শব্দ নিয়ে এক আধটু।। মুজিব রাহমান।। পুবাকাশ
ভাষাজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশের পথে একটি বড় প্রতিবন্ধক। নিজের আত্মাকে দেখার জন্যে যেমন মাতৃভাষার সমৃদ্ধ জানালাটা চাই তেমনি বিশ্বটাকে দেখার জন্যেই চাই বিশ্বভাষার একটি সমৃদ্ধ জানালা। এক একটি সমৃদ্ধ বিশ্বভাষা বাইরের দিকে তাকানোর এক একটি বিশাল বিপুল জানালা।
ইংরেজিও পৃথিবী নামক গ্রহের সমৃদ্ধ ভাষাসমূহের একটি। সব ভাষারই মৌলিক উপাদান শব্দ। শব্দ বিশেষ করে দু চারটা ইংরেজি শব্দ নিয়েই আজকের যৎসামান্য কথোপকথন।
বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বাংলা ভাষার সর্ববৃহৎ কলেবরের সৌধ-প্রতিম ‘বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’ -এর পণ্ডিত-গবেষক সম্পাদক ড. গোলাম মুরশিদ ভূমিকায় লিখেছেন:
‘ অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি’ সম্পাদক জেমস মারে স্কুলের সীমানা অতিক্রম না-করলেও তেইশটি ভাষা জানতেন খুব ভালো করে। এ ছাড়া, আরও আট-নটা ভাষা জানতেন কাজ চালিয়ে নেবার মতো। তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বহুভাষাবিদ। অপর পক্ষে, বিবর্তনমূলক অভিধান তৈরি করতে গিয়ে আমরা প্রতি পদে আমাদের ভাষাজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা অনুভব করেছি।’
একটি উচ্চমানের ইংরেজি-বাংলা অভিধান – ‘এভরিম্যানস ডিকশনারি’। রামকৃষ্ণ পুস্তকালয়, কলকাতা থেকে প্রকাশিত এ অভিধানটির প্রধান সম্পাদক গৌরীপ্রসাদ ঘোষ। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, শেইকসপিয়ার-বিশেষজ্ঞ এবং স্বশিক্ষিত জ্যোতির্বিজ্ঞানী তিনি। তাঁর নেতৃত্বে আরও চারজন বিশিষ্ট ভাষাবিদ এ অভিধানটির সঙ্কলন-সম্পাদনার কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক আশিস কুমার লাহিড়ী, অর্থনীতির খ্যাতিমান অধ্যাপক প্রফুল্ল কুমার চক্রবর্তী এবং ইংরেজি সাহিত্যের মানুষ মুক্তিপ্রসাদ ঘোষ এবং অধ্যাপক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্পাদিত অভিধানটির সম্পাদনাকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ অভিধানটির পাঁচ সদস্যের সম্পাদকমণ্ডলী ১৪০৭ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন।
অভিধানের জন্যে , বহুমাত্রিক এই শব্দ-সঙ্কলনের জন্য, বিশ্বায়নের কালে বাংলা ও ইংরেজি এই দু ভাষার হৃদয়ে পথ কাটার জন্য তাঁরা অর্জন করেছেন আনন্দ পুরস্কার!
ভুবনগাঁয়ে [Global village] ইংরেজি ভাষাকে আজও অনেকেই জ্ঞানালোকের সিংহদ্বার মনে করেন। এবং এ কারণে এক ধরনের অন্তঃসারশূন্য, সস্তা অনুকরণ ও নির্বোধ হনুকরণ বা aping-ও করেন। কিন্তু আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিতে ইংরেজি এখন এদেশের একাংশের কাছে দ্বিতীয় ভাষা। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের জন্যে আরও বেশি পণ্য এবং অধরা। দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে আজও অস্বীকৃত এবং কোন বিশেষ ভাষা-পরিকল্পনার অধীন জোরারোপ নেই, নেই বিশেষ কোনো প্রণোদনা যাতে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি ভাষাটি আত্মস্থ করার বিশেষ অনুপ্রেরণা পেতে পারে।
বিদেশী শব্দ আহরণ ও আত্মীকরণের ব্যাপারে ইংরেজি ভাষার জুড়ি নেই। এটি তেমন বিস্ময়কর নয় যে, প্রবীণ ও সদাশয় Noah Webster যখন তাঁর Compendious Dictionary of the English Language প্রকাশ করেন তখন X- অক্ষরটির ভুক্তিতে সাকল্যে শব্দ সখ্যা ছিল একটি। সেই সময়ের সর্বপরিব্যাপ্ত মহার্ঘশব্দটি হলো: Xebec মানে ‘ভূমধ্যসাগরীয় তিন মাস্তুলওয়ালা ছোটো জলযান।’ আর এ কারণেই এটি বিস্ময়কর নয় যে, কালের বিবর্তনে Oxford English Dictionary -তে x- হরফের অধীন আজ শব্দভুক্তি দাঁড়িয়েছে ৪০০!
দ্রষ্টব্য যে, কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন ভাষার সঙ্গে মিশতে মিশতে সবচেয়ে অপপ্রয়োগ-ধ্বস্ত হয়েছে যে শব্দটি সেটি হচ্ছে- ‘ironic’। অনেক দেশেই শব্দটি কৌতুকাবহ বা funny, মিলধর্মী বা coincidental
আবার unexpected বা অকস্মাৎ সংঘটিত ইত্যাদি হরেক অর্থে ব্যবহৃত।
অথচ শব্দটি একটি বাচ্যালংকার। যার ইশারা ইঙ্গিত আর অর্থ পুরোপুরিভাবেই আভিধানিক অর্থের উল্টো বা বিপরীত যা অসঙ্গতির বিদ্রুপাত্মক উল্লেখকে করে তোলে তাৎপর্যময়!
যে প্রোটিন-টির উপনাম ‘টাইটিন’ [ titin] তার বৈজ্ঞানিক পরিভাষাটিই ইংরেজি ভাষার অভিধানে অবলুপ্ত অথচ দীর্ঘতম শব্দ। একলক্ষ ঊননব্বই হাজার আটশত উনিশ অক্ষর বিশিষ্ট শব্দটি লিখে সংকুলান করতে গেলে আপনার পুরো বারোপাতা কাগজ লাগবে। আর উচ্চারণের ভিডিওটি দেখা হতে পারে ধৈর্যের এক চরম পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া!
আর ৪৫ অক্ষরবিশিষ্ট ফুসফুসের রোগটির নাম তো আমাদের সকলেরই জানা। অভিধান এটিকে এখনও বর্জন করেনি। শব্দটি হচ্ছে:
pneumonoultramicroscopicsilicovolcanoconiosis.
আবার ২৮ অক্ষরের যে শব্দটি উল্লেখ করতে যাচ্ছি সেটিকে অধিকাংশ অভিধান চিহ্নিত করেছে অকারিগরি এবং non-coined শব্দ হিসেবে। শব্দটি হলো:
antidisestablishmentarianism।
আরও একটি শব্দ প্রায় সব অভিধানেই আছে। ২৯ অক্ষর বিশিষ্ট এই শব্দটি কোনো কিছুকে তুচ্ছ বা বাজে বলে মূল্যায়ন করার কাজ বা অভ্যাসকে বোঝায়।
শব্দটি হলো:
floccinaucinihilipilification।
বাংলা ভাষার সার্বভৌম কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষের কবিতায় লিখেছেন:
‘আমরা ডিকশনারিতে যে কথার এক মানে বেঁধে দিই, মানবজীবনের মধ্যে মানেটা সাতখানা হয়ে যায়, সমুদ্রের কাছে এসে গঙ্গার মতো।’
আজকাল অভিধানগুলোও জীবনের মানের পেছনে ডানে বাঁয়ে ছুটছে এবং ডিকশনারিকে জীবনের মতো জ্যান্ত করার চেষ্টার কোনো ত্রুটি করছে না।
১৯৮৯ সালে প্রকাশিত Oxford English Dictionary গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে set শব্দের ভুক্তিটি ছিল ৪৩০টি স্বতন্ত্র অর্থে-সংজ্ঞায় সমৃদ্ধ। আর সম্প্রতি অভিধান সম্পাদকদের মতানুযায়ী set শব্দটির প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে run শব্দটি। উল্লেখ্য, কেবল Verb হিশেবেই run শব্দটির রয়েছে ৬৪৫টি স্বতন্ত্র অর্থ। তিন বর্ণের একটি শব্দের অর্থময়তা রীতিমতো বিস্ময়কর!
অন্যদিকে, কোনো কোনো শব্দের ব্যবহারগত ঊনতাও বিশিষ্ট করে তোলে শব্দটিকে। প্রসঙ্গত, ইংরেজি ‘Girl’ -শব্দটি বাইবেলে একবার মাত্র উল্লিখিত বা ব্যবহৃত হয়েছে। কিংবা, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক ‘গুরুত্বপূর্ণ’ শব্দটিকে তাঁর সাহিত্যকর্মে একবারও ব্যবহার না করার উল্লেখটিও অগুরুত্বপূর্ণ নয়। অথচ শব্দটি সেসময়ে প্রচলিতই ছিল।
ভাষাগত সমৃদ্ধি কতোভাবেই না আঁচ করা যায়। কটূকথা, অশ্রাব্য অভব্য গালিগালাজ বর্ণানুক্রমিক গালি ভাষ্যকে ইংরেজিতে বলা হয় Abecedarian insult -বা বর্ণানুক্রমিক অপমান উৎক্ষেপণ! অভিধান থেকে তার একটি উদাহরণ উপস্থাপন করা যেতে পারে:
’Sir, you are an impotent, conceited, obscene, hairy-buttocked, brainless, wicked, toadying, goatish, indecent, stable-smelling, hunchbacked, thick-lipped, stinking, turnip-shaped, feeble- minded, pimply, trashy, repellent, smarmy, foul-mouthed, greasy, gluttonous, loathsome, wooden-headed, whining, extremely low form of animal life.’
আদ্যোপ্যান্ত গালিটি শুনে থ বনে যেতে হয়। ইংরেজি ভাষার এটিও এক ধরণের শক্তিমত্তা, তাকত বা জোর!
মুজিব রাহমান : সহযোগী অধ্যাপক, ইংরাজি বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ।