আমরা প্রত্যেকেই ঘূর্ণি দরবেশের চিত্রের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত। পুরোপুরি সাদা পোশাক পরে এবং দক্ষতার সঙ্গে তাঁরা নিজেদের ইবাদত পরিবেশন করে। তবে, সুফিজম এবং মৌলভী বা মেভলেভি ঘরানা বা তারিকার অংশ হিসেবে এটি যুক্ত থাকলেও প্রায় সাতশো বছরেরও বেশি সময় ধরে দরবেশ সংস্কৃতি-দর্শনের অঙ্গ রূপেও একে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা যায়। এই অংশে আমরা সুফি দরবেশের ইতিহাস, তাদের বিশ্বাস এবং ঘূর্ণি আচারের তাৎপর্যের কথা জানার চেষ্টা করব।
অতীন্দ্রিয়বাদ এবং সুফিজম বা সুফিবাদকে অভ্যন্তরীণ এবং রহস্যময় মাত্রা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর পারস্য কবি, ইসলামী ধর্মতত্ত্ববিদ, এবং সুফি রহস্যবাদী জাল্লাল আদ-দান মুহাম্মদ রুমির অনুসারীদের দ্বারা তুরস্কের শহর কোনিয়াতে (পূর্বে আনাতোলিয়ান সেলজুক সুলতানিয়ের রাজধানী) মৌলভী ঘরানা গঠিত হয়েছিল। মওলানা রুমির পুত্র সুলতান ওয়ালাদ দ্বারা সংগঠিত, সুফিবাদের এই মৌলভী তরিকা শীঘ্রই নিযুক্ত নেতাদের সঙ্গে অন্যান্য শহরের তাঁদের সম্পর্ক প্রসারিত হতে শুরু করে। এই সম্প্রসারণের উত্তরাধিকার সূত্রে উসমানীয় সাম্রাজ্য জুড়ে ১১৪টি ঠেক বা মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরমধ্যে অবশ্যই বেলগ্রেড, এথেন্স, কায়রো, মক্কা সহ অন্যান্য শহরগুলিও ছিল। যেমন ছিল বাগদাদ, দামেস্ক এবং তাবরিজ।
বিশ্ববিশ্রুত কবি ও আরেফ রুমির জন্ম হয়েছিল হিজরি ৬০৪ সালের ৬ রবিউল আউয়াল তথা ১২০৭ সনের ৩০ ডিসেম্বর। তার জন্মস্থান ছিল প্রাচীন ও বৃহত্তর বালখ্ প্রদেশের বালখ্স নদী-সংলগ্ন একটি গ্রাম যেটি বর্তমানে তাজিকিস্তান, অথবা বর্তমান আফগানিস্তানের অংশ। রুমির পিতা বাহা উদ্দিন ওয়ালাদ ছিলেন বালখ্ এর একজন ধর্মতাত্ত্বিক, আইনজ্ঞ, এবং একজন অতীন্দ্রিয়বাদী বা সুফি সাধক। তিনি ছিলেন এই প্রদেশের সবচেয়ে বড় খতিব বা বক্তা যিনি রুমি এর অনুসারীদের কাছে “সুলতান আল-উলামা” নামে পরিচিত।
বৃহত্তর বালখ্ তখন ছিল ফার্সি সংস্কৃতি ও ইরফান বা সূফী ধারার আধ্যত্মিক সাধনা এবং জ্ঞান চর্চার প্রধান কেন্দ্র যা বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রুমির বাবা ছাড়াও তার ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছেন সে সময়কার ফার্সি মরমি কবি ফরিদউদ্দিন আত্তার নিশাপুরি এবং হাকিম সানাই।
রুমি তাঁর পৈতৃক দিক থেকে প্রখ্যাত সুফি সাধক নাজিম উদ্দিন কুবরা’র বংশধর ছিলেন বলে অনেকেই মনে করেন। তিনি তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় রুম সালাতানাতে কাটিয়েছেন। রুমি ১২৭৩ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। তাঁকে কোনিয়ায় সমাহিত করা হয় এবং সেটি একটি তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে। রুমির মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে সুলতান ওয়ালাদ এবং তাঁর অনুসারীরা “মৌলভী ঘরানা বা তরিকা” চালু করে। তাদেরকে ঘূর্ণায়মান বা নৃত্যরত দরবেশও বলা হয়,যেটি সুফী নৃত্যে “সামা” এর জন্য বিখ্যাত। রুমিকে তাঁর পিতার কাছে দাফন করা হয় এবং তাঁর কবরের ওপর একটি সুরম্য দরগাহ নির্মাণ করা হয়। রুমি ছিলেন একজন তপস্বী, যিনি নির্জনতায় বাস করতেন, খুব কম খাওয়া-দাওয়া করতেন, পরিমিত ঘুমাতেন এবং কথা বলতেন, নিজের রচনার মধ্যেই নিমগ্ন থাকতেন। তাঁর জীবনযাত্রা মেভলেভিদের অনুপ্রেরণায় পরিণত হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে সুফি সংগঠনগুলিকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল সেই সঙ্গে মৌলভী সুফি গায়কদের বাসস্থান বা মঠগুলি, হয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, নয়তো মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছিল বা যাদুঘরে পরিণত করা হয়েছিল। দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌলভী ঘরানার মঠ আজও বর্তমান। এক হল কোনিয়ায় (যেখানে স্বয়ং মওলানা রুমি সমাধিস্থ হয়েছেন) এবং ইস্তাম্বুলের গালতা মেভলেভিহানেসি।
১৯৫৩ সালের মধ্যে তুর্কি সরকার কর্তৃক মৌলভী সামা বা ঘূর্ণায়মান প্রার্থনা অনুষ্ঠানের যে পদ্ধতি, তা জনসাধারণে পরিবেশনের অনুমতি দেওয়া হয় এবং শীঘ্রই সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রক দ্বারা আয়োজিত অনুষ্ঠান দেখার জন্য বিশ্বজুড়ে প্রচুর ভিড় হয়।
মূলত, সেহামেণ অনুষ্ঠানটি ছিল স্রষ্টার প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের একটি দিন। প্রতিটি মৌলভী সম্প্রদায়ের মধ্যে এর অনুশীলন রীতি প্রচলিত ছিল। একটি অনুষ্ঠানে মূলত মৌলভী সংগীতজ্ঞ, মহিলা এবং অনাবাসী দরবেশরা উপস্থিত থাকতেন যারা মৌলভী ‘জিকির’ বা প্রার্থনা চুপচাপ উচ্চারণ করতেন তাদের মধ্যে।
দরবেশরা বিশ্বাস করেন, মানুষের আত্মা নূর দিয়ে তৈরি। আত্মা তাই ইহজগতের নয়, অন্য লোকের। আত্মা সব সময় চায় তার আসল জগতে ফিরে যেতে। সেই জগতে যাওয়ার জন্য ঘূর্ণন একটি উত্তম পন্থা। সুফি ডান্সে দরবেশদের পাক খাওয়ার নির্দিষ্ট ভঙ্গি আছে। অনুষ্ঠানের শুরুতে নবীজির (সা.) প্রশংসা করা হয়, কারণ তাঁর নূর সৃষ্টির পর অন্য সব নূর তৈরি হয়েছে। ঢাকের শব্দ দিয়ে ‘কুন ফায়া কুন’ মানে ‘হও’ ধ্বনিত হয়। আত্মাকে শরীরের মোড়ক দিয়ে এই নশ্বর পৃথিবীতে আনা বোঝাতে ব্যবহার করা হয় বাঁশি। বাঁশির সুরের পরেই শেখ (দলনেতা) ও তাঁর শিষ্যরা মাটিতে আঘাত করতে থাকেন, যেন সত্য বেরিয়ে আসে। এর পরেই হয় ঘূর্ণন। এই অংশের নাম সুলতান পর্ব। সুলতান ছিলেন রুমির সন্তান। রুমির মৃত্যুর বেশ কিছু পরে এই পর্বটি সংযোজিত হয়।
ঘূর্ণনে দরবেশরা একে অন্যের সামনে এসে চোখে চোখ রেখে সম্মান প্রদর্শন করেন। এই অংশের মূল কথা হচ্ছে, একজন গুরু দরকার, যাঁর পায়ের ছাপ অনুসরণ করে অন্যরা পথ খুঁজে পাবেন। বৃত্তাকার ঘূর্ণনের ডান দিক নির্দেশ করে এই জগতে আসার পথ এবং বাঁ দিক নির্দেশ করে আধ্যাত্মিক জগতে যাওয়ার পথ।
আত্মোপলব্ধি হচ্ছে বৃহৎ জ্ঞান। তাই নাচের একপর্যায়ে শুরু হয় আত্মযুদ্ধ। এই পর্যায়ে মানুষের অহম, আকাক্সক্ষা, লোভ, ভয় এমনকি আত্মপরিচয়ও বিসর্জন দিতে হয়। মহামহিমের সঙ্গে পূর্ণ বিলীন হওয়াই এর লক্ষ্য। এ পর্বের শুরুতেই দরবেশরা তাঁদের শরীরে জড়ানো কালো কাপড় খুলে রাখেন জাগতিক সব চাওয়া বিসর্জন দেওয়ার প্রতীকে। শিষ্যদের মাথার লম্বা টুপিতে শেখ চুমু খান আর শিষ্যরা চুমু খান শেখের হাতে। প্রথমে তাঁরা দুহাত কাঁধের কাছে নিয়ে রাখেন, যেন আরবি হরফ আলিফের মতো দেখায়। পরে ধীরে ধীরে হাত ছড়িয়ে ওপরের দিকে তোলেন। তাঁদের ডান হাত থাকে আকাশের দিকে; আর বাঁ হাত নিশানা করে মাটিকে। এই ঘূর্ণনের সময় দরবেশদের বাঁ পা একই জায়গায় থাকে এবং ডান পায়ের মাধ্যমে তাঁরা ঘুরতে থাকেন।
সামা আচারের প্রতীক হিসেবে, সেমাজেন বা গায়কের মাথায় থাকে উটের চুলের টুপি (যাকে বলা হয় সিক্কে)… যা অহংকারের সমাধিস্থলকে উপস্থাপন করে, অন্যদিকে সাদা স্কার্ট, যা অহংকারের কাফন নামে পরিচিত। দরবেশ যখন তার কালো জামাটি সরিয়ে ফেলেন, তখন তাঁর আধ্যাত্মিকভাবে সত্যের পুনর্বার জন্ম হয় বলে ধরা হয়ে থাকে।
ঘূর্ণি চলাকালীন, দরবেশের বাহু খোলা থাকে তাঁর ডান হাতটি আকাশের দিকে নির্দেশ করেন। যা ঈশ্বরের রহমত পাওয়ার প্রতিনিধিত্ব করে। দরবেশের বাম হাতটি মাটির দিকে নামানো থাকে, যার অর্থ স্রষ্টার আধ্যাত্মিক উপহার তিনি ঢেলে দিচ্ছেন সামায় অংশ নেওয়া প্রত্যেকের উপর। এটাও বিশ্বাস করা হয় যে তাঁর নিজের হৃদয়ের ডান থেকে বাম দিকে ঘোরার সময়, দরবেশ সমস্ত মানবতাকে ভালবাসার সাথে জড়িয়ে ধরে।
বর্তমানে প্রতিবছর ডিসেম্বের মাসে আন্তর্জাতিক মেভলানা সুফি উৎসব আয়োজন করে তুরস্ক সরকার। সারা বিশ্ব থেকে দরবেশরা এই উত্সবে অংশ নেন এবং সপ্তাহব্যাপী চলা আধ্যাত্মিক আবহে ফিরে দেখা হয় ৭৫০ বছরের ইতিহাস।
@সালাম ওয়েব