অনূদিত কথামালা


খলিল জিবরানের পারাপারের দর্শন


অনুবাদ: মুজিব রাহমান


পুবাকাশ


🌿

ভাবের মর্মবস্তু তার কথাকে করেছে কালজয়ী। অজর। তার শব্দাবলী সুগন্ধসার ছড়িয়ে যায় হৃদয়ে হৃদয়ে। ধ্যানতন্ময় আধ্যাত্মিক ভাবাবেশঋদ্ধ তার প্রায় সকল ছোট ছোট কথাপুষ্প। তিনি খলিল জিবরান। তাঁর অলোকসামান্য সৃষ্টিসম্ভার থেকে অনুবাদে কয়েকটি চয়ন করছি।

  🌿

▪️রাত্রির পথ অতিক্রম করেই তো একজনকে পৌঁছুতে হয় ভোরের সীমানায়।

▪️কোনো অভিব্যক্ত মতামত কবিতা নয়। কবিতা উঠে আসে রক্তাক্ত ক্ষত থেকে অথবা সহাস্য মুখাবয়ব থেকে।

▪️একজন কবি সিংহাসনচ্যুত রাজা যিনি প্রাসাদের ছাইয়ের উপর বসে ছাইয়ের ভেতর থেকে একটি রাজপ্রাসাদের মূর্ত রূপ বের করে আনার প্রচেষ্টায় বিভোর।

▪️আকাঙ্ক্ষা জীবনের অর্ধেক; উদাসীনতা মৃত্যুর অর্ধেক।

▪️তারা আমাকে পাগল ভাবে কারণ সোনার বিনিময়েও আমি আমার সময় বিক্রি করবো না; আমি তাদেরকে পাগল ভাবি কারণ তারা মনে করে আমার সময়ের দাম আছে।

▪️আমিই আগুনের শিখা, আমিই শুকনো জংলা, আমার একাংশ অপরাংশকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।

▪️খরগোশের চেয়ে রাস্তার অবস্থা কচ্ছপই বেশি করে বলতে পারে।

▪️আমাদের পবিত্রতম অশ্রু কখনোই আমাদের চোখজোড়াকে খোঁজে না।

▪️একজন মহৎ মানুষের দুটি হৃদয়।
একটি হতে ক্ষরিত হয় রক্ত, আরেকটি সহ্য করে।

▪️আমরা প্রায়শ আমাদের আসছে দিনগুলো হতে ধার করি গত দিনগুলোর দেনা শোধ করার জন্যে।

▪️তোমার অন্য সত্তাটি সব সময় তোমার জন্যে দুঃখকাতর। কিন্তু অপর সত্তাটি দুঃখের মাঝেই বেশ বেড়ে ওঠে; অতএব, সবই ঠিক আছে।

▪️যাদের আত্মা নিদ্রিত এবং শরীর বেসুরো কেবল তাঁদেরই দেহ-আত্মা যুযুধান, যুদ্ধরত।

▪️তুমি যখন জীবনের মর্মে পৌঁছে যাও, সব জিনিসে সৌন্দর্যে দেখতে পাও, এমন কি সে-চোখেও যে-চোখ সৌন্দর্য বিমুখ।

▪️আমরা শুধু সৌন্দর্য উপলব্ধির জন্যে বাঁচি। আর সবই অপেক্ষার আঙ্গিকমাত্র।

▪️বীজ বপন করো এবং বসুধা তোমাকে ফুল দেবে। স্বপ্নে তোমার স্বপ্ন আকাশে ছড়িয়ে দাও এবং স্বপ্নই এনে দেবে তোমার প্রিয়তমাকে।

▪️তোমার জন্মদিনে অশুভ মারা গেছে।
এখন তোমাকে আর নরক পেরিয়ে দেবদূতের সাক্ষাতে যেতে হবে না।

▪️অনেক নারী-ই পুরুষের হৃদয় ধার করে; খুব কম সখ্যকই এটি দখলে নিতে পারে।

▪️তুমি যদি অধিকারেই নিতে পারতে তোমাকে আর জোর দাবী জানাতে হতো না।

▪️যখন মানুষের হাত কোন মানুষীর হাত স্পর্শ করে তারা দুজন-ই অনন্তের হৃদয় স্পর্শ করে।

▪️ভালোবাসা-ই প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যবর্তী আড়াল।

▪️প্রত্যেক পুরুষ-ই দুজন নারীকে ভালোবাসে; একজন তার কল্পনায় গড়া, আর অন্যজন এখনো জন্মায়নি।

▪️যে-সকল পুরুষ নারীদের ছোটোখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতি মাফ করতে পারে না তারা কখনোই নারীদের মহৎ গুণাবলি উপভোগ করবে না।

▪️যে ভালোবাসা প্রতিদিন নিজেকে নতুন করে গড়ে নিতে পারে না তা পরিণত হয় অভ্যাসে এবং পরিণামে তা গড়ায় দাসত্বে।

▪️প্রেমিক-প্রেমিকারা একে অপরকে আলিঙ্গন করে না বরং তাদের মাঝে অন্তঃস্থ যা আছে তাকেই আলিঙ্গন করে।

▪️ভালোবাসা এবং সন্দেহ কখনোই কথা বলার মতো সম্পর্ক বজায় রাখে না।

▪️আলোর পাতায় আলোর হাতে লেখা এক শব্দের নাম ভালোবাসা।

▪️বন্ধুতা কখনোই সুবিধা দেবার-নেবার বিষয় নয় , বন্ধুতা সব সময় এক মধুর দায়িত্ব।

▪️সংকটে-সম্পদে সকল পরিস্থিতিতে যদি তুমি বন্ধুকে না বোঝো তাহলে কখনোই তুমি তাকে বুঝতে পারবে না।

▪️তোমার উজ্জ্বলতম সাজ-পোশাকটি অন্য একজনের বোনা।

▪️তোমার জীবনের সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার সে-খাবার যা তুমি অন্যের খাবার টেবিলে বসে খাও।

▪️তোমার সবচেয়ে আরামপ্রদ শয্যা অন্যের ঘরে।

▪️তাহলে এখন বলো, ঠিক কীভাবে অপর থেকে তুমি নিজেকে আলাদা করতে পারো?

খলিল জিবরান

১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে লেবাননে জন্মগ্রহণ করা এ-কবি তাঁর জীবনের সিংহভাগ সময় কাটিয়েছেন অ্যামেরিকায়। প্রতীকবাদী ধারার একজন শিল্পী হিসেবে সাফল্য লাভের পাশাপাশি তিনি আত্মার উৎকর্ষের জন্য লেখালেখির অন্তর্গত তাগিদ অনুভব করেন। ম্যারি হ্যাসকেলের উদ্দীপনা জাগানো পৃষ্ঠপোষণা তাঁকে যারপরনাই অনুপ্রাণিত করেছিল। তারপর ধীরে ধীরে তিনি আজকের দিনের মরমী পুরুষ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেন। তাঁর বিশ্ববীক্ষণের প্রাঞ্জলতা তাঁকে বিশ্বপাঠকদের কাছে প্রিয় করে তুলেছিলো। এবং অ্যামেরিকার জনপ্রিয় সংস্কৃতিকে তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। জিবরানের জীবন দর্শনের সারাৎসার ফুটে ওঠেছে তাঁর প্রতিনিধিত্বমূলক বই The Prophet-এর ছত্রে ছত্রে। সামন্ততান্ত্রিক উৎপীড়ন, উগ্র পুরুষবাদিতা এবং ধর্মীয় কপটতার অস্বীকৃতি তাঁর সমস্ত লেখালেখিজুড়ে অনুরণিত, ধ্বনিতপ্রতিধ্বনিত।

নির্বাসনের বিষয়াদি পৌনঃপুনিক উচ্চারিত হয়েছে তাঁর রচনায়। লেবাননের পর্বতসমূহ তাঁর লেখালেখিজুড়ে একটানা প্রতিধ্বনিত। নিজ বাসভূম হতে উৎপাটিত হবার মর্ম-যাতনা জিবরানকে আলোড়িত করেছে জীবনভর। অ্যামেরিকায় বসবাসরত লেবানিয় এবং বিভিন্ন আরব সম্প্রদায়ের মানুষেরা জিবরানের যে-সব দিনলিপি প্রকাশ করেছে তাতে তাঁর জীবনের শেষপাদের নানান ঘটনা-দুর্ঘটনা, চিন্তা-অভিজ্ঞতার কথা নিরাভরণ সৌন্দর্য ও অসামান্য সারল্যে প্রকাশিত হয়েছে। মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৩১ সালে মহাপ্রস্থানের পথে চলে গেলেন জিব্রান। দুনিয়াময় ভক্ত পাঠকের মাঝে একজন স্বাপ্নিক কবি, অনন্য চিত্রশিল্পী ও মরমী দার্শনিক হিসেবে তিনি আজও বেঁচে আছেন প্রবল প্রতাপে।


মুজিব রাহমান : সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন