করোনা যাপন ।। সামশুল আরেফিন।। পুবাকাশ
মনের গহীনে ভাবনার বসবাস হলেও এই ভাবনা দখল নেয় মানুষের পুরো শরীর। দেহ-মন একেবারে আচ্ছন্ন করে আবর্তিত হয় কখনো সুখের রাজ্যে, কখনো দুঃখের নরকে- এলোমেলো, ইতস্তত।
ব্যাংকের চাকরি। এলোমেলো ভাবনার ফুরসৎ কোথায়। প্রাইভেট ব্যাংক? ভাবনার আবর্তন তো শুধু- টার্গেট বনাম এচিভম্যান্ট। চিরাচরিত এই ভাবনা হোঁচট খেয়েছিল সাম্প্রতিক নয়-ছয় সিদ্ধান্তে। এর মাঝেই হঠাৎ করে করোনার ঘা। যেন মরার উপর খাড়ার ঘা। তাবৎ বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো একটা অদৃশ্য শক্তির অসহায় শিকার হলো। সব ভাবনা কে ছাপিয়ে করোনা এবার মানুষ কে বাঁচা-মরার ভাবনায় বন্দি করে রাখলো।
৮ই মার্চ’২০ টেলিভিশন সংবাদ- দেশে প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত তিন রোগী শনাক্ত। আইইডিসিআর থেকে দেশের সকল বাসিন্দাকে বিশেষ ভাবে সতর্ক থাকার পরামর্শ। সংবাদ শুনে বুকের ভেতর স্পষ্ট হাতুড়ি পেটানোর শব্দ পেলাম।
তবে কী বাংলাদেশও চীনের উহান হতে চলেছে! আর ভাবতে পারছিলাম না। সোজা চলে গেলাম পাড়ার মেডিসিন দোকানে। ভাবলাম কেউ বুঝার আগেই কিছু মাক্স ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার জোগাড় করে ফেলবো। দোকানে গিয়ে চোখ কপালে উঠলো। ইতোমধ্যে ওখানে আমার মত আরো কয়েকজন।
একটা দোকানে বললাম- ভাই মাক্স আছে?
দোকানি মাক্স দেখালে জানতে চাইলাম- দাম কত?
— প্রতি পিস ১৫০ টাকা।
— মগের মুল্লুক নাকি! চেঁচিয়ে উঠলাম।
— আজকে না নিলে কাল দুইশ টাকা দিয়ে ও পাবেন না। দোকানির ভারি কন্ঠ।
দু-একটি দোকানে দেখলাম। সবখানে একই রকম।
ভাবলাম পেঁয়াজের পর এবার মাক্স। একথা মনে হতেই রণে ভঙ্গ দিলাম। এক দোকান থেকে পরিবারের সবার জন্য মাক্স নিলাম। সাথে কয়েকটা হ্যান্ড স্যানিটাইজার।
সময় গড়ায়। আস্তে আস্তে করোনা নিজের রূপ দেখাতে শুরু করে। দিন দিন আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। ২৬ শে মার্চ থেকে সব অফিস বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ ক্রমে সীমিত আকারে ব্যাংকিং। আমরা দুই টিমে ভাগ হয়ে দুরু দুরু বুকে অফিস করছি।
সেদিন সন্ধ্যা। বাসায় ফিরে বাথরুমে ফ্রেশ হচ্ছিলাম। স্ত্রীর দরাজ কন্ঠ -“কই তুমি? এদিকে এসো। চট্টগ্রামে নাকি করোনা রোগী পাওয়া গেছে।”
আমি দৌড়ে টিভির সামনে। ব্রেকিং নিউজ পড়লাম- চট্টগ্রামের দামপাড়ায় করোনা রোগী শনাক্ত। চারটি বাড়ি লকডাউন। আমার হার্টবিট বেড়ে গেল- দামপাড়া তো আমাদের পাশেই ! এ পথ দিয়েই তো রোজ অফিসে যাই!
ফেসবুক খুলে বসে আছি। সহকর্মীদের স্ট্যাটাস থেকে জানা গেল -আক্রান্ত ব্যক্তি আমাদের অপারেশন ম্যানেজারের শশুর। অস্থিরতা আরো বেড়ে গেলো। রাতে ফোন দিলাম। তিনি জানালেন তার শ্বশুর কে নিয়ে দিনভর বিভিন্ন হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ির কথা।পটিয়ায় তার গ্রামের বাড়ি লকডাউন করার কথা।
রাত বাড়ার সাথে সাথে সহকর্মীদের ফোন কলও বাড়তে থাকে। ইতোমধ্যে যারা অপারেশন ম্যানেজারের টিমে অফিস করেছেন তাঁদের কন্ঠে আর্তনাদ- “স্যার এখন আমাদের কী হবে?”
আমি সবাই কে সান্ত্বনা দিলাম। চৌদ্দ দিন আইসোলেশনে থাকার পরামর্শ দিলাম বিজ্ঞ জনের মত।
এদিকে নিজের অশান্ত মনে নানা ভাবনা। আমার চোখ দুটো কেউ যেন দুদিক থেকে টেনে ধরেছে। বাসার সামনের কুকুর গুলোর ঘেউ ঘেউ শব্দ রাতের নৈশব্দ কে ফালা ফালা করে দিচ্ছে। এরই মাঝে মসজিদের মাইকে ফজরের আজান-আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাউম।
সকালে জোনাল ও হেড অফিসের বড় কর্তাদের সাথে কথা হলো। অফিস এলাকার ইউএনও সাহেব ও ফোন দিয়ে অফিস বন্ধ রাখার পরামর্শ দিলেন। সবশেষে ব্যাংকের এমডি সাহেবের সাথে কথা হয়। অতঃপর হেড অফিসের চৃড়ান্ত সিদ্ধান্তে অফিস বন্ধ হয়ে যায়। আমারাও আপাতত হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
দীর্ঘ দিন অফিস বন্ধ। মা, স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে জীবন এখন ইটের চার দেয়ালে লোহার খাঁচায় আবদ্ধ। বাসায় আত্মীয় স্বজনের আসা যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। কাজের মেয়েকে ছুটি দেয়া হল। মেয়েটার চেহারায় আষাঢ়ের মেঘ। আমি অভয় দিয়ে বললাম- ‘আমার বেতন বন্ধ না হলে তোমারটাও বন্ধ হবে না।” মেয়েটা দাঁত বের করে হাসছে। সে হাসিতে খেটে খাওয়া মানুষটির বেঁচে যাওয়ার স্বস্তি।
আমরা বড়রা গৃহবন্দিত্বকে মেনে নিলেও খুব কষ্টে আছে ছোটরা। ছোট মেয়ে শাফিকাহ অবশ্য ঠাঁই নিয়েছে বাসার জানালায়। আমাদের বিপরীত জানালায় ঝুলে থাকে তার খেলার সাথী মৌ। সকাল থেকেই দুই জানালায় শুরু হয়ে যায় দুই বন্দি পাখির কলকাকলি। তবে বিপাকে পড়েছে নবম শ্রেণীতে পড়ুয়া বড় ছেলে শফাকাত। প্রচন্ড মানসিক অবসাদে ভুগছে সে। অল্পতেই রেগে যাচ্ছে। বেশ বুঝতে পারছি ওর একাকিত্ব বোধ, করোনা-ভীতি ও রুটিন লাইফ এলোমেলো হয়ে যাওয়ায় এমনকি করছে।
অগত্যা মোবাইলে ভার্চুয়াল গেম খেলার অনুমতি দিতেই হলো। ধীরে ধীরে আমরা সবাই মোবাইল স্ক্রিনে আটকে গেলাম। জীবন ক্রমেই অনলাইন নির্ভর হয়ে উঠেছে। বাচ্চাদের ক্লাস অনলাইনে। প্রভাষক স্ত্রীও আদিষ্ট হলো অনলাইনে কলেজের ক্লাস নিতে।
রমজান শেষে এল ঈদ। নাহ্ , এবার গাইতে ইচ্ছে হলো না -“ও মন রমজানের রোজার শেষ এলো খুশির ঈদ।” বাসায় পরিবার নিয়ে ঈদের নামাজ পড়লাম। মনটা মুষড়ে গেল।
চট্টগ্রামে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। মনে হচ্ছে করোনার কমিউনিটি ট্রান্সফার ভালো মতই হয়েছে। মানুষের জীবন এখন উভয় সংকটে। ঘরে থাকলে ক্ষুধার জ্বালা বাইরে গেলে করোনার ভয়- এ যেন জলে কুমির আর ডাঙ্গায় বাঘ। এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই ৩১মে,২০২০ থেকে সব অফিস খুলে দেয়া হলো। উদ্দেশ্য- জীবন ও জীবিকা।
একটা শংকা নিয়ে অফিসে আসা যাওয়া করছি। অনলাইন সুবিধা নিয়ে ইতিমধ্যেই সেইফটি গগলস, মাক্স ইত্যাদি সংগ্রহ করে নিজেকে করোনা যুদ্ধের অগ্রসৈনিক হিসেবে দাড় করে ফেলেছি। প্রতিদিন তাপমাত্রা মেপে অফিসে ঢুকতে হচ্ছে।
কর্ণফুলীর পাড় ঘেঁষে আমার অফিস। বর্ষা মৌসুম। নদীর পানি কানায় কানায়। দুই পাড়ে সবুজের প্রদর্শনী। লকডাউনের কারনে যন্ত্রণাদায়ক শব্দের ইঞ্জিন বোট দিয়ে দীর্ঘদিন নদীর বালি তোলা বন্ধ। এই করোনা কালে প্রকৃতি যেন মেলে ধরেছে তার অপরূপ সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য ছেড়ে মরতে ইচ্ছে করছে না। খুব ইচ্ছে করছে গাইতে–“ওরে কর্ণফুলীরে সাক্ষী রাখিলাম তোরে।…..”
ব্যাংকে উপচে পড়া ভীড়। মধ্যবিত্ত গ্রাহকরা সঞ্চয় ভেঙ্গে খাচ্ছে। শাখার ডিপোজিট ধরে রাখা যাচ্ছে না। প্রবাসীরা দেশে এসে বিপাকে পড়েছে। করোনার কারণে বিমান চলাচল বন্ধ।আয় ও বন্ধ। একমাত্র ভরসা ব্যাংকের সঞ্চয়। আমাদেরও কপালে ভাঁজ- ব্যাংক ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কী !
অফিসে কাজের ফাঁকে আমার সহকর্মী জানালো তার শ্বশুর, যিনি চট্টগ্রামের প্রথম করোনা রোগী, সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। একটা প্রশান্তিতে মনটা ভরে গেল। বিশ্বাস হলো- করোনা মানেই মৃত্যু নয়।
আবার ক’দিন পরেই সেই বিশ্বাস দ্রুত পাল্টে যেতে থাকলো। চট্টগ্রামে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। হাসপাতালে আইসিইউ বেডের তীব্র সংকট। অক্সিজেন বোতল নিয়ে কাড়াকাড়ি-একটু শ্বাস নিতে চায় চট্টগ্রাম বাসী। দেশের অর্থনীতির বড় যোগানদাতা চট্টগ্রামের প্রতি এ কেমন আচরণ – ভাবনার রাজ্যে এবার যুদ্ধের দামামা।
ক’দিন আগে আমার এক বন্ধু পরামর্শ দিয়েছিল কিছু অক্সিজেন বোতল মওজুদ করে রাখতে। আমি তার উপর রাগ করে বলেছিলাম- ” এটা অনৈতিক।” সেই আমি এখন ভাবছি – কিছু অক্সিজেন বোতল যোগার করে রাখলে ভালো হয়। সত্যিই করোনা আমাদের বিবেককে ভোঁতা করে দিয়েছে।
করোনা আরো কাছে চলে এল। একেবারে নিজের চৌহদ্দিতে। প্রথমেই আক্রান্ত চাচাতো ভাই বেলাল। ক’দিন ধরে জ্বর। বাসায় চিকিৎসা চলছে। কোন হাসপাতাল ভর্তি নিচ্ছে না। অনেক তদবির করে অবশেষে ‘ম্যাক্স হসপিটাল’। অবস্থার অবনতিতে ‘মা ও শিশু হাসপাতাল।’ দুই দিন যমে-মানুষে টানাটানি। তারপর না ফেরার দেশে পাড়ি জমালো। সবাই স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ।
জীবদ্দশায় যিনি দুই হাতে দান খয়রাত করতেন, তার জানাজায় শত মানুষের যোগ দেয়ার কথা। নিতান্ত পারিবারিক কয়েক জন ছাড়া কেউ এল না। আলমানাহিল ফাউন্ডেশনের সাহসী দল দাফন-কাফন সাড়লো।
তারপর আক্রান্ত রফিক মামা- বিসিক চট্টগ্রামের সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক। জ্বর- কাশি- শ্বাস কষ্ট নিয়ে ‘মা ও শিশু হাসপাতালে। অবশেষে তিনি ও করোনার কাছে হার মানলেন। মা’র চোখে নূহের প্লাবন। ক’দিন আগেও আম্মার সাথে মামার ফোনে দীর্ঘ কথা হয়। ভাই বোনের একথা- সেকথা- অনেক কথা। এ যেন বেলা শেষের কথা মালা।
এবার হারালাম সহকর্মী মিসবাহ ভাই কে । আমাদের আধুনগর শাখার ম্যানেজার। পরে আরো এক সহকর্মী কে। মৃত্যুর মিছিলে আরো অনেকে।
করোনা পজিটিভ বড় আপা ও মেজ আপার পুরো পরিবার। কাজিন রাণী আপা। আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের ভীড়ে আমার বাবাও একজন। কোন স্মৃতি মনে নেই। বাবার দায়িত্ব পালনকারি বড় আপা- দুলাভাই হলেন আমাদের শেষ আশ্রয়। সেই আশ্রয় আক্রান্ত হলে আমাদের পায়ের তলার মাটি যেন সরে যেতে লাগলো। আম্মা কেঁদে কেঁদে হয়রান।
আপার মেয়ে ও মেয়ে জামাই ডাক্তার। তাদের পরামর্শে দুই পরিবারের চিকিৎসা আরম্ভ। শুরু হলো ঔষধ, গরম পানির ভাপ, ফুসফুসের ব্যায়াম। একসময় তাঁরা সুস্থ হলে আমাদের পরিবারে স্বস্তি ফিরে এলো।
এবার আক্রান্ত চন্দনপুরার রোসাংগীর মামা- ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ডিএমডি ও চট্টগ্রাম ব্যাংকারস ক্লাবের সহসভাপতি। অবস্থার ক্রমাবনতিতে ঢাকার আনোয়ার খান মেডিকেলে ভর্তি। প্লাজমার জন্য ফেসবুকে অনুরোধ করলাম। সাড়া পেলাম আমার সহকর্মী কামালের।
তাঁর শ্বশুর-শ্যলক, যারা চট্টগ্রামের প্রথম করোনা রোগী, রক্ত দিতে রাজি। আমি কৃতজ্ঞ হলাম। ভাবলাম কিছু দিন আগেও যারা ছিল আমাদের আতংকের কারণ তাঁরাই আজ চুড়ান্ত ভরসা। করুণাময়ের কৃপায় শেষমেষ প্লাজমা ছাড়াই মামা সুস্থ হলেন।
এভাবে বছর শেষ হতে চলছে। করোনার আক্রমণ এখনো বেড়েই চলেছে। হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা। স্বাস্থ্যখাতকে অযত্নে রেখে উন্নয়নের মহাসড়কে থাকা বাংলাদেশ ক্রমেই মুখ থুবড়ে পড়ছে।
প্রতিদিন অফিস আর বাসা। বন্দী এই জীবন যেন করোনার কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ।
সেদিন পড়ন্ত বিকেল। বাসার ছোট্ট ব্যালকনিতে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বসে আকাশ দেখছি। সূর্য তখন একটা লাল টিপ–দিগন্তের কপালে লেপ্টে আছে। পাখীরা ডানা ছড়িয়ে নীড়ে ফিরছে। ভাবছি পাখীগুলো কত স্বাধীন আর সৃষ্টির সেরা মানুষ গুলো আজ খাঁচায় বন্দী !
হঠাৎ আমার ছেলেটা অস্থির হয়ে উঠলো। বললো-“আব্বূ এভাবে আর কতদিন? খেলতে পারছিনা, স্কুলে যেতে পারছিনা ! ” ওর চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি।
আমি ওর মাথায় হাত রেখে বললাম-” একটু ধৈর্য ধর। দেখবে, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।”
— আব্বু, কখন আসবে সেদিন?
এবার আমি কোন উত্তর দিতে পারলাম না। কারন এই ভাবনা তো আমার মাঝেও। মনের গহীনে আবর্তিত হচ্ছে দিবস রজনী।
সামশুল আরেফিন : পেশা: ব্যাংকার, ম্যানেজার, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, বোয়ালখালী শাখা, চট্টগ্রাম।