স্মৃতি
নূতন জনম দাও হে…
ড. শিরীণ আখতার।। পুবাকাশ
তখন ১৯৮৬ সাল। খ্যাতিমান রবীন্দ্রসঙ্গীতের অসংখ্য গানের স্বরলিপিকার শৈলজারঞ্জন মজুমদার শান্তিনিকেতন থেকে চট্টগ্রামে এসেছিলেন প্রবর্তক সংঘের আয়োজনে। ছবিতে সর্ব ডানে রয়েছেন কবি অরুণ দাশগুপ্ত। মাঝখানে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের পেছনে আমি। তার পাশে রয়েছেন কবি আবুল মোমেনের শাশুড়ি মা ও শ্যালিকা শিপ্রা। শৈলজারঞ্জন মজুমদার তখন বলেছিলেন যে,
‘শুদ্ধ করে রবীন্দ্র সংগীত চর্চা করতে হবে এবং আমি বারবার রবীন্দ্রসঙ্গীতের আয়োজন দেখতে আপনাদের কাছে আসবো।’
অরুণদার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল এক বর্ষণক্লান্ত দিনে। আমার মেয়ে তখন পড়তো ফুলকি স্কুলে। স্কুল থেকে মেয়েকে নিয়ে এনায়েত বাজার দিয়ে যখন আসছিলাম তখন ভারি বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছি। অরুণদার বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। অরুণদা তখন অস্থির হয়ে আমাদের মা-মেয়েকে ভেজা শরীর মোছার জন্য তোয়ালে দিলেন। সেই বাড়ির দোতলায় ছিলেন অরুণদার মা এবং তার মাসিরা। তারা আমার ছোট্ট মেয়েটিকে খুব আদর করতেন।
আমার সাহিত্যকর্মে অরুণদা আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি ছিলেন সাহিত্য জ্ঞানে পরিপূর্ণ একজন মানুষ। প্রবন্ধের ভাষা ও সাহিত্যের ভাষা যে এক নয় তা এই গুণী মানুষ আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন। আমি যখন ভারতে পিএইচডি ডিগ্রির গবেষণা করছি তখন আমার গবেষণাপত্রের লেখার ধরণ কেমন হওয়া উচিত তার ধারণা তিনি দিয়েছিলেন। গবেষণাপত্রের শুরুর দিকের অনেকগুলো পৃষ্ঠা তিনি দেখে দিয়েছিলেন এবং সংশোধন করে দিয়েছিলেন। আমার গবেষণাপত্রের সুপারভাইজার ছিলেন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব শিক্ষক রশিদ আল ফারুকী। কবি অরুণ দাশগুপ্তই আমাকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। অরুণদারা চট্টগ্রাম ‘সাহিত্য পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। যেখানে সাহিত্য সম্পর্কিত আলোচনা হতো। আমার ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে আমি সেই সভাগুলোতে । অরুণদাকে দেখলেই আমার মেয়ে তাঁর কোলে গিয়ে বসেতো। আমার কন্যাকে অরুণদা অত্যন্ত স্নেহ করতেন। আমি আমার গবেষণাকাজে অরুণদার বাসায় যেতাম এবং তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরী থেকে বই পত্র সংগ্রহ করে নোট করতাম। তিনি দুষ্টুমি করে আমার মেয়েটিকে বলতেন বিদেশি শিশু। আর বলতো আমার আসল মা একেবারে গর্ভধারিণী মা। আমি যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন তাঁর সহযোগিতা ছিল সবচাইতে বেশি। তাঁর আত্মীয় স্বজন অনেকেই থাকতেন কলকাতায়। সেই আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমেই আমি কলকাতার রাস্তাঘাট চিনি এবং সবচাইতে আনন্দময় সময় কাটে শান্তিনিকেতনে। আমার মনে পড়ছে একবার শান্তিনিকেতনে গিয়েছি। সঙ্গে ছিল আমার শিশুকন্যাটি। যদিও সে ছিলো একটু ঘুমকাতুরে। তবুও ভোর পাঁচটায় উঠে ঠান্ডা পানিতে গোসল সেড়ে প্রভাত আয়োজনে আমার সঙ্গে যুক্ত হতো নিয়মিত। সেই ভোর পাঁচটায় যখন গোসল সেড়ে আমরা অনুষ্ঠানে যেতাম তখন আমার মেয়ে বলতো,
‘আচ্ছা মা এখানে সবাই কি সকালে সুগন্ধি মেখে আসে? এত সুন্দর গন্ধ আসে কোথা থেকে? শান্তিনিকেতনের পরিবেশ ছিল সবুজ বনানী ও ফুলে ঢাকা। আমি তাকে বলতাম মামনি এগুলো ছাতিম ফুলের গন্ধ।
শান্তিনিকেতনের পথ ধরে হাঁটলেই আমার কেবল মনে পড়তো এই পথ ধরেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাঁটতেন। এই সেই চেনা পথ- এই সেই রাস্তা। আমার হৃদয়ে তখন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য এবং সৃষ্টির বিস্ময় দোলা দিয়ে যেতো বার বার। শান্তিনিকেতনের যে পরিবেশ, গাছপালা, মানুষজন, ফুল-ফল সবকিছুই ছিল আমার কাছে এক অনুভূতির জায়গা। আমি অভিভূত হয়ে পড়তাম ।
‘জীবন এই সুন্দর স্মৃতিগুলো আমার জীবনে অক্ষয় হয়ে আছে। সেই সাথে অরুণ দার সাথে আমার সব স্মৃতি মনে পড়ছে বার বার। আমার জীবনের যে অর্জন তাঁর অনেক কিছুতেই আমি ঋণ স্বীকার করছি প্রয়াত কবি অরুণ দাশগুপ্তের প্রতি।
তিনি ছিলেন একজন অকৃতদার মানুষ। পৃথিবীর সকল মানুষকে কাছে আনার জন্যই তিনি ছিলেন চিরকুমার। আমরাই ছিলাম তাঁর সন্তান সন্ততি। তিনি যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন আমি তাঁকে দেখতে যেতে চেয়েছিলাম। তিনি আমার সাথে ফোনেকথা বলেছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘তুই কষ্ট করে আসিস না। আমি সুস্থ হই তোর সঙ্গে দেখা করতে আসব।’
তিনি চলে গেলেন এই মায়াময় পৃথিবী ছেড়ে। আমরা তাঁর মত একজন মানুষ আর হয়তো কোনদিন ফিরে পাব না। অরুণের মত দীপ্ত অরুণ, অরুণ হয়ে আর ফিরে আসবেনা।
তাই কবিগুরুর কথায় বলতে চাই-
ভয় হতে তব অভয় মাঝে নূতন জনম দাও হে ।।
দীনতা হতে অক্ষয় ধনে, সংশয় হতে সত্যসদনে,
জড়তা হতে নবীন জীবনে নূতন জনম দাও হে ।।
আমার ইচ্ছা হইতে, প্রভু, তোমার ইচ্ছামাঝে-
আমার স্বার্থ হইতে, প্রভু, তব মঙ্গলকাজে-
অনেক হইতে একের ডোরে, সুখদুখ হতেে শান্তিক্রোড়ে-
আমা হতে, নাথ, তোমাতে মোরে নূতন জনম দাও হে ।।
ড. শিরীণ আখতার : উপাচার্য : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।