মহিবুর রহিম

দোয়েলের গান

যারা করে রাতের সুধা পান, তারা শুধু জানে
সুবহেসাদেক থেকে শুরু হয় দোয়েলের গান।

হে বনি ইনসান, সুখদ শিল্পের কারিগর
পৃথিবী ঘুমায় তবু কেন জেগে থাকে মন?

আলোর উদ্ভাসে ভাসে নয়নের দেহসত্তা
কী নিবিড় নিরবতা, কী সূক্ষতর হৃদয় সঙ্গীত!

অন্তরে বিছায়ে দেয় সবুজ গালিচা
শীত নিদ্রায় জেগে ওঠে ক্ষুধা

শোনো, আলোর অনুষঙ্গী সেই দোয়েলের গান
এখনই ভাসার কাল, এবং পৃথিবী জাগার আগেই

সেই ঐকতানের সাথে মিলাও আত্মাকে
যেখানে মিশে যায় উদ্ভাসী দোয়েলের শিস।

মানুষ নিজেই একটি কবিতা
(বন্ধু অধ্যাপক মিজানুর রহমান স্মরণে)

কোন মহৎ কবিতা এতটা হৃদয়ভেদী নয়
যতটা একজন মানুষ তার অস্তিত্বে জানান দিতে পারে
আমি কোন উপমা বা কোন উৎপ্রেক্ষার কাছে
মানুষের নান্দনিকতা খুঁজে পাই না
আমি চিত্রকল্পের পাতা তন্নতন্ন করে দেখেছি
মানুষের গন্ধ আকর্ষণ বা আবেদনের মতো কোন সারমর্ম নেই
কতদিন পুরাণের ঐতিহ্যে আদি অকৃত্রিমতায় ঘুরেছি
হেঁটেছি বিধ্বস্ত সভ্যতার পথে
ইন্দ্রজাল বিছানো কত কাহিনির পংক্তিতে
মানুষের মতো বিকল্প মানুষ আমি দেখিনি কোথাও
যেমন মিজানের মতো কোন বিকল্প মিজান
ইকবালের মতো কোন বিকল্প ইকবাল
পৃথিবীর কোন দৃশ্য বা সার্থকতায় নেই
তোমরা যারা ক্ষুধা ও প্রেমের জন্যে এতটা উৎগ্রিব ছিলে
কিংবা কোন অলীক স্বপ্ন বপনের তাগাদায়
নিজেকে একটা ক্লান্ত পাখির মতো আকাক্সক্ষার রোদে ঢেকে দিলে
আজ শোনো, সময় যে ঔদার্য তোমাকে দিয়েছিলো
তার প্রতিপাদ্য ছিল একমাত্র মানুষ
সেই সর্ববাদী সংবেদন অহমের আঁচলে ঢেকে চলে গেল দিন
তবু তার গন্ধ আজও উপেক্ষার স্মৃতিতে উড্ডীন।

সত্য

মূর্খতার অন্ধকারে ঢেকে রাখা যায় না সত্যকে
সত্য সব প্রতিবন্ধকতাকে ভেদ করে উঠে আসে
আগুনও তার লোমকে স্পর্শ করতে পারে না

উত্তরমেরু সাইবেরিয়া এন্টার্কটিকা থেকে সে উঠে আসে অনায়াসে
আফ্রিকার খরাকাল পার হয়ে স্মরণীয় ইতিহাসের মতো হাসে
গুয়ানতানামোর মতো ঘৃণ্য বর্বরতা অতিক্রম করে
নির্ভয়ে ডিঙিয়ে যায় কত সভ্যতার মৃত্যুর পাহাড়
কত ভ‚ত খসে পড়ে, মৃত্যু মারণাস্ত্র পায়ের তলায় পিষে যায়
আবার সত্য সেই সূর্যোদয় হয়ে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে
যেন একটা অনিবার্য অভ্যুত্থান হয়ে ফিরে আসে
তখন কোন পরিপূর্ণ মওসুমের মতো মনে হয় তাকে

সে পরোয়া করে না আমেরিকা ইউরোপ চীন ইসরাইল
স্নায়ুযুদ্ধ অস্ত্র প্রতিযোগিতা কাঁটাতার
ট্যারিফ ইমিগ্রেশন কন্সেনট্রেশন
অদম্য সাহসীর মতো সবকিছু সয়ে যায়

এমনই সপ্রতিভ সাহসের নাম সত্য

মানুষের অন্তরে উদ্ভাসিত আশাবাদের মতো
আর পাখিদের ঠোঁটে সমাগত উচ্চারণের মতো
স্নায়ুতন্ত্রে উদ্বেলিত ঢেউগুলোর মতো

যার মুন্ডু কেটেও কোনদিন আলাদা করা যায় না!

লরা ভেগলিয়েরি স্মরণে

রোমের হলুদ বাতাস আর আসন্ন সন্ধ্যার চোখে তখন অশ্রু
অনেকেই তাকে সভ্যতার কান্না বলে মেনে নিতে দ্বিধান্বিত
কিন্তু দুর্দশা পতন সচেতন আত্মার কাছে চিরকালই বিব্রতকর
তাই দুঃখিত লরা তার ঝিনুক খোলসে বিষাদের রঙ ঢেলে
গড়ে তুলেন এক অনিবার্য উত্থানের নীরব প্রাচীর

তখন নিয়ন আলোতে জ্বলে উঠেছিল অদৃশ্য উদ্বেগ
প্রাচীন এই নগরীর রাস্তায়
নৈশব্দের ইমারতে ধ্বসে পড়েছিল কামনার রাত
যেন মানুষের মনে অর্ন্তদাহনের মতো মৃত্যুর মহোৎসব
কোটি কোটি ভ্রুণ মৃত্যু আলোর নিউরণে ঝরে
হয়তো দেখেনা কেউ উপলব্দির সৈকতে ঢেউয়ের গর্জন
নির্জন খোলসে ঢেকে ধেয়ে আসে নৈতিক মৃত্যু
অব্যাহত কোলাহল সাইল্যান্সারে মহাপতনের আগাম গোঙানি
কে প্রশ্ন করবে, কে দেবে উত্তর? এমন অমীমাংসিত সন্ধিক্ষণে
সন্তপ্ত হৃদয়ে আশার আলোতে রক্ত ঢেলে
লেখেন তিনি অনিবার্য সাক্ষ্যদানের মতো
তার প্রতিটি অক্ষর অন্ধকারে জ্যোতির্ময় বাতি হয়ে জ্বলে!

স্বপ্নের অধিক এক উদ্যানে

শৈশবের ঘোর লাগা সবুজ সময়ে
কতবার স্বপ্নে দেখেছি সৌম্যকান্তি রবীন্দ্রনাথকে
আর মানুষ মানুষ শব্দে দিশেহারা চিরদ্রোহী
কবি কাজী নজরুল ইসলামকে
তাহারা আমাকে আশির্বাদের ফুল দিয়েছিল হাতে
সে সব স্বপ্নকে সব সময় স্বপ্ন বলেই মনে হয়েছে

বয়ে যাওয়া নদী আর অরণ্য শস্যের মাঠ
কতোবার স্বপ্নের ডানায় উড়াল দিয়ে পার হয়েছি
কোনদিন তাকে বাস্তব বলে ভাবিনি

কিন্তু ইদানিং আমার স্বপ্নগুলোকে অধিকতর কোন সত্য বলে মনে হয়
যখন বিশাল এক উদ্যানের সবুজ গালিচা হাঁটতে হাঁটতে পার হয়ে যাই
ক্লান্ত হওয়ার আগেই আমার জন্য প্রস্তুত থাকে পরিদের ডানা
বিস্ময়কর সেই নিসর্গের নদী ঝর্ণা আর প্রস্তুতকৃত পাহাড়
দেখতে দেখতে বিমুগ্ধ হয়ে বলি সোবহানাল্লাহ

আমার শোকরিয়ায় সত্তর হাজার হুর গুঞ্জনের মতো প্রতিধ্বনি তোলে
পাখি ফুল পতঙ্গ ভোমরা গান গায় আমাকে ঘিরে
আর অসংখ্য সুরের ঝর্ণা আমার পায়ের কাছে বইতে থাকে
যেন আমি যা কোনদিন দেখিনি তা আমাকে দেখানো হয়
আমি যা কোনদিন শুনিনি তা আমাকে শুনানো হয়
আর আহারের জন্য হাজির করা হয় একটি গ্রহের সব ফল ফলাদি
যার অধিকাংশই নাম না জানা
এসব ফলের গন্ধ এমন যে আহারের আগেই সব তৃপ্তি মিটে যায়!
আমি দেখি পৃথিবীর কোন যুদ্ধ ক্ষতই আর আমার শরীরে থাকে না
মন্দার উদ্বেগ দারিদ্র্যের কষাঘাত আর যত শোকের আঘাত নিমিষেই মুছে যায়!

সে উদ্যানে ঘুরে ফিরে মনে হয় কত কাল পার হয়ে যায়
আমি কোন ক্লান্তি বোধ করি না
সমুদ্র সৈকতগুলো ঘুরে দেখি যেন এ সবই অপার্থিব
ফুলের রেণুর মতো ¯স্নিগ্ধ ঢেউ তীরে তীরে আছড়ে পড়ে
মেঘগুলো উড়ে এসে পঙ্খিরাজ ঘোড়ার মতোন আমাকে উঠিয়ে নেয়
আর সব জ্যোতির্ময় রমণীরা সুখকর সঙ্গী হয়
যাদের চোখের থেকে শৈল্পিক সুন্দর আর কিছুই নেই
তারা নিরব বিছিয়ে দেয় জোছনার মতোন আচ্ছাদন
খুলে দেয় ইন্দ্রিয়জ থেকে অতিন্দ্রিয় সব আকাঙ্ক্ষার ভাজ
আমার আহার রূপে আনা হয় প্রতিশ্রুত মাছের ব্যঞ্জন, দুগ্ধ, সুস্বাদু আনার
এক ঝুরি মেওয়া ফলের শরাবন তহুরা
আমি শুধু জাগতিক অশ্রু ভেজা আনন্দের সাথে বলি আলহামদুলিল্লাহ
আমার শোকর শুনে সমস্বর ধ্বনি তুলে অগণন মালাইকা

আমার উদ্যান লেকে সম্মানিত মেহমান করে আনা হয়
কামিয়াব সকল স্বজন আর ছয় লক্ষ ফিলিস্তিনি শিশুদের
যাদের অনেকে মহান শহিদ আর সকৃতজ্ঞ ধৈর্যশীল বলে খ্যাত
তারা এডেনিক ভাষায় অর্থবোধক কবিতার তিলাওয়াত শোনায়
আর সার্থকতার অজস্র ঝর্ণাধারা বইয়ে দেয়
মেঘ পাখি নদী ফুল সুবাসিত বৃক্ষদল সকলেই আজ সংগঠক
হুর নামে খ্যাত সেই সঙ্গীতময়ী রমণীরা কণ্ঠে তুলে মুগ্ধ করা সুর
যা শেষ হয়ে গেলেও কোনদিন শেষ হয় না!

আমার ইচ্ছার অগ্রে আমাকে নিয়ে যায় অদেখা দৃশ্যের গুলিস্তানে
সেইসব ঝর্ণা পাখি ফুল উদ্ভিদ ও ঘাসেদের কাছে
যাদের সৌন্দর্য সুগন্ধ মর্মমূল ভেদ করে চেতনায় উঠে আসে
যে কল্পনা চিরকাল আমাকে টেনেছে তার সম্মোহন অজানার দিকে
যে অলিক সুখরাজ্য কোনদিন ধরা দেয়নি কারো কাছে
যে সার্থকতার জন্য লড়াই করেছি যুগ-যুগান্ত অবধি
আজ সবই এখানে একান্ত স্বপ্রণোদিত হয়ে দৃষ্টি ¯স্নায়ু ও হাতের নাগালে
সকাল দুপুর রাত এক সাথে জ্যোতির্ময় উপলব্দির গুলবাগে আলো ফেলে

আমার স্বপ্নের বিরতি ঘটে এই নান্দনিক নিসর্গে উদ্যানে ঘুরতে ঘুরতে
অথচ স্বপ্নের শেষে তার সত্যতা শিশির ও সুগন্ধ চেতনায় লেগে থাকে!

স্বীকৃতি

পথের ক্লান্তির অবসরে জুতার সুকতলি পর্যন্ত ছিড়ে যায় তার
আর পায়ে পড়ে আগ্নেয়গিরির মতো দগদগে ব্যর্থতার ফোস্কা
সে শুধু চেয়েছিল তার স্বোপার্জিত কবিতার কিছুটা স্বীকৃতি
যা সে অর্জন করেছিল বিপন্ন মানুষের অন্তিম আকাঙ্ক্ষা থেকে

যার ভাষা বুকচেরা রক্তের মতন উষ্ণ ও আকুলতায় বাঁক ফেরানো
অসংখ্য নিহত নদীর হাহাকার যার প্রতিটি ধ্বনি সম্ভারে
অথচ নতুন সম্ভাবনার চরে জেগে ওঠা শস্যের সুগন্ধে স্নাত

কিন্তু তার স্বীকৃতি তো তিরিশ বছরে কোথাও মেলেনি
পন্ডিতেরা তা শোনার আগেই গিধরের মতো গোদ গোদ করে
উত্তরাধুনিক কবিতা ক্যাফেতে বাসি কদমের গন্ধে টিকে থাকা দায়
অথচ বুঝি না এইসব ভাগাড়ে কী ভাবে তারা এতো বগল বাজায়
আহা, শিখবার বহু আগেই তারা হয়ে যায় অভিজ্ঞ শিক্ষক
গোপনে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে অযোগ্যেরা রাতারাতি স্বীকৃতি বাগায়
আর অন্বেষী কবির কৃতী কর্পোরেট স্রোতে ভেসে যায়

তবু কবি হারানো সত্ত্বার খোঁজে এ শহরে জনপদে তন্ন তন্ন ঘুরে
স্বার্থ দ্বন্দ্বের ক্রসফায়ারে নিহত নদীদের দীর্ঘশ্বাস সযত্ন তুলে আনে
গুম হয়ে যাওয়া সম্ভাবনাগুলোর সন্ধানে অবিরত পথ হাঁটে
মধ্য দুপুরে অবিচল দাঁড়িয়ে থাকে দুঃসহ রোদের রিমান্ডে
নিদ্রাহীন খুঁজে বেড়ায় আমাদের নগর সত্ত্বার সীমাহীন অনুতাপ।

বিনির্মাণ শিল্পের সপক্ষে
(বাচিকশিল্পী মুশতাক খন্দকার ও ক্বণন শিল্পীদের)

কখনো এমন হয় চারপাশে শুদ্ধতম কোন ঢেউ নেই
নগরে আছড়ে পড়ে ব্যধিগ্রস্ত দীর্ঘশ্বাস
বাতাসে সিসার গন্ধ ঘুরে ফিরে অজানা উদ্বেগ
কর্পোরেট নগরীতে দিনের ভিতরে রাত হানা দেয়
একটা গোলক ধাঁধা দবদবে সাদাকেও করে দেয় ম্লান
কেমন নিস্প্রভ হয়ে যায় সব গৌরবের কৃতিত্ব সম্ভার

সবকিছু ঢেকে দিয়ে নামে যেন এক বালিয়ারি
উড়ায় শঙ্কার ধূলো, দীর্ঘ হয় নিঃসঙ্গতার ছায়া
ভূত আর ভবিষ্যত একাকার শুধু নেই বর্তমান!
এমন দুঃসহ দিনে মশালের মতো জ্বলে মানবিক মন
বুক থেকে সহসাই নেমে আসে ক্ষোভ
লোকে যাকে দ্রোহ বলে, বিনির্মাণ শিল্পের সপক্ষে
কবিতা কবিতা বলে আছড়ে পড়ে চেতনার উপকূলে!

মহিবুর রহিম:নব্বইয়ের দশকের অন্যতম কবি।সহযোগী অধ্যাপক,বাংলা বিভাগ,চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন