শ্রদ্ধার্ঘ্য
আল মাহমুদ : বঙ্গনাম্নী বৈষ্ণবীর সঙ্গী
মজিদ মাহমুদ।। পুবাকাশ
পাকিস্তান পর্বে, ঢাকা যখন বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, যখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে গ্রামীণ মধ্যবিত্তের শিক্ষার সুবিধাপ্রাপ্ত তরুণেরা নানা ফিকিরে রাজধানীতে জড়ো হচ্ছিল, যখন তাদের আত্ম-পরিচয়ের সংকট প্রবল হয়ে উঠছিল, যখন পাকিস্তানি আশীর্বাদ পুষ্ট এলিট ও নিম্নবর্গের বাঙালিদের ফারাক দ্বন্দ্বে পরিণত হচ্ছিল- ঠিক তখন নজরুলের মতো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-বঞ্চিত এক তরুণ বাঙালির ভাষাগত অভিজ্ঞতা, শ্রম ও সংঘের ইতিহাস নিয়ে হাজির হলেন। মার্কুইস গার্ভেই যেমন রাস্টাফেরিয়ানদের বাণী নিয়ে এসেছিলেন। মার্কুইস যেমন বলেছিলেন- আফ্রিকা তাদের দেশ- তাদের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অনুপ্রেরণা। এই তরুণও শহরে সদ্য গেড়ে-বসা মানুষের মুখ ঘুরিয়ে দিতে চাইলেন গ্রামের দিকে।
গ্রামীণ জীবনে একদিন যারা নিজেদের পরিচয় রেখে রাজধানীতে এসেছিলেন, পিতাদের শ্রম ও প্রার্থনার ভাষা যারা ভুলতে বসেছিলেন, যাদের স্মৃতিতে তখনো ভাস্কর ছিল প্রাইমারি স্কুলের বারান্দায় রোরুদ্যমান সহপাঠিনী- ঠিক তারা অকস্মাৎ টের পেলেন তাদের নিজস্ব কণ্ঠস্বর। সেই কণ্ঠস্বর রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপ থেকে উঠে আসা নিম্নবর্গে মানুষের প্রতি সহমর্মিতা নয়, নজরুলীয় বিপ্লবের দ্বারা সকল অত্যাচার দূরীকরণের নয়, তিরিশের কবিদের তো নয়-ই, রূপসী বাংলার নৈর্ব্যক্তিক একাকীত্ব থেকেও অনেক দূর- এমনকি আমাদের চিরচেনা পল্লী-কবির সাজু-দুলি-রূপাইয়ের মিল তার সঙ্গে সামান্য।
এতকাল বাংলা কবিতায় যে পল্লী-চর্চা হয়েছিল সেখানে কবি ছিলেন অন্য বর্গের। সেই সব কবি ছিলেন তাদের সুখ-দুঃখের প্রতি সহমর্মী, তাদের জীবনের অভিজ্ঞতার প্রতি অনুরক্ত থেকে শহর শিক্ষিতের কাছে, কিংবা তাদের নিজ শ্রেণির কাছে শৈল্পিকভাবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারেন জসীমউদ্দিন- অসুস্থ শিশুর পাশে বিনিদ্র পল্লী-জননী, বৃদ্ধ কৃষকের স্বজন হারানোর হাহাকার, ফেরারি স্বামীর পথ চেয়ে গ্রাম্যবধূর নকশি কাঁথা বুনন- অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে সে সব বর্ণনা করেছেন তিনি। কিন্তু এসব চরিত্রের সঙ্গে কবির প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততার প্রকাশ ঘটেনি। কবি তাদের জানেন কিন্তু কবি তাদের বর্গের লোক নন। কবি এখানে কেবলি মহাকাব্য কিংবা ট্র্যাজেডির রচয়িতাদের মতো চরিত্রের নির্মাতা। আল মাহমুদ-ই প্রথম কবি- যিনি এ সবের ধারের কাছে গেলেন না। করলেন না গ্রাম শহরের ফারাক। তৈরি করলেন না কাহিনিকাব্যের চরিত্র। তাঁর জরাজীর্ণ স্মৃতি ও শব্দগুলো ছেঁড়া কাঁথার মতো জড়িয়ে ধরে তিনি রাজধানীর বুকের উপর দিয়ে হাঁটতে থাকলেন।
শহরের বন্ধুদের কাছে কি সব চিরপরিচিত গল্প বলতে লাগলেন! জানিস, আমি যখন ঢাকা থেকে বাড়ি যাচ্ছিলাম- আমাকে দেখে তো তারা রীতিমত অবাক- ‘সস্নেহে বলল, বসে যাও, লজ্জার কি আছে বাপু, তুমি তো গাঁয়েরই ছেলে বটে, আমাদের লোক তুমি। তোমার বাপের মারফতির টান শুনে বাতাস বেহুশ হয়ে যেতো। পুরনো সে কথা উঠলে এখনো দহলিজে সমস্ত গাঁয়ের লোক নরম নীরব হয়ে শোনে।’ কিন্তু জানিস আমি না তাদের কাছে বসতে গিয়ে কি মুস্কিলেই না পড়ে গেছি- ‘নগরের নিভাজ পোশাক খামচে ধরেছে হাঁটু। উরুতের পেশি থেকে সোজা অতদূর কোমর অবধি।’ আমার মনে হয় কি জানিস, এসব প্যান্ট-ফ্যান্ট বানানো হয়েছে মূলত নিজেদের লোক থেকে দূরে রাখার জন্য। সব উপনিবেশিক বুজরুকি।’
আল মাহমুদ নিজেই এই গল্পের চরিত্র- দুই পাশে দুই ধরনের শ্রেণি বিন্যাস- একদিকে গ্রামীণ কর্মযজ্ঞ- সহজ সরল উৎপপদক শ্রেণি, অন্যদিকে শহুরে এক নিস্কর্মা যুবক। যদিও ‘খড়ের গম্বুজ’ কবিতার যুবক নিজের কাছে প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন- ঠাণ্ডা ধানের বাতাসে বসার, হুকোতে সুখটান মারার কিংবা কুহলি পাখির পিছু পিছু পানের বরোজ পর্যস্ত যাওয়ার। কবির এই অঙ্গীকারের সত্যাসত্য তর্ক সাপেক্ষ; উৎপাদক শ্রেণির প্রতি কবির সমর্থন সাধুবাদ পেতে পারে; কিন্তু উপনিবেশ আর উপনিবেশিতের চরম সম্পর্ক এমন করে আর কে দেখিয়ে দিয়েছেন যে,- ‘সম্পূর্ণ যুবক যেনো বন্দি হয়ে আছে নির্মম এক সেলাইয়ে।’ সভ্যতার এই মেকি সত্যাসত্য দিয়ে আমরা আজ মানুষকে কিভাবে বিভাজন করবো?
কবিতা নিয়ে একটি তর্ক আমার মনে হয় আজ শেষ হয়ে যাওয়া ভালো- তাহলো কবিতা বেঁচে থাকার শক্তি কোথায়? তার দেহে না আত্মায়? বিষয়ে না অঙ্গ-সৌষ্ঠবে? কবিতার শরীর নির্মাণের ক্ষেত্রে অলঙ্কার শাস্ত্রের অনেক দাবি আছে। কিন্তু অলঙ্কার কি কবিতা- ছন্দ শব্দ অলঙ্কারের কোনটাই যেমন কবিতা নয়- তেমনি বিষয়ও কবিতা নয়। সেই পুরোনো গল্পের মতো- গ্রিক রাজা মিলান্দর এলেন বৌদ্ধমুনি নাগসেনের কাছে। নাগসেন জানতে চাইলেন- রাজন, কিভাবে এলেন। মিলান্দর বললেন, রথে। মুনি জানতে চাইলেন রথ কি? রাজা বললেন, ঘোড়া চালিত শকট। কিন্তু ঘোড়া ও শকট কেউ আলাদা আলাদা ভাবে রথ নয়। আবার এর কোনটা ছাড়া রথের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। তেমনি কবিতার বিষয় আঙ্গিক ব্যবচ্ছেদ করলেও প্রকৃত কবিতার অস্তিত্ব কবির সংবেদনশীল মনে।
প্রকৃতপক্ষে কবিতা পাঠক এসব জানতে চায় না। পাঠক জানতে চায়- কবিতাটি তার কোনো একটি সুপ্ত চেতনাকে জাগ্রত করতে পেরেছে কিনা? তার জীবনের কোনো একটা ব্যথা প্রকাশ ও উপশমের ভাষা হিসেবে ক্রিয়শীল কিনা? তার সংগ্রাম ও সংঘে কবিতাটির প্রয়োজন আছে কিনা? আর এই প্রয়োজন যে কবিতা মেটাতে পারে, তার ছন্দ ও ভাষা অনিবার্যভাবে তার দেহের সীমা অতিক্রম করে যায়। আল মাহমুদ যখন বলেন, ‘কবিতা এমন’- তখন আমাদের নগর রুচির প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও না মেনে উপায় থাকে না- কবিতা তো ‘ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেড়া হারানো বাছুর।’ জানি না আল মাহমুদের কবিতার এই সংজ্ঞা আর কতদিন সত্য বলে মান্য হবে? সত্য বলে মান্য হওয়া উচিত কিনা- সেটি তর্ক সাপেক্ষ। কিন্তু যে কারণে চর্যার কবিদের ‘টালত মোর ঘর নাহি পরবেষী’ – ইতিহাসের উপাদান হয়ে আছে। তেমনি, চিরকালীন ইতিহাসের উপাদান থেকে কবিতার এই সংজ্ঞাকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না।
আল মাহমুদ তাঁর বয়ানের কাছে দুর্দমনীয় কর্তৃত্বপরায়ন। নিজের গ্রামীণ উত্তরাধিকারকে প্রতিষ্ঠা করতে চান নগর-তোরণে। কারণ তিনি জানেন, এ সভ্যতার মর্মমূলে মাটি নেই। তিনি রাস্টাফেরিয়ানদের মতো নগরে ঘুরে ঘুরে শ্রম ও সংস্কৃত-উন্মূল মানুষের কাছে ফেলে আসা পিতৃভূমি ও নিজের জাতের তুচ্ছ ঘটনাবলী অবলীলায় তুলে ধরেন। অথচ তাঁর দিকে দৃষ্টি না ফেরানোর উপায় থাকে না।
আল মাহমুদ আমাদের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের কবি- যখন বাঙালি জাতির আত্ম-পরিচয়ের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। যখন ‘অতিতকে বাদ দিলে আজ তার কোনো কিছু নেই।’ তখন ‘শ্রীজ্ঞানের জন্মভূমি এই শীলভদ্র নিয়েছিল নিঃশ্বাসের প্রথম বাতাস।’ পাকিস্তান পর্বে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা- যে চেতনা সংগঠিত হয়েছিল প্রথমত বণিক ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এলিট শ্রেণী দ্বারা- সেই আন্দোলনকে মাটি সংলগ্ন করার জন্য তার বিশাল গ্রামীণ জীবনের পটভূমিকার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল; আল মাহমুদ ‘সোনালী কাবিন’-এ সেই নির্মিতির কাজটি করেছিলেন।
একজন চারণ কবির মতো প্রেরণাকে ভর করে একের পর এক বয়ান করলেন তাঁর স্বদেশ ও স্বজাতির কথা। জর্জ টমসনের ‘মার্কসিজম এন্ড পয়েট’-এর মতো বলতে হয়, ‘যুবকেরা তার চারিদিকে ভিড় করে দাঁড়ালো। তাদের তিনি বীরগাঁথা শোনাতে বাধ্য হলেন। তার গান ছিল গলার জোর আরোপ করে বের করা সুর, গানের চেয়ে বরং ঘর্ঘর শব্দের মতোই। কিন্তু যতই সে উত্তেজিত হয়ে উঠতে থাকলো ততই তার টোকাগুলো হয়ে উঠল চঞ্চল। বর্ণিত যুদ্ধ যতই তীব্র হয়ে উঠতে থাকল, গায়ক ও তার যুবক শ্রোতাদের আবেগও তত তীক্ষ্নতর হয়ে উঠতে লাগলো।’ আল মাহমুদ তখন তাঁর তরুণ যোদ্ধাদের সমর কৌশল আর সৈন্য মোতায়েনের কথা জানিয়ে দিলেন। বললেন-
‘আমাদের সঙ্গে এক বাউলের বিধবা যাবেন/ উষ্ণ বয়সিনী এই বঙ্গ নাম্নী বৈষ্ণবীটি ছাড়া/ তৃষ্ণার রাস্তায় আর অন্য কোনো যুবতী যাবে না।’ এমন নিস্কাম বাক্য এমন উপায়ে এর আগে আর কে বলেছিলেন? এমন কামময় জীবনে দেশ প্রেমের জান্তব বাণী- ‘বঙ্গ’ নাম্নী বৈষ্ণবী ছাড়া আর কোনো যুবতী যাবে না। কেবল চর্যার কাহ্নপার- ‘আলো ডোম্বি তোএ সম করিবে ম সাঙ্গ’-এর সাথে কেবল তুলনা হতে পারে।
আল মাহমুদ তাঁর স্বদেশ চেতনাকে দেখেছেন- হাজার বছর ধরে গ্রামীণ জীবনের উৎপাদক শ্রেণিকুল যেমন তার নারীকে, ভূমি ও কৃষি উৎপাদনকে, সন্তান ও গবাদি পশুকে যেমন জীবনের অবিচ্ছেদ্যতার মধ্যে দেখেছেন- তেমন করে। আল মাহমুদের বিষয় বর্ণনার ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় কামজ চেতনা আধুনিক রুচির কাছে প্রশ্নের উদ্রেক করতে পারে, কিন্তু তার জন্য কবি দায়ি নন। কৃষিভিত্তিক সমাজের ভাষা ও প্রকাশের সঙ্গে নগর কেন্দ্রিক সভ্যতার দূরত্ব এর জন্য দায়ি।
আল মাহমুদ যে সব কারণে বাংলা কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ- এ আলেচনায় তার দু’একটি ইঙ্গিত দেয়া যেতে পারে। হাজার বছরে আমাদের কাব্যপাঠের যে অভিজ্ঞতা তাতে আল মাহমুদ-ই ব্যাপকভাবে কবিতায় শহর ও নগর জীবনের পার্থক্য ঘুচিয়ে দিয়েছেন। তাঁর কাব্য নির্মাণের পথে তাঁর কোনো প্রবল পূর্বসূরি নেই।
তিনি নাগরিক জনরুচির কাছে তুলে ধরেছেন গ্রামীণ নিম্নবর্গীয় শ্রম-শ্রেণির মানুষের জীবন যাপনের প্রণালী। তাদের প্রেম-কাম-শ্রম ও ঘামের গন্ধ- আরুস্তু কথিত নাগরিকদের ড্রয়িং রুম পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পেরেছেন। তাঁর কবিতার প্রতিটি শব্দ শব্দশ্রমিকের মতো সজীব কর্মতৎপর ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
এখানে একটি কথা বলতে হয়, প্রাণিজগতের অন্যপ্রাণী থেকে মানুষের আলাদা হবার অন্যতম প্রধান কারণ, তাকে বস্তুর বাইরে ভিন্ন এক ভাষার জগতে বাস করতে হয়। তার চারপাশে তার জাতির যে অসংখ্য শব্দরাজি ভেসে বেড়ায়- এমনকি তার চঞ্চুর মধ্যে যে শব্দগুলো অর্থবহ রূপ পায়- তা-ই মূলত একটি জাতির পরিচয়ের সূত্র।
বাঙালি জাতির যে ধারণাটি আমরা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি তা নিঃসন্দেহে তার ভাষা কেন্দ্রিক; আর ভাষার সামগ্রিক অস্তিত্ব অবশ্যই কেবল সমকালীন নয়। একটি ভাষাগোষ্ঠী বিলুপ্ত হলেও সেই ভাষার স্ক্রিপ্ট ও স্ক্রিপচার থেকে সেই জাতির পরিচয় পুনর্নির্মাণ করা যায়। জৈব-জীবনের মধ্যে মানুষের জীবন সীমাবদ্ধ; কিন্তু ভাষার জীবন সেই ভাষাগোষ্ঠীর সমান বয়সী। আজকে বিশেষ করে মানব জাতির ইতিহাস নির্মাণের যে কৌশল- কেন্দ্রের অফিসিয়াল ভাস্যের বাইরে থেকে তার ভাষা ও সাহিত্যের উপাদান থেকে কর্মময় মানুষের কোলাহল তৈরি করা। আল মাহমুদের কাব্যভাষায় একটি জাতির হাজার বছরের ক্রিয়াভিত্তিক শব্দরাজি পরম সফলতার সঙ্গে ধরা দিয়েছে- যা থেকে হাজার বছরের বাংলাদেশের বাঙালির একটি ইতিহাস পুনর্গঠিত করা যায়।
আল মাহমুদের কবিতা ভবিষ্যতে সাবঅলটার্ন ইতিহাস রচয়িতার কাছে অতিব মূল্যবান হবে- সে কথা এখন বলা যায়। তাছাড়া আল মাহমুদের কবিতার আরেকটি গুরুত্বের দিক- গ্রাম ও নগরের মিথস্ক্রিয়ার ফলে উদ্ভূত মানসিক সংকট কালে- গ্রাম ও শহরের- উভয় অংশের মানুষের যোগাযোগের ক্ষমতা-সম্পন্ন ভাস্য তৈরি করা।
শহর যখন গ্রামের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল শহরে আগত তরুণদের পিতামাতা তখনো গ্রামে বাস করছিল, কিংবা পিতার কবর জেগে ওঠা চরের পিঠের মতো আশ্রয় নিয়ে জেগে ছিল- তখন আল মাহমুদের কবিতা যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে দারুণ কাজ করেছিল। পূর্ব পুরুষের পেশা ও ভাষার লজ্জা থেকে তারা মুক্তি পেয়েছিল।
আজকে রাজধানী কেন্দ্রিক বাঙালি-আনার যে ধারা পরিপুষ্ট হচ্ছে তার গ্রামীণ উত্তরাধিকার হারিয়ে যাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক সমাজের কাঠামো খুব অল্প-ই পরিবর্তন হয়েছে। কারণ, রাজধানীর পরিপূর্ণ জনঘনত্ব- গ্রাম থেকে সহজে কাউকে আসতে দিচ্ছে না। আসলেও তারা মারাত্মক সংখ্যালঘু। আর রাজধানীতে যে সব তরুণ বেড়ে উঠছে তাদের গন্তব্য অন্য দেশের রাজধানী। তাদের অনেকে ভুল উচ্চারণে বাংলা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। বাংলার প্রতি তারা অনেকেই মাতৃত্বের আবেগ হারিয়ে ফেলছে। তাদের মাদের অনেকেই আজ খাঁটি বাঙালি মা নয়। যদিও যৌবনে আল মাহমুদ গ্রামের কালো কৃষকদের এনে রাজধানী অবরোধ করতে চেয়েছিলেন। আল মাহমুদ নিজেও সে চিন্তার জায়গা থেকে সরে গিয়েছিলেন। কারণ, তিনি নিজেও এখন অনেক শহুরে তরুণের পিতা হয়তো পিতামহ। তাদের শাহরিক বাস নিশ্চিত করতে তারও হাপিত্যেশ। এর ভালো-মন্দের মীমাংসা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়।
তবু আল মাহমুদকে নিয়ে এতক্ষণ যে আলোচনা করা হলো তার অপর পিঠ নিয়ে দু’একটি কথা না বললে- এ আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সাহিত্যের নির্মম ইতিহাসের পাতায় হাতে গোনা যে ক’জন কবির নাম উৎকীর্ণ হয়ে থাকবে বলে অনুমান করা যায়- আল মাহমুদ তাদের অন্যতম প্রধান। ফলে ইতিহাসের প্রতি আল মাহমুদের দায় অনেক বেশি। রবীন্দ্রনাথকে যেমন সামন্ত চরিত্রের জন্য, প্রতিভাবান বঙ্কিম-শরচ্চন্দ্রকে সাম্প্রদায়িক মন্তব্যের জন্য যেমন সকল ভালোত্বের মাঝেও ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। এজরা পাউন্ড এমনকি গুন্টারগ্রাস যেমন তাদের কর্মের দায় এড়াতে পারেন না। আল মাহমুদও কিছু সিদ্ধান্তের জন্য ইতিহাসে সমালোচিত হবেন। তাঁর মতো বাঙালির প্রতিভাবান সন্তান ইঁদুর দৌড়ের দোহাই দিয়ে সব কিছু জায়েজ করতে পারেন না।
আজ এদেশের ইতিহাসের সত্যে বখতিয়ার যেমন অনিবার্য, পাল ও সেন রাজন্যরাও অপর নন। বখতিয়ারের সমসাময়িক ঐতিহাসিক মিনহাজ-উস-সিরাজ তাঁর ‘তাবাকাৎ-ই- নাসিরি’তে এ কথা বলতে ভোলেন নি যে, লক্ষণ সেন শান্তিপ্রিয় ও দয়াদ্র শাসক ছিলেন- এমনকি তিনি তাঁর জন্য আল্লাহ’র দরবারে নাজাত কামনা করেছেন। কবি আর যা-ই করুন মসনদের ইতিহাস লিখবেন না। সব দেশে সব কালে গরীব, নির্যাতিত, প্রান্তিক, সংখ্যালঘু ও ভালনারেবল জনগোষ্ঠীর কথা কবি ছাড়া আর কে বলবেন? আল মাহমুদের চেয়ে এ কথা বাংলা কবিতায় আর কে-ই বা ভালো করে জানতেন! আর কে-ই বা এমন লিখেছিলেন-
‘পূর্ব পুরুষেরা কবে ছিল কোন সম্রাটের দাস
বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোয়াড়,
সেই অপবাদে আজো ফুঁসে ওঠে বঙ্গের বাতাস।’
মজিদ মাহমুদ: আশিদশকের খ্যাতিমান কবি ও চিন্তক।