গল্প
চাওয়ালা
আবু সাঈদ হান্নান
পুবাকাশ
কর্পোরেশনের পুরনো ভবনের সামনের এই লাইনটির বয়স বেশিদিনের না। লাইনের বাসিন্দারা এতোদিন নিম্ন আয়ের হলেও হালে যুক্ত হয়েছে বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ির শার্টপ্যান্ট পরা ভদ্দর সমাজের নাগরিকরাও। ফলে লাইন দিনকে দিন সুদীর্ঘ হচ্ছে। অফিসগামী শিক্ষিত সমাজের লোকেরা কাকডাকা ভোরে লাইন ধরতে না পারলেও তাদের পরিবারের সদস্যরা কর্তার দায়িত্ব কাঁদে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে সে দায়িত্ব পালন করে। কেউ সূর্যোদয়ের আগে খড়িমাটি দিয়ে গোল চিহ্ন করে, কেউ ইট রেখে আবার কেউ ব্যাগ বালতি প্লাস্টিকের খালি বোতল রেখে লাইনের ক্রম ঠিক রাখে। এসব নিয়ে ঝগড়াও হয় হরহামেশা। নিম্নশ্রেণির লোকেরা এসব নিয়ে বাতচিত করে। ভদ্র নারী পুরুষেরা দোপাট্টা কিংবা সস্তা মাস্কে বদন ঢেকে নিরব থাকে।
জামিল চৌধুরী, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চডিগ্রিধারী নাগরিক। স্বাধীনভাবে এবং রুচিমতো চলবেন বলে ভালো মাইনের হাফডজন চাকুরির সুযোগকে সচেতনভাবে না করে দিয়েছেন। শুরু করেছিলেন প্রকাশনা ডিজাইন এবং অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনার ব্যবসা। খায়েস ছিলো এসব পেশাকে রুচিসম্মতভাবে উপস্থাপন এবং শিক্ষিত যুবসম্পদকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তোলার। ভালোই করছিলেন। স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে করে নিয়েছিলেন সম্মাজনক অবস্থান। তার হাত ধরে বহু তরুণ আপন পায়ে দাঁড়িয়ে নিজেরাই এজাতীয় ব্যবসায় স্থান করে নিয়েছ।
দুই হাজার বিশসাল। মানুষের সমাজে হানা দিয়েছে এক ভয়ংকর সভ্যতা বিনাশী মড়ক। বিশের বিষবাষ্প ডালাপালা বিস্তারের ফলে মুখ থুবড়ে পড়েছে অন্যসব পেশার পাশাপাশি মধ্যমমানের সৌখিন এবং মানবসভ্যতার লিখিত স্মারক সংরক্ষক প্রকাশনা ডিজাইন এসব ব্যবসাও। লোকসান গুনতে গুনতে অনেকে বাধ্য হয়ে ব্যবসা গুটিয়ে নেন ।
জামিল চৌধুরী সংকুচিত বেসাতি এবং নিয়ন্ত্রিত জনবলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চললেও মারী পরবর্তী সময়ের ভয়ানক ছোবলে এলোমেলো হয়ে যায় স্বাভাবিক জীবনধারা। অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা চালু রেখে সাটার টেনেছেন সাজানো সৌখিন অফিসের। জলে ফেলে দিয়েছেন সখের সব অফিস আসবাব। মারীকালীন সময়ে নিজের পুরোটা উজাড় করে সেবা করেছেন মানুষের। যে সেবায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে স্ত্রী, পুত্র, স্বামীসহ আপনজনেরা। পুরো সাতাশমাস অহোরাত্র উনিশ ঘন্টা ব্যয় করেছেন মানুষের কল্যাণে। ধার ধারেননি কিংবা নাক কপালে তোলেননি জাতপাতের বালাইয়ে। খাবার বিতরণ, চিকিৎসা দান, মরদেহ দাফন এসব করে কাটিয়েছেন পুরো করোনা সময়। তহবিল যোগাড়, সুষ্ঠু বিতরণ এবং মারী ও মারী পরবর্তী মানসিক বিপদগ্রস্থদের কাউন্সেলিং করেছেন তাদেরকে পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে। এসব করতে করতে সুবিচার করতে পারেননি স্ত্রী-সন্তানের প্রতি। পরিবারের অতি আপন এক সদস্যের অক্সিজেন অপ্রতুলতা এবং চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে মৃত্যু ঘটায় এ পথে প্রাণপণ আত্ননিয়োগে ব্রতী হন জামিল চৌধুরী।
মারীর ছোবল একসময় কমে আসে। পুনরায় সচল হয় জীবনগতির চাকা। বিশ্ববাজার এবং বিশ্বমন্দার দোহাই দিয়ে পাগলা ঘোড়ার মতো লাফিয়ে বাড়ে দ্রব্যমূল্য। নাকানিচুবানি খেতে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ। নাভিশ্বাস উঠে নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির। তারা না পারছে স্মুথ জীবন চালাতে, না পারছে কারো নিকট হাত পাততে। মধ্যবিত্ত জামিল চৌধুরীকেও প্রাত্যহিক হিমশিম সামলাতে দ্বারস্থ হতে হয় কমদামের পণ্য সরবরাহখানায়। বাস্তববাদী, প্রোঅ্যাক্টিভ পুরুষ জামিল চৌধুরী লাইনে দাঁড়িয়ে কমদামে পণ্য সংগ্রহকে কোনভাবেই অসম্মানের কিংবা লজ্জার বিষয় মনে করেন না। হালে তার পাশের ফ্ল্যাটের এবং পরিচিতজনেরাও এ লাইনে যুক্ত হয়েছেন। চণ্ডিপাঠ থেকে চটি সেলাই থিওরীতে বিশ্বাসী জামিল জীবনের পরতে পরতে এভাবেই সফলতা খুঁজেছেন। তবে এ দর্শন আওড়ানোর চেয়ে নিজে করে দেখানোর প্রতিভু হতে সচেষ্ট তিনি।
লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবিথর পণ্য ক্রয়ের চেয়ে ভিশনারী জামিল আলাপচারিতায় খবর নেন আগপিছের ঊনদামে পণ্যপ্রত্যাশীদের। আলাপের ফাঁকে খুঁজে পাওয়া অনেক হতদরিদ্রকে কিনে দেন চাল তেল নুন। সামাজিক মাধ্যম ও নিজের ব্যক্তিত্ব কাজে লাগিয়ে ফান্ড সংগ্রহ করেন এসব মানুষের জন্য। ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানেথ এই প্রবাদ বোধ হয় এজাতীয় মনুষদের সম্মানেই সৃষ্টি হয়েছে।
উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা ছমির আলী। রিকসা চালিয়ে পেট চালান। একা চাঁটগাঁ শহরের ঘুপচি গলিতে দিনাতিপাত করে মাসে মাসে দেশের বাড়িতে বউ বাচ্চার জন্য পাঠাতেন রসদ। কুড়িগ্রামের মঙ্গাক্রান্ত গ্রামের বাড়িতে সোমত্ত হয়ে ওঠছে মেয়েটা। ছেলে দুটো স্কুলে যায়। তাই পিঠের সাথে মিলিয়ে যাওয়া পেট নিয়ে রিকসা বাইকে বাইতে গতরে আর জোর পাননা। দিকাবারি প্রয়োজন মতো দিতে না পারায় কোম্পানি আর তাকে রিকসা দেননা। নিদারুণ অভাবে পতিত ছমির আলী চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন। উপায়ন্তর না দেখে সকাল সকাল টিসিবিথর লাইনে না দাঁড়িয়ে হাত পাতেন দীর্ঘসারির জনতার কাছে। এ পেশায় পূর্বাভিজ্ঞতা না থাকায় লাজুক চোখে ইতস্তত হাত বাড়ান। মাঝে মাঝে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকেন নির্বাক ছলছল নয়নে।
জামিল চৌধুরীর নজর এড়ায় না ছমির আলীর গতিবিধি। একদিন সকালে কাছে ডাকেন ছমির আলীকে। জাতসংগঠক এবং মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ জামিল চোখ দেখেই বুঝে নেন ছমির আলী পেশাদার ভিক্ষুক নন। রাজধানী হোটেলে চা নাস্তা খাইয়ে পুরো হিস্টরি জেনে নেন ছমির আলীর। জানতে চান এখন কী কাজ করতে চান বা কী কাজ করতে পারবেন। ছমির আলীর ইতস্তত জবাব বাবা এহন আর গতরে বল নাই। দেশ গেরামে গিয়েও কিছু করতে পারুম না। তবে ছোট খাটো কোন কাজ বা ব্যবসাপাতি করতে পারতাম যদি, তাইলে দুইটা ভাত খাইতে পারতাম।
তিনপোলের মাথা্য় গোলাম রসুল মার্কেটে ছমির আলীকে নিয়ে যান জামিল চৌধুরী। ষাট কাপ চা ধারণ ক্ষমতার একটি ফ্লাস্ক, কিছু একবার ব্যবহার্য কাপ, চা পাতা, চিনি এবং চৈতন্যগলি থেকে ডজন দুই লেবু কিনে দেন। বলেন কাল সকাল থেকে কর্পোরেশনের সামনে চা বিক্রি করবেন। কষ্ট কম, একসাথে অনেক কাস্টমার পাবেন।
ছমির আলী বাকরুদ্ধ ছলছল চোখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো শশ্রুধারী জামিল চৌধুরীর পবিত্র চেহারার দিকে। কী হলো ধরেন! নেন। নিয়ে বাসায় যান। কাল সকালে গরম পানি নিয়ে চলে আসবেন এবং বিসমিল্লাহ বলে ব্যবসা শুরু করবেন। হঅ বাজান । আল্লাহ আপনের বালা করুক। জামিল চৌধুরীকে পিতৃস্নেহে গায়ে হাত বুলিয়ে ছমির আলী চলে গেলেন।
সকালের সোনা রোদে দিনের প্রথম খাবার খেয়ে না খেয়ে নারী পুরষের দল লাইন ধরে কমদরে টিসিবির চাল ডাল তেল নুন কিনতে।
ছমির আলীর চা ব্যবসা দিনতে দিন প্রসার হচ্ছে। নারী পুরুষেল দল পাঁচ টাকাদরে গরম গরম চা পান করে অপেক্ষা করে টিসিবিথর মালবাহী ট্রাকের। সুখ দুঃখের গল্প আর ছমির আলীর চা লাইনধারীদের অপেক্ষার সময়কে বিনোদনময় করে।
দিনে হাজারখানেক টাকা লাভ হয় প্রতিদিন। ছমির আলীর খই ওঠা চামড়া এখন আর নাই। চুলগুলোও আঁচড়ানো। দেশের বাড়িতে প্রতিরাতে মোবাইল ফোনে কথা বলে। টাকা পাঠায়। আর বলে বহরের মা, আমি একজন ফিরিশিতা পাইছি। সাক্ষাৎ ফিরিশতা। আমার জীবন পাল্টাই দিছে। আল্লায় তার বালা করুক। তোমরা নামাজ পইড়া তেনার বালা চাইবা। মাস তিনেক পরে আমি আইমু। ছমিরনরে এককান বালা ঘর দেইখা বিয়া দিমু।
ছমির আলী চা বেচার ফাঁকে ফাঁকে পুরো লাইনে চোখ বুলায়। আন্দরকিল্লা মসজিদের সিঁড়ি পর্যন্ত ঘুরে আসে। রাজধানী হেটেলের ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করে। রাজাপুকুর লেন এবং রহমতগঞ্জের আশে পাশে প্রতিদিন প্রতিটি মানুষের চেহারা দেখে। খুঁজে ফেরে তার ফিরিশতাকে। কিন্তু খুঁজে পাননা। লজ্জায় সামনা সামনি নামটা পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করেননি। নিজেকে ধিক্কার দেন ক্যান যে লোকটার নাম জানলাম না। ক্যান যে মোবাইল নম্বরটা নিলাম না। তাইলে তো একবার মোবাইল করে কথা বলতে পারতাম।
কদম মোবারক মসজিদে নামাজ শেষে ছমির আলী হাত তোলে আয় অল্লাহ , তুমি তেনার বালা কইরো। এর চেয়ে ভালো কোন প্রার্থনা নিরক্ষর ছমির আলীর জানা নাই।
চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে বস্তির দিকে যেতে যেতে ছমির আলী মনে মনে ভাবে ফিরিসতাগোরে মনে লয়- সব সময় দেখন যায় না।
আবু সাঈদ হান্নান : গল্পকার ও সম্পাদক : সাহিত্যের কাজ কাঞ্চী ।