মসলিন পাট আর অন্তর্বাস

রেফায়েত কবির শাওন

আঁশ জাতীয় পদার্থ থেকে উৎপন্ন জিনিস নিয়ে আমরা বরাবরই গর্বিত। উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত আমাদের গর্ব ছিল মসলিন, বিংশ শতাব্দীতে পাট আর একবিংশতে এসে রেডিমেইড গার্মেন্টস। পত্রিকার বিজনেস সেকশন পড়লে যে কারও মনে হবে এই দেশের আরএমজি সেক্টর এত বেশি ডলার আনে যে বাংলাদেশ ব্যান্কের গোডাউনেও জায়গা সংকুলান হয় না।

সমস্যা হল এই ডলারের ব্যাপারটা আমার মাথায় কোন ভাবেই ঢুকে না। এত বেশি টাকা যদি এই সেক্টর আয় করে তাহলে গার্মেন্টস তিনমাস বন্ধ রাখলে তারা শ্রমিকদের বেতন দিতে পারে না কেন? দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী শিল্পমালিকরা কি তিনমাসের খরচ চালানোর মত আয় করে নাই।

কথাটা একজন গার্মেন্টস বিশেষজ্ঞকে জিজ্ঞেস করায় জবাব দিলেন গার্মেন্টস খোলা রাখার ব্যাপারটা বেতনের সাথে সম্পর্কিত নয়। বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার দিয়েছেন, ঠিক সময়ে তাদের ডেলিভারি দিতে না পারলে ভবিষ্যতে আর কাজ পাওয়া যাবে না। এই ব্যাখ্যাটাও আমার মাথায় ঢুকলো না। করোনা মহামারিতে সারাবিশ্বই আক্রান্ত। এ অবস্থায় বিদেশি ক্রেতাদের নতুন কাপড়ের দরকারটা হবে কেন। কোন এক দূর্জন একবার বলেছিল, বাংলাদেশের গার্মেন্টস যা রপ্তানী করে তার সিংহভাগই অন্তর্বাস। কথাটা আমি বিশ্বাস করিনি, ডোনাল্ট ট্রাম্পের টুপি আর শার্ট যে বাংলাদেশ থেকে গেছে সেটাতো সিএনএনও দেখিয়েছে। কিন্তু এক্ষনে কথাটা আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে, করোনার ভয়ে নিশ্চয় বিদেশিরা ঘন ঘন তাদের অন্তর্বাস পরিবর্তন করছে আর সেজন্য আমাদের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির উপর ওরা চাপ সৃষ্টি করছে সাপ্লাই চেন ঠিক রাখার জন্য। একটু গভীরে গেলে ব্যাপারটার সত্যতা সবাই বুঝতে পারবেন। এই যেমন আমি, এখন সারাদিন বাড়িতে লুঙ্গি পরে থাকি, তাতে লুঙ্গি গুলোর অবস্থা সঙ্গীন। তাই এইবার ইদে আড়ং অনলাইনে লুঙ্গি অর্ডার দেব ভাবছি।

করোনা বন্দীর এই জীবনে, চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে সূনীতি ভুষণ কানুনগো, আবদুল হক চৌধুরি, আর ড. আবদুল করিমের বইগুলো আবার পড়ছিলাম। একসময় আমাদের এই চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মান শিল্প এত উন্নত ছিল, জার্মানির এক বন্দর শহরে এখনও ডিসপ্লে করা চট্টগ্রামের তৈরি জাহাজ। ইউরোপের অনেক দেশেই তা রপ্তানী হত। চট্টগ্রামে একটা জায়গা আছে ইষান মিস্ত্রির হাট। নিরক্ষর ইষাণ মিস্ত্রি পৃথিবীর সেরা পালতোলা জাহাজ বানাতে পারতেন। দোভাষ পরিবারের মালিকানাধীন শিপিং লাইনের জন্য তৈরি ঈষান মিস্ত্রীর তৈরি জাহাজ উঁচু টিলায় তৈরি করে, কাঠের পাটাতনে চর্বি দিয়ে পিচ্ছিল করে নদীতে ভাসানোর বিস্ময়কর কাহিনী সে সময়ের ইংরেজ প্রশাসকের আত্মজীবনীতে ঠাঁয় পেয়েছে। ওয়েস্ট্রার্ন মেরিনের হাত ধরে, আবার ফিরে আসছে দেশের জাহাজ নির্মাণের সোনালী অতীত। সিমেন্ট, ইস্পাত, ওষুধ শিল্পও এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে শোনা যায় শুধু গার্মেন্টসের নাম। আজকের পত্রিকায় পড়লাম, গার্মেন্টস শিল্পের বেতন বোনাস দেয়ার জন্য আগামী শুক্র ও শনিবার ব্যান্ক খোলা থাকবে। অদ্ভুত, এই করোনা ঝুঁকিতে গার্মেন্টস খোলা রেখেও ঈদের বেতন বোনাস ওরা দুইদিন আগে দিতে পারল না। উল্টো ব্যাঙ্কারদের জীবনও ঝুঁকিতে ফেলে দিল। অন্য কোন শিল্পের জন্য তো এরকম করতে হয় না।

আনিসুল হকের মৃত্যুর পর লাইম লাইটে তাঁর স্ত্রী রুবানা হক। আমি অনেক আগে থেকেই তাঁর ভক্ত। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে নিয়মিত উপসম্পাদকীয় লিখতেন। প্রাঞ্জল ইংরেজির সাথে তাঁর মানবিক বোধ সম্পন্ন লেখা খুবই ভাল লাগে। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়, রুবানা হকের মত বিজিএমই নেতাদের এই কমিউনিকেশন স্কিল দেশের পলিসি মেনিপুলেশনে ব্যবহ্রত হয়। আমাদের রাজনীতিতে গার্মেন্টস মালিকদের প্রভাব, তাঁদের ব্যাক্তিগতভাবে যতটা উপকৃত করেছে, দেশ কি আসলে ততটা উপকৃত হচ্ছে?

সরকার অনুমতি দেয়ার পরও এদেশের প্রচুর ব্যবসায়ি দোকানপাট মার্কেট বন্ধ রেখেছে তাদের কর্মচারি আর ক্রেতাদের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে। এই ব্যবসায়িদের বেশিরভাগেরই চকচকে এসইউভি নেই, দুবাই, মালয়শিয়ায় সেকন্ড হোম নেই, নেই কানাডার বেগম পাড়ায় প্রাসাদ। ব্যাক্তিগতভাবে এদের অনেককে চিনি যারা নিজেদের জমানো টাকা থেকে কর্মচারিদের বেতন বোনাস দিয়েছেন সারামাস বন্ধ থাকা সত্বেও। অথচ গার্মেন্টস মালিকরা সঙ্গবদ্ধভাবেই তাদের হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারিকে ভয়ন্কর ভাইরাসের মুখে ঠেলে দিলেন। তারপরও বেতনের দাবীতে বিক্ষোভ চলছে, রাস্তা অবরোধ হচ্ছে। এখনওকি এই সেক্টর নিয়ে গর্ব করব?

গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির কন্ট্রিবিউশন ছোট করা আমার উদ্দেশ্য নয়। বৈদেশিক মুদ্রার কথা বাদ দিলেও গার্মেন্টস আমাদের নারীদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে ব্যপক ভাবে। কিন্তু এখন হয়ত সময় এসেছে নারীর ক্ষমতায়নকে অন্যভাবে দেখার। ভ্যালেন্টাইন ডে’তে সস্তা দামের লাল কাপড় পরে গোলাপ ফুল হাতে প্রেমিকের সাথে ঘুরে বেড়ানোই নারীর ক্ষমতায়ন নয়। বাঙ্গালোরের স্মার্ট মেয়েদের মত নিজে গাড়ী চালিয়ে আমাদের মেয়েরাও অফিসে যাবে, কম্পিউটারের সামনে বসে, পৃথিবীর অপরপ্রান্তের অফিস নিয়ন্ত্রন করবে এ ধরণের চিন্তা করার সময় এসে গেছে। আমাদের ছেলেরাও কেন পিছিয়ে থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছেলেটা কেন ইউরোপ আমেরিকার কাপড়ের দোকানদারদের কনভিন্স করে গার্মেন্টসের কাপড় বিক্রির জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করবে? কেন ওরা সুন্দর পিচাই, সত্য নাদেলার মত সিলিকন ভ্যালির পাহাড় চুড়ায় বসে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করবে না?

অবিশ্বাস্য পরিবর্তন আসছে তথ্য প্রযুক্তিতে, জীব প্রযুক্তিতে। আগামী বিশ্ব প্রযুক্তির, বিজ্ঞানের। একযুগ আগে যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের শ্লোগান দেয়া হয়, তখন ভেবেছিলাম আমরা পজিটিভ পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছি। কিন্তু হায়, কয়দিন যেতেই আবার সেই এনালগ গার্মেন্টস নিয়েই গর্বে ফিরে গেলাম। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া শুধু তথ্য প্রযুক্তি দিয়েই হারিয়ে দিল করোনাকে। এখনও সময় আছে, Let us make Bangladesh digital again.

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন