নাসির উদ্দিন আহমদ’র একগুচ্ছ কবিতা ।। পুবাকাশ
এক. পলিমাটি দেহ
পলিমাটির এই দেহ নিয়ে
বসে আছি
ক্রিসপি চিকেন বার্গারের অপেক্ষায়
হাতে বিশ-বিশের শেষ টোকেন
গায়ে ঢলে পড়ছে বছরের শেষ
সূর্যের তেজ
কাল কি নূতন সূর্য উঠবে
নূতন আকাশ কি হাসবে ছায়াপথে
নূতন গন্ধের রাত কি নামবে পৃথিবীতে কাল
চিকেনের গায়ে কাল কি উঠবে নূতন সোয়েটার
না কি তপ্ত তেলে কালও ঝলসে যাবে দেহ তার
কাল কি ব্যাবচ্ছেদে হাসবে নূতন রক্ত-লগন?
নাকে উড়ন্ত চাউমিনের ঘ্রাণ
দূরে কাছে শিশু ভাইরাসের তালমাতাল উৎসব
কিউ লেগে আছে কাউন্টারে ক্যাশে টেবিলে কিচেনে
সামাজিক দূরত্ব ভুলে
পৃথিবীতে এখনো কিউ লেগে আছে
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় পড়ন্ত বোমায়
কার্তুজে বারুদে সৈকতে হাহাহারে কিউ
এসব ভিড় ভাট্টা ঠেলে বসি থাকি কবিতায়
কখন ডাক আসে
টোকেন নিয়েই চলে যেতে হবে আগামী বছরের কোলে..
হাতে কাজ নেই—টোকেন
মাথায় চিন্তা নেই—কবিতা
পকেটে ভরসা নেই—উড়ে চলা
বছরের শেষ দিন—ভ্যাকসিন কই!
হঠাৎ বয় এসে বলে, স্যার আটচল্লিশ
টোকেনের সাথে মিলিয়ে মনে মনে হাসলাম
কাল আটচল্লিশ
কারো কারো হয়ে যাবে ঊনপঞ্চাশ..
দুই. এসো নূতন
সৌখিন রাত্রি উড়ে গেছে
ঝুলে আছে জামদানী স্মৃতি
পাড়ায় পাড়ায় চাঁদ চমকায়
দূরে সরে গেছে বিষাদের গীতি
এসো নন্দনতত্ত্ব শব্দ সহচর
মালা গাঁথি জোছনা-কবিতার
কে চায় জখমের দাগ ঘূণ
যন্ত্রনা নীল প্রহরের হাহাকার
এসো নূতন প্রমত্ত-স্বপ্ন-গীত
বাতাসে বাতাসে বুনি মুক্ত সুঘ্রাণ
জড়িন আলোয় নেচে গেয়ে
নূতন পক্ষ মেলে রচি কাব্য-বাখান..
তিন. মাটির চির-সন্তান
কোথাও উড়ে যেতে পারিনি
কোমল ডানায়
প্রবল অভিকর্ষ টানে আটকে পড়ে আছি
বেলা অবেলায়—ধূসর মৃত্তিকায়;
কখনো সৌর ঘূর্ণি ডাকে নিছক উল্লাসে
বাষ্প হয়ে ক্ষণিক ছুঁয়েছি মেঘের রং
হয়তো শালিকের মতো ফুরুৎ উড়াল
তারপর তোমার কোলে-কাঁখের অমোঘ কোলাজে
মিশে গেছি সান্ধ্য অন্ধকারে
ভুলে গেছি উড়াল গান—ডানার উচ্ছ্বাস!
জল কাঁদায় গড়াগড়ি খেয়ে ছায়া সৌরভ চুমে
রাতে দিনে
দূর্বাঘাসে ঢেঁকি শাকে ঝরা পাতায় পাতায় আড্ডা শেষে
বুঝে গেছি—আমি মাটির চির-সন্তান;
বুঝে গেছি
এখানেই গতি— এখানে স্থিতি লয়
এখানেই মুখ এখানেই অন্তরা
এখানেই স্বর ব্যঞ্জন পরিচয়
এখানেই আছি রয়ে যাব অনন্তকাল
শুধু ক্ষাণিক উড্ডয়ন আলোর ক্ষুধায় পতঙ্গ উপমায়
তারপর
অনন্ত মাটিতেই চির-বাঙ্ময়!
চার. নিজস্ব সড়ক
পাখিদের রাস্তার কোন নাম নেই
মাছেদের ও তাই
তারা নিজেরাই চলতে ফিরতে
নিরন্তর রাস্তা বানায়
যে পথে পা বাড়ায় সেটাই সড়ক
সেটাই এভিনিউ
তারপর সাঁতরে যায় সারাটি জীবন…
দেখো
প্রজাপতি
নূতন নূতন রাস্তায় উড়ে
ডানায় ডানায় সারাক্ষণ
মায়াবী মোহন
মানুষেরাই শুধু
চিরচেনা চিরজানা
নাম দেওয়া রাস্তায় ঘুরে ফিরে দিনমান
ও পাখি
ও প্রজাপতি
ও মাছ
আমাকেও হাঁটতে দিও তোমাদের নামহীন
প্রশস্ত লেইনে,
যেন তোমাদের মতো
নিজের বানানো আনন্দ সড়কে
হেঁটে হেঁটে পাই
ছোপ ছোপ রঙের বাগান….
পাঁচ. জলপাই
সকাল থেকেই গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠছে
বারান্দায় অপ্সরী-জলপাই
তেল মেখে লাবণ্য ত্বকে
ধীরে ধীরে ঊর্ণা খুলে ডেকে ডেকে বলে
—আয় ধীরপ্রবণ কুয়াশায়
গতরে গতরে সেই পুরণো স্বর্গবেলার
মাঘি সরিষার ঘ্রাণ
পাকা রং অঙ্গে-মর্মে ঝলকায়!
কে কোথায় জড়িয়ে আছে মাধ্যাকর্ষণ বলে
কার গতরে আছড়ে পড়ে রোদ
কার গতরে তোষামোদ-গদগদ-তেল
কার মেদে মজ্জায় লেগে থাকে জোছনার দাগ
কে কখন সঙ্গোপনে পান করে নিবিড় আরাম
জানে না জলপাই জানে না সকাল
শুধু বৈয়ম খুলে বোতল খুলে
পৃথিবীর কাছে উল্লাস-তৈল বিতরণ
এসব বিতরণ পর্ব শেষে
টক টক স্বাদ নিয়ে উঠে আসে কেউ তণুকায়
জিহবায় ইন্দ্রীয় পাড়ায়…
ছয়. শালিক-রাঙা স্বপ্ন
তোমাকে দেখা হলো
রঙ্গ কোলাহল হলো
হাসাহাসি হলো ঘরে বারান্দায়
শুশ্রুষা হলো কত
আগুনের শিখা জ্বেলে শিরায় পাথরে
পুড়ে যাওয়া হলো সমস্ত বিকেল
গার্হস্থ্য পথ ভুলে
পেস্তা বাদামের কুট্ কূট আভাসে
উড়ে যাওয়া হলো
অনন্ত শব্দ সম্পাত নত হলো
অশান্ত সরোবরে ডুবে যাওয়া হলো
ক্ষয়ে যাওয়া আলোয়
অসমাপ্ত কবিতা পড়া হলো
তোমার চূর্ণ বিচূর্ণ উষ্ণ ধ্বনি শোনা হলো
বিবর্ণ সব পাতা ঝরে গেলে
শ্যামাবর্ণা সোহাগে নূতন বৃক্ষ উদিত হলো
তখন নূতন পত্র কুসুম ছুঁয়ে ছুঁয়ে
অবিশ্বাস্য রসমঞ্জরী ভিতর
শালিক-রাঙা স্বপ্নের জন্ম হলো।
নাসির উদ্দিন আহমদ : কবি ও প্রাবন্ধিক।