ছোটো গল্প
কাঠের বুদ্ধ
রেদওয়ান খান
পুবাকাশ
আসন্ন ঠাণ্ডা হিম হিম সকালে, বিছানায় জাহানারাকে উষ্ণতা দিতে কে থাকবে পাশে ? অভির বাবা আবু ইউসুফ না-কি অভির টিচার আহমেদ সাইদ ? তার শীতানুভূত শরীরে, এক আলো-আঁধারি-নিশিথে, ঘুম ঘুম চোখের সামনে দু’টি ভাঙা নৌকা টুপ্ করে ডুবতে থাকে। পাশেই, ময়লা-আবর্জনায় তখন হাবুডুবু খাচ্ছে একটি বস্তু– অন্ধ কাঠের বুদ্ধ মূর্তি।
ইউসুফ চলে যাবার পর, হঠাৎ করে ভীষণ একা হয়ে গিয়েছিল জাহানারা। দু’বছরের বেশি হয়ে গেল, সে গেছে ইউরোপে। সুইজারল্যান্ড। এভাবে সময় ভাগ হয়ে যায়। মানুষও ভাগ হয়ে যায়। স্বপ্ন-সাধ-কথামালা– সব কিছুই ভাগ হয়ে যায়। ইউসুফ যখন দেশে ফিরবে, এসে দেখবে তার ছোট্ট তুলতুলে অভি কতোটা বড় হয়ে গেছে। যখন গেছে, তখন অভির বয়স ছিল পাঁচ। যখন ফিরবে, তখন, কতো হবে ছেলের বয়স? ছেলে এখন স্কুলে যাচ্ছে। এইসব সাত-পাঁচ ভাবছে জাহানারা। বিছনায়, বালিশে হেলান দিয়ে, হাঁটুর উপর পুরোনো ফটো-এ্যালবামের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে নানান কিছুর স্মৃতিভার তাকে কাতর করে তুলছে।
ইউসুফ সুইজাল্যান্ড গিয়েছে স্কলারশিপে। চার বছরের কোর্স। সে বলেছে, যাওয়ার সময়, জাহানারার মন খারাপ দেখে–
ধুর, একদম চিন্তা করো না তো ! দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে সময় চলে যাবে, তুমি টেরও পাবে না।
উত্তরে, জাহানারা শুধু বিষণ্ন চোখে তাকিয়েছিল আবু ইউসুফের দিকে। সে কি মনে মনে ভেবেছে, এমনও, যে, এই যাওয়া যেন হয়– ফিরে আসা!
ওই দেশ আর ওখানকার নানা বিষয় নিয়ে উচ্ছ্বসিত চিঠি লেখে ইউসুফ। সেদিনও সুন্দর খামে করে চিঠি এসেছে। লিখেছে, তুমি না আসলে বুঝবে না, কী বিউটিফুল একটা দেশ, জানু ! একদম চিন্তা করবে না, একটু সময় দাও, আমি তোমাকে আর অভিকে এখানে নিয়ে আসবো। বাংলাদেশ একটা থাকার জায়গা হলো ? বাংলাদেশে কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পেতো না ইউসুফ। আর আজকাল, টেলিফোন আর চিঠি পড়ে পড়ে সুইজারল্যান্ড মুখস্থ হয়ে গেছে জাহানারার। জাহানারাও, ইউসুফের কাছে শুনে শুনে সুইজারল্যান্ডের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে।
উত্তরার নিকুঞ্জ আবাসিকের এই ভাড়া ফ্ল্যাটে জাহানারার দিন কাটে না রাত কাটে না। অথচ সে যে বসে থেকে কল্পনায় উড়ে বেড়ায়,ব্যাপারটা তা-ও না। ঘরের প্রায় সব কাজই, এখন জাহানারা একাই করছে। সকাল-বিকালে ছুটা কাজের লোক সুমনের মা এসে ঘর-ফার্নিচার মুছে দেয়, জরুরি হলুদ-রসুন-আদার খোসা ছিলিয়ে বা বেটে দেয়; মরিচ বেটে দেয়। কাপড় ধুয়ে দেয়। ঢাকা শহরে দিন দিন কাজের লোক পাওয়াও মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। একটু এদিক থেকে সেদিক হলেই বলবে, খালা, কামে রাখলে রাখবেন না রাখলে মানা কইরা দিবেন। গার্মেনে কাজের অভাব নাই।
এদের মাসিক বেতনও, আজকাল সাধ্যের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। যত প্রকার কাজ তত প্রকারের আইটেম-ফি চার্জ করে। ধোয়া-মোছার জন্য এক হাজার টাকা। কাপড় কাচার জন্য এক হাজার। রুটি বানানোর জন্য এক হাজার। এইভাবে, আইটেম- ফি চার্জ করে কাজের বুয়ারা। তারা সমতায় বিশ্বাস করে। তাই, যতপ্রকারের কাজ হবে, ততপ্রকার সমান পরিমাণ টাকাকে গুণ করে দিলেই হবে। সেই অনুপাতে কাজের সময়ও বন্টন করবে ঝটফট ফটাপট। যেন মাছি। অতি দ্রুত সব কাজ শেষ। ঢাকা শহরের সব বাড়িতেই একই নিয়ম চালু করে ফেলেছে তারা। এদর সাথে কথায় পারা জাহানারারও কাজ না।
রান্না,ছেলেকে স্কুলে আনা-নেয়া, খাওয়ানো-পরানো-ঘুম পাড়ানো, ঘর-বিছানো গোছানো, রাজলক্ষ্মী- গাউছিয়া-চাঁদনীচ মার্কেটে শো-পিচ খুঁজে বেড়ানো এ সবই, আজকাল একাই করছে জাহানারা। এতো কিছু করার পরও, তবু, নিঃসঙ্গতা তাকে সারাক্ষণ কুরে কুরে খায়। জাহানারা অন্তরে বাহিরে নিদারুণ একাকীত্বে ডুব-সাঁতার কাটে।
সারা ঘর একধরনের শূন্যতায় খা খা করছে। হাহাকার ছড়ানো এই ফ্ল্যাটে মাঝে মাঝে এই একাকীত্ব মনের ভেতর দারুণ ভয় জাগিয়ে দেয়। তখন মনে হয়, ছেলে অভি না থাকলে নিজের অজান্তে মরেই যেত জাহানারা।
ইউসুফ চলে যাবার পর, এক ধরনের শূন্যতার ভারে জাহানারার বুক ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। সেই ভাঙ্গা বুকের দুকূল জোড়া লাগাতে মোবাইল ফোন খুব কাজে লেগেছে।
হ্যালো, কি করছিলে। সুদূর সুইজারল্যান্ড থেকে ইউসুফের কণ্ঠ উড়ে আসত।
তোমার কথা-ই ভাবছিলাম। শরীর ভালো তোমার ? ওদেশে নাকি খুব শীত ? জানতে চায় জাহানারা।
না। এখন শীত কম। গাছে গাছে ফুল। হালকা বাতাস। এখানকার সবচে সুন্দর কি জানো ?
কি?
এখানকান প্রকৃতি ও মানুষ। দুটোই।
আমাদের ছেড়ে থাকতে ভালো লাগছে তোমার ? একটা বিষণ্নতা ছড়িয়ে পড়তো জাহানারার এই প্রশ্নে। মোবাইলের ওপান্ত থেকেও,সেই বিষণ্নতার সুরটি ধরতে ভুল হতো না ইউসুফের।
না ভালো লাগছে না। তবু থাকতে হবে তো আমাকে, তাই না। অভি ভালো ? প্রসঙ্গ ঘুরায় ইউসুফ। বলে, দেখি তোমাদেরকে নিয়ে আসতে পারি কি-না। এমন সুন্দর দেশ না দেখলে জীবনের কোনো মানে হয় না। এখন দাও অভিকে। ও কি ঘুমিয়ে পড়েছে ?
এইসব আলাপচারিতার পর, জাহানারার মন সুইজারল্যান্ডের পুষ্পোদ্যানে ঘুরে বেড়াতো। কেমন যেন সব কিছু গুলিয়ে ফেলে একটা স্বপ্নঘোরের ভেতর তলিয়ে যেতে থাকে সে। এই প্রথম বিরহকাতরতা সম্পর্কে একটা প্রাথমিক কিন্তু বাস্তব ধারণা পায় জাহানারা। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় তুমুল প্রেম করে ইউসুফকে বিয়ে করেছিল জাহানারা। সব কিছুই ভালোভাবেই চলছিল। ইউসুফ বিদেশ চলে গিয়ে, সবকিছুই এলোমেলো করে দিয়ে গেছে যেন।
চাইলে জাহানারা চাকরি করতে পারতো। কিন্তু চাকরি ওর নিজেরই পছন্দ না। এখন ভাবছে, বাসায় বসেই স্বাধীনভাবে একটা কিছু করবে। কত মেয়েরা আজকাল কত কিছুই করছে। নানানরকম এনজিও থেকে লোন নিয়ে ছোট ছোট ব্যবসাও করছে। কিছু একটা করলে সময়টা যেমন কাটবে তেমনি পয়সাও আসবে। কিন্তু করি করছি করি করছি করে করে কিছুই করা করা হয় না জাহানারার। সে খানিকটা অলস প্রকৃতির মেয়ে। অলস প্রকৃতির মেয়েরা স্বপ্নঘোরে দিনরাত একাকার করে দিতে পারে। জোছনা রাতের পরী হয়ে তারা পদ্মপাতায় আলতো করে ঘুমিয়ে থাকতে ভালোবাসে। শ্রাবণের তুমুল বৃষ্টিতে তারা অচিন ফুলের সৌরভ হয়ে বুঁদ করে দিতে পারে প্রকৃতি ও পুরুষকে। তারা এমনকি, একা একা ঘুম থেকেও জেগে উঠতে পারে না। তাদেরকে ভালোবেসে কোমল স্পর্শে আলতো করে জাগিয়ে তুলতে হয়। নইলে জোছনাকাতর পদ্মপরীদের ঘুম ভাঙে না।
এখন ইউসুফ চলে যাবার পর, সে কি করবে, হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারে না জাহানারা। একবার ভেবেছে, কোনও একটা কোর্স করে নিলে কেমন হয়। তাই সে, দৈনিক ইত্তেফাকের নানান বিজ্ঞাপন কাটা শুরু করেছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছে সে-সব। তারপর কাঁচি দিয়ে কেটে ফাইলবন্দি করছে। হেয়ার কাটিং, কুকারি, ইন্টেরিয়র ডিজাইন,কমিউনিকেটিভ ইংলিশ, টিভি নিউজ প্রেজেন্টার ইত্যাদি বহু বিষয়ে গভীর আগ্রহ নিয়ে পেপার কাটিং করে সে। কিন্তু কোন কোর্সটা করবে সেটা ভেবে ভেবে দিনরাত যায়। কূল-কিনারা করতে পারে না।
তবে কোনও কিছুই স্থবির হয়ে থাকে না প্রকৃতিতে। প্রকৃতি স্থবিরতা পছন্দ করে না। ফলে জাহানারাকে তার সেই অতল সিদ্ধান্তহীনতা থেকে প্রায় হাত ধরে তুলে আনে একজন মানুষ এক সম্পূর্ণ অন্যরকম মানুষ। সে যেন বলে, দূরে কোথায় দূরে কোথায় নয়; তুমি এইখানে উঠে আসো, হে নারী, হে দেবী সৌন্দর্যময়ী! যেন ঘুমঘোরে জাহানারর কর্ণে বেজে ওঠেন ইন্দুবালা দেবী– ডেকে ডেকে কেন তারে ভাঙালি ঘুমেরও ঘোর..স্বপনে সে এসেছিল স্বপন-কুমার মনোচোর, সখি স্বপন-কুমার মনোচোর!
আহমেদ সাইদ সুপুরুষ। লম্বা। গায়ের রঙ শ্যামলা। চিকন নাক কাস্তের মতো। আবার সরু চিকন দ্বিতীয়ার চাঁদের সঙ্গেও তার সুন্দর নাকের তুলনা করা যায়। জোড়া কালো ভ্রূ। গভীর কিন্তু ভাসমান টইটম্বুর দুই চোখ। সেই দুই চোখ কি জাহানারাকে নতুন কোনো মৃত্যুর দিকে টানছে ?
আহমেদ সাইদ, জাহানারার বালক-পুত্র অভির হাউস-টিউটর। এর আগে আরেকজন টিচার ছিল। অনেকদিন পড়িয়েছিলেন তিনি। পড়াতেন ভালো। তার সরকারি চাকরি হয়ে যাওয়ায় সেই টিচার-ই তার পরিচিত আহমেদ সাইদকে অভির জন্য দিয়ে যায় । সে এশিয়ান ইউনির্ভাসিটিতে এমবিএ করছে। বাড়ি বরিশালের উজিরপুর। মোটামুটি যা হয়, এটকু অনটনের মধ্যে থেকে পড়ছেন। থাকছেন মিরপুরে, টোলারবাগ না কলওয়ালাপাড়ার এক ব্যাচেলর ফ্ল্যাটে। মেসে। সপ্তাহে তিন দিন অভিকে হোমওয়ার্কসহ অন্যান্য পড়া দেখিয়ে দিতে আসে। মিরপুর থেকে নাখালপাড়া বেশ খানিকটা পথ। ঢাকা শহরে রাস্তা-ঘাট, রিকশা-বাস-ট্রাফিক কোনওটারই কোনও ঠিক ঠিকানা নাই। তবু কষ্ট করে আসে আবু সাইদ। এ জন্য যে, নিজেকে আর্থিকভাবে কিছুটা সাহায্য করা প্রয়োজন। বাবা-মা’র পক্ষে সব খরচ যোগাড় করা সম্ভব না। আরও ভাইবোন আছে যারা কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ছে।
অভিকে পড়াচ্ছে বেশ কয়েক মাস ধরেই। জাহানারার হাজব্যান্ড, ইউসুফ সুইজারল্যান্ড চলে যাওয়ার মাস দু’য়েক পরই, আগের টিচার নূর কামরুল ইসলাম চলে যাবার পর। নূর কামরুল ইসলামও ভালো পড়াতেন। তবে তার চোখে কোনও ধরনের টইটম্বুর দিঘীটিঘি ছিল না। লোকটা ছিল নোয়াখাইল্লা। টনটনে ঠাসঠাস কথাবার্তা। তবে পড়াতেন ভালো। অভিও পছন্দ করতো। এই নতুন টিচারকেও পছন্দ করে অভি। আদর-ভালোবাসা আর ভূতের গল্প বলে বাচ্চাদের মন জয় করা সহজ। আহমেদ সাইদ ভূতের গল্প বলতে ওস্তাদ। এমন হয় যে, পড়ার সময় শেষ করেও, মাঝে মাঝেই তাকে আরও আধা ঘন্টা এক ঘন্টা থেকে যেতে হয় তার ছাত্রের শর্তে। অংক পারলে পড়াশেষে ভূতের গল্প বলতে হবে।
পাশের রুম থেকে, ছুটা কাজের লোক সুমনের মাকে দিয়ে টিচারের জন্য চা পাঠিয়ে দিতে দিতে, আহমেদ সাইদের সঙ্গে তার ছেলে অভির পড়া ও ভূতের গল্পের আবদার– সবই শোনে জাহানারা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একজন নারী আর একজন পুরুষের মধ্যে কখন কি প্রক্রিয়ায় সম্পর্কের রসায়ন ঘনীভূত হয়, তা বলা মুশকিল। সম্পর্কটি হয়ে যাওয়ার পর, বিশেষ করে উত্তুঙ্গ অবস্থা থেকে খানিক থিতিয়ে আসা অব্দি এর সাম্প্রতিক বা দূরবর্তী অতীত প্রেক্ষিতটি খুঁজতে ভালোবাসে না কেউ। কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে। ফলে, মানুষ চলমান এক জীব– নদীর মতো চিরবহমান সময়কে সঙ্গে নিয়ে চলাই তার ধর্ম। সুন্দর আর নির্বিকার প্রজাপতির মতো। বাগানের কতো ফুলই রঙের বাহারে প্রজাপতিদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। একারণে, আবু ইউসুফ বিদেশে চলে যাবার পর, নিঃসঙ্গতা চারিয়ে উঠলে, পুত্র অভির টিচার আহমেদ সাইদের প্রশস্ত বুকে নিজেকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে জাহানারা। প্রথম প্রথম এসব অলীক কল্পনা মনে করে নিজের ভেতরে হেসে কুটিকুটি হয়েছিল সে, লজ্জায় লাল হয়েছিল ড্রেসিং টেবিলের বড় আয়নার সামনে, ঠোঁটে একটুখানি সুবাসিত লিপস্টিকের প্রলেপ মাখতে মাখতে। এখন আর নিজে নিজে হেসে কুটিকুটি হয় না সে। সময় গড়িয়ে গেলে, এখন মনে হয়, অভির টিচার আহমেদ সাইদ ছেলেটা আসলেই অসম্ভব সুন্দর, স্মার্ট আর চুম্বকীয়।
জাহানারা শো-পিস সংগ্রহ করতে পছন্দ করে। প্রায়ই আসাদ গেইটের আড়ং, গুলশানের মাত্রা না যাত্রা, ইকেবানা বাত্যাদি বড় বড় শে-পিসের দোকানে ঢুঁ মেরে মাটি, ব্রোঞ্জ বা ক্রিস্টালের উপকরণ নিয়ে আসে। একবার তার শখ হলো বিক্রমপুরের বিখ্যাত পটচিত্র সংগ্রহ করবে। আবু ইউসুফ জাহানারাকে ভালোবেসে একদিন নিয়ে গিয়েছিল জীবিত কিংবদন্তী শম্ভু আচার্যের পটচিত্রশালায়। কলাপাতার ফাঁকে উঁকি দেয়া গ্রাম্য বধুর অসাধারণ একটা পট নিয়ে এসেছিল বেশ দাম দিয়ে। সেটি ড্রয়িংরুমে টানানো।
এখন, ইউসুফ মাঝে মাঝে সুইজারল্যান্ড থেকে ছোট ছোট ক্রিস্টাল শো-পিস পাঠায়।
আজকাল শো-পিস দেয় আরেকজনও। আহমেদ সাইদ। অভির নতুন টিচার। কী একটা ট্যুরে সে গিয়েছিল কক্সবাজার, রামু না-কি, এখন মনে নাই– টেকনাফ। কী মনে করে সাইদ জাহানারার জন্য নিয়ে এসেছে একটা চমৎকার কাঠের বুদ্ধ। বার্মিজ কাঠের তৈরি এই বুদ্ধমূর্তি। দেখেই চির-নীর্মিলিত চোখ আর উপরের দিকে তোলা একটি হাত,আরেকটি ভাঁজ-করা হাঁটু-ঊরুসন্ধিতে; দেখেই মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে এই পবিত্র মূর্তি মানুষকে বিভোর করে রেখেছেন। ধ্যান ও অভয়-আহ্বানে। মাঝে মাঝে ছোট এই কাঠের বুদ্ধের দিকে চেয়ে থেকে জাহানারার ইচ্ছে হয়, নিজেও একটু ধ্যান করে নির্বাণের প্রকৃত রহস্য আত্মস্থ করতে।তবে সে আহমেদ সাইদকে বলেছিল –
এসব কেন করতে গেলেন, টিচার!
শুধু আপনার জন্য। আমি জানি, আপনি ভালোবাসেন।
ভীষণ সুন্দর হয়েছে। থ্যাঙ্কস,টিচার!
সেই ধ্যানী বুদ্ধ নির্বাণের পরম বাণী নিয়ে ড্রয়িংরুমে, এন্টিকের গোল টেবিলটাতে শোভা পাচ্ছে আজকাল।
এরপর থেকে, পূর্বেকার সংগৃহীত নানান রকমের শো-পিস খুবই ধুলোমাখা ম্লান-জীর্ণ-ভঙ্গুর মনে হতে থাকে জাহানারার। একদিন বহু কষ্ট করে এসব সুন্দর সুন্দর জিনিস সংগ্রহ করেছিল সে। কিন্তু আজকাল এসব কিছুই ভালো লাগে না; ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে, ঘরের মধ্যে উপবিষ্ট কাঠের বুদ্ধমূর্তির ধ্যান করতে বসে জাহানারা।
তার কেবলই মনে হতে থাকে, তার বিছানার কিনার ঘেষে একটি নদী– নিরঞ্জনা– কূলকূল ধ্বনি তুলে আড়াই হাজার বছর অতীতের থেকে বয়ে আসছে। ভাসিয়ে দিচ্ছে ঘর-বারান্দা-বিছানা। এ হচ্ছে সেই নদী যা মানুষকে প্রতিনিয়ত এক ঘাট থেকে আরেক ঘাটের দিকে আহ্বান করে যায়। কোনও ঘাটেই যেহেতু নদীর কোনও স্থিরতা নেই, তাই এখন, নিরঞ্জনা নদীর মাহাত্ম্য অনুভবে জাহানারার অন্তরাত্মা দিশেহারা। ফলে, কোনও ঘাটেই, এখন, জাহানারা তার চিরসখা ইউসুফকে দেখতে পায় না। ‘চিরসখা’ ধারনাটি এখন এক ধরনের শ্লোক হয়ে ওঠে। মাঝি চলে গেলে খেয়া ঘাটের নৌকা তো শূন্যের আহ্বান ছাড়া আর কিছুই না। ফলে অপসৃত ইউসুফের জায়গায় জীবন্ত অস্তিত্ব হয়ে ওঠে আরেক সুন্দর সুপুরুষ। আহমেদ সাইদ। কেন আজকাল এমন হচ্ছে একথা জানে না জাহানারা। বুদ্ধের অসম্ভব ধানস্থ্য-সমাধি-রূপ জাহানারাকে হয়তো পাগল করেই দেবে। সে যেন আর আর অভি বা সুইজারল্যান্ড প্রবাসী ইউসুফের দিকে নজর দিতে বা মনোযোগি হতে পারছে না। তার নিজের ভেতরে এক ধরনের পরিবর্তন-রূপান্তর টের পায় সে নিজেই। তার গতি থামানোর যেন ক্ষমতা নেই জাহানারার। সে এক প্রকার অসহায়ত্ব অনুভব করে। আর মানুষের সমস্যাগুলো খুবই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। ফলে কেউ তা বুঝবেও না, বুঝাবার বৃথা চেষ্টা করাও হবে একটা আত্মছলনা। এ সঙ্কট জাহানারার নিজের।
শুক্রবার সুইজাল্যান্ডে সাপ্তাহিক ছুটি– উইক-এন্ডের রাতে ইউসুফ ফোন করে। এদিন সে বেশিক্ষণ কথা বলে। কথা বলেই যায়, বলেই যায়। ইউসুফের কথা শেষ হতে চায় না। জাহানারা হুঁ হাঁ বলে শেষ করার একটা ইঙ্গিত দিলেও, ইউসুফ বোঝে না। এই সময়টা, ভোরবেলাকার এই ফোনকল, আজকাল জাহানারার কাছে দীর্ঘ এক অনন্তকাল বলে মনে হতে থাকে। কেন যেন আর আগের মতো ইউসুফের নানারকম উচ্ছ্বাসময় কথাবার্তায় একাত্ম হতে পারে না। অস্থিরতা কাজ করে।
আচ্ছা, আমার অভি আজ কি দিয়ে ভাত খেয়েছে ? সে কি এখন নিজে নিজে ভাত খেতে পারে !
কী আশ্চর্য কথা বলো না তুমি আজকাল ! খেতে পারবে না কেন ? দিব্বি খায় । নইলে মাইরের ভয় আছে না !
ধূর ! তুমি বাচ্চার গায়ে হাত দেবে না,জানু। এটা তোমার খুবই বাজে অভ্যাস।
দেখো, তোমরা পুরুষরা বাচ্চা মানুষ করার কী বোঝো, শুনি ? মায়েরা জানে, কত হম্বিতম্বি করে, বা-সোনা বলে এদেরকে খাওয়াতে হয়।
আচ্ছা হয়েছে। তোমরা মেয়েরা অনেক কিছুই করো। বাচ্চার গায়ে হাত দেয়া খুবই বাজে একটা কাজ। ওসব করবে না। বোঝাবে, বুঝলে।
দেখো, ইউসুফ, এতো সকালে তোমার ফোনোদেশ আমার ভাল্লাগছে না। তুমি আজকাল বড় বেশি বকবক করো। এখন রাখো। দেশে ফজরের আজান হবে একটু পর। একটু ঘুমাতে না পারলে আমার মাইগ্রেন পেইন শুরু হবে। প্লিজ এখন রাখো।
খুবই হতাশ অবস্থায়, ফোনের ওপাশ থেকে সশব্দে থেমে যায় আবু ইউসুফ। যারা পরিবার পরিজন ছেড়ে বিদেশ থাকে, তাদের সম্ভবত পরিবারপ্রেম বা দেশপ্রেম বেশি জাগ্রত হয়। পরবাসীগণ একেকজন জাগ্রত দেবতা।
আবু ইউসুফকে থামিয়ে দিতে একপ্রকার বাধ্য করে, এখন আর ঘুম আসছে না জাহানারার। ফজরের আজান হতে খুব বেশি দেরি নাই। সে তার নিজের উদাসীন ব্যবহারের নিজের কাছে কিছুটা বিস্মিত–বিস্ময় ভ’র করে তার করোটিতে। ফলে মাইগ্রেনের পেইন শুরু হবে হবে করছে। এই অবস্থায়ই একবার জোনাকির মতো চোখ পিটপিট করে ভেবেছে, সে সাইদকে, অভির টিচারকে– কি দেবে, মন না শরীর ? কি দেয়ার আছে তার ? তারপর তলিয়ে গেছে মাইগ্রেনের ব্যথার ভিতর। আজ তার কখন ঘুম ভাঙবে– কেউ জানে না।
অভির টিচার আহমেদ সাইদ তার আম্মু অর্থাৎ জাহানারাকে আপা বলত। এখন আর বলে না। সাইদের ইচ্ছে হয়, জাহানারাকে আদর করে ‘জানু’ বা ‘জুনু’ বলে ডাকতে। জুনু ডাকটাই বেশি ভালো। কিন্তু জুনু নাম ডাকতে গিয়ে মুখ লালচে হয়ে ওঠে। অভিকে পড়াতে পড়াতে, ভূতের গল্প শোনাতে শোনাতে কখন যে সে নিজেই ভৌতিক সম্মোহনে ডুবেছে, সে নিজেই জানে না।
কদিন আগেও, সাইদের পিছনে দু’তিনজন মেয়ে ঘুর ঘুর করেছে। এখনও করছে। ক্যাম্পাসে ওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে হাঁটা-চলা প্রায় দুষ্কর হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে ক্লাসমেট ঋতিতে তার খুবই পছন্দ। কিন্তু পরীক্ষা ফাইনালের আগে একটা ভালো কাজে জয়েন করার আগে, ঋতিকে গ্রীন সিগনাল দিতে চায় না সাইদ। পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত পরানের গহীন ভিতরে মেয়েদের জন্য লালবাতি জ্বালিয়ে রেখেছে সে। এই ধরনের অনীহা ও দায়িত্বহীনতার কারণে, এক সময় রেগে গিয়ে ঋতি, আহমেদ সাইদকে বেশ কয়েকবার হিজড়ে বলে অপমানও করেছে। সে-সব আপমান সাইদের কাছে বেশ আরামপ্রদ মনে হয়েছে। সে খানিক লাল হয়ে ভেবেছে, বলুক না। মেয়েদের এত পাত্তা দেয়ার কিছু নাই। পৃথিবীতে কঠিনতম ‘চীজ’ হচ্ছে এই নারী। এদেরকে যত কম পারা যায়–‘লাই’ দেয়াই ভালো। তাছাড়া এত তাড়াহুড়ারই বা কি আছে। চলুক না কিছুদিন এভাবে। মেয়েদের বড় বেশি তাড়া।
ফলে সিগনাল বাতি জ্বলে ওঠে অন্যখানে। সবুজ অনুপম। দৃষ্টিনন্দন। সৃষ্টিনন্দন।
এ সময়, আহমেদ সাইদ ও জাহানারার বুকের ওপর এক নবতর নিয়তি ভ’র করে। ফলে শরতের শান্ত নদীতে নেওকা ডুবে যায়। একজন বিবাহিত, নিঃসঙ্গ-একাকী, ‘জননী’ নারীর বুকে হাবুডুবু খেতে থাকে আরেকজন ছাত্র-যুবক অবিবাহিত রাজকুমার।
জাহানারা যে পাশের ঘরের পর্দা ফাঁক করে, মাঝে মাঝেই, আহমেদ সাইদকে গিলে খায় এটা টের পেতে খানিক সময় লাগলেও, শেষ পর্যন্ত টের পায় সে। ফলে অভিকে অংক কষতে দিয়ে বা সুন্দর হস্তাক্ষর অনুশীলন করতে দিয়ে, এতোদিন ধরে তার চোখে জ্বলে-থাকা লাল বাতি দু’টি ক্রমে সবুজ করে দিয়ে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে ছড়িয়ে দেয়। সে যেন এক হঠাৎ-ঘোষিত নভোচারী। জাহানারা নামের এই নারীর বাড়ি হয়ে ওঠে তার সুনীল আকাশ। আহমেদ সাইদের সাড়ে-তিন-হাত শরীর সেই আকাশে নভোচারীদের মতোই ওজনহীন শূন্যে ভাসতে থাকে। আর জাহানারা দেখে, সাইদের প্যান্টের জিপার ফেটে একটি অলৌকিক কাঠি বেরিয়ে আসছে ! সেই অলৌকিক কাঠি যেন আপাত-পতিত ভূমিতে বিঁধে দিতে চায় তার সুতীক্ষ্ণ ফলা। কর্ষণ করতে চায়। লিখে ফেলতে চায় একখানি বেদনা-মধুর মহাকাব্য। কোনো জমিন কখনো এভাবে আহমেদ সাইদকে নিজের ভেতরে টানেনি। হয়তো আকাশ আর মাটি এভাবেই পরস্পরকে টানে।
সম্প্রতি এয়ারমেইল লেখা খামে চিঠি এসেছে। ইউসুফ লিখেছেঃ ‘… জাহানারা, তোমার কি শরীর খারাপ ? ফোন করলে সামান্য কথা বলেই কেমন যেন তোমার ক্লান্তি ক্লান্তি ভাব টের পাই। কোনও কথা বললে তার উত্তর না দিযে তুমি যাই যাই করতে থাকো। আগে তো এমন করতে না ! ব্যাপারটা বেশ বিস্ময়কর। অভির কথা জানতে চাইলে বা তার সাথে কথা বলতে চাইরেও কেমন যেন একটা বিরক্তিভাব করে পোন ছেলে পালিয়ে যেতে চাও তুমি ! তোমার সমস্যা কোথায় আমাকে না বললে আমিই বা এতো দূর থেকে বুঝবো কেমন করে। তোমার কি মাই্গ্রেনের ব্যথা বেড়েছে ? শরীর খারাপ হলে ডাক্তার দেখাবে। রোগ ভালো করার জন্যই তো ডাক্তার। রোগ পুষিয়ে রাখবে না। আমি কাছে নেই বলে নানান কষ্ট হবে, সে আমি জানি। নিজেকে একা ভাববে না। আর আমি এত দূরে কেন পড়ে আছি ? তোমার-আমার আর আমাদের সন্তান অভির জন্যই। অভির সামনে তুমি শরীর খারাপ বা মন খারাপ করে থাকলে, সেটা যে ভালো দেখায় না– আশা করি এটা বুঝার ক্ষমতা তোমার আছে। এমন কিছু বাচ্চার সামনে করবে না, যাতে ওর বেড়ে ওঠাতে সমস্যা হয়। ওকে একা থাকতে দেবে না। বাসায় যে নতুন টিচার এসেছে, সে কেমন পড়ায় ? না-কি পড়া মুখস্থ করতে দিয়ে, চেয়ারে ‘আসামবিড়ি’ দিয়ে নাক ডেকে ঘুমায়– এসব খেয়াল রাখবে…।’
ইউসুফের চিঠির উত্তর দেয়া হয় না। দেই দেই করে জাহানারার কেবলই দেরি হয়ে যায়। চিঠি লেখার প্যাডে কলমের দাগ পড়ে না।
আহমেদ সাইদ অভিদের বাসায় বেশি সময় দিতে গিয়ে ধানমন্ডি-মিরপুরের দুটি টিউশনি হারায়। হাত খরচাসহ অন্যান্য খরচা থেকে বেশ কিছু টাকা খ’সে গেল অনর্থক। পকেট ফাঁকা হয়ে গেলে মন খারাপ হয় সাইদের।
জাহানারা সাইদকে আদর করে বলে, তোমার আর অন্য কোনও টিউশনি করার দরকার নেই। তুমি অভিকেই পড়াও একটু বেশি সময় দাও ওকে।
সময়টা যে অভিকে নয়, জাহানাকেই দিতে হবে এটা বুঝে পকেট খালি হওয়ার দুঃখ ভোলার চেষ্টা করে আহমেদ সাইদ।
মাস শেষে শাদা খামে ঢুকিয়ে তিন হাজার টাকা বেশি দিয়ে দেয় জাহানারা। ধানমন্ডি-মিরপুরের টিউশনি হারিয়ে, কোনও বাড়তি টিউশনি না করে, এভাবে বিশেষ ‘ইনকাম-বোনাস’ পাওয়ায় বেশ ঝরঝরা মন নিয়ে হাতিরঝিল লেইকের পাড়ে হাওয়া খায় সে। কখনও-বা, বন্ধু ইরাজকে সঙ্গে নিয়ে শেরাটনের পাশে, সাকুরা বার-এ গিয়ে ধোঁয়া ধোঁয়া পরিবেশে বসে একটু জেডি– জ্যাক ড্যানিয়েল পান করে আসে। সঙ্গে কাঁচা ছোলা আর রেড মার্লরোরো। একারণে, আজকাল, নিজের বুক-সিনাকে বেশ বড়সড় চিতানো মনে হয় সাইদের। নিজেকে পুরুষ মানুষ ভাবতেও বেশ খানিকটা অহঙ্কারসুলভ উষ্ণতা অনুভব করে।
বিকেলে, আজকাল অভিকে, স্কুল থেকে নিয়ে আসার কাজটি করে আহমেদ সাইদ। এটি বাড়তি দায়িত্ব পড়েছে। এটা করার জন্য জাহানারা তাকে অনুরোধ-অনুনয় কোনওটাই করেনি। সে নিজ থেকেই করা শুরু করেছে কিছুদিন হল। জাহানারাও, এতে অখুশি হয়নি। ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার একটা বাড়তি ঝামেলার এইরকম সমাধান সে ভেবে দেখেনি।
এরপরও, সাইদের কোনও কিছুই আজকাল ভালো লাগে না। নিজের পড়া এখনও শেষ হয়নি। সামনে ফাইনাল। পড়ায় মন দিতে পারছে না সে। টিএসসিতে আড্ডা দিতে দিতে পিচ্ছি জাফরানের আখের গুড়ের চা খেতেও তিতা তিতা লাগে যেন। অভিদের বাড়িতে প্রচুর সময় দেয়ার পরও, মনে হয়, অভিকে পড়াতে আর ভালো লাগছে না। অন্য যে দুএকটি ছাত্র আছে, তাদেরকেও পড়াতে মন চায় না। তার মন শুধু জুন জুনু জুনু জুনু জিকির করতে থাকে।
পিচ্ছি জাফরান বলে, মামা চা ত পুরাডা খাইলেন না। মিঠা কম অইছে মামা ?
না রে । মিঠা ভালা অইছে। দে আরেক কাপ দে।
আইচ্ছা। সিকরেট দিমু আরেট্টা, মামা ?
দে।
গরিব ছেলে পিচ্ছি জাফরান। টিএসসিতে তার চাচার সাথে চা বিক্রির কাজ করে। ঠিক পিচ্ছি নাই এখন আর জাফরান। বাড়ি চাঁদপুরের মতলবে। মোহনপুর। নাকের তলায়, ঠোঁটের উপর ঘন গোঁফরেখা দৃশ্যমান। পুরোনো প্যান্টের জিপার লাগতে ভুলে গেছে সে। পরনে ময়লা গেঞ্জি। লিকলিকে লম্বাটে হয়ে উঠেছে জাফরান। এখানে দুপুরের পরই প্রেমিক-প্রেমিকা ও নানারকম যুগলদের আড্ডায় মুখর। জাফরান জানালা-খোলা প্যান্ট পরে দিব্যি তার চাচার সাথে কাস্টমারদের গুড়ের চা, আদা চা, মশলা চা আর সিগারেট সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। সিগোরেটে টান দিতে দিতে আহমেদ সাইদ জাফরানের সংগ্রামের কথা ভাবে। কিন্তু কত ভাবনাহীন জীবন তার, জাফরানের– এটা ভেবে নিজের জীবনের ভাবনা এসে ভিড় করে; মাথা গুলিয়ে ওঠে আহমেদ সাইদের।
দু’দিন আগেই জাহানারা বলেছে, তার পেটের ভেতরে গৌতম বুদ্ধ আসছেন ! জাহানারা প্রায়ই কথা বলে হেঁয়ালি করতে ভালোবাসে। তাই প্রথমটায় গুরুত্ব না দিলেও, পরে যখন বিষয়টি পরিস্কার হয়, তখন, আহমেদ সাইদ, গৌতম বুদ্ধের উপমাকে জাহানারার একটু বেশি বাড়াবাড়ি বলে মনে করে। কারণ কথা শুনে কথাটি পরিস্কার হওয়ার পরই, তার মাথা ভোম ভোম করে ঘুরতে শুরু করে। চোখের সামনে কী যেন কি– একটা আগুন জ্বলা শুরু করে।
জাফরানের দেয়া তিন নম্বর গুড়ের চা শেষ করে নতুন সিগারেট ধরাতে ধরাতে আকাশের দিকে তাকায় আহমেদ সাইদ। সেখানে কয়েকটি নাগরিক চিল ঘূর্ণাকারে শূন্যে ভাসছে।
ভালোবাসা কারে কয় জাহানারা এ কয় মাসে হাত ধরে শিখিয়েছে সাইদকে। সে নিজে যে-রকম অভিকে হাত ধরে ধরে শেখায় সুন্দর হস্তাক্ষর বা অন্য কোনও অনুশীলন, অনেকটা সে-রকমই। একবারে হাতে কলমে শিক্ষা। কিন্তু সেই শিক্ষালাভের পর, এখন আহমেদ সাইদের ঘুম হয় না। গৌতম বুদ্ধের আগমন-সংবাদ শোনার পর, অস্থিরতায় সারা রাত এপাশ-ওপাশ করে সে। গভীর রাতে মোবাইল বেজে ওঠে। জাহানারার কল।
কি করছ ?
আমাদের কথাই ভাবছি। চোখে একদম ঘুম নেই।
কেনো, ঘুম নেই কেনো ?
ভাবছি কিভাবে এমন হয়। কিভাবে মানুষ স্বর্গচ্যূত হয়।
কি রকম ?
না, মানে, ঐ যে বলছিলে আমার কলমের খোঁচায় নাকি নতুন গন্ধমবৃক্ষ অঙ্কুরিত হয়েছে ?
হুম। কিন্তু ভয় হল– আমার বাচ্চা রয়েছে। অভির কি হবে তখন ? বিদেশে ওর বাবা রয়েছে। শনির আখড়ায় শ্বশুর-শ্বাশুড়ি-ননদ রয়েছে।
কিন্তু বিষয়টা আমার পক্ষে অসম্ভব ভয়াবহ। আমার রক্ত হিম হয়ে আছে তোমার কাছ থেকে ঘটনা শোনার পর থেকে। জানো, বুঝো কিছু তুমি ! আমার জীবনে এরকম কিছু হোক তা আমি চাইনি।
ঘটনা যা হবার হয়েছে। তবে আমাদের আরও সাবধান হওয়া দরকার ছিল, সাইদ। বোকার মতো কথা বলো না। পুরুষের মতো কথা বলো। মিনমিনানি একদম অপছন্দ আমার।
আমি তো অভিকে পড়াতে এসেছিলাম তোমার বাসায়। অন্য কিছু তো না, তাই না।
এখন তুমি কি নিজের দায় নিতে চাও না ? দোষটা আমার একার ?
এ তোমার অন্যায় বাড়াবাড়ি, জাহানারা। আমার পড়াশোনা-ক্যারিয়ার এভাবে হুমকির মুখে পড়বে জানলে আমি সাবধান হতাম। কিন্তু তোমার পেট ভারী হচ্ছে– এ তো কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু তুমি কাঁদছো কেন এখন ? আশ্চর্য ! মনে হয় আমি তোমার পিছনে লেগেছিলাম !
এসব কথাবার্তার পর, জাহানারার মনে হতে থাকে, সে নিজেই, তার হাজব্যান্ড ইউসুফ এবং পুত্র অভির সঙ্গে বিশ্বাসভঙ্গ করেছে। একই সঙ্গে সে অনেক ভেবেছে, আত্মবিশ্লেষেণ করেছে, দেখেছে ইউসুফ-অভির মতোই আহমেদ সাইদও, তার জীবনে এখন এক পরম সত্য। মানুষের জীবন বড়োই বিচিত্র-জটিল। জীবনটা এমনি করেই হয়তো, কোনো না কোনো মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের কাঁটাতারে আটকে যায়। নচেৎ মানুষ কিভাবে বাঁচে। জাহানারা বেশ ভালো করেই অনুভব করে, সে আহমেদ সাইদের প্রেমে পড়েছে। এ নিছক দৈহিক বিষয় না। তারও চেয়ে বেশি কিছু। সাইদকে সে ভালোবাসে। সাইদের মধ্যে এমন কিছু একটা আছে যা জাহানারার ঘরে সাজানো, সাইদেরই দেয়া ধ্যানী বুদ্ধের মতোই, যাকে পরিত্যাগ করা যায় না। ধ্যানেরও একটা আশ্চর্য চুম্বকীয় শক্তি যে আছে সেটা অনুভব করে শরীরের রোমকূপে কাঁটা দেয় জাহানারার। জাহানারা এ-ও জানে, সাইদ তাকে ভালোবাসেনি। সাইদের জন্য সেটা হয়তো স্বাভাবিক না। তার নিজের বেলায়ও কি তা স্বাভাবিক !
জাহানারা এখন টের পায়, তার চোখের পিছনে কোথাও একটা নদী আছে। সেই নদী এখন ভয়াবহ ঢল তুলবে। তার একূল-ওকূল সব ভাঙবে এখন। তলিয়ে নেবে।
কয়েকদিন ধরে আহমেদ সাইদ অভিকে পড়াতে আসে না। তাকে মোবাইল ফোনেও পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ সময়ই রিসিভ করে না। ক্রিং ক্রিং রিংটোন বাজতে থাকে অথবা একটি নিরেট-রোবোটিক নারীকণ্ঠ বলতে থাকেঃ দুঃখিত, এই মুহূর্তে আপনার করটি সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহ করে একটু পর আবার চেষ্টা করুন।
এখন গভীর রাত। ঘরের ভেতর হালকা নীল আলো জ্বলছে। ছোট অভি বিড়ালের মতো তুলতুল হয়ে ঘুমাচ্ছে। কয়েকদিন ধরে টিচার কেনো আসেন না, এ-নিয়ে সে নানান প্রশ্ন করে জাহানারাকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছে সারা বিকেল, সারা সন্ধ্যা। এখন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ছেলেটা তার টিচারকে পছন্দ করতো। আর সাইদ পড়াতো ভালো। টিচারের জন্য মন খারাপ ছেলেটার। তার মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দেয় জাহানারা।
তারপর উঠে কিছুক্ষণ পায়চারি করে জাহানারা। সে জানে, তার এখন আর ঘুম আসবে না। বারান্দার দরোজা খুলে সেখানে পাতা সোফায় বসে। নিজের হাতে লাগানো নীলমণিহার লতায় ফোটা ফুলগুলো লতাপাতাসহ ঘুমাচ্ছে। তখন আকাশে একধরনের রাত্রি-আবরণ দূরের চাঁদটাকে ঘোলাটে করে রেখেছে। এ-সময়, একটি রাতজাগা অচিন পাখি ডানার শব্দ তুলে কোথায় যেন উড়ে যায়। তখন টি-টেবিলে বসা ধ্যানী বুদ্ধের কথা মনে পড়ে জাহানারার। তারপর, বারান্দা থেকে উঠে গিয়ে সে, জাহানারা, কাঠের বুদ্ধমূর্তিটিকে হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখে। চেয়ে চেয়ে দেখে। সেখানে কোনও প্রাণ ছিল না। বারান্দার পাশেই একটা ক্রমশঃ ক্ষীণ হয়ে আসা জলাধারে,হঠাৎ ছুঁড়ে মারে সে, সাইদের দেয়া উপহার– বার্মিজ কাঠের বুদ্ধকে। তারপর বিছানায় এসে ঘুমন্ত অভিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে। তার শরীর কাঁপছে। শীত শীত করছে। পায়ের কাছে রাখা পাতলা কাঁথাটা টেনে নিয়ে গায়ে দেয়। নিজের। অভির।
সকালে জাহানারাকে যেতে হবে ক্লিনিকে। বর্ণালী নাসিং হোমে ড. আতেকা খাতুনের সঙ্গে কথা হয়েছে। ড. আতেকা বলেছেন, প্রেগ্ন্যান্সি প্রাইমারি স্টেজে আছে। ফেলে দিতে সমস্যা হবে না। যেতে হবে খুব ভোরে। খালি পেটে।
আসন্ন ঠাণ্ডা হিম হিম সকালে, বিছানায় জাহানারাকে উষ্ণতা দিতে কে থাকবে পাশে ? অভির বাবা আবু ইউসুফ না-কি অভির টিচার আহমেদ সাইদ ? তার শীতানুভূত শরীরে, এক আলো-আঁধারি-নিশিথে, ঘুম ঘুম চোখের সামনে দু’টি ভাঙা নৌকা টুপ্ করে ডুবতে থাকে। পাশেই, ময়লা-আবর্জনায় তখন হাবুডুবু খাচ্ছে একটি বস্তু– অন্ধ কাঠের বুদ্ধ মূর্তি।
রেদওয়ান খান : কবি ও কথাকার।
পড়লাম। স্বামী অনুপস্থিতিতে জাহানারার একাকীত্ব গুছিয়ে আসে শিক্ষক আহমেদ সাঈদ। এবং একসময় সে অনুভব করে শরীর না শুধু মন দিয়ে বসে আছে সাঈদকে।