মুজিব রাহমান
সিপাহী বিদ্রোহের দিনগুলোতে গালিব ঘরের দরজা বন্ধ করে একাকী বসে থাকতেন। খেতাব, রাজবস্ত্র ও পেনশন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখনই তিনি ‘দস্তবুঁ’ নামে তাঁর দুর্দিনের এই দিনলিপি প্রাচীন ও কঠিন ফারসি ভাষায় লিখেছিলেন।
যে উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন তা সফল হয়েছিল।
“এখন এই জুলাইয়ে পনেরোতম মাস। ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে বকেয়া যে পেনশন পাওয়া যেত সেটা পাওয়ার কোনো রাস্তা পাওয়া গেল না। বিছানা এবং কাপড়-চোপড় বিক্রি করে দিন কাটাচ্ছি। এ যেন সেই ব্যাপার, লোকে রুটি খাচ্ছে আর আমি কাপড় খাচ্ছি। ভয় হচ্ছে যে, যখন কাপড় সব (বিক্রি করে) খেয়ে ফেলব তখন নগ্ন হয়ে না খেয়ে মারা যাব।”
[ দস্তবুঁ – মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব
অনুবাদ – পুষ্পিত মুখোপাধ্যায়]
মির্যা মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ খান গালিব ( ১৭৯৭ – ১৫ফেব্রুয়ারি ১৮৬৯) আগ্রায় জন্মগ্রহণ করেন। এক মোহসঞ্চারী কালপর্বে গালিব দিল্লিতে বসবাস করতেন। অসাম্প্রদায়িক সর্বজনীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ মোগল সাম্রাজ্যের সর্বস্বান্ত শেষ মোগল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের সভাকবি ছিলেন তিনি। মোগল সাম্রাজ্য তখন ধীর কিন্তু নিশ্চিতভাবেই ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে প্রায় নিষ্প্রভ, বিবর্ণ। কার্যত, ব্রিটিশই তখন নির্ঝঞ্ঝাটভাবে ক্ষমতায় সুপ্রতিষ্ঠিত। সামন্ততান্ত্রিক অভিজাতদের একজন ছিলেন গালিব। এ নিয়ে তার গর্ব ছিল। টনটনে আত্মমর্যাদাবোধ ছিল। তাঁর আনুগত্য তখন দ্বিধা বিভক্ত। একদিকে মোগলদের প্রতি তার আনুগত্য অন্যদিকে নূতন শাসক ইংরেজদের সঙ্গে খাতির জমাতে হবে। তাঁর আয়ের একমাত্র উৎস ছিল উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পেনশন বা বৃত্তি সুবিধাও ঠিক রাখতে হবে।
গালিব তখন শয্যাশায়ী। ১৮৬৩ সাল। দিল্লিতে শুয়ে আছেন হাত-পা ভর্তি ঘা। বিষফোঁড়ার ক্ষতে ক্ষতাক্ত। সব ধরণের চিকিৎসাই ত্বরিত ফল দিতে ব্যর্থ হলো। গোটা এক বছর শুয়ে থাকতে হলো। ঘায়ের এই সংক্রমণে মারাত্মকভাবে ফুলে গেল তাঁর পা। ১৮৬৪ সালের শেষ নাগাদ যন্ত্রণাদগ্ধ দীর্ঘ নির্ঘুম রাত ভোরের আভাস দিলেও সোজা হয়ে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়ল।
তিনি লিখেছেন, অবস্থা এতোটাই বেগতিক ছিল যে, এক মাথা উঁচু দেয়াল তুলতে যত সময় লাগতো আমার সোজা হয়ে দাঁড়াতেও সে পরিমাণ সময় লাগতো। তারপর আসলো ছড়ি হাতে অল্প হাঁটার দিন। দৃষ্টিশক্তি ও স্মরণশক্তি দুটোই ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। শুয়ে থাকতেই পছন্দ করতেন। আর বলতেন, তিনি ভীত নন। মরণে তার ভয় নেই। লিখেছেন-
মৃত্যুর জন্য প্রত্যেকেরই ঠিক করা আছে দিন
তবু কেন কাটাও রাত নির্ঘুম?
(A day is fixed for one’s death
Why pass then the night unslept?)
জ্যোতিষশাস্ত্রে গালিবের ছিল নিজস্ব বোঝাপড়া। শাস্ত্রীয় অনুমান অনুযায়ী ভেবেছিলেন ১৮৬১ সালেই তিনি মারা যাবেন। ঐ বছরটি ছিল কলেরা মহামারির বছর। বছরটি এল। বছরটি গেল। তিনি বেঁচে গেলেন। মহামারি উত্তরজীবী হলেন। পরবর্তীতে তিনি মজা করে বলতেন, এমন একটা সাধারণ মহামারিতে মারা যাওয়া তাঁর মতো একজন সম্মানিত মানুষের জন্যে হতো মর্যাদাহানিকর!
তিনি ভাল করেই জানতেন, শিকারি নিরস্ত্র। ধনুক নেই। নেই তীর। সব দিক থেকেই। শরীর অশক্ত। সকল আকাঙ্ক্ষা চেষ্টারহিত। এখন মীমাংসার সময়। সময় আপসরফার।
তাঁর হৃদয় কন্ঠে বেজে ওঠলো –
পথবিচ্যুত নৌকা যখন তীরের দিকেই ভিড়ছে, গালিব,
মাঝির অবিচার নিয়ে আল্লাহর কাছে আর অভিযোগ করা কেন?
[ When the boat has drifted to the shore, Ghalib,
Why complain to God of the boatman’s injustice?]
গালিবকে নিয়ে বনসাই এ লেখাটি প্রিয় কবি সৈয়দ শামসুল হকের অনুবাদে গালিবের একটি গজল দিয়ে আপাতত রাখছি।
আশা শুধু মিছে ছলনা।
পথ খুঁজে পাওয়া হলো না।
মরে যাবো – সে তো নিশ্চিত।
রাতে ঘুম তাও এলো না।
আগে আমি খুব হেসেছি –
ঠোঁটে আজ হাসি ফোটে না।
জানি, উপাসনা পুণ্যের –
নামাজেও মতি হলো না।
কিছু কথা থাকে নিশ্চুপ –
গজলেও বলা গেলো না।
মন পুড়ে পুড়ে ভস্ম –
দেখলো না ঘ্রাণ পেলো না।
মন আনমনা এতোটা –
নিজেকেই জানা হলো না।
পথ চেয়ে আছি মৃত্যুর –
এই আসে তবু এলো না।
আছে মুখ? – যাবে মক্কায়?
গালিবের কথা বোলো না!
মুজিব রাহমান:সহযোগী অধ্যাপক,ইংরেজি বিভাগ,চট্টগ্রাম কলেজ।