নানির কথা


আবু জাফর সিকদার।। পুবাকাশ


পর্ব চার

নানা মারা যাওয়ার পরই শুরু হলো নানির আসল সংগ্রাম! সীমিত আর্থিক সক্ষমতা নিয়ে একটি বড় পরিবারের খাওয়া পরার সংস্থান করা ছিলো সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ছেলে মেয়েদের শিক্ষা দীক্ষা, বিয়েশাদি এসব আনুসাঙ্গিক বিষয়াদি তো আছেই! সেসব ঢেউ সামলাতে গিয়ে, নানির একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে যা ছিলো সবটুকুই তিনি হাতছাড়া করতে বাধ্য হন। বিয়ের সময় প্রচুর স্বর্ণ ও রৌপ্যের গহনা দেয়া হয়েছিলো নানিকে।

এখন তো প্রচুর কাবিনের টাকার হাঁকডাক তোলা হয়, দশ বিশ লাখ থেকে শুরু করে কোটি টাকা কাবিনে লেখানোর প্রতিযোগিতা চলে কিন্তু পরিশোধের তেমন কোন আগ্রহ কোনো পক্ষেরই থাকে না, অন্য দিকে যৌতুকের লাগামহীন চাহিদায় কনেপক্ষকে পথের ভিখারি বানিয়ে ছেড়ে দিতেও বরপক্ষের এতটুকু বিবেক দংশন করে না! ঘরবাড়ি ভিটে মাটি বিক্রি বা বন্ধকি রেখে হলেও যৌতুকের দাবী মিটাতে বাধ্য হচ্ছে কনেপক্ষ, কী জঘন্য মানসিকতা, আর কী ভয়াবহ এই সামাজিক ব্যাধি আমাদের ঘিরে ধরেছে! তখনকার সময়ে এসব বনেদি পরিবারে বিয়েশাদিতে কনেপক্ষের সম্মান বা মর্যাদা ছিলো অনেক বেশি। যৌতুকের তেমন বালাই ছিলো না, তবে উল্টো কনেপক্ষকে সের দরে নগদ স্বর্ণ ও রৌপ্য গহনা দিয়ে পুরুষদের বিয়ের পিঁড়িতে বসার অনুমোদন মিলতো! এটা কোনো পক্ষের প্রতি অনুগ্রহ বা জুলুম নয়, প্রকৃতপক্ষে নারীর হক আদায়ের নগদ ব্যবস্থা। নানিও সেভাবে প্রচুর স্বর্ণ ও রৌপ্য অলংকারের মালিক ছিলেন বলে জানা যায়! তবে নানি এসব অলংকার পরে সাজুগুজু দিতেন এমনটা কখনো দেখিনি! শেষ দিকে নানা, বড় মামার লেখাপড়ার খরচ দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে, নানি বেশ কিছু অলংকার ছেলের লেখাপড়ার জন্য বিক্রয় করে দেন। আর যেগুলো ছিলো তাও বিভিন্ন সময়ে সংসারের প্রয়োজনে বেচা বিক্রি করতে হয় নানিকে। এর জন্য তার ভেতর বাহ্যিকভাবে ছিলো না কোনো আফসোস, কোনো রকম হাহাকার কিংবা দীর্ঘশ্বাস! ভেতরে ভেতরে একটা কষ্টবোধ ছিলো হয়তো।

নানিকে দেখতাম একদম ক্লান্তিহীনভাবে সকাল-সন্ধ্যা-রাত অবধি প্রায় বিরামহীনভাবে কাজ করতে থাকতেন। ফজরের নামাজ পড়ার পর থেকে শুরু হওয়া এই কর্মযজ্ঞ শেষ কখন হতো আমরা বুঝতে পারতাম না। তার আগেই যে ঘুমিয়ে যেতাম আমরা! ধান ভানার কাজ থেকে চাল বাধা, উঠোন ঝাড়ু দেয়া থেকে গরুর গোয়াল পরিষ্কার, ঘরের লোকজন আর কামলাদের রান্নাবান্না, গরু হাঁসমুরগীর নিয়মিত খাবার দেয়া সব কিছুতেই ছিলো নানির অক্লান্ত পরিশ্রম। নানিকে লম্বা অসুখবিসুখে পড়ে থাকতে দেখা যেতো না, জ্বর, সর্দি, কাশি এসব হলেও খুব একটা ঘরে শুয়ে বসে থাকতেন না। কাজ যেন সব সময় তাকে তাড়া করে ফিরতো।

আড্ডা, হাসি তামাসা এসবেও তিনি মশগুল থাকতেন না। তবে
নাতি নাতনিদেরকে খাওয়ানো দাওয়ানো, নাওয়ানো, পরানো এসবেও তার কোন রকম আলস্য ছিলো না, আমাদের প্রতি ছিলো তার সীমাহীন ভালোবাসা। ছেলে ও মেয়ে পক্ষের অনেক নাতি নাতনি, সবাইকে তিনি সমানে আদর, স্নেহ, মমতায় আগলে রাখতেন।
আমি প্রথম মেয়ের ঘরে প্রথম নাতি (বড় আরও তিনজন পরপর মরে যাওয়া পর আমার বেড়ে উঠা!) হবার সুবাদে আমার কথা আলাদা!আমি ছিলাম সবার চেয়ে বেশিই সৌভাগ্যবান!

পর্ব পাঁচ
শুধু নানির দিক থেকেই নয়, নানার কাছ থেকেও একমাত্র আমিই, নাতি হিসাবে বাঁধভাঙা ভালোবাসা ও আদরের একচ্ছত্র হকদার হয়ে উঠেছিলাম! আমাদের বাড়ি ও নানার বাড়ি যেহেতু পাশাপাশি পাড়া, মাঝখানে মাত্র দু’তিনশ গজের ব্যবধান। জন্মের সময় নানার বাড়িতেই ছিলাম। যখন আম্মা আমাদের বাড়ি আসতেন, প্রতিদিন নানার সকাল কাটতো আমাদের বাড়িতে, আমাকে নিয়ে নানার নানান খুনসুটি, আদরের বাঁধভাঙা জোয়ারে আমাকে ভাসাতেন, তিনিও ভাসতেন!

তিনি যেদিন মারা গেলেন সেদিন নাকি আমি ভীষণ কান্নাকাটি করছিলাম কিছুতেই থামানো যাচ্ছিলো না, তিনি আমাকে কাঁধে চড়িয়ে একবার ঘরে আসছিলেন, আবার বের হয়ে মসজিদের পুকুর পাড়ে ঘুরতে যাচ্ছিলেন। এভাবে অনেকক্ষণ চলার পরও আমার কান্না নাকি সেদিন থামাতে পারেননি! তিনি বন্ধুর সাথে পাহাড়ের দিকে অবশেষে যাত্রা করেছিলেন। তার মৃত্যুর ঘটনা তো আগের পর্বে বর্ণনা দিয়েছি। আমার অন্য মামাতো খালাতো ভাই বোনদেরকে সেই আদর মমতা থেকে বঞ্চিত করে তিনি সেদিন চিরতরে না ফেরার দেশেই চলে গেলেন। তারা হয়তো এই আদর মমতা মাখানো নানা/দাদার ভালোবাসাকে অনুভব করতে পারবে না, কিন্তু আমি আজও যে নানার কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর ঘোরের মধ্যেই থাকি! এই অনুভূতিকে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়!

তারপর তো আস্তে আস্তে বড় হতে থাকলাম, বাড়তে থাকলো দুরন্তপনা। আমাদের বাড়িতে তেমন কোন গাছপালা ছিলো না। আর নানার বাড়িতে ছিলো নানা রকমের বোঝাই করা সব ফলের গাছ। আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, পেঁপে, আতা, শরিফা, কামরাঙা, বরই, বাতাবি লেবু, বেলম্বু, আনারসসহ আরও কতো গাছ! মূল ভিটা এবং পুকুরপাড়ের গোয়ালঘরের ভিটায় সেই সব নানা সিজনের ফল গাছের ছড়াছড়ি।পুরো শৈশব ও কৈশোর কটেছে এসব গাছের ডালে ডালে।
আমি আর কাঠবেড়ালিই এই রাজ্যের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী!

আজিজ মামা, ছোট নানার একমাত্র ছেলে এবং আমরা প্রায় সমবয়সী, ছিলো সেই সময়ের খেলার সাথী। আমার বড় মামাতো বোন মুক্তা আর মেজ খালাতো বোন কাজলের তখনও শিশুকাল। তারাও আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো।

সত্যিই এখন ভাবতে আশ্চর্য লাগে! আমাদের ছেলে মেয়েরা কীভাবে অনেকটা চার দেয়ালের গণ্ডির ভেতর বড় হচ্ছে! না আছে গাছের ছায়া, না আছে গাছপাকা ফলের মধুমাখা মায়া। ওরা বোঝেনা পাখপাখালির হাতছানি কী, ওরা কাঠবেড়ালি দেখে উচ্ছ্বসিত হয় কার্টুনে, টেলিভিশন পর্দায় নয়তো ট্যাব বা এন্ড্রয়েড ফোনের স্ক্রিনে! প্রকৃতি তাদের কাছে এখন পুরোপুরি নির্বাসিত। ছয় মাসে নয় মাসে, ঈদে চাঁদে, নানা আচার অনুষ্ঠানে, পার্বণেও তারা যেতে চায় না গ্রামে। শাশ্বত সবুজ শ্যামল নয়নাভিরাম ছায়া ঘেরা মমতাময়ীর কোন স্মৃতি তাদের টানে না! শুধু প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য, নেয়ামত থেকে তারা বঞ্চিত তা নয় তারা পিতামহ, পিতামহী, মাতামহ বা মাতামহীর অকৃত্রিম স্নেহ মমতা, আদর আপ্যায়ণ থেকেও চরমভাবে বঞ্চিত হয়ে গেছে। এক অদ্ভুত সময়ের ডিজিটাল সওয়ারি তারা! সময় হয়তো এভাবেই বদলে দেয় সবকিছু।

পর্ব ছয়.
নানির একটি দৃষ্টিনন্দন খোদাই করা কাঠের সিন্দুক ছিলো! এই রকম সিন্দুক এখন বিলুপ্তির পথে। কেবল জাদুঘরে ঢুকলে এসবের কিছু নমুনা দেখতে পাওয়া যায়। কালো কুচকুচে রঙের, অথচ খুবই চমৎকার চারপাশে ফুল তোলা, চার চাকাযুক্ত। উপরের ডালাটা দিয়ে খোলা বাঁধা করা হতো। ঐ সিন্দুকটা হয়তো নানির বিয়ের সময়ে পাওয়া উপহার হবে! যা হোক, এই সিন্দুক নিয়ে আমার একটি চমৎকার স্মৃতি মনের কোণে এখনও ঝলঝল করে! সিন্দুকটি নানি অনেক সময় খুললে আর তালা লাগাতেন না। পিতলের পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, সিকি, আধুলি জমিয়ে রাখতেন সিন্দুকের এক কোণায়। আইসক্রিম, কটকটি মিঠাই এসব বিক্রেতা এলে নানির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে ঐ জমানো পয়সা থেকে একটা দুটো কয়েন বের করে দিতেন। আমি, ছোট খালা, মুক্তা, কাজল যারা দলে থাকতো মিলে মজা করে খেতাম। নানির কাছে গিয়ে চাইলে দিয়ে দিতেন কিন্তু সবসময় নানির কাছে আবার চাইতে লজ্জা লাগতো। তাই এত চাওয়া-চাওয়ি বাদ দিয়ে খোলা সিন্দুকে ডালা ফাঁক করে পয়সা নিয়ে দিব্যি চালিয়ে দিতাম! প্রাইমারিতে যখন পড়ছি, তখন আমাদের ফকিরখিলের একজন ব্রাক্ষ্মণ, নামটা মনে করতে পারছি না, ছোট একটি হান্ডিতে করে প্রায় প্রতিদিন মিষ্টি বিক্রি করতে আসতেন স্কুল আঙ্গিনায়, আবার পাড়ায় পাড়ায়ও যেতেন তিনি। নানির জমানো পয়সার বেশির ভাগ আমি তার পেছনেই খরচ করেছি! সংরক্ষণের অনিহা, অযত্ন, অবহেলায় সিন্দুকটা হয়তো একসময় চুলার লাকড়ি হয়ে গেছে। এখনও আফসোস হয় সেই সিন্দুকের জন্য। না বলে বলে, নানির জমানো পয়সাগুলো নিয়ে শ্রাদ্ধ করার জন্যও খুব অস্বস্তি হয়, তবে মুখ ফুটে কখনও বলা হয়নি কাউকে, অন্তত নানির কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়া উচিত ছিলো আমার! তা আর হয়ে উঠেনি। তাই এই অস্বস্তি আমাকে আমৃত্যু তাড়া করে ফিরবে!

নানির পোশাকআশাকে তেমন কোন বিলাসিতা ছিলো না। একদম বিধবা সাজেও তিনি থাকতেন না। একধরণের, দুটি আলাদা আলাদা অংশবিশিষ্ট, থানের রঙিন ঝুট কাপড় পরতেন তিনি। নিচের অংশটি সাধারণত সবুজ গাঢ় রঙের উপর ফুল তোলা হলেও উপরে অংশ সাদা জমিনে রঙিন ফুল তোলা থাকতো । তিনি কেন আমার সব নানিরা এসব ঝুট কাপড়ই পরতেন দেখেছি! তবে বৃদ্ধ বয়সে এসে চিকন পারের, হাল্কা ফুল তুলা সাদা শাড়ি পরা শুরু করেন।এগুলোর বেশির ভাগই ছেল মেয়ে কিংবা নাতি নাতনিদের কাছ থেকে ঈদে বা বিভিন্ন বিয়েশাদি উপলক্ষে তিনি উপহার হিসাবে পেতেন। তাই আলাদা করে খুব একটা কাপড়চোপড় কিনতে হতো না।

আরও একটা বিষয় লক্ষণীয় ছিলো, নানাদের চেয়ে সব নানিরাই অনেক বেশি বেঁচে ছিলেন, অল্প বয়সে যারা মারা গেছেন তাদের বিষয়টি আলাদা, প্রেক্ষিত ভিন্ন ছিল। নানিদের এক একজনের অনেক ছেলে মেয়ে জন্মদান, লালনপালন, স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেও তাদের দীর্ঘ জীবন একটি রহস্যই বটে! আধুনিক মায়েরা একটি বা দু’টি সন্তানের লালপালন করে যেভাবে হাঁপিয়ে যান, তাদের যে অনুযোগ, অভিযোগ সেই তুলনায় নানি,দাদিদের কিংবা মায়েদের কষ্ট পরিমাপ করতে গেলে সত্যিই অবাক হতে হয়! তারা ‘পীড়া ছাড়া মুরগীর’ ন্যায় কষ্ট সয়ে সয়ে জীবনকে কয়লা করে ছেলে মেয়েদের মানুষ করতেন আর প্রতিদান হিসাবে বেশিরভাগ সময় অপমান, জিল্লতি ইত্যাদির ভাগিদার হয়ে থাকতেন, খুবই নীরবে, নিভৃতে। শাশুড়ি, বৌ,দেবর, ননদ, ভাবি এসব শব্দ দ্বৈরথের ভেতর যে বিষবৃক্ষ জন্ম নেয় তা থেকেই মূলত বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে যৌথ পরিবারে। এর সূত্র ধরেই ভেঙ্গে গেছে একান্নবর্তী পরিবার, ভেঙ্গেছে যৌথ পরিবার, এখন তো বেশিরভাগ একক পরিবারের সংসার। তবে এখানেও এই ভাঙ্গন থেমে নেই। এখন একক পরিবারও ভাঙ্গনের মুখে! বৌ স্বামীকে সহ্য করে না, স্বামী বৌকে সম্মান দেয় না। মা, বাবা আগে থেকে আলাদা! সন্তান একটা বা দুটো বেওয়ারিশের মতো হোস্টেলে বা কাজের বুয়ার কাছে বড় হচ্ছে! কেউ কেউ তো আরও মডার্ন ! মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং অপূর্ব! চমৎকার বোঝাপড়ার নমুনা হলো আলাদা আলাদা ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকা। আহা,কী অভূতপূর্ব এক অদ্ভুত সংসার!

এই প্রসঙ্গে আর একটি বিষয় না বললেই নয়, এই সব অকাল বিধবা মহিলারা একটি চরম সামাজিক হেনস্তার শিকার হতেন প্রায়শ। তাদের সন্তান সন্ততিরাও সেই অপবাদের অংশিদার হতেন। আমার মা এবং আমাদেরকেও এই চরম অবমাননাকর পরিস্থিতিতে বড় হতে হয়েছিল! পান থেকে চুন খসলেই আমাদেরকে বলা হতো, ‘ ঝির্গানের বাইন্যা পোয়া ‘ অর্থাৎ মেয়ে মানুষের শাসিত ছেলে! অসংখ্যবার এসব শুনে শুনে আমরা বড় হয়েছি! কষ্ট পেয়েছি বটে, তবে আল্লাহর অশেষ দয়ায়, আমাদের মায়েদের দৃঢ়তায় আমরা ছেলেমানুষ শাসিতের চেয়ে গুণে মানে মর্যাদায় কোন দিকে পিছিয়ে ছিলাম না। তাই এসব বিধবা মায়েদের সন্তানসন্ততি নিশ্চয় তথাকথিত পুরুষশার্দূলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। বিধবা এবং তাদের সন্তানদের হেয় করার জন্য, বিশেষ করে গ্রামের মাতব্বর বা মুরব্বি শ্রেণির লোকজন এই অসদাচরণটি বেশি করতেন।


আবু জাফর সিকদার : কবি ও কথাশিল্পী। 

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন