ইশারা অবিরত: শঙ্খ ঘোষ’র জন্য অঞ্জলি।। মুজিব রাহমান।। পুবাকাশ


শঙখ ঘোষ (জন্ম ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২- মৃত্যু ২১ এপ্রিল ২০২১)


যা কিছু আমার চারপাশে ঝর্না
উড়ন্ত চুল
উদোম পথ
ঝোড়ো মশাল
যা কিছু আমার চারপাশে স্বচ্ছ
ভোরের শব্দ
স্নাত শরীর
শ্মশানশিব
যা কিছু আমার চারপাশে মৃত্যু
একেক দিন
হাজার দিন
জন্মদিন
সমস্ত একসঙ্গে ঘুরে আসে স্মৃতির হাতে
অল্প আলোয় বসে থাকা পথ ভিখারি
যা ছিল আর যা আছে দুই পাথর ঠুকে
জ্বালিয়ে নেয় এতদিনের পুনর্বাসন।

( শঙখ ঘোষের ‘পুনর্বাসন’ কবিতার শেষাংশ)

চির প্রস্থানের পথে চলে গেলেন বাংলা ভাষার এক প্রবাদপ্রতিম কবি, কবি শঙখ ঘোষ!

আহা, তাঁর ‘ছন্দের বারান্দা’য় দাঁড়িয়েই তো একদিন কবিতা বৃষ্টির মোহময় টুপুর টাপুর শুনে আশ্চর্যের জগতকে চিনতে সজাগ হয়ে ওঠেছিলাম।

দে’জ পাবলিশিং প্রকাশিত তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ভূমিকায় তিনি লিখেছেন:

‘সত্যি বলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই কবিতার। কিন্তু জীবিকাবশে শ্রেণীবশে এতই আমরা মিথ্যায় জড়িয়ে আছি দিনরাত যে একটি কবিতার জন্যেও কখনো-কখনো অনেকদিন থেমে থাকতে হয়।’
তাঁর কবি জীবনে কবিতায় কবিতায় তিনি বাঙালি মধ্যবিত্তের অসহায়তার কথা, অক্ষমতার কথা, আত্মপ্রবঞ্চনার কথা, ক্ষমতার আলো-অন্ধকারের কথা লিখে গেছেন অসামান্য কাব্যকুশলতায়।

১৯৩২ সালে ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলার চাঁদপুরে যিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন আজ ২১ এপ্রিল ২০২১ তিনি কলকাতায় নিজ বাড়িতে ৮৯ বছর বয়সে চলে গেলেন।

‘কে না জানে সব অনিত্য।
নিয়ে যাই তাই খড়কুটো
বেঁচে যে রয়েছি এই-না ঢের
ভিখিরির আবার পছন্দ!

কেটে যাবে দিন আনন্দে
ভাসমান সব বাসিন্দার।
জীবন তো একই কাসুন্দি
ভিখিরির আবার পছন্দ!’

এমনতরো সহজ-গভীর উচ্চারণের কবি আর নেই।

কবিরও বিস্ময় ভ্রমণ একদিন শেষ হয়ে যায়। কবিকেও চির প্রস্থানের রহস্যময়তায় নির্বাক চলে যেতে হয়। শব্দের মোহময় জগত ছেড়ে, মানুষ ছেড়ে, নিসর্গ ছেড়ে। চির দিনের জন্যে অনন্তের পথে। চলে গেলেন কবিতার শঙখ, গদ্যের শঙখ, ‘যা সত্য তাকে সরাসরি বলা’র শঙখও।

সেই কবে আজিজ মার্কেটের ম্যারিয়েটা থেকে ‘নির্মাণ আর সৃষ্টি’ সংগ্রহ করে শঙখ ঘোষের গদ্যে ডুব-সাঁতার।
তাঁর গদ্যে-কবিতায় অনবদ্য ‘কবিতার মুহূর্ত’ আমাদেরকে নূতনভাবে শিক্ষিত করে তোলে। জীবন সত্য আর কাব্য সত্যের নিবিড়তা গাঢ় হয়ে আছে এই বইটির শব্দে শব্দে।

মুখোশ, বিজ্ঞাপন,বিকিকিনি আর পণ্যায়নের এই সময়ে পরিচিতির সংকটের চেয়ে আর কোন বড় সংকট নেই। ‘ তাঁর মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ কী সহজে কী শক্তিমত্তা কথাই না উচ্চারিত!

তাঁর বিখ্যাত ‘লাইন’ কবিতার সত্য আজও বিশাল জনগোষ্ঠীর অনুচ্চারিত বাস্তবতা:
‘লাইনেই ছিলাম বাবা, লহমার জন্য ছিটকে গিয়ে
খুঁজেই পাই না আর নিজেকে – কী মুশকিলে পড়েছি!’

এই মুশকিলের আর অবসান ঘটে না।

কবির ‘শব্দ ও সত্য’ পাঠ জিজ্ঞাসু পাঠকের জন্য এক নূতন জগতের সন্ধান। শব্দের বহুমুখী আর তির্যক সব বিষয় নিয়ে কী অসামান্য আলোক সম্পাত ঘটেছে এই বইয়ে।

কবিতা, মূলত, ইশারা প্রধান। শিল্পের অন্যান্য মাধ্যম নাটক, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র ইত্যাদির পারস্পরিক সম্পর্কের অনেক কিছুই আলোচিত হয়েছে তাঁর ‘ইশারা অবিরত’ প্রবন্ধ গ্রন্থের আটটি প্রবন্ধে।
সত্যিকারের কবিতা পড়তে পড়তেই যে একজন পাঠক অবগাহন করতে পারেন বহুশিল্পসংগমের জঙ্গম মোহনায় শঙখ ঘোষ ‘ইশারা অবিরত’বইটির ভূমিকাতেই একথা বলে দিয়েছেন।

‘কবির অভিপ্রায়’ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রচর্চাকেন্দ্রে প্রদত্ত শঙখ ঘোষের পর-পর তিনদিন উপস্থাপিত ‘লেখক’, ‘লেখা’, ‘পাঠক’, শিরোনামাধীন বক্তৃতার সংকলন। এই তিন বিষয়ে নানা জিজ্ঞাসার সহজ, সুন্দর, সহৃদয় উজ্জ্বল উত্তর পেয়ে যাই এই গ্রন্থে।

তাঁর ঘুমিয়ে পড়া এলবাম, তাঁর ঐতিহ্যের বিস্তার বিস্তৃত হয়ে রইলো আমাদের জন্যে, মহাকালের জন্য।
শেষ পর্যন্ত কবিকে কবিতার চেয়ে অধিক করে আর কোথাও মেলে না। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দিনগুলো রাতগুলো’ অতিক্রম করে তিনি লিখেছেন আরও অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ। তাঁর কোনো কোনো কবিতার শিরোনাম, কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম প্রবাদ হয়ে গেছে। তাঁর ‘লোকে বলবে মূর্খ বড়ো, লোকে বলবে সামাজিক নয়।’
তাঁর
‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্য গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।’

কিংবা কবির ‘ধুম লেগেছে হৃদকমলে’ জলই পাষাণ হয়ে আছে’ ইত্যাদি কাব্য শিরোনামগুলোও তাঁর কবিতা বিষয়ে অবিরত ইশারার মত কাজ করে।

তাঁর ‘খরা’ কবিতাটি উদ্ধৃত করে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে শোকার্ত শ্রদ্ধা নিবেদন করছি:

সব নদী নালা পুকুর শুকিয়ে গিয়েছে
জল ভরতে এসেছিল যারা
তারা
পাতাহারা গাছ
সামনে ঝলমল করছে বালি।

এইখানে শেষ নয়, এই সবে শুরু।
তারপর
বালি তুলে বালি তুলে বালি তুলে বালি
বালি তুলে বালি

বিশ্বসংসার এ-রকম খালি
আর কখনো মনে হয়নি আগে।


মুজিব রাহমান: কবি-প্রাবন্ধিক-অনুবাদক।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন