আলীগড় দর্শন

নাসির উদ্দিন আহমদ

ইতিহাস ছুঁয়ে দেখার বাসনা দিন দিন প্রবলতর হচ্ছে। ইতিহাসের কাছ থেকে অনেক গল্প শুনা যায়—অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়। আর ভারতের পরতে পরতে যেন ইতিহাস।পরিকল্পিতভাবেই আজ সকালে আমাদের যাত্রা আলীগড়ের পানে। ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশ—যেখানে বিশ কোটি লোকের বসবাস।সেখানকার এক জেলা শহর আলীগড়—বলা হয় ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় নগর।দিল্লী থেকে উত্তর প্রদেশের দিকে কিছুদূর গেলেই যমুনা এক্সপ্রেস হাইওয়ে। চলে গেছে সোজা আগ্রায়। আট লেইনের রাজপথ। দুপাশে সারিবাঁধা ফুলের গাছ। ঝোঁপের মতো গুল্মের সারি। মাঝখানেও—যাকে বলি ডিভাইডার সেখানেও ফুলের গাছ—ফুটে আছে রঙিন ফুল। পিচ ঢালা রাস্তা—মসৃণ। এই হাইওয়েতে কিছুদূর যেতেই বামে চলে গেছে আলীগড় রোড। এটি হাইওয়ের মতো প্রশস্ত নয়। কিছুটা সংকীর্ণ রাস্তা। সংস্কারের কাজ চলছে। মাঝে মাঝে জীর্ণ—ভাঙা-চোরা। আমরা ট্যাক্সি চেপে যাচ্ছি আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। উদ্দেশ্য—ঐতিহ্যবাহী এই বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখা আর সাথে কিছু দর্শনীয় স্থান। ছুটির দিনকে কাজে লাগানোর কোশেশ আর কি! রাস্তায় মহিষের গাড়ি, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, ট্রাকটর।পথে পথে শুয়ে আছে গরু। রাস্তার দুই ধারে গম ক্ষেত, হলুদ সরিষা ক্ষেত, সব্জী বাগান। আখ মাড়াই চলছে পথে পথে। মেশিনে চিপড়ে রস বের করা হচ্ছে।বাজারে আখের গুড়, মোটা টালীর মতো, ওজোনে দুই কেজির মতো হবে এক একটি পাটালী গুড়ের। বুঝা গেল এই রস থেকেই এখানে তৈরী হয় গুড়। মাঝে মধ্যেই বাজার। পথে পথে বাদাম। গরম বাদাম বিক্রী হচ্ছে। পথে নেমে বাদাম কিনলাম। খুবই সস্তা বিশ টাকায় আড়াই শ গ্রাম। বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠ। চারজন মিলে গল্প করতে করতে যাচ্ছি বলে মনে হলো পথ বুঝি তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেলো। নজরে এলো আলীগড় শহর।

আলীগড় এক সময় বিখ্যাত ছিলো আলীগড় আন্দোলনের জন্য। এই আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন স্যার সৈয়দ আহমদ। ভারত পিতা মহাত্মা গান্ধী তাঁর সম্পর্কে বলেছেন—Sir Saiyad was a prophet of education।

তাঁর ধ্যান-জ্ঞানে ছিলো বিশেষত তদানিন্তন পশ্চাদপদ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানে শিক্ষিত করে তোলা। ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত করে অনগ্রসর জাতিকে সামনের সারিতে নিয়ে আসা। ১৮৫৭ সালের সিপাহী-বিপ্লবের পর তিনি গভীরভাবে অনুভব করলেন এই অংশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর দুরাবস্থা। তিনি নেমে গেলেন মহান ব্রতে। ১৮৫৯ সালে মুরাদাবাদে প্রতিষ্ঠা করলেন গুলশান স্কুল। এর চার বছর পর আলীগড়ের পাশেই গাজিপুরে স্থাপন করলেন ভিক্টোরিয়া স্কুল। ১৮৭৫ সালে
আলীগড়ে স্থাপন করলেন মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ যা পরবর্তীতে আত্মপ্রকাশ করে আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি হিসেবে। তাঁর এই তাবৎ কর্মকান্ডই মূলত আলীগড় আন্দোলন যা ভারতীয় উপমহাদেশে এক নূতন রেনেসাঁ আন্দোলনের মতোই। বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান ভারতের প্রথম তিন-চারটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়র একটি। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ranking-এ যা কয়েশত ধাপ এগিয়ে।

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল তোরণ দিয়ে ঢুকছি। মনের মাঝে এক অন্য রকম অনুভূতি। নিরিবিলি পরিবেশ। গাড়ির হর্ণের শব্দ নেই। গাছপালায় ঠাঁসা—সবুজ। বিশাল ক্যাম্পাস। কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ অল্প সময়ে ঠাওর করাও মুশকিল। ছত্রিশ শত একরের বেশী জায়গা জুড়ে এর বিস্তৃতি। চল্লিশ হাজারেরও বেশী ছাত্র-ছাত্রীদের পদচারণায় মুখরিত ক্যাম্পাস। এক একটি ফ্যাকাল্টির আলাদা আলাদা বিল্ডিং। এক নজরে ঘুরে দেখা। আমাদের মূল টার্গেট দুটো জায়গা খুব ভালো করে দেখব। প্রথমত জওহরলাল নেহরু মেডিকেল কলেজ—যা মূলত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ফ্যাকাল্টি—ক্যাম্পাসের ভিতরেই। আর দ্বিতীয়ত মওলানা আজাদ লাইব্রেরী। আর বাড়তি প্রাপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জামে মসজিদ। তবে একটি আশ্চর্যের ব্যাপার এখানে বলে রাখি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো এলাকায় মসজিদের সংখ্যা কিন্ত সাঁইত্রিশটি।

বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞান চর্চার সর্বোচ্চ উঠোন-আঙিনা। জ্ঞান-গবেষণা এখানে মূখ্য। বাংলাদেশের মতো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালগুলোতে কোন চিকা-মারা নেই। কারো কোন শ্লোগান নেই। তবে এর মূল তোরণে একটি শ্লোগান আছে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের—আল্লামাল ইনসানা মা লাম ইয়ালাম। এর অর্থ মানুষকে তিনি শিখিয়েছেন যা সে জানতো না। জ্ঞানের বিচরণ—জ্ঞানীদের বিচরণ এখানে।

গাড়িতে করেই ঘুরছি। বিভিন্ন অনুষদ গাড়ি থেকে নেমে আর দেখা হলো না। মাইক্রোবায়োলজি-জুয়োলজি-বোটানী-ইতিহাস-ভূগোল থেকে শুরু করে থিয়োলজি-সিভিল ইন্জিনিয়ারিং-মেকানিক্যাল ইন্জিনিয়ারিং-কম্পিউটার সাইন্স সব উঠোনের সামনে দিয়ে ঘুরে এসে এক বিশাল বাগানের তোরণে থামলাম।
গুলিস্তান-ই-সাইয়িদ গেট। স্যার সৈয়দ আহমদের নামে এই পুষ্প-উদ্যান। তোরণ পেরুলেই প্রশস্ত রাস্তার দুপাশে বিশাল মাঠ—সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো। গোলাপ ফুলের বাগান। পাম গাছের সারি। রয়েছে আরো নানা জাতের রঙিন ফুল। বিকেলে এই গেট খুলে দেয়া হয়। চক্ষু আর মনের প্রশান্তি সৃষ্টির জন্য এমন উদ্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনার জন্য সত্যিই সুখকর। ভিসি ও প্রভিসির বাসভবন নজরে এলো। সামনাসামনি দুটো সাজানো গুছানো বাসভবন। উঁচু দেয়াল।ভিতরে ফুটে আছে ফুল।সবখানে একটা শান্ত-সৌম্য-কোমল অবয়ব।

এলাম মাওলানা আজাদ লাইব্রেরী দেখতে। বলে রাখি শুরুতেই—এটি এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ লাইব্রেরী।লাইব্রেবীর সামনে বিশাল চত্বর। বড় বড় গাছের সারি। বসার ব্যবস্থা রয়েছে। লাইব্রেরীর ভিতরের রুমগুলোতে পড়াশুনা চলছে। চব্বিশ ঘন্টা খোলা থাকে পাঠকক্ষ। ছুটির দিনেও বন্ধ নেই এটি। শুধু বই-এর কক্ষটি রোববার বন্ধ। ছেলে-মেয়েরা একসাথে পড়ছে। তবে শুধু মেয়েদের জন্য রয়েছে আলাদা পাঠকক্ষ। এই লাইব্রেরীতে রয়েছে আঠার লক্ষ বিভিন্ন ভাষায় রচিত বই। অনেক দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের পান্ডুলিপি এখানে রয়েছে তার মাঝে দুটো অমূল্য পান্ডুলিপির কথা না বললেই নয়। একটি চৌদ্দশ বছরের পুরনো মদিনাতুল ইলম (জ্ঞানের নগরী) হযরত আলীর (রা.)—চামড়ার কাগজে লিখিত কুফি-লিপীর একটি পান্ডুলিপি। আরেকটি জাবের ইবনে হাইযামের আরবী ভাষায় লিখিত Book of Optics এর ল্যাটিন অনুবাদ। এছাড়া মোগল সম্রাট বাবর, হুমায়ুন এবং আকবরের জারিকৃত ডিক্রীর কপি এখানে সংরক্ষিত আছে। অনেক আশা ছিলো এগুলো সচক্ষে দেখব। কিন্ত বাঁধ সাধলো রোববার। ছুটির দিনে কিতাব-ভান্ডারের দ্বার থাকে রুদ্ধ যদিও পাঠকক্ষের দ্বার কখনো বন্ধ হয় না এখানে। জ্ঞান-ভান্ডারের আশপাশে ঘুরলেও ভালো লাগে। তাই ঘুরে গেলাম এই পাঠাগার।

এবার ক্যাম্পাসের হিরন্ময় আঙিনার আরেক প্রান্তে এলাম। এখানে জওহরলাল নেহরু মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। ভারতের অন্যতম প্রধান মেডিক্যাল বিদ্যাপিঠ। যেহেতু আমরা চারজনই চিকিৎসক—এটা ঘুরে দেখার ডাক আত্মার গভীর থেকেই পেয়েছি। গাড়ির গেট বন্ধ। তবে মানুষের জন্য সীমিত গেইট উন্মুক্ত। ভিতরে ঢুকতেই প্রথমে নজরে এলো আমার স্পেশালিটি—Endocrinology বিভাগ। তবে যে প্রান্ত দিয়ে ঢুকছিলাম সেখানকার কিয়ৎ রুগ্ন-দশা মনকে আহত করেছিলো শুরুতেই। বিল্ডিং পুরণো। যত্নের অভাব দৃশ্যমান। পরিচ্ছন্ন তবে ঝকমকে নয়। ওয়ার্ডগুলোর পথে যেতে যেতে কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছিলো। কিন্ত অন্য প্রান্তে গিয়ে মনটা ভালো হয়ে গেলো। ওপিডি, গাইনী-কার্ডিওলজি বিভাগের চেহারা আসলেই চকচক করছে।

পেটে ক্ষুধা। ডক্টরস ক্যান্টিনে গেলাম। সাধারণ কক্ষেই বসে ছিলাম। ম্যানেজার আমাদের পরিচয় পেয়ে ভিতরে রক্ষিত ডাক্তারদের কক্ষে নিয়ে গেলো। চিকেন বিরিয়ানী ছিলো দুপুরের মেনু।
বিশ্ববিদ্যালয় দর্শনের পাঠ চুকিয়ে এখন আমাদের গন্তব্য আলীগড় ফোর্ট। সেখানে যাওয়ার আগে আমার মন জুড়ে এই কথাটিই অনুরণিত হচ্ছে—একদিন স্যার সৈয়দ আহমদ জ্ঞান-বিজ্ঞান-গবেষণার যে ফল্গুধারা সৃষ্টি করেছিলেন তা আজো এখানকার পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর জ্ঞান-পিপাসা নিবারণ করে যাচ্ছে। এটি না থাকলে এখানকার এই মানুষগুলোর উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্র যে কোথায় হতো আল্লাহ মালুম!

আলীগড় ফোর্ট—বহু ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ আর রাজ্য-বদলের সাক্ষী। আজ অবশ্য ভগ্ন-দশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অযত্নে-অবহেলায়।আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন শেষে সেদিকেই আমাদের যাত্রা। বলা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেশী এই ফোর্ট। দ্রুতই এলাম। পড়ন্ত বিকেল। তোরণের সামনে গাড়ি থামলো। প্রথম তোরণ দিয়ে ঢুকতেই এক ব্রীজ। এটির সাথে লোদী গার্ডেনের সম্রাট আকবার নির্মিত ব্রীজের সাদৃশ্য খুঁজে পেলাম। ইব্রাহীম লোদীর আমলেই মুহাম্মদ নামক আলীগড়ের তদানীন্তন শাসক এই শক্তিশালী দূর্গটি নির্মাণ করেন—১৫২৪-২৫ সালে। সাবিত খান নামক আরেক শাসক পরবর্তীতে এর সংস্কার সাধন করেন। দূর্গটির হাত বদল হয়েছে বার বার। ১৭৫৯ সালে গোয়ালিয়রের মারাঠা শাসক মাধব রাও এই দূর্গটিকে দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেন। তিনি এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য সমাবেশ করেন ইউরোপীয় ধাঁচে। আর আলীগড় যুদ্ধে মারাঠা বাহিনীর সাথে এখানে সংগঠিত হয় ভয়ানক যুদ্ধ ইংরেজদের।সে কথায় পরে আসব।

দূর্গটির চারদিকে গভীর জলাশয়। গভীর খালেরও এখন রুগ্ন দশা। পানির উপর সবুজ ক্ষুদে পানা ভাসছে। জলাশয়ের পাড়ে অনেকেই এই বিকেলে আড্ডা জমিয়েছে। আর এই জলাধারের পাড় ঘেঁষে ত্রিশ ফুট উঁচু ইট-পাথরের পাঁচিল। পৃথিবীর অনেক প্রাচীন নগরীর দূর্গ কিংবা রাজপ্রাসাদের বাইরের দিকে এমন জল-বেষ্টনী রয়েছে। শুনা যায় এসব জলাশয়ের কোন কোনটিতে কুমীর চাষ করা হতো। এগুলো সব করা হতো দূর্গকে সুরক্ষিত রাখার নিমিত্তে। ব্রীজ পেরুলেই আরেকটি তোরণ। প্রহরী আছে এখানে। এই গেট দিয়ে ঢুকতেই পাঁচ-সাত গজ পরেই আসল তোরণ। সুরঙ্গ পথের মতো। এর ভিতরে শব্দ করলে প্রতিধ্বনী শোনা যায়। এই পথের প্রবেশমুখে ডান পাশে এক মর্মর পাথর যেখানে খোঁদাই করে লিখা আছে কতিপয় বৃটিশ ক্যাপ্টেন এবং লেফ্টেন্যান্টদের নাম। ১৮০৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মারাঠা বাহিনীর সাথে এক ভয়াল যুদ্ধে তারা মৃত্যু-বরণ করেন। সেদিনের যুদ্ধে মারাঠা বাহিনী পরাজিত হয় বৃটিশ জেনারেল লেকের কাছে। মারাঠাদের ক্ষয়ক্ষতি জানা না গেলেও বৃটিশ সেনাবাহিনীর প্রায় নয়শত সেনা সেদিন নিহত হয়। এটি ছিলো তাদের বিরাট ধরণের ক্ষতি।

দূর্গের ভিতরে শুরুতেই এক স্কুল। বলা যায় দূর্গটিকে কাজে লাগানোর কোশেশ চলছে। বিশাল জায়গা। আমরা শুধু এক প্রান্ত দেখেছি। এটি এখন নানা জাতের বৃক্ষ আর গুল্মের উদ্যান। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানী বিভাগের তত্ত্বাবধানে চলছে এই উদ্যানের কার্যক্রম। অনেক চেনা-অচেনা গাছ আছে এখানে। একটি গাছের নাম weeping tree—বাংলায় নাম করা যেতে পারে রোরূদ্যমান বৃক্ষ। তবে গাছ তো কাঁদে না কাঁদে মানুষ—গাছের প্রতিক্রিয়ায়। আর তাই রোরূদ্যমান না বলে কান্না-জাগানিয়া বৃক্ষ বললেও ক্ষতি নেই। এই গাছটি ধূলো-বালি আর পোষা-প্রাণীর পরেই তৃতীয় স্থান দখল করে আছে অ্যালার্জি তৈরী করার জন্য। এই গাছের পাশে এলে ল্যাটেক্স নামক এক উপাদানের অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়ায় মানুষের নাক-চোখ দিয়ে বেরুতে থাকে কান্নার ধারা। তাই এটি weeping tree। সুন্দর করে ছেঁটে বর্তুল আকৃতি দেয়া হয়েছে গাছটিকে। মজার বিষয় হলো গাছটি কিন্ত এখন আর কাঁদাচ্ছে না বরং গাছটিকে দেখে আমাদের মনের গভীরের কান্নাও শুকিয়ে জেগে উঠছে আনন্দ-ধারা। সবুজ প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে এই দূর্গটি বেশ কাজে দিচ্ছে। আর নিশ্ছিদ্র পরিত্যক্ত নিরিবিলি এই দূর্গ এখন কপোত-কপোতীদের প্রেম-লীলার এক সুন্দর ক্ষেত্র যেন! দূর্গের ধ্বংসাবশেষ আরেক প্রান্তে। সময় আমাদেরকে সেই প্রান্তে যেতে সাঁয় দিচ্ছিলো না। আমরা চলে এলাম ফের গাড়িতে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আমরা শহর একটু ঢুঁ মেরে দেখব। কোথায় শহর? এ যেন বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক এক স্থান। কিছুদূর যেতেই নজরে এলো সুন্দর এক মসজিদ। আমরা থামলাম। মাগরিবের সুমধুর ধ্বনী ভেসে আসছে তখন—অনেকগুলো মসজিদ থেকে। মনে হচ্ছে মসজিদের শহর ঢাকা মহানগরীর মতো। মন ভরে গেলো এই মসজিদটি দেখে। আর এই মসজিদটিই আমি দুপুরে খুঁজছিলাম—কারণ এটি এই নগরীর এক ঐতিহাসিক মসজিদ—আলীগড় জামে মসজিদ। মসজিদের সামনে বিরাট মাঠ—স্টেডিয়াম। এই সময়েও ক্রিকেটের অনুশীলন করছে দুটো দল। মসজিদটির গঠন নান্দনিক। ঐতিহাসিক এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন স্যার সৈয়দ আহমদ—১৮৭৯ সালে। তবে এর প্রবেশ মুখে দশটি শ্বেত-পাথরের টুকরোতে ঠাঁই পেয়েছে সুরা আল ফজর। এই ক্যালিওগ্রাফির কাজটি করেছিলেন এক ঐতিহাসিক পারস্যের শিল্পী সম্রাট শাহজাহানের সময়। যিনি তাজমহলের ক্যালিওগ্রাফির কাজও করেছিলেন। তাঁর নাম ইয়াকুত রকম।মসজিদের পূর্ব দিকে সুন্দর এক ছাত্রাবাস।

মাগরিব শেষে আমরা আবার চেপে বসলাম গাড়িতে। শহরটির ঐতিহ্যের একটি স্মারক তো থাকা দরকার! এই শহরটিকে কিন্ত তালার শহর ও বলা হয়। আমাদের মাথায় ঢুকেছে একটি হলেও আলীগড়ের তালা নিয়ে যাব। এক দোকানের সামনে থামলাম। সবাই মিলে তালা কিনে রওয়ানা দিলাম দিল্লীর পানে। জানি না এই তালা চোরেরা ভাঙতে পারবে কিনা। তবে আমাদের দলের একজন বলে উঠলো—এই তালার গায়ে লিখে রাখব আলীগড়ের তালা। তাহলে চোর নাকি ভয়ে আর খুলতে আসবে না তা।
২৭.১১.১৯/ দিল্লী।

নাসির উদ্দিন আহমদ: নব্বই দশকের কবি। পেশায় চিকিৎসক। সামরিক বাহিনীর চিকিৎসা বিভাগে কর্মরত।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন