপর চলে
আফতাব শিরে ঝলে।
চুটে জ্বালা চৌদিকে ইঙ্গিত মৃত্যুর,
কোন্খানে নাহি চিন্ পানি এক বিন্দুর ।
মরু-বালু ঝলকায়।
উন্মনা ছুটে চলে বাতাসের হায় ।
নাই পানি, নাই ছায়া জ্বলজ্বল মরুকায়া
কারবালা প্রান্তর ঝা-ঝাঁ করে চৌদিক
শান্তির রেখা নাই, সান্ত্বনা মৌখিক।
হাহাকার ! হাহাকার !!
আজ বুঝি দুনিয়ায় জাগিয়াছে মহামার ।
লও পানি জান যায় ছাতি চাপি পাঞ্জায়।
কাতরায় পানি বিনে আজি তারা শাহারায়।
‘শরাবন তহুরা’র সাকি যারা আখেরায় ।
মা’র বুকে শুখা তন
মিলে নাকো ফোঁটা দুধ, কাঁদে শিশু আনমন।
কলেজার টুকরা সে সন্তান এক পাশে
জবে-করা কবুতর ছটফটি মরে হায়!
ফাটে শােকে মা’র প্রাণ, ‘দাও পানি ছেলে যায়’
দিল বুকে জনকের
ফিরে এল কোলে শিশু বুকে তীর জহরের।
শত্রুর রণভেরী ফোরাতের সীমা ঘেরি
বাজে ঘন গৌরবে দামামার দম্
ঝঙ্কৃত মুহুর্মুহু অস্ত্রের ঝমঝম ।
আস্ফালি হাঁকে বীর,
কম্পনে অরাতির পরানে না মানে থির।
রক্তে নহর’ বয় কোথা জয়-পরাজয়।
নিষ্ঠুর তাণ্ডবে রুদ্র সে নেচে ঘুরে
খাত্ উনে জান্নাত আসমানে আঁখি ঝুরে!
আল্লার বাধা শের
হুঙ্কার ছাড়ে রােষে, খুন চায় জালেমের।
হা হােসেন অকসাৎ নিদারুণ শেলাঘাত
মূৰ্ছিতা মা-ফাতেমা জান্নাত দরজায়
জুলফিকার ধরে ‘শেরে খােদা পাঞ্জায় ।
আসমানে দুনিয়ায়।
ক্রন্দনে বাজে শুধু হা-হােসেন! হায়! হায়!
এই সেই মহরম সেদিনের সেই গম্।
ভুলেছ কি মুসলিম ? ‘দীন’ তবে ইসলাম,
সত্যের উপাসক তুমি ন্যায়-পয়গাম
মুক্তির পন্থায়—
ছুটে চলাে নাশি এই মিথ্যা ও অন্যায়।
কলিকাতা, ১৩২৭
আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত কবির কবিতা সংকলন থেকে গ্রন্থিত।